আজাদ তরিকায় আজাদরে স্মরণ
হুমায়ুন আজাদের জন্মদিনে তারে স্মরণ করা যাক। ব্যক্তিগতভাবে আজাদের কাছে আমি ঋণী, শত মানুশের সমুখে দাঁড়ায়ে, ফিফটি ফাইভ টানতে টানতে নিজের কথাটা কিভাবে চট করে বইলা ফেলতে হয়, এইটা আজাদের কাছে আমি শিখছি।
আজাদের কাছে আমি গদ্য শিখছিলাম, পরে ওই গদ্য না লেখলেও, শেখাটার মূল্যমান ছিল বিপুল। আজাদের গদ্যের সবচাইতে বড় গুণ হইলো এর শব্দসম্ভার এবং বাক্যের সংবিধিবদ্ধতা, বড় দোষের ভিতরে এই মুহূর্তে মনে পড়তেছে—হিউমার ওনার গদ্যে প্রায় নাই-ই।
হিউমারহীনতা যদি আজাদের গদ্যের অন্যতম দুর্বলতা হয়, তাইলে সেই দুর্বলতার মেকাপ হিশাবে তার গদ্যে আছে তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা, আতিশয্য। কটাক্ষ আর শ্লেষে হুমায়ুন আজাদ ওস্তাদ মানুশ, এই ব্যাপারে তারে আমি গুরু মানি। কলম ক্যামনে তরবারি (বা পিস্তল)-র কাম করে, আজাদের গদ্য পড়লে কিছু বোঝা যায়। তার এই বক্তব্যের তীব্রতা, ঋজুতা প্রায়শই উগ্রতায় পর্যবসিত হইছে, তাত্ত্বিক প্রবন্ধ গিয়া দাঁড়াইছে ব্যক্তি আক্রমণে। তবে তার এই তীব্র কটাক্ষ আর শ্লেষই তার গদ্যরে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় বানায়ে রাখছে আজও, অস্বীকারের উপায় নাই। আজাদের লেখা আমার প্রিয় গদ্য বই—লাল নীল দীপাবলী।
আজাদের কবিতা গড়পড়তা, কয়েকটা কবিতা ছাড়া তার প্রায় সকল কবিতাই এক ছকে ফালায়া পইড়া ফেলা যায়, একদম অনায়াসে। কিন্তু কিছু শব্দসমবায় এবং এর ব্যবহারের দৃঢ়তা, কিছু থিমের পৌনঃপুনিকতা আজাদের কবিতারে বিশিষ্টতা দিছে। আজাদের কবিতার বইগুলা সবই প্রায় একইরকমের, এর মধ্যে আমার পছন্দের বই আজাদের সর্বশেষ বইটা—কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু। এই বইটাতেই আজাদরে একটু অন্যরকম লাগছে।
র্যাদার, ছড়ায় আজাদ অনবদ্য। বেশকিছু ভাল ছড়া আজাদ লিখছেন, আকারে-প্রকারে-আঙ্গিকে সেগুলি বেশ চমকপ্রদ। কিশোরসাহিত্যে আজাদের আসল শক্তি ধরা দিছে বইলা আমার ধারণা। তার কিশোরদের জন্য লেখা সবগুলা বই-ই—সেগুলির হেটস্পিচসমূহ বাদে—আমার খুব পছন্দের।
নিয়তির নটঙ্কি, আজ আজাদের যেই বইটা সবচাইতে বেশি বিক্রি হয়, বিসিএস পরীক্ষার্থীদের সুবাদে, সেইটাও আজাদ লিখছিলেন কিশোরদের জন্যেই।
আজাদের লেখা আমার প্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই হইলো—ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না।
হিউমারহীনতা যদি আজাদের গদ্যের অন্যতম দুর্বলতা হয়, তাইলে সেই দুর্বলতার মেকাপ হিশাবে তার গদ্যে আছে তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা, আতিশয্য। কটাক্ষ আর শ্লেষে হুমায়ুন আজাদ ওস্তাদ মানুশ, এই ব্যাপারে তারে আমি গুরু মানি। কলম ক্যামনে তরবারি (বা পিস্তল)-র কাম করে, আজাদের গদ্য পড়লে কিছু বোঝা যায়। তার এই বক্তব্যের তীব্রতা, ঋজুতা প্রায়শই উগ্রতায় পর্যবসিত হইছে, তাত্ত্বিক প্রবন্ধ গিয়া দাঁড়াইছে ব্যক্তি আক্রমণে। তবে তার এই তীব্র কটাক্ষ আর শ্লেষই তার গদ্যরে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় বানায়ে রাখছে আজও, অস্বীকারের উপায় নাই।
প্রবন্ধে (অ্যাকাডেমিক ও নন অ্যাকাডেমিক) আজাদ শক্তিশালী, মোস্টলি তার ভাষিক দৃঢ়তার জন্যেই। নতুবা, বিষয়বস্তু, চিন্তা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির দিক থিকা আজাদ একজন নন-ক্রিটিকাল উগ্র মডার্নিস্ট, ওয়েস্টার্ন এনলাইটেনমেন্টের আলোর ঝলকানিতে দৃষ্টি হারানো অধ্যাপক। তিনি ওয়েস্টের পুরান চিন্তাগুলারে নতুন ও প্রাণবান ভাষার মোড়কে অনূদিত রাইখা গেছেন, তেমন কিছু যোগ-ভাগ করতে পারছেন বইলা মনে হয় নাই।
