ইরফান খান
এক অসাধারণ অভিনেতার মন
ঘটনাচক্রে, গোটা দেশ লকডাউনে যাওয়ার আগে আগে সিনেমা হলে গিয়ে যে সিনেমাটি দেখেছিলাম, সেটি ছিল ইরফান খানের সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ‘আংগ্রেজি মিডিয়াম’। কোনও অভিনেতার অভিনয়ের পরিপূর্ণ নৈপুণ্যে ছাড়াও, এই সিনেমার যে বিষয়টি আপনার মনে থাকবে, তা হলো তিনি পর্দায় এমন এক পিতাকে চিত্রিত করেছিলেন যিনি মা এবং বাবা উভয়ই হতে চেষ্টা করছেন, এমন এক বাবা যিনি তার কিশোরী কন্যার মতোই অনড় কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাবা হিশেবে তিনি যেনো দুর্বল, আক্রান্ত, পরাস্থও-বা!
আর এটিই আমাদেরকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়, তার অভিনয় আমাদের এতো ভালো লাগে কেনো? তার কাজের পরিমণ্ডল? কিংবা যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতেন? পর্দায় তার উপস্থিতি? নাকী বিপদাপন্নতা?
সকল অনুরাগি দর্শকই বলবেন যে, তাঁর দৃষ্টি আমাদের সঙ্গে কথা বলতো। তাঁর করা সবগুলো চরিত্রই কেমন অরক্ষিত, বিপদোন্মুখ। বলিউডের মাচোম্যান নায়ক হওয়ার আদর্শটি তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন। তাহলে এই মানুষটির বিশেষ এমন কী বৈশিষ্ট্য ছিল যা লাখো-কোটি মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতো?
আমার কাছে, এটি একটি উজ্জ্বল তারার নিখুঁত নম্রতার মতোই, যিনি উঠে এসেছিলেন এক নিরভিমান প্রেক্ষাপট থেকে এবং নিজেই সেটিকে বিশাল রূপ দিয়েছেন। সৃজনশীল স্তরে, তিনি কখনই নিজের সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিলেন না। বলিউডের বেশিরভাগ স্টাররা যেরকম ভাবনায় ভোগেন যে নতুন কেউ এলে খুব দ্রুতই নিজের সাম্রাজ্যের পতন ঘটবে, এরকম ভাবনা ইরফানের কখনওই ছিলোনা। তিনি জানতেন যে কী করছেন, কীভাবে করছেন এবং তার চারপাশে কি ঘটে চলেছে, কারণ তিনি ছিলেন ‘নিখাদ’।
সকল অনুরাগি দর্শকই বলবেন যে, তাঁর দৃষ্টি আমাদের সঙ্গে কথা বলতো। তাঁর করা সবগুলো চরিত্রই কেমন অরক্ষিত, বিপদোন্মুখ। বলিউডের মাচোম্যান নায়ক হওয়ার আদর্শটি তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন। তাহলে এই মানুষটির বিশেষ এমন কী বৈশিষ্ট্য ছিল যা লাখো-কোটি মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতো?
তিনি যে সকল পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেকেই বলেছেন যে ইরফান একটি পৃথক স্টাইল তৈরি করেছিলেন। তিনি পুরোপুরি নিজের জন্য আলাদা ঘরানা তৈরি করেছিলেন। মুম্বাইয়ের মাফিয়া ডনদের কাছে হত্যে দিয়ে পরে থাকেন নি তিনি, যিনি তাঁর নৈপুণ্যে বিশ্বাস রাখতেন এবং সম্ভব-সব সর্বোত্তম উপায়ে সেটিকে ব্যবহৃত হতে দিতেন। ইরফান নিজেই ‘উত্তরাধিকার’ তৈরি করতে পেরেছেন, নিজেকে অন্যের ফাঁদে আটকে যেতে দেননি। যে কারণেই সম্ভবত তিনি সব ধরণের সিনেমাপ্রেমীর অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব।
বিশ্বজুড়ে এবং দেশজুড়ে সমবেদনা প্রকাশের সাথে সাথে, আসুন আমরা ভুলে না যাই যে এই মানুষটিকে তার যথাযোগ্য সম্মান অর্জন করতে কতো কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আমরা তো জানিই যে তাঁর পাতে কেউই সেরা পছন্দসমূহ রাখেনি। জয়পুরের এক যুবক যা স্বপ্ন হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন, তিনি তা নিজের মতো করেই পূরণ করে গেছেন।
একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অভিনয় শুরু করেছিলাম একটি কারণেই, এটি আমাকে ব্যস্ত রাখতো…নয়তো নিজেরই উপরই বিরক্ত হয়ে পড়তাম…আমার সকল উদ্বেগ, আমার ক্ষোভ, আমার ভয়… আমি সবসময় নিজেকে খুব ভয় পাই। নিজের ভয়কে সামাল দেওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল অভিনয় করা।’
এটি খুব সহজ-সরল স্বীকারোক্তি যা অন্য যেকোনও কিছুর মতোই বিপদাপন্ন। এমন হৃদয় জানে কোথায় যেতে হবে এবং কীভাবে সেখানে যেতে হবে । এ-হৃদয় বেশিরভাগ সময় নিজের সাথে যোগাযোগ রেখে চলে, কথা বলে।এ এমন এক মন যা স্বীয় প্রতিভার সঙ্গে সঠিক সমীকরণ করেছে। যদিও বাইরে থেকে কেউ অনুমানও করতে পারবে না যে তিনি ভেতরে ভেতরে ‘নিজেকে ভয় পেতেন’। ইরফান আপনাকে-আমাকে নিরস্ত্র করে রেখে গেছে তাঁর পদচারণায়, তাঁর শান্ত-সমাহিত উপস্থিতি দিয়ে আর তাঁর উদ্দীপ্ত হাসি ছড়িয়ে।