স্মৃতিকাব্য
গোস্তের দোকানে আবদুল মান্নান সৈয়দ
কতদিন গফুরের গোস্তের দোকানে যাই না। আমাদের শুক্রবার কেন আসে না! অবশেষে এলো ছয় দিন পর। কাঁঠাল বাগানে গফুরের গোস্তের দোকান। গফুর গরুই বিক্রি করে। খাসি, পাঠা কিংবা অন্যকিছুই না! গিয়ে দেখি একলোক গোস্তের তাপ মাপছে। মরা গরু, অথচ গোস্ত লাফায়। অই লোক সাদা বুট, নীল ট্রাউজার, ধবধবে গেঞ্জি, নীল টুপি পরা।
গফুর বলল, স্যাররে চিনেন নাকি? বললাম: না তো! উনি মান্নান সৈয়দ স্যার! বললাম: আচ্ছা! সৈয়দ গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন: সাখাওয়াত টিপু আপনারে আমি চিনি! এই বলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: বাংলা কবিতা বেহাত হয়ে গেছে! আমি ভয় পাই। গফুরকে বলি সিনার গোস্ত দেন। গফুর মান্নান সৈয়দকে কলিজা দিলেন। আমি হাত দিয়ে দেখি: গোস্ত এখনো গরম! মান্নান সৈয়দ বললেন, দুনিয়ার সেরা গোস্ত কাঁঠাল বাগানে পাওয়া যায়!
চলে যেতে চাই আমি। সৈয়দ বলেন, থামেন থামেন! চলেন জিঞ্জিরা হোটেলে যাই। পথে শিশির ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে দেখা। মিটিমিটি চোখ। কাজল গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসেন। বাতাসে গোফটি বাঁকা হয়ে আছে। আর বলেন, বাসায় ফোন দিয়ে এসো। মান্নান সৈয়দ মনে হয় শিশিরকে চিনলেন নাকি চিনলেন না। আমার সন্দেহ হয়! না চিনলেও বিমূর্তের শিল্পের মতো রহস্যময়। ঝাপসা রেখার মতো চোখও কি আবছা হয়। দেখলাম: চশমার গভীরে চোখ। আরো গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি। আজব লাগল!
মান্নান সৈয়দ একটু উদাস মনে কাঁদলেন। আনমনে হাসলেন। চায়ের ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। খুব রহস্যময় চোখের ভঙ্গি। আমাকে না চেনার ভান করে বললেন, জানেন বাংলা কবিতা বেহাত হয়ে গেছে। বললাম: জানি, গফুরের গোস্ত ঠাণ্ডা হচ্ছে!
জিঞ্জিরা তেমন দূর নয়। রাস্তা পার হলে জিঞ্জিরা হোটেল। ঢোকা মাত্রই জয়নাল হাজির। বলে, স্যার কি লাগবে! মান্নান সৈয়দ বললেন, জিলাপি আর চা দাও। বললাম: জানেন নাকি জিঞ্জিরায় পৃথিবীর সেরা কবিতার কচুশাক রান্না হয়? উনি বললেন, আপনি রসিকজন! শোনেন একটা গল্প— একবার ভারতীয় এক কবিকে বললাম, আপনি তো আমার লেখা পড়েননি! আমি আপনাকে পড়লাম। ভ্যাবাচেকা খেয়ে তিনি বললেন, গোস্ত শব্দটি কলকাতার বাংলায় ব্যবহার হয় না! আমি আর মান্নান সৈয়দ জানি, গোস্তের উত্তাপ মান্টো ছাড়া কেউই বোঝেনি।
হঠাৎ ভাবীর ফোন। তবে কার কথা ভাবলেন তিনি! মান্নান সৈয়দ একটু উদাস মনে কাঁদলেন। আনমনে হাসলেন। চায়ের ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। খুব রহস্যময় চোখের ভঙ্গি। আমাকে না চেনার ভান করে বললেন, জানেন বাংলা কবিতা বেহাত হয়ে গেছে। বললাম: জানি, গফুরের গোস্ত ঠাণ্ডা হচ্ছে!
১/৪/২০১৯
ঢাকা
- শিশির ভট্টাচার্য্য, চিত্রশিল্পী