:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
হামীম কামরুল হক

কথাসাহিত্যিক

আন্দাজি কথা (পর্ব-১)
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

আন্দাজি কথা (পর্ব-১)

১.
নারীরা নিজেরাই আর্ট, তাদের সচরাচর হৃদয় অর্জন করতে হয় না। কিন্তু পুরুষের হৃদয়টাকে গড়েপিটে তৈরি করতে হয়, অর্জন করতে হয় — এজন্যই কি Heart- কথাটা। ‘আর্ট’ যুক্ত ‘হি’-ই হল হার্ট।

 

২.
অনেকেই মনে করেন, কবিতা-গল্প-উপন্যাস না পড়লে যে খুব ক্ষতি তা নয়। এসব না পড়লে মানুষ মূর্খ হয় না, কিন্তু তার মানবিকতা লোপ পায়, কারণ তাতে শান দেওয়া হয় না, ফলে তা ভোঁতা হয়ে যেতে থাকে। একসময় সে তা হারাতে থাকে, আর যে মানবিকতা হারায় সে আর মানুষ থাকে কি? সে জ্ঞানী হোক, গুণী হোক, সে মূর্খ ছাড়া আর কী! আসলে পরিণত হয় ইতরে। আমাদের সমাজে শিক্ষিত ইতরের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। এরাই নানান প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে ইতরতাকে মহামারীর রূপ দিয়েছে।

 

৩.
জ্ঞানী হওয়া যায়, জ্ঞান চর্চা করলে, কিন্তু প্রজ্ঞাবান কী করে হওয়া যায়? জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তির কাছ থেকে একটা সূত্র পাওয়া গেল। সে অনুযায়ী বোধ করি যে, একজন সৎ মানুষ যদি শিল্প ও জ্ঞানের চর্চা করে তাহলেই তার ভেতরে প্রজ্ঞার জন্ম হতে পারে। কারণ যে জ্ঞানী সৎ নয়, সে জ্ঞানীই নয়, সে শিল্পী সৎ নয় সে শিল্পীই নয়। বলা বাহুল্য এখানে সৎ মানে কিন্তু ‘সাধু’ বোঝাচ্ছে না।

 

৪.
পশ্চিমারা নাকি ভোগ করে একা, কাজ করে সবাই মিলে। তাই, দশে মিশে করে কাজ, হারে জিতে নাই লাজ। আমরা ভোগ করতে চাই একযোগে, সবাই মিলে। কিন্তু কাজ করি একা (কারণ উপায় নাই, সহযোগিতাও নাই; অন্যদিকে অতি সন্ন্যাসীতে এখানে গাজন নষ্ট হয়)। আমাদের বাংলা অভিধানগুলি এর একটা দৃষ্টান্ত। এক হরিচরণের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-ই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে বলেছিলেন, যা দশ জনের কাজ তা আমরা একা করি। আর যা একজনের কাজ তা আমরা সবাই মিলে করি। আমাদের ভালো কাজগুলো একা একাই করতে হয়। অন্যের কথা তো দূরের কথা; পরিবারের লোকরাই সর্বোচ্চ অসহযোগিতা করে – তা-ই রাষ্ট্রীয় আকার পেয়ে গেছে মাত্র। আর ‘পারস্পরিক অসহযোগিতা’ই আমাদের বাংলাদেশের আরেকটা কঠিন বাস্তবতা।

 

৫.
ব্যর্থতা-বেদনা-বিপদে যে পাশে থাকে না, সে বন্ধু নয়। কিন্তু আপনজন হয়েও যে কারো সাফল্য-আনন্দ- সৌভাগে পাশে থাকে না সে কি শত্রু? মনে হয় না। তাকে বলি স্টুপিড। স্টুপিডের আসলে বাংলা হয় না; তারপরও একটা বাংলা করতে হয়— মূঢ়। শব্দটা এমন ভারী যে উচ্চারণ করতেও কষ্ট হয়। বন্ধু মানুষকে হালকা করে, আর মূঢ় ব্যক্তি কারো আপনমানুষ হলে তার ভার বহন করা অত্যন্ত কঠিন।

 

