:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
হাসনাত শোয়েব

কবি, গদ্যকার

ইয়েলো আন্ডারওয়্যার- প্রথম অধ্যায়
ব্যবহৃত শিল্পকর্ম: ভিনসেন্ট ভ্যান গোঘ

ইয়েলো আন্ডারওয়্যার- প্রথম অধ্যায়

বৃষ্টি পড়ছে। আমি ঠিক থেকে দুরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। কতটা দূরে? যতটা দূরে দাঁড়ালে বৃষ্টি দেখা যায়, কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজা যায় না। আমার দেখা ও না দেখার মাঝে ঝুলছে কতগুলো হলুদ আন্ডারওয়্যার। হবে সাত কিংবা আটটা। বৃষ্টির কারণে ঠিকঠাক গুনে দেখা যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে সে হলুদ মাথার ভেতর গেঁথে যায়। ঠিক হলুদ না, হলুদ না আন্ডারওয়্যার। সেগুলো নারীর নাকি পুরুষের? তাও বুঝা যাচ্ছে না। হতে পারে ২১ বছর বয়সী কোন নারীর কিংবা ২৮ বছর বয়সী কোন পুরুষের। বৃষ্টি কমতে থাকে, কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার আগেই কেউ এসে নিয়ে যায় আন্ডারওয়্যারগুলো। কে নিয়ে গেল? ২১ বছর বয়সী নারী নাকি ২৮ বছর বয়সী পুরুষ। জানা হলো না। ঠিক তখনই কেউ একজন কুকুর নিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল। মনযোগ দিতে গিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। এর ফাঁকেই নাই হয়ে যায় আন্ডারওয়্যারগুলো। আমার জানা হলো না সেগুলো কার, কেইবা তুলে নিয়ে গেল! ১০১ ডিগ্রি জ্বর এবং মাথার ভেতর ৭-৮ টি হলুদ আন্ডারওয়্যার নিয়ে বাসায় ফিরে আসি আমি।

শুয়ে পড়ি, স্বপ্ন দেখি। জ্বর জ্বর চোখ স্বপ্ন দেখে সাতটি হলুদ আন্ডারওয়্যার। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে চাই, দূরে সরে যায়। স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি। না, সেটিও স্বপ্ন। অবশেষে সাতটি ধাপ পেরিয়ে জেগে উঠি। পেছনে পড়ে আছে দুই ধাপ, সামনে চার। আমি আছি তৃতীয় ধাপে। সেখানেই খুন হয়ে গেছে তিতির। মাধ্যমিক জ্যামিতি বইয়ের শেষ পৃ্ষ্টায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে সে। দূরে বারান্দায় ঝুলানো তারে দুলছে আরো একটি হলুদ আন্ডারওয়্যার।

স্বপ্ন শেষ হয়। আমি ক্লান্ত বোধ করি। জেগে উঠি। রাস্তায় বেরিয়ে যাই। খুঁজতে থাকি, একটা ল্যাম্পপোস্ট, একটা বাসস্টপ। তার বিপরীতে একটা সাদা বাড়ি। দ্বিতীয় তলায় একটা বারান্দা। তারে ঝুলানো ৭-৮ টি হলুদ আন্ডারওয়্যার। খুঁজে পাই না। আমি তবুও খুঁজতে থাকি। দিন-রাত এক করে খুঁজতে থাকি। সাদা বাড়ি, টানা তার ও ৭ টি হলুদ আন্ডারওয়্যার। কেন খুঁজি? কোন কারণ নাই। তবুও খুঁজি। হয়তো জানতে চাই, আন্ডারওয়্যার সাতটি কেন কিংবা সবগুলোই হলুদ কেন? ভিন্ন কারণও হতে পারে। হয়তো জানতে চাই সেগুলো ২১ বছর বয়সী কোন নারীর নাকি ২৮ বছর বয়সী কোন পুরুষের? কিন্তু তুমুল বৃষ্টির ভেতর হারিয়ে ফেলা সেই বাড়ি আমি খুঁজে পাই না। এক সময় আন্ডারওয়্যার খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সাত ধাপের স্বপ্ন দেখি, তৃতীয় ধাপে গিয়ে জেগে উঠি। সেই বারান্দায় ঝুলানো হলুদ আন্ডারওয়্যার দেখে স্বপ্ন ভাঙে। এভাবে চলতেই থাকে… একদিন দুইদিন তিনদিন। আমার খুঁজতে থাকা রিপিট হতে থাকে, স্বপ্ন দেখা রিপিট হতে থাকে।

