

সেলিম মোরশেদের সূত্রমুখ
কাগুজে-বিদ্যার তকমা নিয়ে, খানিকটা লম্বা সময় পর্যন্ত রাজধানী-শহরে জীবিকা-অনুসন্ধানের উদ্বোধনকালে, তখন ১৯৮৬ এর শেষ-শেষ – দেখা হচ্ছে সেলিম মোরশেদ-এর সঙ্গে। ষাটের পুরনো ঢাকা-বিউটি বোর্ডিং-নিউমার্কেট ছড়িয়ে তখন সাহিত্যের ক্লাশ-সাহিত্যের তর্ক-যুদ্ধ চলছে শাহবাগে; এর তাপ, এর উজ্জ্বলতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, পিজি হাসপাতালের বটতলা, পিজি হাসপাতালের সামনের রাস্তা, হাসপাতালের আঁধার-আঁধার দেয়াল সিঁড়ি হয়ে, আলোকিত মানুষ তৈরির স্বপ্নে বিভোর অন্য এক শিল্প-শিল্প ঘরবাড়ির বারান্দা পর্যন্ত ততদিনে ছড়িয়ে গেছে। কবুল করি – আমার অর্বাচীনতা, আমার ব্যক্তিত্বহীনতা, বন্ধুত্ব গড়ার ব্যর্থতা, আমার মূর্খতা, যূথবদ্ধ হওয়ার অক্ষমতা, ঢাকাই-কালচার ইন্ডাস্ট্রির সেই উজ্জ্বল-ঝলমলে রাস্তায় হাঁটার অনুমতি তক্ষণি যোগাড় করতে পারেনি। তবে সেলিম মোরশেদ’এর সুহৃদবৃন্দ, সেলিম মোরশেদের অফিসিয়াল বন্ধুবর্গ, এবং ওঁর ভাবনালোকের যারা আমৃত্যু-আজীবন কমরেড – ওঁরা হঠাৎ রাস্তায় থামিয়ে কখনও বাক্যবিনিময় করেছেন, চায়ের নেমন্তন্ন দিয়েছেন অথবা তাঁদের ওষুধপত্রের বানান ঠিক করার সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছেন; সেই সুবাদে সেলিমকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিপুল সেই জ্যোতির্ময় বিদ্বৎ সমাজের সাথে সেলিমের অনুপস্থিতিতেই অনেকখানি পথ একসাথে হেঁটেছিলাম; বলতে কী, এই নিরীহ-গৌরব-আনন্দ জীবনের এই মধ্যপ্রান্তে পৌঁছে এখনো অনুভব করি মাঝে-মধ্যে। গৌরব হয় আরেকটি কারণে – সেলিম মোরশেদ, ওঁর ‘কাউন্টার ক্রিয়েটিভ অ্যাকটিভিটিজ’ এর অংশ হিসেবে যে কাগজগুলোর অনুমোদন দিয়েছেন, ওঁরা কখনও দয়া করে, মায়া করে, নাকি হঠাৎ-বিভ্রমে কখনও ওঁদের সুমহান কাগজে লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন! আমার দরিদ্র মন, অপুষ্ট মন ওই গোপন-নিশ্চিহ্ন হওয়া প্রশ্রয়-পর্ব নিয়ে এতকাল পরেও অনেকখানি নৈকট্য অনুভব করে, দ্রবীভূত হয়, এবং অনুভব করতে শেখে জয়েসের আর্টিস্টের মত – আত্মা আসলে একখণ্ড বালতি ভর্তি টলমল জলের ধারা!
