স্মৃতিকাব্য
আল মাহমুদের চুলা
ওইতো সেবার কলকাতা থেকে মৃদুল দাশগুপ্ত এলেন। ভোট নিয়ে লিখবেন। ভোট নিয়ে তার যে উচ্ছ্বাস তাতে জল ঢাললেন আল মাহমুদ! মাহমুদ বললেন, ভোটের দিনেই চুলা ঠাণ্ডা থাকে। পায়ের নিচের মাটি শক্ত হয়ে যায়। আমি জুতা খুললাম। আশ্চর্য হলাম। হাত ধরলাম তার। সত্যিই তো জলজ সাপের মতো পিচ্ছিল বরফ। টুপটুপ ঠাণ্ডা জল মাহমুদের দুচোখ বেয়ে নামতে লাগল। তিনি বললেন, আমি কবি। আর কিছুই না। আমাকে তোমরা সমর্থক বানাবে না।
বস্তুত মৃদুল না এলে আমাদের কখনো মগবাজার যাওয়া হতো কিনা সংশয় আছে। এমন কি ফরিদ কবিরও যেতেন কিনা বলা মুশকিল। তারপরও গেলেন মৃদুলের চাপে। মাহমুদ আমাকে চিনেন না। ফরিদ কবির বললেন, মাহমুদ ভাই সাখাওয়াত টিপু তো আপনার দুহাত ধরল। চিনেছেন তাকে? এক মিনিট নিরবে সব কথা শূন্য হয়ে গেল। মৃদুল দেখি মাথা নত করে প্রণাম করছেন। ঠাণ্ডা আল মাহমুদ উষ্ণ হয়ে গেলেন। বললেন, এটা কেন করলেন? আমাদের ধর্মে মানুষের কাছে মস্তকাবনত হওয়া শিরক! জয় গোস্বামী এসেছিল তাকেও বলেছি, আমি এসব পছন্দ করি না।
আমরা খানিক নৈঃশব্দ্যের কলে পড়লাম। ভাষাও নিথর! কিভাবে বাতাস স্বাভাবিক করি! বললাম, আপনি নিষিদ্ধ থাকার সময় প্রথম কবিতা ছাপাই আমি। মাহমুদ বলেন হ্যাঁ! দেখি তার মোটা চশমার গ্লাসে সফেদ কুয়াশা জমে গেছে। চোখ অন্ধ হলে চশমার কোন দাম নাই। বাদামী রঙের ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে ফরিদ কবির বললেন, মৃদুল যে খুব চাইছিল আপনাকে দেখতে। আল মাহমুদ মৃদুলকে চিনলেনই না। তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা বললেন। বললেন, তার মতো বড় কবি কলকাতাতেই আর নাই।
লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরা আল মাহমুদকে সেদিন পাচক মনে হল। সফেদ চেহারা তার যেন শরতের একটুকরো মেঘ। বারবার তিনি স্ত্রীর কথা বলছিলেন। আর বললেন, তিনি চলে গিয়ে আমাকে একাকী করলেন। এমনকি ভাষাকেও একা করলেন। আল মাহমুদের ঠোঁট যেন শব্দের চুলা হয়ে গেছে। আগুন বেরুচ্ছে কেবল শব্দের ভেতর। আমি বললাম, চলেন এবার উঠি। মাহমুদ বললেন, তোমরা তো কখনো আসো না কেউ। বললাম, মগবাজারে কোন রেলস্টেশন নাই।
বাতাস খানিক ভারী হলে ফরিদ কবির হাসলেন। বললেন, আমরা তো আপনার কবিতা ছেপেছি। হুম মাহবুব বলেছিল। আমি মৃদুলের অসহায় চোখের দিকে তাকালাম। মৃদুল রানাঘাটের গল্প শুরু করলেন। আল মাহমুদ রানাঘাটের কথাও মনে করতে পারলেন না। মৃদুল বললেন, মাহমুদ দা আশির দশকে আপনি রবীন্দ্রসদনে কবিতা পড়েছিলেন। মাহমুদ তাও মনে করতে পারলেন না। হয়তোবা সুনীলরা ডেকেছিল, মাহমুদ বললেন, ষাটের দশকে কবিদের তালিকায় আমাকে ষাটজনের বাইরে রাখা হতো। আশিতে এসেই দেখি, আমি না রাহমান তর্ক বেঁধে গেল। সবই বোগাস!
আমার ভাঙা গাড়িটির কথা মনে হলো। আমাদের যাওয়ার গাড়িটি ভেতর থেকে খোলা যায় না। বাইরে থেকেই ড্রাইভারকে খুলতে হয়। ফলে আটকে যাওয়ার আশংকা ছিল! বাইরের বাতাস খুব বেশি ঢুকতে পারে না। ফাঁকে দেখি চা আর নোনতা বিস্কুট এলো। সেদিন দুপুরে আমাদের ক্ষুধা ছিল পেটে। চায়ের চিনির পরিমাণ মাহমুদের কবিতার মতো লাগল। মাহমুদ সিগেরেট চাইলেন। মৃদুল ভারতীয় সিগেরেট দিলেন। মাহমুদ যখন ধোয়া ছাড়ছিলেন তখন চক্রাকার বিষণ্ন লাগল। হাওয়াটা উদ্বিগ্নময়!
লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরা আল মাহমুদকে সেদিন পাচক মনে হল। সফেদ চেহারা তার যেন শরতের একটুকরো মেঘ। বারবার তিনি স্ত্রীর কথা বলছিলেন। আর বললেন, তিনি চলে গিয়ে আমাকে একাকী করলেন। এমনকি ভাষাকেও একা করলেন। আল মাহমুদের ঠোঁট যেন শব্দের চুলা হয়ে গেছে। আগুন বেরুচ্ছে কেবল শব্দের ভেতর। আমি বললাম, চলেন এবার উঠি। মাহমুদ বললেন, তোমরা তো কখনো আসো না কেউ। বললাম, মগবাজারে কোন রেলস্টেশন নাই।
৩/৪/২০১৯
ঢাকা
- শামসুর রাহমান, বাংলাদেশের কবি
- জয় গোস্বামী, কলকাতার কবি
- মৃদুল দাশগুপ্ত, কলকাতার কবি ও সাংবাদিক
- ফরিদ কবির, বাংলাদেশের কবি
- মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশের কবি ও প্রকাশক