স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। হলুদ আন্ডারওয়্যার খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। জ্যামিতি বইয়ে তিতিরের চিৎ হয়ে থাকা লাশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। যেন ‘স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে’। ধীরে ধীরে আমি হতাশ হতে থাকি। কিন্তু ঠিকই খুঁজতে থাকি হলুদ আন্ডারওয়্যার। আমার সেই খুঁজতে থাকা বারবার রিপিট হতে থাকে। আমি নিজেও বারবার রিপিট হতে থাকি। তিতিরের খুন হওয়াও। এই রিপিটিশনের মাঝেই আমার চোখে পড়ে ‘ইয়েলো’র শো রুম। হলুদ আন্ডারওয়্যার খুঁজে পেতেও আমার কষ্ট হয়নি। কিন্তু একেকটি আন্ডারওয়্যার ৬০০ টাকা শুনে বেরিয়ে আসি। এরপর ফুটপাতে সন্ধান মেলে অসংখ্য হলুদ আন্ডারওয়্যারের। যেন আমার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি আন্ডারওয়্যার যেন হলদে পাখি। ফুটপাত থেকে মূল রাস্তা যেন অজস্র হলদে পাখিতে ভর্তি হয়ে আছে। ছুঁয়ে দিলেই উড়ে যাবে, লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে পড়বে। বেছে বেছে সাতটি হলুদ আন্ডারওয়্যার কিনে নেই। যেহেতু আমি জানি না মাথায় গেঁথে থাকা আন্ডারওয়্যার পুরুষ নাকি নারীর। তাই তিনটি পুরুষ ও চারটি নারীর আন্ডারওয়্যার কিনি। যদিও আন্ডারওয়্যারের লৈঙ্গিক আইডিন্টিটি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে বিহ্বল করে রাখে। বাড়তি কোন চিহ্ন না থাকার পরও মানুষ জানে কোনটি পুরুষ এবং কোনটি নারীর আন্ডারওয়্যার। যদিও আপনি ঝুম বৃষ্টিতে যাত্রী ছাউনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্যপাশে কোন বাড়ির ব্যালকনিতে ঝুলানো আন্ডারওয়্যারের লিঙ্গ বুঝতে পারবেন না। আর সেই বুঝতে না পারাই কিন্তু আপনাকে ঠেলে দিতে পারে ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটের দিকে। কোন কারণ ছাড়াই জীবন ও জগতের সমস্ত দার্শনিক সমস্যা আপনার সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করবে। এবং আপনি বাসায় ফিরবেন সাতটি হলুদ আন্ডারওয়্যার এবং জ্বর নিয়ে । যা কেবলই আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে।

ঘরে ফিরে একে একে সাতটা আন্ডারওয়ারের প্রত্যেকটি পরে দেখি। প্রতিটি আন্ডারওয়্যার দেখতে একই রকম। যদিও তাদের লিঙ্গ ভিন্ন। তিনটি পুরুষ ও চারটি নারীর আন্ডারওয়্যার। প্রতিটি আন্ডারওয়্যারের গল্পও আলাদা। তাহলে আমরা দেখছি, একই রকম দেখতে সাতটি আন্ডারওয়্যার দুটি লিঙ্গে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের লিঙ্গ ভাগ করার বিষয়ে তাদের নিজেদের কোন হাত নেই। এটা পুরোপুরিভাবেই আমার আরোপ করা।

