মেঘ বৃষ্টির গল্প
জ্যৈষ্ঠের এক দারুণ সূর্যের বেলা জলরোদ ভেঙে প্রকৃতির জন্ম। অথচ প্রকৃতির ধমনী এই বৃষ্টির স্বরে আপন, কারণ সে প্রকৃতি, আর তার ধাইমায়ের নাম তো ভানু।
বিনুনির মতো খুলে খুলে ঢেউজল ঢেউটিন ভেঙে শব্দ করে নামে। মেঘের আওয়াজে সব ইহলোক, পরলোক, পুরাণের আওয়াজ, পৃথিবীর তামাম রোগের ক্ষত, মৃত্যু আহাজারি ঢাকা পড়ে যায়। এমন বর্ষা আনে দক্ষিণ উপকূলের সব নিবিড় আদিম অরণ্য।
কাঠ কেটে নিয়ে-যাওয়া তামাম অরণ্য হাহা করছে। আগুন লাগা বনে বনে ডাকাতের মতো বাঁচার একটা অভিপ্রায় গাছের কালো কোটরে পেঁচার মতো বাসা বাঁধে, আর সেই আশোনা আওয়াজ ধ্যানের মতো শোনায়।
প্রকৃতির মেয়ে মেঘবালিকা মায়ের কড়ে আঙুল ছুঁয়ে শুয়ে থাকে ঢেউটিনের তলায় এই ঘন দুর্যোগে। কড়ে আঙুলের মধ্যে একটা পাখির মতো তাজা ধমনী প্রবাহিত হয়। তাই বেশির ভাগ সময় মেঘবালিকাকে বোঝার জন্য প্রকৃতি মায়ের কথা লাগে না।
এই মেঘবালিকাকে সে বৃষ্টির ঠান্ডা ঠান্ডা জল আঁজলা ভরে দেয়, দেয় কচি শালপাতায় গরম খিচুড়ি, তারপর তাকে গান শেখায়। গানের সময় প্রকৃতির অন্য কোনো হুঁশ থাকে না। বেলা চড়ে যায়। সারি সারি পিঁপড়েরা কাজে যায় মাথায় নিয়ে বোঝা। পাখিরা এ গাছ সে গাছ ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে। পতঙ্গদের মালগাড়ি চলে।
আর মেঘবালিকা অরণ্য থেকে আনা একটা পুরনো, সূর্যের আলোয় শুকানো খাতা থেকে সুর শেখে। আর মা মনসার পুরান। মনসা ছিল এক ডানপিটে মেয়ে যে প্রাণীকুল আগলাত। পুরান তো গল্পই। হয়ত একদিন গ্রেটা থুনবার্গ মা মনসা হয়ে যাবে। কে বলতে পারে। কে যেন এ রকম একটা কথা বলেছিল। বোধহয়, লেখক অমিতাভ ঘোষ।
বহুদিনের লক আপে প্রকৃতি আর মেঘবালিকার কাপড় ছেঁড়া আর মলিন হয়ে গেছে। চুলে তেল নেই। কিন্তু শ্বাস আছে। শ্বাস আছে বলে এই বিনুনির মতো খুলে খুলে ছড়িয়ে যাওয়া ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও প্রকৃতি মোমবাতি না জ্বালিয়ে গানই করে। কোনো কোনো দিন সেই গান শুনে একটা দুটো জোনাকি এসে দরদ করে আলোও দেয়।
তারপর একদিন রাজ্যে রাজ্যে ঢেঁড়া পড়ে যায়। এবারের কালাজ্বর, তারপর মারী ও মড়কের প্রভাব কাটাতে কেন্দ্র থেকে বর্ষামঙ্গল পালন করা হবে। আরো সুন্দরী গাছ, আরো মেহোগনি আরো শাল আরো তাল, গাব, গজালের চারা লাগবে। বর্ষামঙ্গলের অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য চাই গল্প, শ্লোক, এইসব।
দেশে লেখার আকাল নেই, তাই উল্কাপাতের মতো সব লেখা বাদামী পারসেলে ভরে অনর্গল হরকরার বস্তা করে সাইকেলে চেপে পিছল বাদলা পথে পাঠানো হতে থাকে।
প্রকৃতি দুই কলম লিখত। প্রকৃতির ধাইমা ভানুর কাছে তার অক্ষর পরিচয়। আর ভানুমা পা লম্বা করে হাঁটুর ওপর ফেলে শিশু প্রকৃতিকে ঘুম পাড়াত সুরে সুরে পুরাণের ছড়া কেটে। সেই করেই তো প্রকৃতি গান শিখল।
প্রকৃতি জানে মৃত্যুর কাছাকাছি বসবাস করতে করতে মানুষের কৃশ ছায়াও বহুগুণে ভারী লাগে। মানুষের মুখ এখন অচেনা লাগে মাঝেমধ্যে, আর রাস্তাঘাটের তার কেটে ফেলেছে বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সে লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বলে, আমিও চাই পাখি হতে। পায়ের ভার অনুভব করতে করতে প্রকৃতি ঘুমিয়ে পড়ে।
