সত্যজিৎ রায়, পথের পাঁচালী এবং কিছু নেপথ্যের গল্প
Art is not a pleasure trip, it is a battle. -অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একটি মহৎ শিল্প একদিনেই গড়ে উঠে না। এর পেছনে থাকে শিল্পীর রক্তাত্ব হাতের ছোঁয়া। একটি শিল্প তৈরি হতে প্রয়োজন হয় শিল্পীর অসাধারণ ধৈর্য, সাধনা, সৃষ্টিশীলতায় ডুবে থাকার শক্তি সহ আরো অনেক কিছু। পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায়ের ঠিক এমনই এক মহৎ সৃষ্টি। কিন্তু এই সৃষ্টি একদিনেই গড়ে উঠেনি। এর পেছনেও রয়েছে কত কঠিন সাধনা, ত্যাগ, যন্ত্রনার ইতিহাস! অনেক সাধনা আর রক্তক্ষরণের পরেই বুঝি সৃষ্টি হয় এক মহৎ শিল্পের! স্বামী বিবেকানন্দ প্রায়ই তাঁর ভক্তদের বলতেন কথাটা, “ফাঁকি দিয়ে মহৎ কোন কাজ হয় না”। অন্যান্য মাধ্যমের কথা জানি না তবে শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে এ কথাটি শতভাগ সত্য।
প্যারিস থেকে ভারতে আসার পথে ‘চুসান’ নামের একটি জাহাজে বসেই সত্যজিৎ তাঁর পরিকল্পনাটা স্থির করে ফেলেছিলেন। তিনি ছবি বানাবেন তারপরও আবার সেই ছবিটি হবে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’কে অবলম্বন করে। রায় তখন জাহাজে বসে আরেকটি কাজও করছিলেন। ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বইটির প্রচ্ছদের ভার তখন তাঁর উপর। সেটির প্রচ্ছদ নিয়েও তিনি তখন মগ্ন কারিগর। সম্ভবত ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ করতে যেয়েই সত্যজিৎ এর মনে চলচ্চিত্র নির্মাণ এর সিদ্ধান্তটি আসে। জাহাজে সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বিজয়া রায়। বিজয়াকে বললেন তাঁর মনের কথাটি। ”পথের পাঁচালীকে সিনেমায় রূপ দিব।” বিজয়া সত্যজিৎকে ভালো করেই চিনতেন। সত্যজিৎ যদি কোন কিছু করার পরিকল্পনা করেন তাহলে তিনি সেটি করবেনই। তারপরও তিনি প্রশ্ন করলেন সত্যজিৎকে। “গ্রামের ছবি, অথচ তুমি তো আমাদের গ্রাম কোনদিন চোখেও দেখোনি”। সত্যজিৎ এর ঝটপট উত্তর, ”বিভূতিভূষণের বইতে গ্রাম-বাংলার যে বিবরণ আছে, তাতে চোখের সামনে যেন সব দেখতে পাই। তবে হ্যাঁ, ফিরে গিয়ে কলকাতার কাছাকাছি কোন গ্রাম নিজের চোখে দেখে আসতে হবে”।
‘পথের পাঁচালী’ তৈরিতে মোট বাজেট ছিল সত্তর হাজার টাকা। সত্যজিৎ যে দশ হাজার টাকা সিনেমায় ইতিমধ্যে ব্যায় করেছিলেন সেই টাকাকে ধরা হল ‘সিকিউরটি মানি’। চিত্রস্বত্ববাবদ বিভূতিভূষণের বিধবা স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাকা দেওয়া হল। চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সব আর্টিষ্টদের টাকা দেওয়া হল। সত্যজিৎ লিখেছেন, “একমাত্র আমার জন্যেই সেখানে কোনও বরাদ্দ নেই, এই পর্যায়ে একমাত্র আমিই কিছু পাব না।”
ব্যস, যাত্রা হল শুরু। তবে কাজটি যে ছিল কঠিন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৫১ সালে কলকাতায় প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছিল। সেই চলচ্চিত্র উৎসবটি ছিল সত্যজিৎ এর কাছে বিশাল এক ঘটনা। বলা যায় তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল সেই উৎসবটি। তাঁর ভাষায়, “সেই সময় এক হল থেকে আরেক হলে প্রায় পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছি আমরা। গড়পড়তায় রোজ তখন গোটা চারেক করে ছবি দেখেছি।” সেই চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল ডি’সিকার এর ‘মিরক্যাল ইন দি মিলান’, রোসেলিনির ‘ওপেন সিটি’, আকিরা করোশাওয়ার ‘রসোমোন’ ইত্যাদি। চলচ্চিত্র উৎসব শেষে সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য, “আমার মনে কোন সংশয় রইল না যে, আমি ছবিই তুলব। পথের পাঁচালীই হবে আমার প্রথম ছবি। যদি ভালো না হয় তো মাথা নিচু করে ফিরে যাব কিমারের কাজে’।