ঘরে ফিরে একে একে সাতটা আন্ডারওয়ারের প্রত্যেকটি পরে দেখি। প্রতিটি আন্ডারওয়্যার দেখতে একই রকম। যদিও তাদের লিঙ্গ ভিন্ন। তিনটি পুরুষ ও চারটি নারীর আন্ডারওয়্যার। প্রতিটি আন্ডারওয়্যারের গল্পও আলাদা। তাহলে আমরা দেখছি, একই রকম দেখতে সাতটি আন্ডারওয়্যার দুটি লিঙ্গে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের লিঙ্গ ভাগ করার বিষয়ে তাদের নিজেদের কোন হাত নেই। এটা পুরোপুরিভাবেই আমার আরোপ করা। আমি চাইলে তাদেরকে হয় নারী কিংবা পুরুষ যেকোন একটি ধরে নিতে পারি। আবার চাইলে কোন লিঙ্গ নির্ধারণ নাও করতে পারি। সেক্ষেত্রে আমার সম্পর্কে আপনারা কিছু বিষয় পূর্বানুমান করে নিতে পারেন। যাই হোক, আমি আপাতত আন্ডারওয়্যারগুলোকে তারা যেমন (প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী) তেমনই ধরে নিচ্ছি। অর্থ্যাৎ তিনটি পুরুষ ও চারটি নারী। কিন্তু যেহেতু কথক হিসেবে আমাকে আপনারা পুরুষ ধরে নিচ্ছেন (তাছাড়া আমি পুরুষের মতো জামা পরি, আমার একটি পুরুষাঙ্গ আছে এবং জাতীয় পরিচয় পত্রসহ যাবতীয় দলিলে আমাকে পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে)। তাই আমি চাইলেও এই মুহূর্তে আমার ‘পুরুষ’ পরিচয়কে লুকাতে পারছি না। তাইলে আমি যদি নারীদের আন্ডারওয়্যার পরি সেক্ষেত্রে আপনারা সেই আন্ডারওয়্যারটিকে নারীর বলেই ধরে নেবেন? অর্থ্যাৎ একটি নারীর আন্ডারওয়্যার পুরুষ পরার পরও কি সেটি নারীদের আন্ডারওয়্যার বলে বিবেচিত হবে? এটুকু ভাবার পর আমার দু:শ্চিন্তা বাড়তে থাকে। কারণ, সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারি আমার কেনা সাতটি আন্ডারওয়্যার ঝুম বৃষ্টিতে যাত্রী ছাউনির বিপরীত পাশে সেই বাড়িটির ব্যালকনিতে ঝুলানো আন্ডারওয়্যারের চেয়ে আলাদা। ১৪ টি আলাদা আন্ডারওয়্যারের চরিত্রও আলাদা এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্বসম্পন্ন। তবে কি আমি এতক্ষণ কেবল নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম? এসব যখন ভাবছিলাম তখন আমি চার রাস্তার মোড়ে। আরো একটু পর বুঝতে পারলাম আমার পরনে একটি কেবল হলুদ ‘নারী’ আন্ডারওয়্যার ছাড়ার আর কিছুই নেই। যদিও আমার কাছে এই মুহূর্তের এসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেইটি বাড়িটি খুঁজে বের করা। যার বারান্দায় ঝুলছিল সাতটি হলুদ আন্ডারওয়্যার।

