বিস্ময়কর মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
অল্পদিনের ব্যবধানে মারা গেলেন দেবেশ রায়, অরুণ সেন ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনজনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। পরিচয়ের সূত্র ছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক ও নাট্যকার সেলিম আল দীন। তাদের কারণেই এই তিনজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে একাধিকবার দেখা সাক্ষাৎ ও আড্ডা হয়েছে। যতদূর জানি তিনজনই মোটামুটিভাবে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর বাইরে যে সাহিত্যিক বলয়গুলো ছিল তার একটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এরা তিনজন। বলয়টির নাম ছিল প্রতিক্ষণ। প্রতিক্ষণ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থা এর কেন্দ্রে ছিল। অনেক তরুণ লেখক এ বলয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের কিছু লেখকের ব্যাপারে তারা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। অবশ্য আনন্দবাজার গোষ্ঠীর অনেকেও বাংলাদেশের লেখকদের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের লেখা নিয়ে তিনি বেশি উচ্ছ্বসিত ছিলেন বলা যায়। আনন্দবাজার গোষ্ঠী তাদের পছন্দসই লেখকদের আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে। আনিসুজ্জামান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তসলিমা নাসরিন, হাসান আজিজুল হক সে পুরস্কার পেয়েছেন। তুলনায় প্রতিক্ষণ গোষ্ঠী খুব বেশি বাংলাদেশের লেখকের লেখা প্রকাশ করেছে বা তাদের বই প্রকাশ করেছে এমনও ঘটেনি।
অরুণ সেন ও দেবেশ রায়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্য বোঝার একটা চেষ্টা দেখা গিয়েছিল। অরুণ সেন কিছু কিছু লিখেছেন, দেবেশ রায়ও লিখেছেন। তাদের চেষ্টার মধ্যে আন্তরিকতার ছাপ ছিল। কিন্তু তারা পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলাদেশের লেখালেখিকে বাংলাদেশের সাহিত্য নামে চিহ্নিত করেছিলেন। আমার মতে পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকে বাংলাদেশের লেখালেখিকে বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। কারণ বাংলাদেশের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যই। আমরা যখন সাহিত্যের বিবেচনা করি তখন বাংলাদেশে বসে যারা লিখেছেন তাদের আলাদা করে দেখি না। মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতির পর অনায়াসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাম নিই। উৎপল, বিনয়, শক্তির পাশে আল মাহমুদের নাম নিই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, অমিয়ভূষণ মজুমদার, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়ের সাথে সাথে সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, শওকত আলী, আহমদ ছফার নাম নেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনার সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হককে আলাদা করে বিচার করার রেওয়াজ আমাদের এখানে নেই। কারণ বাংলাদেশে আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে শিখিনি। সাহিত্যের একটা অংশকে আলাদা করে মুসলমানের সাহিত্য, পূর্ব বাংলার সাহিত্য বা বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে বিচার করার রেওয়াজ আমাদের নেই। এই উদারতা একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকরা এমন উদারতা থেকে নিজেদের যুগের পর যুগ বঞ্চিত করে চলেছেন। আমি মনে করি এই সংকীর্ণতা থেকে তাদের শীঘ্রই বের হয়ে আসা উচিৎ।
অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ কথাগুলো এলো। বলতে চেয়েছি, বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য দেবেশ রায় ও অরুণ সেনের ভালোবাসার মধ্যে অনেক সমস্যা ছিল। তাদের ভালোবাসা আমরা অকপট ভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। তাদের চেষ্টাকে আমরা সম্মান করেছি। আশা করেছি তাদের এইসব চেষ্টার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকরা ভবিষ্যতে নিজেদের আরো সাবালক করে তুলতে পারবেন।