অনেকটা শূন্য হাতেই রায় নেমে পড়লেন চলচ্চিত্রের কাজে। হাতে কিছু জমানো টাকা, জীবন বীমা কোম্পানী থেকে আগাম কিছু টাকা আর বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে পাওয়া হাজার পাঁচেক। মোট দশ হাজার টাকা মূলধন নিয়েই তিনি নেমে পড়লেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবি নির্মাণের কাজে। প্রাথমিক ভাবে চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র যেমন হরিহর, সর্বজায়া, অপু, দুর্গা, তাদের পিসি ইন্দিরা ঠাকুরণ এই কয়েকটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে শিল্পী খোঁজায় তিনি মন দিলেন।
তবে সত্যজিৎ কাজটি যত সহজ ভেবেছিলেন বাস্তবে তা ছিল কঠিন। তবে স্ত্রী বিজয়া রায় এর দিক থেকে সব রকম সহযোগিতার আভাস পেলেও প্রথম বাধাটি আসে তাঁর মা সুপ্রভা দেবীর কাছ থেকে। মার আপত্তির কারণ ছিল অনেক। বিশেষ করে সেই সময়ে ব্রাহ্মসমাজ কোন ভালো পরিবারের মানুষ চলচ্চিত্রে নামতেন না। আরেকটা মূল এবং প্রধান কারণ ছিল চলচ্চিত্র মাধ্যমটি ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটি পেশা। এদিকে সত্যজিৎ রায় তখন তাঁর পেশায় প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ। প্রতি মাসে সেই সময়ই তাঁর মাসিক বেতন ছিল দুই হাজার একশত টাকা। এমন ভালো চাকরি ছেড়ে চলচ্চিত্র! সত্যজিৎ এর ভাষায়, “তাঁর আপত্তি এইখানে, যেভাবে আমার আয়ের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেই পাকা চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এমন একটা কাজ আমি করতে চলেছি, আমাদের পরিবারে আর কেউ যা ইতিপূর্বে করেননি”।
শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় তার মাকে রাজি করালেন এই বলে যে চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর চাকরিটা ছাড়বেন না। সুপ্রভা দেবী রাজী হলেন।
এর মধ্যে একদিন সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রস্বত্ব নিয়ে পাকা কথা বলার জন্য বিভূতিভূষণের বিধবা স্ত্রী রমা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করলেন। রমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর স্মৃতিতে সে ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে, “দীর্ঘদেহ, ব্যাক্তিত্বপূর্ণ বিশাল পুরুষকে দেখে প্রথমেই শ্রদ্ধা জাগে। পরনে প্যান্ট, গায়ে শার্ট, আর তার ওপরে একটি সুন্দর সোয়েটার। কাঁধে চামড়ার মোড়কে মোড়া দামি ক্যামেরা”। রমা দেবী ‘পথের পাঁচালী’র চলচ্চিত্র স্বত্ব কাগজে স্বাক্ষর করলেন।
এবার শুরু হল চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রীর সন্ধান। এই কাজটাও অনেক কঠিন হয়ে গেল! সত্যজিৎ কাউকেই পছন্দ করছেন না! বিভূতিভূষণের উপন্যাসে যেভাবে অপু আর দূর্গার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তিনি সেই অপু আর দুর্গাকে খুঁজছেন। শেষপর্যন্ত অপু আর দূর্গার খোঁজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। হাজার হাজার বাচ্চারা ইন্টারভিউ দিল। কিন্তু কোন ফল হল না। সত্যজিৎ এবং বিজয়া দুজনেই খুব হতাশ হয়ে গেলেন! শেষ পর্যন্ত কাকতালীয়ভাবে ঘটল একটা ঘটনা। অপুকে আবিস্কার করা হল সত্যজিৎ রায়ের পাশের বাড়ির ছাদেই! বিজয়া রায় একদিন বাড়ির জানালার কাছে বসে বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে পড়ল একটি ছেলের উপর। এইতো সেই অপু! তিনি উত্তেজনায় চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কাজের লোক পাঠিয়ে ছেলেটিকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। জানা গেল তার ডাক নাম সুবীর অর্থাৎ সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন সন্ধ্যায় সত্যজিৎ এসে সুবীরকে দেখে তিনিও চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন ‘এইতো সেই অপু!’ অপুকে খুঁজে পাওয়া গেল এবার দুর্গাকে খোঁজার পালা। সেই একই সমস্যা। উপযুক্ত দূর্গাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবারও ঘটলো আরেকটি কাকতালীয় ঘটনা! সত্যজিৎ রায়ের সহকারী লেখক আশিস বর্মন দুর্গার একটা খোঁজ পেলেন। আশিস বর্মন কলকাতা বেলতলা একটা স্কুলের কাজে যেয়ে সেখানে উমা দাশগুপ্ত নামের একটি মেয়ের দেখা পেলেন। মেয়েটিকে দেখেই তিনি ভাবলেন মেয়েটিকে দিয়ে দুর্গার অভিনয় করানো যেতে পারে। তিনি সত্যজিৎকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানালেন। সত্যজিৎ রায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উমা দাশগুপ্তকে তাঁর বাড়িতে আনার ব্যাবস্থা করলেন। উমার বয়স তখন এগার। উমাকে কাছে পেয়ে বিজয়া রায় দূর্গার মত গাছকোমড় শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে সত্যজিৎ এর সামনে নিয়ে এলেন। সত্যজিৎ এবারও চিৎকার দিয়ে উঠলেন, “এই তো দুর্গা!” অন্যদিকে পথের পাঁচালীর ছোট বয়সের দুর্গার জন্যে পেয়ে গেলেন বন্ধু করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা শম্পা অর্থাৎ রুনকি বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তখন তার বয়স ছিল চার কি পাঁচ।
সত্যজিৎ নিজেই নিজের কাজে খুশি। তার ভাষায়, “কাজ যা করেছি, তার জন্যে মনে মনে নিজেকেই তারিফ জানাচ্ছিলাম। সত্যি বলতে কী, এ ছবির সঙ্গে ভারতে বা পৃথিবীতে তোলা কোন ছবিরই মিল নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমার উপরে হলিউডের রেনোয়াঁর কিংবা ডি’সিকার প্রভাব থাকা স্বত্বেও এ ছবি একেবারে হাড়ে-মজ্জায় ভারতীয়”।
এর পরের কাজ হল ইন্দির ঠাকুরণ চরিত্র উপযোগী একজন বৃদ্ধাকে খুঁজে বেড় করা। রেবা দেবী নামের একজন মঞ্চাভিনেত্রী সত্যজিৎ রায়কে জানালেন তিনি একজন অভিনেত্রীর খবর দিতে পারবেন। তার নাম চুনিবালা দেবী। তিনি মঞ্চে ত্রিশ বছর ধরে অভিনয় করেছেন এবং সিনেমাতেও সমান দক্ষতায় অভিনয় করতে পারবেন। বিভূতিভুষণ এর বর্ণনা অনুযায়ীও তিনি পুরোপুরি ফিট। বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাসে বৃদ্ধার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন সেটি ছিল এমন, “পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। দূরের জিনিস আগের মত ঠাহর হয় না”।
সত্যজিৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ছড়া জানেন কোন?’
এ কথা শুনতেই চুনি বালা ‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি’ পুরো ছড়াটি শুনিয়ে দিলেন। সত্যজিৎ যথারীতি ইন্দির ঠাকুরণকেও খুঁজে পেলেন। রায়ের ভাষায়, “চুনিবালা আমাদের হতাশ করলেন না”। সর্বজয়াকে খুঁজে বের করতে খুব কঠিন হল না।সত্যজিৎ রায়ের বন্ধু সুব্রত বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী করুণা বন্দোপাধ্যায়। তিনি অভিনয় না করলেও ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে তাঁরও চলচ্চিত্রে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আর তিনি পেশাদার কোন অভিনেত্রীও ছিলেন না। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাচন করা হল সবর্জয়ার রূপ দেওয়ার জন্যে। তারপর খুঁজে পেলেন হরিহরের ভুমিকায় কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। কানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন আর তাছাড়া হরিহর চরিত্রে উপযুক্ত অভিনেতা ছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিনেমার মূল অভিনেতাদের সন্ধান পাওয়ার পর সত্যজিৎ এবার সিনেমার শ্যুটিং এর কাজে হাত দিলেন। কলকাতার কাছেই বোড়াল নামের একটি গ্রামকে তিনি বেছে নিলেন যেখানে উপন্যাসে বর্ণিত আছে কাশফুল বন আর সেই বনের মাঝখান দিয়ে