আরো কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম বৃষ্টি ও অন্ধকার একসঙ্গে নামছে। মনে হচ্ছে একটু পর হয়তো কেয়ামত শুরু হবে। পৃথিবীর কোথাও এই মুহূর্তে আর কোন জনমানুষ নেই। কোন এক মহামারীতে সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। এবং এই বৃষ্টিই পৃথিবীর শেষ বৃষ্টি, এর মধ্য দিয়ে পৃথিবী তার লেজ গুটিয়ে নেবে। যদিও আমি নিশ্চিত হতে পারছি না এটা দিন নাকি রাত। কেউ যেন দিন ও রাতের মাঝে সুক্ষ্ম একটা পর্দদা টেনে দিয়েছে। এমনকি বার টারের হিসেবও মনে নাই। কেবল মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে হাঁটছি, হাঁটা থামালেই একটা গ্রেটার জিরো এসে সব শুষে নেবে। অবশ্য আমিও হাল ছাড়ছি না, পৃথিবীর কোন শক্তিই আর আমাকে থামাতে পারছে না। অন্তত একটি শাদা বাড়ি এবং তার বারান্দায় ঝুলানো সাত-আটটি আন্ডারওয়্যার খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত তো বটেই। তাই হাঁটছি, কেবলই হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে আরো অনেকক্ষণ পর আমার ভুল ভাঙল। বুঝতে পারলাম আশেপাশের ছড়িয়ে চিটিয়ে থাকা দুই-চারজন লোক আমাকে দেখছে। বৃষ্টির কারণে খুব যে দেখা যাচ্ছে তা না। কিন্তু বৃষ্টি ভেদ করেও কেবল হলুদ আন্ডারওয়্যার পরা একজন মানুষকে দেখা কঠিন কিছু না। সেই সব চোখে যদিও কোন বিস্ময়, কৌতুক, ঘৃণা বা অন্য কিছু ছিল না। যেন এমন দৃশ্য দেখতে তারা বেশ অভ্যস্ত। হয়তো নিজেরাও কখনো কখনো হলুদ আন্ডারওয়্যার পরে রাস্তায় নেমে পরে। বৃষ্টির বেগ কমে আসতে শুরু করলে আমি প্রথম লক্ষ্য করলাম, একটি শিশু বিস্ময় দৃষ্টি। যদিও তার একটি চোখে ভর করেছিল বিস্ময় এবং অন্য চোখটিতে ছিল বাকিদের মতো নির্লিপ্ততা। তবে কি মানুষের চোথ দুটিও কখনো সমতা বজায় রাখতে পারে না? অবশ্য দেখার ক্ষেত্রে দুটি চোখের কার্যক্ষমতা সাধারণত আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। সেজন্য চমশা ব্যবহারকারীদের অনেকের দুই চোখে আলাদা পাওয়ার থাকে। কিন্তু তাই বলে বিস্ময়, আনন্দ, ঘৃণা বা অন্য যেকোন অনুভূতির প্রকাশে দুটি চোখের কার্যকারীতা কি আলাদা হতে পারে? এই সব প্রশ্ন ও ভাবনার চারপাশে যখন আমি পেন্ডুলামের মতো দুলছিলাম, তখনই বুঝতে পারি হাঁটতে হাঁটতে আমি আসলে নিজের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। তবে আসলেই আমি এতক্ষণ হাঁটছিলাম নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীর আমাকে বলছে আমি হেঁটেছি। নাকি, হাঁটার যে ভাবনা সেটাও বাস্তবে হাঁটার মতো ক্লান্তিকর। এ পর্যায়ে আর ভাবতে মন চাইল না। তখন চোখে পড়ল রাস্তার উল্টোপাশে দোকানদারও আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তার দু চোথেই অবশ্য সমান বিস্ময় দেখা গেল। তাহলে মানুষগুলোও হাঁটার মতো ভাবনার অংশ? নাকি দোকানদার আমার পূর্ব পরিচিত বলে! অথবা সে ভাবছে আমার কাছ থেকে তার পাওনা ৪৭৩ টাকার কথা। নারীদের হলুদ আন্ডারওয়্যার পরা কারো কাছ থেকে আসলেই পাওনা টাকা আদায় করা যায় কিনা সেই প্রশ্নও অবান্তর নয়। পুনরায় ভাবনা থামিয়ে এবং তার সেই বিস্ময় দৃষ্টি এড়িয়ে সিগারেট নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.