

সাহিত্যের জন্য সেলিম মোরশেদের পলিটিক্স ও সংগ্রাম
অনেক দিন ধরেই ভাবছি সেলিম মোরশেদকে নিয়ে লিখব। আশির দশকের মাঝামাঝিতে, যাত্রা শুরুর একেবারে প্রথম দিকে, তাঁকে নিয়ে যে দু-একজন দু-এক কলম লিখেছেন তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। মনে পড়ছে, দুই গল্পকার পারভেজ হোসেন ও শহিদুল আলম সম্পাদিত ‘সংবেদ’-এ তাঁর ছড়া নিয়ে ছোট্ট একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে রচনাকে এখন আমি আর গ্রহণীয় মনে করি না এর অসারতার জন্য। তখন কি আর কিছু বুঝতাম নাকি! মাত্র নতুন শিং গজালে যেমন ছাগলছানা ঢুশোঢুশি করে সেটা ছিল তেমন কাজ।
সেলিম মোরশেদ দীর্ঘ সময় ধরে শুদ্ধ অন্তর নিয়ে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন। একজন সাহিত্যিকের জন্য অন্তরের শুদ্ধতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আশির দশকে সচেতন ভাবে সাহিত্যচর্চা শুরুর সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কেবল পাঠকতুষ্টির জন্য কিছুই লিখবেন না। সাহিত্যকে বাণিজ্যের মাধ্যম বিবেচনা করতে তিনি একেবারেই রাজি নন। জীবন যাপনে স্বাচ্ছন্দ্য লাভের ধান্দায় যাঁরা লেখালিখি করেন এমন কারো সঙ্গে তাঁর কোনো আদর্শিক সম্পর্ক থাকতে পারে না! লেখক হিসেবে একেবারে স্থিরলক্ষ্য: নিজের অন্তরে অনুভূত সত্যের পক্ষে পাঠকমনকে চাবকে শুদ্ধ করে নিতে চান তিনি।
কে আর সেধে চাবুক খেতে চায়! সেজন্যে বোম্বাইয়া বিনোদনপন্থীরা তাঁর খোঁজ করেন না; ফলে বাজারি ডাকে তাঁর বইয়ের নাম ওঠার সুযোগ নেই। কে চায় সে সুযোগ! সে ডাকের প্রত্যাশাও নেই সেলিম মোরশেদের। তিনি যে সেই আশির দশক থেকে সাহিত্য নিয়ে বাণিজ্যিকতার বিরুদ্ধে ‘বুনো শুয়োরের গোঁ’ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন! চলতি হাটে তাঁর বই বিকোবে কেন? ফলে দুষ্প্রাপ্যতাহেতু সবসময় তাঁর সব বই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষেও। বিশেষ বিশেষ সময়ে যখন চোখে পড়েছে সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি তখনই। বন্ধুত্বের অগ্রাধিকারে কখনো কখনো বই পেতে স্বয়ং লেখকেরও শরণাপন্ন হয়েছি।
সেলিম মোরশেদের মতো এমন একজন ‘চাবুক-হাতে’ লেখক সম্পর্কে বাজারচলতি ভঙ্গিতে দু-চার কথা লিখে ফেললে তো আর চলে না! পাঠকদের যেহেতু তিনি চাবকে সোজা করতে চান সেহেতু পাঠক হিসেবে আমারও তো দায় আছে পরিশুদ্ধ হয়ে নেবার! সে দায় মাথায় নিয়ে লিখবার জন্য অনেকবারই তাঁর লেখাপত্র পড়তে বসেছি। কিন্তু জীবন যাপনের হাজারটা দরকারি ধান্ধায় ‘চাবুক খাওয়া’ শুদ্ধি নিয়ে পড়তে বসা হয়ে ওঠেনি। আমার সংগৃহীত সেলিম মোরশেদের বইগুলো যত্নে রেখেছি দরকারের সময় হাতে পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেগুলো যত্নে থাকলে কী হবে, নিজেই তো বাস্তুচ্যুত হয়ে নিউইয়র্কে এসে পড়েছি। এখন আর সেসব চটজলদি কাছে পাবার উপায় নেই!