৬.
নদীগুলো হলো পৃথিবীর কান্না, করুণাও। তারাই পৃথিবীকে সজীব রাখতো। এখন মানুষের চোখেও করুণার জল নেই, নদীগুলিও শুকিয়ে যাচ্ছে।… আমাদের চোখগুলোকে নরম করতে হবে। এত শক্ত চোখে আমরা কোনো কিছুই আসলে এখন দেখছি না। শক্ত চোখে অশ্রুপাতও হয় না। হলেও তা প্রেমের নয়, ঈর্ষায়। (মহাভারতের বরাতে বলি: প্রেম যদি বৃক্ষ হয়, করুণা হলো তার শেকড়)।

 

৭.
তারাশঙ্করদের মতো লেখকদের লেখায় সততা ছিল, সরলতা ছিল, মহত্ত্ব ছিল। নির্মাণ-বুদ্ধি, আঙ্গিকের কারিকুরি কারো কারো মতে অতটা ছিল না। তারপরও লেখাগুলো এখনো টিকে আছে। আগামীতেও টিকে থাকার সম্ভবনাই বেশি। কিন্তু দেশি বলি কি বিদেশি, সবখানেই লেখায় নির্মাণ বুদ্ধি ও আঙ্গিকের কারিকুরি অনেক, কিন্তু আগের সেই গুণগুলির দেখা প্রায় পাওয়া যায় না। কাম্যুর সময়ই কাম্যু তারচেয়েও অত্যাধুনিক লেখকদের লেখা নিয়ে বলতে চেয়েছেন: যদি মলিয়ের-তলস্তয়ের লেখাকে লেখা বলি, তো এসবের সঙ্গে তার কত দূরত্ব—সেটা মাপা যায় না। তাদেরগুলি লেখা হলে, এগুলো লেখা নয়; আর যদি এগুলো লেখা হয়, তাহলে তাদেরগুলি লেখা নয়।

 

৮.
মাঝে মাঝে ধন্দ লাগে— মানুষ কি দয়া করে ভালোবাসে, নাকি ভালোবেসে দয়া করে। (আবারও স্মরণীয় আন্দাজি কথা-৬: প্রেম যদি বৃক্ষ হয়, করুণা হল তার শেকড়)। এই দয়া/করুণা কিন্তু ‘মার্সি’ নয়, সিম্পাথি-অ্যাম্পাথি মিলিয়ে কিছু একটা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা মিলিয়ে কিছু একটা। কথাটা শুনে একজন নারী সহকর্মী বলেন, মানুষ দয়া করেই ভালোবাসে। আসলেই কি তাই? ধন্দ কাটে না।

 

৯.
দয়া মমতা প্রেম— জীবন থেকে সরে গেলে, সাহিত্য থেকেও সরে যায়। তা-ই গেছে। বাংলাদেশের ‘অতিসৃজনশীল’ এবং বিরলপ্রজ (যারা নাকি তেমন লেখা মনে জেগে না উঠলে লিখতেই চান না) সাহিত্যিকেরা প্রেমের গল্পকে ক্যাতক্যাতে, জলো বলে মনে করেন, আসলে তারা তাদের অক্ষমতা আড়াল করার জন্য এসব বলেন। মার্কেসের মতো লেখকের লেখায় প্রেম কতটা এসেছে, তা বলা বাহুল্য। আর এখন তো জীবনে ও সাহিত্যে সর্বত্র চালাকিই বড় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বুদ্ধিমান কেউ কেউ ভালোবাসায়, মমতায়, দয়ায়, ক্ষমায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাদেরও লোকে ধূর্ত বলে ভুল করে।

 

১০.
রাজা থাকলে, বিদূষক থাকবে। এখন কেউ-ই নেই। এখন সবাই ভৃত্য, মানসিকভাবে। ভৃত্যের কোনো বিদূষকের দরকার নয় না, তার দরকার মোসাহেব।

 