ভানু মা বলল, বর্ষামঙ্গলে অরণ্যে যে ফুল হবে সেই ফুল ছড়িয়ে যাবে আকাশের গায়ে। তাহলে আকাশ ধূসর হবে না। সেই গাছের ফলবীজ ঝরে যাবে সব বন্যায় তাহলে বন্যা সরে গেলে নদীর চরে সবুজ পলি পড়ে যাবে। তুই লেখ। প্রকৃতি লিখল। তারপর সেই হাতে লেখা গল্প পাঠিয়ে দিল অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের কাছে। কিন্তু প্রকৃতি যে শহরে থাকে সে তো মারীর শহর, এখন সেখানে মন্বন্তর আর সেই সব কারণে রাস্তাঘাটে কারো জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। ভানু মায়ের মনে ছিল না, আর প্রকৃতির জানা ছিল না, এই মড়ক শহরে লকডাউনের মধ্যে কুরিয়ার সার্ভিসে এখন অনেক অনিয়ম। তাই প্রকৃতির গল্প পৌঁছতে কয়েক মাস কয়েক মাস লেগে যায়। এর মধ্যে পথে পথে গল্পের গায়ে বাষ্প, কাদা আর লালা জমে ওঠে। অথচ বর্ষামঙ্গলের গল্প হতে হবে সুন্দরী গাছের মতো চিরন্তন, সতেজ, যেন একলব্য ধ্যান। কিন্তু তাই কি হয়? গল্পের গায়ে মুদ্রিত অক্ষর সব জৌলুস হারায়, মাঠে মাঠে হাহা করে মন্বন্তর। বৃষ্টির শিশির-মাটি গন্ধ কোথায় পালায় কে জানে।
বর্ষায় প্রকৃতি ভানুমা আর মেঘবালিকাকে সঙ্গে নিয়ে মাটি খুঁড়ে নিজেরাই ঘরের আঙিনায় শালের চারা লাগায়। তাদের কনুই আর নখ মাটিতে কালো হয়ে যায়। তারপর গাছের গোড়ায় তারা দেয় কোঁচড় ভরে জল। যে জল খেলে তরু বাঁচে, মানুষ বাঁচে, আকাশ বাঁচে, পাখি বাঁচে। সেই জল এনে তারা ঝারি ভরে দেয়। তারপর গান গায়। ছড়া কাটে। ভানু মা চশমার মধ্যে দিয়ে চার চোখে তাকিয়ে থাকে। ওদের গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে। তারপর শালিখ পাখির মতো ধূসর ডানা ঝেড়ে ঝড়ের মেঘে যেন হারিয়ে যায়।
মেঘবালিকা রাতে শুয়ে শুয়ে বলে, মাকে বলে, বনবিবির কাছে সে চেয়ে নেবে একটা উপহার।
কী রে?
মা, আমি উড়তে চাই।
প্রকৃতি চুপ করে থাকে। ছোটবেলা থেকে মেঘবালিকা দাঁতপরীতে বিশ্বাস করে। বনবিবিকে বিশ্বাস করে।
মেঘবালিকা আবার বলে, মা আরেকটা বর হলেও হবে। গুপীবাঘার জুতো। যেখানে খুশি হারিয়ে যেতে পারব।
প্রকৃতি মেঘবালিকাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। বলে, কোথায় যেতে চাস? আমাকে সঙ্গে নিবি?
মেঘবালিকা বলে, তুমি গুপী আর আমি বাঘা হলে তো আমাদের একসঙ্গে তালি মেরে হারিয়ে যেতে হবে।
আর একা পাখি হলে? উড়ে যাবি?
আমার কোথাও যাবার নেই। আমি শুধু উড়তেই চাই, মা।
প্রকৃতি জানে মৃত্যুর কাছাকাছি বসবাস করতে করতে মানুষের কৃশ ছায়াও বহুগুণে ভারী লাগে। মানুষের মুখ এখন অচেনা লাগে মাঝেমধ্যে, আর রাস্তাঘাটের তার কেটে ফেলেছে বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সে লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বলে, আমিও চাই পাখি হতে। পায়ের ভার অনুভব করতে করতে প্রকৃতি ঘুমিয়ে পড়ে।
দুই জন কড়ে আঙুল ছুঁয়ে থাকলে বাতাসে ঘর যেন কাঁপতে থাকে। কলকল জল আর হাওয়ার তাণ্ডবে দুইজন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে তারা পাখি হয়ে গেছে, ডানার নিচে ভর করেছে বেগবান বাতাস, আর ওরা ভাসতে ভাসতে ঝড়ের কোলে হারিয়ে যাচ্ছে, আর ঝড় তাদের চোখে জ্বেলে দিচ্ছে অচেনা বিজলির আলো।