সেলিমের যশোর শহরে আমার যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা হয় ১৯৭৩ সালের কোনো এক শীত-সকালে। নতুন ভর্তি হওয়া বোর্ডিং স্কুলের দাবি ছিল এক জোড়া ব্রাউন কেডস। আমার আবাল্যের শহর তন্ন তন্ন করে ব্রাউন কেডস না পেয়ে, হাজির হয়েছিলাম যশোর দড়াটানা রোডে, নিকট আত্মীয়ের এক পিকআপের পেছনে চেপে। আসলে পিতৃহীন এই কিশোর ভয়ে-সঙ্কোচে-লজ্জায়, হঠাৎ মোশান-সিকনেস’ এর ঘূর্ণনে সেদিন লাগাতার বমি করে সরকারি গাড়ির শরীর সৌন্দর্যহীন করে। এরপর নানান অজুহাতে সেলিমের শহরে গিয়েছি বটে, কিন্তু আমার অনন্তকালের নিঃসঙ্গতা, বন্ধুহীনতা, আত্মীয়হীনতা, সাহিত্যের স্বাদ-গন্ধ আদান-প্রদানের অজুহাতে কখনও আমার ফিরে আসা, কিম্বা আমার ঘরমুখো হওয়ার নিরুপায় আয়োজনকে ভালবাসায়-অবজ্ঞায় নস্যাৎ করে না, স্থগিত করেনা; ফলে আমি দাঁড়িয়ে যাই, চিরকালের নো-ম্যানস আইল্যান্ডে।
খুব শক্ত করে, স্পষ্ট ভাষায় নিজের ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা, দ্রোহের কথা সবাই প্রকাশ করতে পারেন না; লেখা একটি ‘কাজ’ – মানিক বাড়ুয্যের ওই শপথ বাক্য, সেলিম আমাদের সময়ে উচ্চারণ করেছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার হয়ে, সবচেয়ে বেপরোয়া হয়ে।
সেলিম মোরশেদকে দেখার সুযোগ হয় এই সঙ্গহীন-নিঃসঙ্গতার পরিসর থেকে। ওঁর প্রপিতামহ মৌলভী আফতারোদ্দীন, ওঁর মনস্বী বন্ধুবর্গ, ওঁর কবিতা-গান, ওঁর নিজের চিত্রকলা, পুত্রের মৃত্যু, ওঁর বিবিধ পেশা বদল, ওঁর বিপদজনক মারামারি, ওঁর অ্যান্টি-স্টোরি, ওঁর ইফোর্ট, ওঁর ব্যক্তিগত ইশতেহার, ওঁর কার্ডিয়াক সার্জারি – এ’সব মিলিয়ে আমি ‘পাল্টা ধারার লেখক’ সেলিম মোরশেদ’এর খানিকটা ছাপচিত্র তৈরি করি আমার কাছে। খুব শক্ত করে, স্পষ্ট ভাষায় নিজের ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা, দ্রোহের কথা সবাই প্রকাশ করতে পারেন না; লেখা একটি ‘কাজ’ – মানিক বাড়ুয্যের ওই শপথ বাক্য, সেলিম আমাদের সময়ে উচ্চারণ করেছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার হয়ে, সবচেয়ে বেপরোয়া হয়ে। ওঁর গল্প-উপন্যাস, যা তাঁর কাছে ছিল ‘ইফোর্ট’ – সে-সব আড়াল করে সেলিম মোরশেদের উচ্চারণ থেকে আমি, ওঁর অনুমতি ছাড়াই এবার তৈরি করি, সেলিম মোরশেদের ম্যাক্সিম নামক একটি অনু-গ্রন্থ, যেন বুক পকেটে রেখে ধ্যানমগ্ন হওয়ার জন্য, বিপদ এড়ানোর জন্য, সাহসী হওয়ার জন্য ঘন-ঘন আওড়ানো যায়:
- আমরা ফাইট করছি মিডিয়ার বিরুদ্ধে, গলিত পতিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে নয়
- যারাই সাহিত্য সম্পাদক কোনো-না-কোনোভাবে লেখালেখির জগতে তারা ব্যর্থ
- সাতশত বছরে বাংলা ভাষার ইতিহাসে সুবিমল মিশ্রের মতো এতো ব্যাপক বেপরোয়া এবং গঠনমূলক ভাঙাচোরা আর কেউ করেনি
- আমরা প্রতিটা কম্পিউটার সংস্থা এবং গার্মেন্টস সেক্টর থেকে বিজ্ঞাপন নিতে পারি সম্মিলিতভাবে