১১.
সুখ সভ্যতা আনে, আর সভ্যতা আনে সংস্কৃতি। আমরা সুখের নির্মাণই ঘটাতে পারিনি। বিষয়টি কী তা-ই তো জানি না। বার্ট্রান্ড রাসেলের বই ‘দ্য কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’-এর অনুসরণে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সুখ’ বইটা থেকে এর আকার-প্রকার-প্রকৃতিটা জেনে নেওয়ার প্রয়াস কজন করে। আর বই থেকে তো সুখের ধারণা ও প্রেরণা পাওয়া যায় না, যদি না আমাদের জীবনবোধের ভেতরে তা না থাকে। মজার ব্যাপার হলো ‘জীবনবোধ’ ব্যাপারটাই বা কজন বোধ করে। তাহলে আমাদের কোথায় হবে সুখ, কীভাবে নির্মিত হবে সভ্যতা আর আমরা পাবো সংস্কৃতি?

 

১২.
একটা লোক তখনই সুখী ও সহী হতে পারে, যদি তার মনে ও চর্চায় থাকে : ‘আমার কিছু লাগবে না।’ আমরা সবাই কমবেশি এটা বুঝি, কিন্তু কজন সেটা মানি? যা মানা হয় না, তাতে এসব জানা বা না-জানায় কোনো তফাৎ থাকে না।

 

১৩.
বলা বাহুল্য পশ্চিমাদের সঙ্গে আচরণগত অনেক তফাৎ আমাদের আছে। (প্রমথ চৌধুরীর ‘আমরা ও তোমরা’র কথা কি মনে পড়ে?) সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্রে এর একটি মনে হয় প্রবল— সেটি হল, তারা অন্যদের তুলে ধরে নিজেরা ওঠে; আর আমরা অন্যকে ছোট করে নিজেরা উঠতে চাই। শর্ত একটাই: তাকেই তুলে ধরা যায়, যে সত্যিকারের লেখক। অলেখককে তুলে ধরা মানেও সত্যিকারের লেখককে খাটো করা। অলেখকের বেলায় চেষ্টা করা যেতে পারে— তার নিন্দা না করে তার বৈশিষ্ট্যগুলি ধরিয়ে দেওয়া। তাতেও যদি সে না খ্যান্ত দেয়, তাহলে আর কীই বা করার থাকে। তবে ‘ইন দ্য লং রান’ বলা তো যায় না, একদিন অলেখকও লেখক হয়ে উঠতে পারে। লেখা! — বড়ই রহস্যময় চিজ।

 

১৪.
‘যে পথের কথা কেউ জানে না, সেই পথই আসল পথ।’ — কথাটা তাওবাদী হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম লাও-ৎসের ‘তাও তে চিং’-য়েতেই মনে হয় আছে। কিন্তু না, নেই। এ কথা কেন আমার হঠাৎ মনে জেগে উঠল? কথাটা তো সত্যিই হেঁয়ালিপূর্ণ। ‘তাও তে চিং’-এ অবশ্য একটা কথা আছে— ‘সত্য কথা প্রায়শই হেঁয়ালিপূর্ণ হয়।’ তাহলে কি এই কথাটা সত্য? অন্যরকম করেও বলতে পারি— ‘যে পথে কেউ যায়নি, সেই পথই আসল পথ।’ —আরো অনেকরকম করে বলা যায়। কিন্তু যেভাবেই বলা হোক না কেন, কথাটা সত্য কিনা সেটাই আসল, তাই না?

 

১৫.
মাঝে মাঝেই মনে হয়: এদেশে সাহিত্যটাহিত্য এসব কিছু নয়, অন্তত বাংলাদেশে আমরা যে-গুটিকয়েক লোক যা নিয়ে মেতে থাকতে চাই বা আছি। সুবিধার রাহিত্য (অভাব) আমাদের সাহিত্য করায়। সুবিধা করে নেওয়াটাই আসল। আমরা সবাই এই জালে ধরা পড়ে গেছি। (বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ ছিলেন। সাহিত্য করার জন্য মানসিক ও বস্তুগত দুদিক থেকেই যে আভিজাত্য ও সফস্টিকেশান দরকার হয় সেসব তাদের ছিল।) আর কমলকুমার মজুমদারের মতো লোকেরা, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অদ্বৈত মল্লবমর্ণের মতো মানুষেরা ছিলেন সাহিত্যের সঙ্গে বিবাহিত, আর আমরা সাহিত্যের সঙ্গে ছেনালি করে বেড়াই।