দেবেশ রায়ের মতো দেখা হওয়ার আগে থেকেই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কাছে বিস্ময়কর একটা চরিত্র ছিলেন। তাকে নিয়ে আমাদের বিপুল আগ্রহ ছিল। ওই সময় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে আমাদের যে সীমাহীন উচ্ছ্বাস তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বলতে গেলে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। স্প্যানিশ ভাষায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য পড়ার সামর্থ্য আমাদের কোন দিনই ছিল না।
সদ্যপ্রয়াত এ তিন সাহিত্যিকের মধ্যে একেবারে আলাদা জাতের মনে হয়েছিল মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাকে অনেকটাই আত্মমগ্ন মনে হয়েছে। মুখে সবসময় একটা ফুর্তির হাসি, এক ধরনের উদাসীনতা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, দেখেছি। ছোটখাটো চেহারার এই লোকটি ঠাঠা করে হেসে দিতে পারেন। ভোঁস ভোঁস করে সিগারেট খান। কৌতুক করতে পারেন। সাহিত্যিকদের চেনা সিরিয়াসনেস তারমধ্যে অল্প সময়ের চেনা পরিচয়ে খুব একটা খেয়াল করিনি। তিনি হাস্যরস দিয়ে আমাদের খুব আপন করে নিয়েছিলেন। তার জীবনের অনেক মজার গল্প আলোচনার মধ্যে চলে এসেছিল। তারমধ্যে একটি মনে আছে। প্রেমের গল্প। তার বাইরে থাকা প্রেমিকা যখন দেশে আসেন তখন তিনি নাকি একটা হোটেল ভাড়া করে একমাস তার সঙ্গে কাটান, প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে।
তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। খেলা নিয়ে তার অনেক বই আছে। খেলার বেশ সমঝদার ব্যক্তি। মতি নন্দীর পর মূল ধারার বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে খেলা নিয়ে আস্ত আস্ত বই লেখার মত লেখক বেশি পাওয়া যায় না। এখন বরং ক্রীড়া সাহিত্য নামে এক ধরনের সাংবাদিক সাহিত্যের জন্ম হয়েছে।
তার আরেক গুণের পরিচয় শুনেছি। তিনি অসাধারণ পাঠক। আড্ডার মধ্যেই কথা উঠেছিল সাহিত্যিকদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি পড়েন? বাংলা ভাষায় কোন লেখা প্রকাশ হলে সেটা নাকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখ কোনোভাবেই এড়াতে পারতো না। আরেক সর্বভূক পাঠক ছিলেন দেবেশ রায়। তিনিও নাকি যা চোখে পড়তো তাই পড়ে ফেলতেন। আর মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এদের দুজনকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলে শুনেছি।
দেবেশ রায়ের মতো দেখা হওয়ার আগে থেকেই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কাছে বিস্ময়কর একটা চরিত্র ছিলেন। তাকে নিয়ে আমাদের বিপুল আগ্রহ ছিল। ওই সময় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে আমাদের যে সীমাহীন উচ্ছ্বাস তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বলতে গেলে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। স্প্যানিশ ভাষায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য পড়ার সামর্থ্য আমাদের কোন দিনই ছিল না। ইংরেজি ভাষা পড়ার জন্য বই জোগাড় করে দ্রুত পাঠ করার দক্ষতা আমরা যখন অর্জন করতে পারিনি। ফলে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে আমাদের সকল উচ্ছ্বাস মূলত ছিল মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নির্ভর।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হুয়ান রুলফো, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, কার্লোস ফুয়েন্তেস সহ অনেক লাতিন লেখক এর নাম প্রথম আমরা তার কাছেই শুনি। তার অনুবাদেই প্রথম আমরা এই লেখকদের গল্প উপন্যাস পড়ি। সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রবন্ধ, বইয়ের ভূমিকা আমরা গোগ্রাসে গিলতাম- লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ে যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় এই আশায়। শুধু লাতিন লেখার অনুবাদ নয়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের আরো অনেক সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। চেসোয়াভ মিউশ, মিরোস্লাভ হোলুব, নিকানোর পাররার কবিতার সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এমে সেজায়ারের দেশে ফেরার খাতা বাংলা কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে আছে।
অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্য তিনি অনুবাদ করেছেন। এগুলোর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিল ভৈকম মুহম্মদ বশীর।
পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার বিস্ময়কর সব লেখককে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছেন এবং সেগুলো অনুবাদ করে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে গত বছর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পিটার হ্যান্ডকের লেখাও তিনি অনুবাদ করে ফেলেছিলেন অনেক আগে। এর বাইরে জনপ্রিয় সাহিত্যের মধ্যে টিনটিন, জুলভার্ন মূলত তাঁর হাত ধরেই বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছেছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের এক বিশাল অবদান। বুদ্ধদেব বসু রিলকে ও বোদলেয়ার অনুবাদ করে বাংলা ভাষায় আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। সে কাজে তিনি বেশ সফল হয়েছিলেন বলা যায়। পরে তার অনুবাদ নিয়ে অনেক সমালোচনাই হয়েছে। কিন্তু তার অনুবাদগুলো বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নাই।
বাংলা ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর ঘটনা মনে হয় মধ্যযুগে ঘটেছে। ওই সময় অনুবাদের কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছিল যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে খরার হাত থেকে রক্ষা করেছে। বলতে গেলে ওই অনুবাদগুলো না থাকলে বাংলা সাহিত্যের ওই সময়টাকে অন্ধকার যুগ বলে রায় দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু অনুবাদ বলতে কোন অচেনা অজানা সাহিত্যকে বাংলা ভাষার মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার যে বিপুল উদ্যোগ বোঝায় তার নিদর্শন বাংলা ভাষায় খুব বেশি দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল রুশদেশের রাদুগা ও প্রগতি প্রকাশন। তারা যেভাবে মার্কসীয় সাহিত্যের বিপুল সম্ভার অনুবাদ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছে তার তুলনা অতীতে বর্তমানে ভবিষ্যতে নেই। তেমনি রুশদেশের কালজয়ী লেখকদের লেখা অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের এক শক্তিশালী ধারা তৈরি করে ফেলেছে। রুশদের এই অনুবাদের পেছনে হয়তো তাদের স্বাজাত্যবোধ ছিল, মার্কসীয় মতাদর্শ প্রচারের উদগ্র বাসনাও ছিল। কিন্তু তারা যে বাংলা ভাষায় রুশ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অনুবাদ করে পৌঁছে দিতে পেরেছে তার তুলনা এ দেশের ভাষা চর্চার ইতিহাসে আর নাই। ফলে ইংরেজির বাইরে রুশ সাহিত্য যেভাবে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছে তেমন আর ঘটেনি বলতে গেলে। ইংরেজির চেয়ে রুশ প্রভাব আমাদের সাহিত্যে অনেক বেশি করে পড়েছে। কেননা ইংরেজি সাহিত্য সংগঠিতভাবে অনুবাদ করে বাংলা ভাষায় প্রচার করার কোন উদ্যোগ এ যাবত আসেনি সেভাবে। বলতে গেলে, শেক্সপিয়ার, ক্রিস্টোফার মার্লো, ডিকেন্সের সাহিত্য পর্যন্ত এদেশে সংগঠিতভাবে অনূদিত ও প্রচারিত হয়নি। এই বিষয়ে রুশদের নিষ্ঠা একাগ্রতা ও সর্বব্যাপী কর্মোদ্যোগ তুলনাহীন।
রুশদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পর এককভাবে যদি অনুবাদ সাহিত্যে কারো অবদানকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয় তবে তার নাম হবে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একাধারে যেমন লাতিন আমেরিকার বিপুল সাহিত্য অনুবাদ করেছেন তেমনি পরবর্তী তরুণদের উৎসাহিত করেছেন লাতিন সাহিত্য অনুবাদ করার ব্যাপারে। নিজে অসংখ্য লেখা অনুবাদ করেছেন, লেখকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকের সঙ্গে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের আর কোন মাধ্যম ছিল না। কেননা লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ঔপনিবেশিক ইংরেজি সাহিত্য নয় বা রুশদের মত মতো কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে সে সাহিত্য আমাদের কাছে পৌছাবার কোন উপায় ছিল না। মানবেন্দ্র চেয়েছিলেন বলেই লাতিন সাহিত্যের বিপুল সম্ভার আমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। তুলনায় আফ্রিকান সাহিত্য খুব কমই বাংলায় আসতে পেরেছে। অনুবাদের অপ্রতুলতার কারণে জার্মান ও ফ্রেঞ্চ সাহিত্য আমাদের এখানে অনেকটাই অপরিচিত ও অবহেলিত বলা যায়। আমার মনে হয়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তার অনুবাদ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে একটা রূপান্তরের সূচনা করে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার তুলনা সত্যিই বিরল।