- এই যে এক্সপ্লয়টেড হওয়ার সিস্টেম এরই জোটফল নিয়ে স্ট্যাবলিশমেন্ট হয়। এটাই প্রতিষ্ঠান
- মিডিয়া সুকৌশলে নির্ধারণ করে লেখকের সত্তাকে
- অধিকাংশ সাহিত্য সম্পাদক মদ্যপ, নারীসঙ্গলিপ্সু এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকে
- আমাদের শ্রেণীচৈতন্যকে প্রমোট করা যাবতীয় নান্দনিক বিষয়কে ভাঙাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা
- ছোটো কাগজ যৌথ ট্যালেন্ট অর্থাৎ সমান্তরাল মেধা তৈরি করে
- আমি জীবনের দুঃসহ বাস্তবতা এবং অমানবিক মূল্যবোধগুলোকে পাঠকের সামনে ছুঁড়ে দিতে চাই – দেখুক তারা তাদের নিজেদের অবয়ব দেখুক
- আর্ট মানে অবশ্যই আমার কাছে ইফোর্ট
- কখনো যদি সময় আসে ব্রিটিশ এবং নেহেরুর ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ আমাদের নিতে হবে
- মানুষের জন্য চাই উন্মুক্ত কথা বলার অপরিসীম স্বাধীনতা। আর স্বাধীনভাবে কথা বলার জায়গা
- এমনকি সেই সব গ্রামে যেখানে বিদ্যুৎ যায়নি, অচিরেই… তারা হাতে লিখে সেই সব এলাকা থেকে ছোটো কাগজ বের করবে
- বাঁচার একটাই পথ হিট এন্ড হিট
- স্ববিরোধিতার সত্য বোঝা দরকার; সমন্বয়ের সূত্র জানা দরকার।
ওঁর এই প্রবচন গুচ্ছ নিশ্চয় আরো বিস্তৃত করা যায়; কিন্তু সেলিমের প্রস্তাবিত সমন্বয়-সাধনার সব সূত্রাবলী আমার তক্ষুণি শেখা হয় না। যেমনটি ওঁর সলোমন বলছিল একবার – ‘… কোন কিছুই যেন দাঁড়াচ্ছে না – বিষয় কিংবা বিষয়বস্তু, আইডিয়া এবং ট্রিটমেন্ট এমনকী চিন্তার সূত্রটাও’। আমার অর্ধশিক্ষিত মন তখন সেলিমকে অবলম্বন করে একখণ্ড ভারতবর্ষ, একখণ্ড বাংলাদেশ, একখণ্ড ইউরোপ ও একখণ্ড মানব-বিশ্ব আবিষ্কারের পথ খুঁজতে নামে। লক্ষ্য করি – সেলিমকে এ-যাত্রা অবলোকনের সুযোগ ওঁর লেখায় বাংলাদেশের হঠাৎ-হঠাৎ কতিপয় সুভদ্র লেখক এবং তার কীর্তিময় লেখার নাম জানা যাচ্ছে। পাঠক্রমের ধারাবাহিকতায় ওঁর পছন্দের চলচ্চিত্রকার, লেখক, গীতিকবি, চিকিৎসক এবং মোল্লা মেডিকেল হল নামক একটি পছন্দের ওষুধঘরও চিহ্নিত করা গেল। ওঁর বইয়ের পৃষ্ঠায় সারি-সারি শ্রেষ্ঠ বন্ধুদের নাম ভেসে আসে জলজ-পুষ্পের মত। আমাদের একবার অনুভব হয় – যশোর মনিরামপুরের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কোন ঘর থেকে গান, মৃত্যু ও কান্না ভেসে আসছে যেন। বাইপাস সার্জারির টেবিলে ঘুম ঘুম নেয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্সের ভেতর কার্তিক লাহিড়ী, মলয় রায়, সলোমন, পিজির বটতলা, কবি শফিউল আজম, সঞ্চয় প্রথম, গরীব শাহ হাসপাতাল, গাণ্ডীব ’এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ, যশোর প্রেস ক্লাব, জুতো কোম্পানী, সুব্রত সেন গুপ্ত, কোচবিহার, আনন্দজ্যোতি মজুমদার, কোলকাতা বইমেলা, … বোবা যুদ্ধের টেবিল, দীপেন্দ্রনাথ, দেশভাগ, হাবিব ওয়াহিদ, সিসিএ (কাউন্টার ক্রিয়েটিভ এ্যাকটিভিটিজ) এবং সুবিমল মিশ্র নামক দূরের একটি বাতিঘর, ওটির ভয়-ভয় আলোর সাথে ইঁদুর-বেড়াল খেলা করতে-করতে তখন সেলিম মোরশেদের শরীর এবং বুক স্থির-অবশ করে ফেলেছে। সেলিম বুক জুড়ে হৃৎপিণ্ডের কাটা চিহ্ন নিয়ে, কাটা সাপের মুণ্ডু এবং রক্তের চিহ্নসমূহ দেখায়। পাসোলিনির জিগপেন ছবির নায়ক যেমন মাংস খাওয়ার আনন্দ ব্যক্ত করেছিল, (I killed my father, I have eaten human flesh and I tremble with joy), সেলিমের হেমাঙ্গিনী শঙ্খচূড় সাপের শরীর পুড়িয়ে পেট পুরে খেয়ে সেই আনন্দের একটি অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করে অনুবাদ গ্রন্থের কোথাও একজন সখিচান মৃত্যুদূত হয়ে বাঁশিতে সুর তোলে! আমরা আউলচাঁদ নামক অবতারের সন্ধান পাই, শবদেহের নিচে কাঠ সাজিয়ে মুখাগ্নির আয়োজন চলছে, সন্ধ্যার শেষ আলোয় সদ্য মৃত-আত্মার স্মারক হিসেবে টুইনচা উড়ে যাওয়ার শব্দ হয়। কোথাও শহরময় হায় হাসান হায় হাসান বলে বুকে ছুরি চালিয়েছে কেউ, বাক্রুদ্ধ জোনাকিরা সশব্দ। মাথা এবং লেজসুদ্ধ পুরো সাপটা হেমাঙ্গিনী যেন দেখতে পাচ্ছে। আমরা দেখছি বিশুর ইন্টারোগেশন এবং টর্চার সেল। আমরা ভ্রাম্যমাণ-লিফলেট টুটুলকে দেখতে পাই হোসেন ডাক্তারের সাথে – ‘খুব শক্তি হওয়ার কোনো ওষুধ আছে ডাক্তার?’ ডাক্তার ওষুধের নাম বলে, অথবা কথা বলে তেতাল্লিশের মন্বন্তর, উপনিবেশিক মন, ঢোঁড়া সাপ, কাজলরেখা ও মৃগনাভী নিয়ে। আমরা কথা বলি রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রী প্রধানদের ব্যক্তিগত জীবন, রূপ-লাবণ্য এবং শৌর্যবীর্য নিয়ে। মদ হাতে বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে আমাদের সুবিখ্যাত মোহাম্মদ আমীর খসরু সেদিন চলচ্চিত্র এবং চরক সংহিতা নিয়ে আলোচনা করে। আমাদের কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায় এবং কতিপয় অর্ধমানুষের জীবনযাপন নিয়ে কথা বলতে-বলতে বমি করে। আমাদের সামনে ‘ট্রিপল এক্স’ আসে। পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একজন যুবককে দেখে আমরা সামান্য সময় থমকে দাঁড়াই। আমরা ভীত হই, সতর্ক হই এবং অভিযোগের গলায় কারোর নাম দেই ‘সেমো’। আমরা সুব্রত’র যৌনজীবন এবং মায়ের শরীর নিয়ে ওর কৌতূহল বিষয়ে দু’একটি এ্যানেকডোটস মনে রাখার চেষ্টা করি, অথবা আত্মহত্যার স্বরূপ নিয়ে ওর সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত মৃদু তর্ক ছাড়াই …। আমরা সোশাল ড্রামা শিখি, কালচার শিখি, ভায়োলেন্স শিখি, ভয়ারিজম শিখি এবং ছিটে রুটির সঙ্গে মুরগির মাংস খাওয়ার দারুণ আনন্দদায়ক অভ্যাস চর্চা করি লাগাতার। আমাদের বন্ধুদের কেউ আবার এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি করে এবং ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’এর বইটি বিক্রির সময় ঝাউগাছে প্রজাপতির অনুরণন দেখে সামান্য