 

১৬.
রাষ্ট্রে যা যা ঘটে তারচেয়ে সমাজে যা যা ঘটে সেসব সাহিত্যে দেখানো সবচেয়ে ভালো। সমাজে যা যা ঘটে তারচেয়ে কোনো পরিবার বা বংশে যা যা ঘটে তা দেখানো আরো ভালো। আর পরিবারে যা যা ঘটে তারচেয়ে ব্যক্তির জীবনে যা যা ঘটে তা দেখানো আরো ভালো। সাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস এভাবে রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিনিষ্ঠ হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে ‘আধুনিক উপন্যাস’ হয়েছে। ব্যক্তির মধ্যে রাষ্ট্র কেবল নয়, ব্যক্তির মধ্যে বিশ্বকে হাজির করাটাই মনে হয় এখনকার লেখকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উল্লিখিত নানান ধরনের দৃষ্টান্ত হিসাবে মহাভারত, ইলিয়াড, ওয়ার অ্যান্ড পিস (রাষ্ট্র সমস্যা); রামায়ণ, দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ (পারিবারিক সমস্যা); ওডিসি, দ্য ট্রায়াল (ব্যক্তি সমস্যা) ইত্যাদি গ্রন্থের কথা যখন মনে হয়, তখন ‘মহাভারত’ এবং ‘ওডিসি’র দিকে অনেকের ঝোঁকটা বেশি থাকে, বোঝা যায় দুধরনের জিনিসের মিশেল আমাদের ভেতরে আছে। ‘ইউলিসিস’-এ শুনেছি ব্যক্তি ও সভ্যতার দ্বৈরথ দেখানো হয়েছে। মার্সেল প্রুস্তের ‘রিমেমবারেন্স অব থিংস পাস্ট’-এও নাকি একই কাণ্ড মহাকাণ্ড হয়ে উঠেছে। মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড’-এও কাজটা জমেছে ভালো। কিন্তু স্যামুয়েল বেকেট যখন ‘মোলোয়’, ‘ম্যালান ডাইস’ ও ‘দ্য আননেইমেবল’ আমাদের সামনে পেশ করেন এবং তাঁর এই ট্রিলজিতে ‘আমি’কে যেভাবে হাজির করেন, তাতে উপন্যাসে পূর্বজদের নিমার্ণের সব কিছু ভেঙে পড়ে। পরের অনেকের চেয়েও তাকে আরো কয়েকশ বছর এগিয়ে থাকা বলে কেউ কেউ মনে করেন। তাতে মুশকিল হল এই যে, আমরা বুঝতে পারি না, আসলে কোথা থেকে শুরু করবো, কারণ আমরা ধরতে পারি না, কোথায় এসে শেষ হয়েছে এই রকমের উপন্যাসের অভিযাত্রা।

 

১৭.
‘অ্যান্টি-লিটারেচার’ বা সাহিত্যবিরোধী বলে একটা কথা আছে। পাশ্চাত্যের কেউ কেউ ‘অ্যান্টি-লিটারেচার’ বলতে বোঝান, যাদের লেখা দুর্বোধ্য, পড়া যায় না। পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেয়ে, পাঠক যাতে তার লেখা সহজে না পড়তে পারে, সেই মতো করে লেখাটা লেখেন। জেমস জয়েসের মতো লেখকের গায়েও তাই এর ছাপ্পা লেগেছিল। কারণ তার লেখা সাধারণ পাঠকের জন্য নয়। আমাদের দেশের ‘অ্যান্টি-লিটারেচার’ ভিন্ন মাল—সাহিত্যের নামে নোংরাস্বার্থ উদ্ধার ও বিচিত্র শয়তানির মজমা বসানোই এদের কাজ। মানুষকে ছোট করা, অলেখককে লেখক বানানো, বাজে লেখা ও বইকে সাহিত্য হিসেবে প্রচার, শিল্প-সাহিত্যের নামে নানান ফটকাবাজি কীভাবে করা যায় এটাই তাদের দিনরাত্রির অন্যতম চিন্তা। (মজার ব্যাপার হলো যারা সাহিত্য পড়ে না, সাহিত্য নিয়ে যাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই; যারা জীবনকে ভালোবাসে, মানুষকে ভালোবাসে—সেইসব মানুষকে আমরা সাহিত্যবিরোধী বলব না।) বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, সাহিত্যবিরোধী এইসব লোকের প্রায় সবাই তথাকথিত সাহিত্যজগতেরই মানুষ। কেউ স্বয়ং লেখক, কেউ সমালোচক, কেউ সম্পাদক, কেউ প্রকাশক। তবে এদের নামের আগে অবশ্যই ‘তথাকথিত’ শব্দটি দিতে হবে।