রেল লাইন। সত্যজিৎ তখন প্রতি শনিবার এবং রবিবার শুটিং করেন আর বাকি দিন অফিস করেন। এদিকে শুটিং এর মাঝখানে হঠাৎ করেই টাকার অভাবে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে ‘পথের পাঁচালী’তে লগ্নি করার মত কোন প্রযোজককেও তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সবার সেই একই কথা। ”নায়ক নায়িকা নেই, এই ফিল্ম মানুষ কি দেখবে? কে আসবে ঐ বুড়িকে দেখতে?” কিন্তু সত্যজিৎ মোটেও হাল ছেড়ে দেননি। টানা ৮ মাস শুটিং বন্ধ থাকার পর বিজয়া রায়ের বিয়ের গয়না মাত্র ১৩০০ টাকায় বন্ধক দিয়ে আবার শুটিং শুরু করলেন।
অর্থের জন্যে চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ যখন রুদ্ধ ঠিক সেই কঠিন সময়ে পুত্রকে উদ্ধার করতে সত্যজিতের মা সুপ্রভা দেবী স্বয়ং মাঠে নেমে গেলেন। সুপ্রভা দেবীর এক বান্ধবীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বেশ জানাশোনা ছিল। তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। বিজয়া রায়ের এর স্মৃতিতে ”পুত্রকে উদ্ধার করতে মা একদিন গেলেন বেলামাসির বাড়ি। বেলামাসি আমার শাশুড়িকে খুব ভালোবাসতেন, তাই ওঁর কথা ফেলতে পারেননি। দিন কয়েক বাদেই বিধানচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে সংবাদ এল, সত্যজিৎ রায় যেন তাঁর সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনে দেখা করেন”।
শেষ পযন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পশ্চিম বঙ্গ সরকার রাজি হল সত্যজিতের সিনেমাটি তৈরি করতে। ‘পথের পাঁচালী’ তৈরিতে মোট বাজেট ছিল সত্তর হাজার টাকা। সত্যজিৎ যে দশ হাজার টাকা সিনেমায় ইতিমধ্যে ব্যায় করেছিলেন সেই টাকাকে ধরা হল ‘সিকিউরটি মানি’। চিত্রস্বত্ববাবদ বিভূতিভূষণের বিধবা স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টাকা দেওয়া হল। চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সব আর্টিষ্টদের টাকা দেওয়া হল। সত্যজিৎ লিখেছেন, “একমাত্র আমার জন্যেই সেখানে কোনও বরাদ্দ নেই, এই পর্যায়ে একমাত্র আমিই কিছু পাব না।”
শেষ পযন্ত তৈরি হল সেই ঐতিহাসিক সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’। সত্যজিৎ নিজেই নিজের কাজে খুশি। তার ভাষায়, “কাজ যা করেছি, তার জন্যে মনে মনে নিজেকেই তারিফ জানাচ্ছিলাম। সত্যি বলতে কী, এ ছবির সঙ্গে ভারতে বা পৃথিবীতে তোলা কোন ছবিরই মিল নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমার উপরে হলিউডের রেনোয়াঁর কিংবা ডি’সিকার প্রভাব থাকা স্বত্বেও এ ছবি একেবারে হাড়ে-মজ্জায় ভারতীয়”।
১৯৫৫ সালের ৩মে ছবিটি নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব আর্ট (মোমা) প্রথম আন্তর্জাতিক উদ্বোধন হয়। ১৯৫৫ সালে ২৬ আগষ্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতে প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি প্রথম উনিশ দিনেই টিকেট বিক্রি হয়েছিল তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা। হল ভাড়া আর আনুসঙ্গিক খরচ বাদ দেওয়ার পর পশ্চিম বঙ্গ সরকার সিনেমাটি থেকে আয় করেছিল এক লক্ষ পয়ষট্টি হাজার নয় শত আটাত্তর টাকা।
‘পথের পাঁচালী’র উৎরে যাওয়ার পর সত্যজিৎ চলচ্চিত্রকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করলেন। তিনি ডিজি কিমার চাকরিটি ছেড়ে দিলেন। শুরু হল সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জীবন। সত্যজিৎ মানেই শুধু ভারত নয় গোটা পৃথিবীর চলচ্চিত্র পাড়ায় এক বড় ইনস্টিটিউশন।
দেশি বিদেশি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত ‘পথের পাঁচালী’ মানুষের ভালোবাসায় মেশানো এক চলচ্চিত্রের নাম। সন্দেহ নেই মানুষের এই ভালোবাসাই ‘পথের পাঁচালী’র সবচেয়ে বড় পুরস্কার।