সময় অন্যমনস্ক হয়। আমাদের মায়েদের কেউ বাবাকে রেললাইন থেকে ধরে এনে হাউমাউ কাঁদছিল। আমরা দেখছিলাম ওয়্যারলেস স্টেশনের আলোক বিন্দুমালা, দেখছিলাম ঝকঝকে তারকাপুঞ্জ, দেখছিলাম মিউনিসিপ্যালিটির সরু রাস্তা, উপচেপড়া চন্দ্রমল্লিকা, শিলার সবুজ ওড়না এবং রিজিয়া সুলতানার মানসিক অসুস্থতা। আমরা পলায়ন করে, শ’খানেক ব্যাঙ ধরে মন্দিরের বারান্দায় বিশ্রামের আয়োজন নিই, আর হাঁপানি বন্ধের জন্য বাদুরের মাংস খাই আরাম করে। আমাদের বন্ধু সেমো’র হাতে তখন কলকাতা বুক ফেয়ারে দেখা ট্রান্স-সেক্সুয়াল সুদেষ্ণার বৃশ্চিক রাশি সম্পর্কিত ভূত-ভবিষ্যতের বই, দেশব্রতী পত্রিকা চারু মজুমদার, এবং শর্মী পান্ডে’র দেয়া একখণ্ড চকবার। সেমো সলোমনের মত কাউকে ডেকে, সুরেন্দ্রনাথ রোডের মাঝামাঝি কোন এক ভয়-ভয় মৃত-গলিতে বহুরাত পর্যন্ত এক গোপন নিষিদ্ধ-দুর্বিনীত সাপলুডু খেলায় নিমজ্জিত হয়।

অনুমান হয় – এই খেলার অন্যতম সহযোগী সেলিম মোরশেদ এবার সত্যি-সত্যিই হৃদযন্ত্রের মাংসপেশীতে সেভেন্থ সিল’এর মৃত্যুদূতের মত কাউকে আঁচ করতে পারেন। সেলিম স্থির প্রতিজ্ঞ হন – ‘… আসলে তপ্ত বালির ভেতর দিয়েই তাঁকে হাঁটতে হবে। অত্যন্ত সাবধানী এবং সতর্ক হতে হবে, চরম পিপাসিত মুহূর্তেও এমন কারো কাছ থেকে পানি চাওয়া যাবে না যে পরবর্তী সময়ে এর সুযোগটা নেবে। … শতকরা ৯৯% সম্ভাবনা রয়েছে মৃত্যুর। কোনো প্রাপ্তি নেই। কোনো প্রত্যাশা নেই। ভবিষ্যৎ ভাবার সময় কোথায়, তবে স্বপ্ন আছে। যদি কেউ বেঁচে যায়, তাঁর একটাই স্বপ্ন! ছোটো স্বপ্ন! একটা নিজস্ব বাথান। একটা যৌথ খামার। এটা সে গড়বে বলেই পুরো জীবনটা বাজি রেখেছে’।
সেলিমের ‘যৌথ খামার’ গড়ার স্বপ্ন ‘স্বাধীনভাবে কথা বলা’র প্রতিজ্ঞা – এই দুই অনুষঙ্গ’এর সম্ভাবনা, নৈকট্য ও বৈপরীত্য নিয়ে এখন বিস্তর আলোচনা সম্ভব। আলোচনা সম্ভব মিডিয়া-সন্ত্রাস, মাইগ্রেশন, ডেভেলপমেন্ট রিফিউজি নিয়ে; আলোচনা সম্ভব মেনিফেস্টো, নাগরিক জীবন, যৌনতা, নারীবন্ধু, কমিটমেন্ট এবং ইমেজের রিপ্রেজেন্টশন নিয়ে। আলোচনা সম্ভব দেশভাগের দ্রোহ-ক্ষয় এবং রক্তপাত নিয়ে; কথা বলা যায় এ্যানার্কির রকমফের নিয়ে এবং বহুকাল আগে তৈরি হওয়া অথবা ক্ষয় হয়ে যাওয়া আন্তঃধর্মের সহনশীলতার রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে। লক্ষ করি – হাইপার-ক্যাপিটালিজম’এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমাদের প্রতি মুহূর্তে সেলিমের মত শরীর-মন এবং আত্মা ধ্বস্ত করে রেখেছে। দেখি টলস্টয় সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিত্যাগ করার প্রস্তাবনা রেখেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়ই – “The modern state is nothing but a conspiracy to exploit; but most of all to demoralize it’s citizens … Henceforth I shall never serve any government anywhere.”
