নারসিসাসের আরশি – ৩
শাহিদ আনোয়ারের শিথান পৈথান
চন্দন চৌধুরীর সাথে যেদিন প্রথম বইমেলায় দেখা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন- আবার কখনো দেখা হবে পথের নিয়মে! পথের নিয়মে সবার সাথে আর দেখা হবার সুযোগ হয় না। অনেক কবির সাথেই বিরল একবার দুবার দেখা হয়েছে কিন্তু তাদের সাথে সেই সব সামান্য প্রত্যক্ষ স্মৃতিই অসামান্য পরোক্ষ স্মৃতি হয়ে দানা বেঁধেছে। কারো কারো সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে না; যেমন সোহেল রাব্বী, মাসউদ শাফি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মত অনেককেই খুঁজে পেয়েছি, তারপরেও কেউ কেউ বেমালুম হারিয়েই গেছেন আমার জীবন থেকে; যেমন হাবিব আহসান, আহমেদ রায়হান, শাহিদ আনোয়ার কিংবা পিয়াস ওঝা। আমার জানা মতে এঁরা ফেসবুক ব্যবহার না করার মত স্বাধীন মানুষ। ফেসবুক কেমন এক ধরণের বন্দিত্ব উপহার দিয়ে থাকে বলে মনে হয়েছে আমার।
অরুণ দাশগুপ্ত ছিলেন দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক। একদিন অরুণদার বাসায় গেছি। পান চিবোনো শেষ হলে আমার কবিতা দুটো জমা রাখবেন, অপেক্ষায় আছি। দেখি কবি শাহিদ আনোয়ারও আছেন, কিংবা অরুণনদার বাসা থেকে আমরা এক সাথেই বের হলাম। যাহোক ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে শাহিদ আনোয়ার বললেন তাঁর কবিতার বইয়ের নাম ঠিক করেছেন আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার। তখন দেশে সেনাশাসন, পৃথিবীতে তখনও খোলা হাওয়া আসেনি, লাল রঙের একটা আলাদা দ্যোতনা বিরাজ করত। দুজনেরই গন্তব্য সবুজ হোটেল। ওখান থেকে রিকশা ছাড়া গতি নাই। কিন্তু কবি রিকশায় যাবেন না। হেঁটে হেঁটে (সন্ধ্যার আকাশ দেখতে দেখতে?) যাবেন। অগত্যা তাঁকে বিদায় দিয়ে একাই রিকশায় চাপলাম। কিছুদূর যেতেই পাহাড়ি উজানী রাস্তা ফুঁড়ে ছোট্ট একটা দা হাতে এক তরুণ আগন্তুক আমার রিকশা রোধ করে দাঁড়িয়ে ঘড়িটা খুলে নিতে নিতে মানিব্যাগটা চাইলেন। আমি দুপকেট থেকে খুচরো খাচরা টাকা বের করতে করতে বললাম, আমিতো মানিব্যাগ ইউজ করি না! (সত্যিই তাই)। যাহোক তুই সম্বোধন করে ব্যাক করে যেতে বলল রিকশা নিয়ে। আমি খুব আহত হইনি কেননা সেদিন বিকেলে পাওয়া পুরো মাসের খরচটা প্যান্টের ব্যাক পকেটে অক্ষত ছিল।
সবুজে পৌছে শাহিদ আনোয়ার এবং অন্যান্য আড্ডাবাজদেরকে পেলাম। ঘটনার পর্যালোচনা দ্রুতই শেষ হল, কেননা সে জমানায় এরকম ‘ঝাপটা’ খুবই সাধারণ ব্যাপার এবং অনুল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। শাহিদ আনোয়ার সেদিন আমার কবিতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটা কথাই বললেন— “কবিতায় exploration আছে”। মানে ভাল বুঝিনি কিন্তু বড় ভাল লেগেছিল এই উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য।
শাহিদ আনোয়ারের এই ধাত্রী আর সেবিকা বাংলা কবিতার কালোত্তীর্ণ দুটি চরিত্র। এক মুখে আল্লাহর বাণী সরাসরি কবিতায় নিয়ে এসে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত সুন্দর সংঘের কথা বলছেন, অন্য মুখে গণিকার মর্মবেদনার কথাও বলছেন। অনুসংগ হিসেবে শুঁড়িখানা এই কবির কাছে গালিবের মতোই আরাধ্য।
কিন্তু ওই লাল মাফলারের কথা ভুলিনি, যদিও ওই শিরোনামে কবির কোনো বই প্রকাশের কথা আমার জানা নেই! শীতের দিনে মাফলার পড়লেই কবির অদেখা সেই লাল মাফলার মনে পড়ে যায়। গত বছর কবির সহধর্মিণী কবি সেলিনা শেলীর ফেসবুকে কবির শ্রেষ্ঠ কবিতার ‘দেখনহাসি’ ধরনের প্রচ্ছদ প্রকাশিত হতে দেখেই এই গল্পটুকু লিখেছিলাম।
২.
কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে
ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?