 

১৮.
দুনম্বরি বা ভেজাল ওষুধ ও খাদ্য বাজারে চালানো যতটা মারাত্মক, তারচেয়েও মারাত্মক অসাহিত্যকে সাহিত্য ও অলেখককে লেখক হিসেবে সুযোগ দেওয়া। ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ শরীরের জন্য বিপজ্জনক, আর ভেজাল লেখা মন ও মননের জন্য একই রকম ক্ষতিকর। একটি ক্ষতি করে স্বাস্থ্যের, অন্যটি সংস্কৃতির।

 

১৯.
সিকান্‌দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’কে আমি বলি বাংলাদেশের ‘বঙ্গদর্শন’। এই পত্রিকা জাতীয় দায়িত্ব পালন করছে, সত্যিকারের লেখকদের লেখক হতে সুযোগ দিয়েছে। সেই পত্রিকায় কেউ লিখলে তার ভরসা থাকতো সম্পাদক বা সেই পত্রিকার দায়িত্বশীল কেউ সেটি ভালো করে পড়বেন। সেই ‘সমকাল’ তাই চিরকালের পত্রিকা হয়ে গেছে। আর এখন, একালে যাদের লিখতে হচ্ছে তাদের নিজ দায়িত্বেই লিখতে হয়, সম্পাদক ভুল বাক্য, ঠিক বাক্য কী তাই জানেন না। কারণ বেশিরভাগ সম্পাদক এখন পাতা ভরানোর কাজ করেন। আর লেখালেখির সঙ্গে ‘দেখাদেখি’র সম্পর্কটা হল এখন লেখা ছাপানোর প্রধান শর্ত।

 

২০.
গণতন্ত্র নিয়ে একটা ভয় (বা সংখ্যাকে সমীহ করা, বড় করে দেখা) সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষের যৌথঅবচেতনে থেকে গেছে (যদিও গণতন্ত্র কী তা নিয়ে বোধকরি পরিষ্কার ধারণা তখন ছিল না)। মহভারতে একদিকে কৌরবদের একশ ভাই, অন্য দিকে পঞ্চপাণ্ডব; কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ সঙ্গ নিলেন পাণ্ডবদের, অন্যদিকে কৌরবদের দিলেন নিজের অক্ষৌহিণী সেনা। আর কে বেশি শক্তিশালী হল— বুদ্ধি, আদর্শ, সত্য; নাকি ক্ষ্যাপামি, দুর্নীতি এবং মিথ্যা? কৃষ্ণ হলেন বুদ্ধি, আর অক্ষৌহিণী সেনা হল শক্তি। এক বনাম লক্ষ! অথচ সংখ্যার জোরেই যেন গণতন্ত্র চলে। তাহলে? কে যেন বলেছিলেন, সত্যিকারের গণতন্ত্র পালন করতে হলে, লালন করতে হলে প্রত্যেকটা মানুষকে দেবতা হতে হয়। আর আধুনিক গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত সেক্যুলার/ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া (যদিও ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি সেক্যুলারের বাংলা নয়, একে ধর্মবিযুক্তি বলা যেতে পারে অথবা ইহজাগতিকতা শব্দটি বরং কাছাকাছি, কিন্তু সে তো বুঝদারের জন্য, আসল অর্থ হল রাষ্ট্র, প্রশাসন, শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা, সর্বোপরি যৌথ জীবন ও সমাজের একটি দিকও কোনো এক বা একাধিক ধর্মীয় মতে-আচারে প্রকট তো নয়ই, প্রচ্ছন্নভাবেও আচ্ছন্ন হবে না)। এটা না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না। মজার বিষয় হলো পৃথিবীতে একটি দেশেও নেই যেটি সত্যিকার অর্থে সেক্যুলার/ধর্মনিরপেক্ষ। ফলে গণতন্ত্র— এও কাজির গরু। কাগজে আছে, গোয়ালে নেই।