কে না জানে, আমার দুর্বল-মন রাষ্ট্রের এই খোলনলচে, রাষ্ট্রের এত সব ঘরবাড়ি, রাষ্ট্রের এতসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যাখান করার তীব্র প্রতিজ্ঞা-সাহস নিশ্চয় রক্ষা করতে পারেনি! সেলিমের উজ্জ্বলতা, সেলিমের প্রতিজ্ঞা, সেলিমের বীক্ষা এবং তাঁর প্রতিজ্ঞারক্ষার অন্তর্গত ধ্যান ও সীমাহীন রক্তপাত নিয়ে আমার বলাবলি, তাই অনেকখানি অস্পষ্ট এবং ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। হয়ত এই বিপুল-তীব্র বিপন্নতা এড়ানোর জন্যই একদিন ‘লেখা’ নামক এক রক্ত-মোক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছিল। লেখা ‘জীবনের ব্যাখ্যা’ – এই কথাটি একবার ভেবে আবার স্থির হই, লেখা অন্য এক অফুরন্ত শক্তির আঁধারও বটে। লিখতে লিখতে যে প্রাণশক্তি আসে তা কখনও শুশ্রূষার মতো জেগে থাকে শিয়রে। যৎসামান্য লেখাপড়ার মনোরম-অসুস্থতার পাঁকে ডুবে যেতে-যেতে একদিন বুঝতে পারি – নিজের দেখাটা আসলে সবটুকু নয়, মিথ্যা-গৌরব এড়াতে, অথবা আজন্মের অস্বচ্ছতা এবং ক্ষীণ দৃষ্টির ভয়, হীনমন্যতা এবং অপমান এড়াতে এবার সেলিমের চোখে নিজের চোখ প্রতিস্থাপন করি। বুঝতে পারি, নিজের বলাটা, অনুভব করাটা সবটুকু নয় – এজন্য ডুবন্ত মানুষের খড়-কুটো আঁকড়ে ধরার মত, জগতের অগুনতি মানুষের কাছে যাই, আর ‘একক’ আমি হয়ে উঠি লক্ষ-কোটি মানুষ। তারপর লক্ষ-কোটি মানুষের সেই চোখ জমাট হয়ে তৈরি হয় আমার নিজের এক জোড়া চশমা। দেখা গেল চক্ষুষ্মান সেলিম চেনা পথে না হেঁটে বহুদিন আগে অন্য এক অচীন-অনভ্যস্ত পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, তাঁর অবলোকনের উপায়-পদ্ধতি খুঁজতে-খুঁজতে – ‘… আই এ্যাম দি কিং অব অল আই সার্ভে!’ নিজের রক্তপাতের ব্যাকরণ এপিটাফে লেখার মত, তেজস্বী-বীরের মত, আমাদের নবী হযরত জাকারিয়ার মত সেলিম তাই অগ্রিম লিখে ফেলেন: ‘… করাতের দাঁতগুলো লক্ষ্য করি! নৈঃসঙ্গেয়র দু’ধারী করাত। … আমি পাটাতনের উপর করাতের দিকে মাথাটা রেখে উপুড় হয়ে সেজদার ভঙ্গিতে এগোতে থাকি। তারপর আস্তে আস্ত্বে নিজেকে ঠেলি – … কপালের মাঝ বরাবর সিঁথির ভেতর দিয়ে করাতটি স্পর্শ করে ঢুকেছে। … মাঝামাঝি চেরাই হতে চলছি আমি। আমার কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে গিয়ে লোকজনের গায়ের গেঞ্জিতে লেগেছে। … কিছুক্ষণের ভেতর শরীরটার মাঝামাঝি ভাগ হয়ে আমি দু’টুকরো হবো। … দু’ভাগ হতে হবে তবুও ভাবছি – নিজেকে বিস্তৃতির অতলে ফেলতে পারিনি’।…
এই আক্ষেপ, এই যাতনা, এই অতৃপ্তি-ই হয়ত আরও বহুদিন তাঁকে সজাগ রাখে, চেনা-অচেনার গোলকধাঁধায় আটক করে, বৃহৎ করে, বিস্তৃত করে, অপার করে, অতলস্পর্শী করে, আর হঠাৎই তাঁর মনে হয় সোমেন চন্দের ‘… মৃত্যুটা এখনো আদর্শ হতে পারে’। মৃত্যু উদযাপনের এই জ্যোতির্বলয়ে হাঁটতে-হাঁটতে এবার খানিকটা সাহস জমা হয় দুর্বল-ভীরু পায়ে; অনুভব করি – মৃত্যুর এই তীব্র সৌন্দর্য, একদা পিজি হাসপাতালের অক্ষয়বট ছুঁয়ে আরব বসন্তের সুঘ্রাণ তুলতে-তুলতে ওয়ালস্ট্রিট হয়ে সেলিমের প্রিয় শাহবাগ চত্বরে, ধরা যাক নতুন এক ‘কাউন্টার ক্রিয়েটিভ এ্যাকটিভিটিজ’এর উদ্বোধন ঘটিয়েছে, যার শুরু ২০১৩ ‘এর এক বিস্ময়কর-বসন্তে। সেই গোপন-অতল আগুনের বিস্তার দেখার জন্য, বসন্ত-ঋণের জন্য, আমরা এবার স্থির হই, অপেক্ষা করি।
[লেখাটি ‘অনিন্দ্য’ সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদের সৌজন্যে প্রাপ্ত।]