(ধাত্রী, শাহিদ আনোয়ার)
শাহিদ আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইতে লাল মাফলার সংক্রান্ত কবিতাটি আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল; শোয়েব নাঈম ভাই মনে করিয়ে দিলেন। কবিতাটির নাম আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার। সে কবিতার লাইন- ‘সেলিনা আখতার তুমি প্রস্তুত রেখো, দেখো ভুলো না আবার / প্রিয় শাড়িটির নীল আঁচলের কাটা নীল কিছু ব্যান্ডেজ’।
শাহিদ আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই হাতে নিয়ে জেগে উঠল পাঠ্যস্মৃতি। জানি ক্ষুধার্তের মতো পড়া যায় রহস্য উপন্যাস, কিন্তু এই কবিতার বইটিও আমি ক্ষুধার্তের মতোই পড়ে ফেললাম। ক্ষুধা অবশ্য মেটেনি। প্রসংগত উল্লেখ্য, কবিদের স্বতন্ত্র কবিতার বই পড়ে যে তৃপ্তি পাই, শ্রেষ্ঠ কবিতা কিংবা নির্বাচিত কবিতা পড়ে আর সে মাত্রার তৃপ্তি আমি পাই না, কারণ সম্ভবতঃ পাঠ্যস্মৃতির মানদন্ডে কবিদের কাছে আমার উচ্চ আকাংখার পারদ।
শাহিদ আনোয়ারের প্রথম একগুচ্ছ কবিতা পড়ার স্মৃতি মনে করতে পারি ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের প্রতিবাদী কবিতা উৎসবে সমকালীন কবিদের একটা কবিতা সংকলন থেকে। নিশুতিরাতে স্থূল ভোঁতা একটা পতনের শব্দ শুনে কোন অভাগার মস্তক থেকে রক্ত গড়ালো ভাবতে ভাবতে পাশ ফেরা কবির অভিজ্ঞতাটি বাংলাদেশের বিখ্যাত একটি ছোট গল্পের দৃশ্যের সাথে যেমন মিলে যায়, কবির আর একটি কবিতার প্রতিবেশিনীর জন্য শোকগাথা তেমনি পঁচিশ বছর আমার করোটির ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল সেই কবিতারই প্রতিকবিতা নিজের জন্য একটি এলিজি! আলো আঁধারীর জ্যোৎস্নায় অনুচ্চ স্বরে চাঁদ বা মেঘের সাথে কবির পরামর্শ করে নেয়ার বুদ্ধিটাও বেশ মনে পড়ে, বেশ লাগে! কবি লিখেছেন মনোটোনাস গর্ভে কুঁকড়ে থাকা থেকে মুক্তকারী ধাত্রীর জন্য আকাংখার কথা, শাদা পোশাকের নার্সের হাতে শিরায় অমৃত মেশানোর রূপকথা। শাহিদ আনোয়ারের এই ধাত্রী আর সেবিকা বাংলা কবিতার কালোত্তীর্ণ দুটি চরিত্র। এক মুখে আল্লাহর বাণী সরাসরি কবিতায় নিয়ে এসে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত সুন্দর সংঘের কথা বলছেন, অন্য মুখে গণিকার মর্মবেদনার কথাও বলছেন। অনুসংগ হিসেবে শুঁড়িখানা এই কবির কাছে গালিবের মতোই আরাধ্য। শুঁড়িখানার ছদ্মাবরণে জীবন ও জগতকে উন্মোচিত করেছেন এক গ্রন্থে—
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে
একটি গোলাপ ফোটে
পরা-নারীর পরা-প্রেমের
পরা-শব্দ ছোটে।
আমায় একটি পরা-কাব্য
দাও না প্রেমের খোদা
থাকবে যেথায় মদের গন্ধ
মিষ্টি-নরম- সোঁদা।
(শুড়িখানার নুড়ির মধ্যে/৪, শাহিদ আনোয়ার)
সন্দেহ জাগে, তিনি কি এ কালের মির্জা গালিব কিংবা বিশ শতকের রূমি?
৩.
কবি বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ। এখন সেই অসুস্থতা গুরুতর। তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে লিখে ফেললাম একটা কবিতা—
সামাজিক যোগাযোগে তুমি নাই, তোমার খবর আছে নিম্নরূপ-
পক্ষাঘাত নিয়ে পড়ে আছ অর্ধেক চেতনায়
মেঘলা রাতের সাথে আজ আর পরামর্শ করো কি করো না,
বিস্মৃতির গাঢ় চাদরে ডুবে যাচ্ছে শুড়িখানার নুড়িগুলো,
দূরে সরে যাচ্ছে শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন, খুলনা জেল, অসময়ে
আকাশের দিকে উড়ে তোমার লাল মাফলার;
কেরাতের স্বর ভেসে আসে পাড়ার মসজিদ থেকে-
সিবাগাতাল্লাহে ওয়ানমান
আহসান মিনাল্লাহে সিবাগাতান!
শিথানে জেগে আছে শ্রেষ্ঠ কবিতা হাতে সেলিনা শেলীর ভাস্কর্য।
তোমার সান্নিধ্য ক্ষণিকের, আশির দশকে
চকবাজার কি আন্দরকিল্লায়
অথচ বয়ে বেড়াচ্ছি ঘনিষ্ঠ সতীর্থের স্মৃতি যেনবা
বন্দর নগরী হরতালে অবরুদ্ধ তোমার মৃদু পরিহাসে-
ধীরে মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে নাজিল কবি- স্বীকৃতি
সবুজ হোটেলের চায়ের সাথে বিরল বৈভব।
আর একবার চাই মেধাবী স্বীকৃতি, কিছু বলো
তোমাকে নিয়ে লেখা স্মৃতি-গদ্যের শিল্প গুন নিয়ে
কিংবা আমার সাগর পর্যটনের কবিতাগুচ্ছ নিয়ে।
তার আগে, মেরুন রঙের পুলোভার গায়ে
কুয়াশা সরিয়ে যেতে যেতে
সেই রক্তমাখা অভাগীর মস্তকের কথা মনে করিয়ে দিব;
বন্দরের যানজট, শুভ্র নার্সের সিরিঞ্জ ভরা দুঃখ পৈথানে রেখে
পতেংগার দিকে যাবার পথে
আরেক প্রস্থ চা হয়ে যাক।
(কবির শিথান পৈথান/ মোশতাক আহমদ)