 

২১.
সংখ্যা যখন ২১ তখন ভাষা নিয়েই কথা হোক। আমাদের ভাষা এখন যে স্তরে তাতে কেবল ধর্ম নিয়ে আলোচনাটা চলতে পারে, আর আমরাও ধর্মের বাইরে তেমন যেতে পারি না, কারণ আমাদের ভাষাও তা পারে না। ভাষাকে এখনো দার্শনিক বিষয়াদি আলোচনা করার ক্ষমতা সম্পন্ন করে তুলতে পারিনি। অথচ বাংলা কত শক্তিশালী ভাষা যে শুরুতেই এভাষায় গোটা বাইবেল এতে অনুবাদ করা গেছে। বিজ্ঞানের আলোচনাও যে নেই তাই বা কী করে বলি। কিন্তু সেটা আমরা গণমুখী করে তুলতে পারিনি, যেটা করে তোলার ভিত্তিতে এই ভাষা দিয়ে দর্শন এবং বিজ্ঞানকে পূর্ণভাবে আয়ত্ত করা যাবে। এখন আর আমরা ভাবতে পারি না যে চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশল বিজ্ঞান বাংলায় পড়া যাবে। অথচ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এক সময় বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ানো হতো, ১৮৫১ সাল থেকে এটা শুরু হয়েছিল। আর পরে ১৯১৬ সালের পরে শুরু হয়েছে ইংরেজিতে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ানো। ১৮৬৭ সাল থেকে ১৯০০ সাল অব্দি বাংলা ভাষায় প্রায় ৭০০(সাতশো) চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হয়। তারপর তো ব্রিটিশরা ছাত্রদের মান, ওষুধপত্রের ব্যবহার, পেটেন্ট ইত্যাদির ধুয়া তুলে, বাংলায় মেডিক্যাল পড়ার বারোটা বাজিয়ে দিল।

 

২২.
রবীন্দ্রপূজা আমাদের দশভূজা হতে না পারার আক্কেলসেলামি (কারণ এর জন্য কত টাকা এবং কত সময় নষ্ট হয়—তার হিসাব কে রাখে? রবীন্দ্রচর্চা ঠিকমতো হলে রবীন্দ্র-পুরোহিতদের ব্যবসাটা বন্ধ হতো। কবীর সুমনের গান আছে— ‘প্রাণে গান নেই বলে তাই রবিঠাকুর মূর্তি গড়া’) ছাড়া আর কী। দেবী দূর্গাকে দেখে বোঝা যায় যে মানুষেরও দশভূজা হওয়া সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ মানুষ ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ দশভূজা ছিলেন। আবদুশ শাকুরের ‘রবীন্দ্রনাথের অনুজ্জ্বল অঞ্চল’ নামে যে বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, কলকাতা থেকে সে-বইটিই বের হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ মানুষ ছিলেন’ নামে। বাঙালির কিছু আশ্চর্য ব্যাপার আছে, যেটা তার সবচেয়ে বড় শক্তি, সেটাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা; তার ভেতরেই রয়ে গেছে তার এগুতে না পারার যাবতীয় কারণ। সে-রকমই এক মহাশক্তি ও মহাদুর্বলতার নাম রবীন্দ্রনাথ।

 