একটু আগে বলছিলাম, আজাদের অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধও ভাষার গুণে (বা দোষে) ব্যক্তি আক্রমণে রুপান্তরিত হইছে অনেক ক্ষেত্রে। এইটারে দোষ-গুণ যাই বলি না কেন, অ্যাকাডেমিক বা নন-অ্যাকাডেমিক, ভাষার লাগাম হাতে থাকলে যেকোন লেখারেই যে সৃজনশীলতার পর্যায়ে উন্নীত করা যায়, অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধও যে ‘সাহিত্য’ হইতে পারে, বাঙলাভাষায় এইটার নজির আজাদ রাইখা গেছেন। তার লেখা আমার প্রিয় প্রবন্ধের বই—সীমাবদ্ধতার সূত্র।
হুমায়ুন আজাদরে নিয়া লেখতে গেলে ম্যালাকিছু মনে আসে। ছোটকাল থিকা হুমায়ুন আজাদ আমারে মুগ্ধ করতেন, মানে তার লেখাজোখা বা চিন্তা না, ‘হুমায়ুন আজাদ’ কইলে এই হিপোক্রেসিময় জগত-সংসারে বইসা যে একটা প্রবল আমিত্ববোধ জাইগা ওঠে, সেই বোধটাই ভাল লাগতো, এখনও বোধ হয় লাগে কিছু কিছু। কিন্তু জগত সংসারে স্থির সত্য নাই বোধ হয়, ফলে আজাদের হিপোক্রেসির একটা গল্প দিয়া লেখাটা শেষ করব। এই গল্প, বিডি আর্টসে চঞ্চল আশরাফের ‘আমার শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ’ ধারাবাহিক লেখাটির কোন এক পর্বে, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক আহমদ মাযহারের কমেন্টসূত্রে জ্ঞাত। কমেন্টটি হুবহু কোট করা হইলো।
‘চঞ্চল আশরাফ, আপনার লেখাটা ভালো লাগছে। হুমায়ুন আজাদ আমারও শিক্ষক ছিলেন। তরুণ বয়সে তার ব্যক্তিত্বের তীব্রতা ভালো লাগত, আবার অনেক ক্ষেত্রে তার বক্তব্য দ্বারা প্রতিহতও হতাম। তবে এড়িয়ে চলতাম না।
আধুনিক বাঙলা কবিতার একটা সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। শুরুর দিকে আমাকে বলেছিলেন তার সঙ্গে কাজ করতে। কথা ছিল নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে বের হবে বইটি। নওরোজের কাদির খান সাহেব বলেছিলেন সংকলনটিতে কবিতা ছাপতে হলে কবিদের অনুমতিপত্র তার কাছে জমা দিতে হবে। কারণ হুমায়ুন আজাদকে অনেকেই পছন্দ করেন না বলে এ নিয়ে গোলমাল হতে পারে। প্রথমে হুমায়ুন আজাদ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে রাজী হয়েছিলেন। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই অনুমতিপত্র সংগ্রহের কাজটি করতে। কবি আল মাহমুদের সঙ্গে সেই সময়টাতে আমার খুবই সখ্য ছিল। প্রায়শই শিল্পকলা একাডেমিতে তার অফিসে আড্ডা দিতে যেতাম। সেইসূত্রে অনুমতি চাইলে কবি আল মাহমুদ অসম্মতি জানিয়েছিলেন। শুনে খুব রেগে গিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কাদির খানকেও জানিয়েছিলাম ব্যাপারটা। তিনিও বলেছিলেন, বই বের হলে কবিরা গোলমাল করবেন তাদের অনেকেরই কবিতা নেই বলে। পরে অবশ্য আমার পক্ষে ঐ কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি, আমার নিজের অন্যতর ব্যস্ততার কারণে।
বেশ কয়েকবছর পরে অবশ্য হুমায়ুন আজাদ আধুনিক কবিতার একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন যেটা প্রকাশিত হয়েছিল আগামী প্রকাশনী থেকে। আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে, তাহলে যতদূর মনে পড়ে ঐ সংকলনে আল মাহমুদের কবিতা বাদ দেয়া হয়েছিল, তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী-এই অভিযোগ তুলে। হুমায়ুন আজাদ কবিতার স্বার্থকতা সম্পর্কে যা বলতেন তার প্রতিফলন তার নিজের কবিতায় খুব একটা ছিল বলে আমার অন্তত মনে হয় নি।’