২৩.
সমালোচনা মানে ভারসাম্য রক্ষা করে আলোচনা নয়। মানে পঞ্চাশভাগ ভালো বললাম, আর পঞ্চাশ ভাগ মন্দ দেখিয়ে দিলাম। বরং কারো ভেতরে যদি আশি ভাগ মন্দ থাকে, সেটি আশি ভাগই দেখানো এবং বাকি কুড়ি ভাগ যে ভালো সেটি দেখানোই হল সত্যিকারের সমালোচনা, একইভাবে উল্টোটাও। মানে যতটুকু কারো বিবেচনায় ধরা পড়ে—সেই মতো দেখানো এবং অবশ্যই যুক্তির সঙ্গে দেখানো, কেবল মন্তব্য করে ছেড়ে দেওয়া যাতে না হয়। সমালোচনা খুশি করার জন্য নয়, আক্রমণ করার জন্যও নয়। আমরা এমন সংস্কারবদ্ধ যে সমালোচনা/ ক্রিটিক মানেই ভুল-ত্রুটি ধরা হয়েছে। আমরা (আমি নিজেও এই ‘আমরা’-র ভেতরে আছি) সেই মতো সমালোচনা করতে পারি না বলেই আমাদের কোনো সমালোচনারই কোনো দাম নেই, সেটি রাজনৈতিক সমালোচনা হোক, কি সাহিত্য সমালোনাই হোক, তা দাঁড়ায় না, ঝুপ করে পড়ে একেবারে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।

কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করে? শকুনি পাশাকে না পাশা শকুনিকে?—কৃষ্ণের প্রশ্ন ছিল।

 

২৪.
সবসময় সুন্দরকে ঘিরেই অসুন্দর কাহিনি জন্মাচ্ছে, সেই কাহিনিই চমকপ্রদ, মনোহর, এমনকি নিদ্রাহরও হয়ে উঠছে। স্থির পুকুর নিয়ে কখনো গল্প-উপন্যাস হয় না, সেখানে একটা ঢিল পড়া চাই, সেই ঢিলটাই অসুন্দরের ঢিল। ‘মহাভারতে’ এক নারীর পাঁচ স্বামী।—এমন ‘অশ্লীল’ না হলে কোনো কিছু জমে? (দ্রৌপদীর রূপের বর্ণনাটা ‘বিরাটপর্বে’ সুদেষ্ণার উচ্চারণে শোনা যাক, ‘তোমার গুল্ফভাগ অনুচ্চ, ঊরুদ্বয় সংহত, নাভীপ্রদেশ অতি গম্ভীর, নাসিকা উন্নত, অপাঙ্গ, কর, চরণ, জিহ্বা ও অধর লোহিতবর্ণ, বাক্য হংসের ন্যায় গদগদ, কেশালাপ অতি মনোহর, অঙ্গ শ্যামলবর্ণ, নিতম্ব ও পয়োধর নিবিড়তম, পক্ষ্মরাজি কুটিল, মধ্যভাগ ক্ষীণ, গ্রীবা কম্বুর ন্যায়, শিরা-সকল অদৃশ্য এবং মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় রমণীয়।’—এমন এক নারীকে নিয়ে পাঁচ ভাইয়ের ভাগ করে দাম্পত্যযাপন—কী ভয়াবহ! ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভে’ এক সুন্দরী নারী নিয়ে বাপ-ছেলেতে টানাটানি। কী মারাত্মক!) অন্যদিকে অসুন্দরকে ঘিরে যে-আখ্যানগুলি সবসময় রেখায়িত, কিন্তু তেমন একটা লেখা হচ্ছে না, সেখানে ‘সুন্দরের’ ঢিল মেরে দেখা যাক না কী হয়। ধরা যাক, একজন অসৎ রাজনীতিবিদ বা দুর্নীতিবাজ আমলা বা একজন সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী হঠাৎ করে ‘ভালো’ হয়ে যেতে চাইল। এই ভালো হতে চাওয়ার ইচ্ছাটাই অসুন্দরের ভেতরে সুন্দরের ঢিল। তারপর কী হয় দেখাই যাক না।

 

২৫.
শিক্ষা হলো চাবি, জ্ঞান হলো ক্ষমতার গুদামঘর, আর প্রজ্ঞা হলো ক্ষমতার বিপরীতে একা থাকার শক্তি।
আমাদের দেশে হবে সেই লোক কবে—জ্ঞানে না বড় হয়ে প্রজ্ঞায় বড় হবে? যে ক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে?

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.