বর্তমান কাল তো বৈদ্যুতিন মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণাধীন। জানতে পেরেছি ‘মেঘচিল’ নামে একটা ওয়েব পোর্টাল বের হচ্ছে। সামান্য খোঁজ নিয়ে যা বুঝেছি তাতে লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা নিরূপণের জটিলতায় না গিয়ে সরল বিবেচনায় ‘মেঘচিল’কেও আমার কাছে এক ধরনের লিটল ম্যাগাজিনই মনে হয়েছে। মোটা দাগে এর লিটল ম্যাগাজিনত্ব এখানে যে, এর কোনো বাণিজ্য-অভিপ্রায় নেই। অন্তরের আহ্বানই এই পোর্টালে সাহিত্যচর্চার মূলে। তাদেরকেই তো অনুমোদন করার কথা চাবুক-হাতে লেখকের। হ্যাঁ, সেলিম মোরশেদকে এইভাবে অনুসন্ধান করার ব্যাপারে ‘মেঘচিলে’র অভিপ্রায়কে আমিও সম্মান জানাই। ‘মেঘচিল’-সম্পাদক খোঁজ পেয়েছেন যে সেলিম মোরশেদের সঙ্গে আমার দীর্ঘকালের জানাশোনা ও বন্ধুত্ব রয়েছে। যতদূর বুঝতে পারি এই লেখার আহ্বানের পেছনে সম্পাদক বিজন অরণ্যের কাছে এটুকই আমার সব চেয়ে বড় যোগ্যতা। তাঁর ডাক পাওয়ার পর মনে হল, সেলিম মোরশেদের বইগুলো হাতের কাছে থাকলে করোনাকালের গৃহবাসী জীবনে ভালোভাবে পড়ে নেয়া যেত। তাঁর যত বই আমার সংগ্রহে আছে সেগুলো নাড়াচাড়া করলে এবং একই সঙ্গে আমার সংগ্রহের সংবেদ–অনিন্দ্য–গাণ্ডীবের পুরনো সংখ্যাগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলে মনে পড়ে যেত অনেক কথা। এসব নিয়ে একটা কিছু হয়তো লিখে উঠতে পারতাম স্বল্প আয়াসে। বিজন অরণ্যকেও জানালাম সে-কথা। আমার এই অভাবের কথা শুনে সেলিম মোরশেদের কিছু রচনার পিডিএফ কপি তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম; বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‘স্মলপ্রেস’ (লিটল ম্যাগাজিনের জ্ঞাতি প্রকাশনা সংস্থা) হিসেবে বিবেচনাযোগ্য ‘উলুখড়’-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে আরো কিছু লেখা পেয়ে গেলাম সেলিম মোরশেদের। আশি ও নব্বইয়ের দশকের কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনও উল্টেপাল্টে দেখে নিলাম সেখানে। বুঝলাম ঠিকমতো পড়াশোনা করে লিখতে কিছু বেশি সময় লাগবে। এবারও তো তাহলে লেখা হয়ে উঠবে না তাঁকে নিয়ে! তাই অন্য পথ ধরলাম। মনে হল, ব্যক্তি সেলিম মোরশেদকে তো প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সক্রিয় দেখছি। এর আলোকে তাঁকে নিয়ে দু-চার কথা নিশ্চয়ই লিখতে পারব। সুতরাং আমার বর্তমান রচনা এগোল এই পথেই!
সেলিম মোরশেদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। বয়সে তিনি আমার চেয়ে সামান্য এগিয়ে। তখন তিনি দু-একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পেশাগত কাজ করেন ও গল্প লেখেন। কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ করলাম সাহিত্যচর্চাকে তিনি আর কেবল স্থুল বিনোদনমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতে পারছেন না। সে সময়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমতলায় তুমুল আড্ডা হত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রাঙ্গণটি ছিল উন্মুক্ত। ঢাকার বেশ কিছু তরুণ সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিক, চলচ্চিত্রকর্মী, নাট্যকর্মী সেখানে যাতায়াত করতেন তখন। সকলে যে সেখানে লাইব্রেরির সদস্য হিসেবে, কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে বইপড়া বা অন্য কর্মসূচিতে অংশ নিতে যেতেন তা নয়। অনেকেই যেতেন কেবলই আড্ডা দিতে। এর কারণ ওই প্রাঙ্গণটি তখন ছিল সৃষ্টিশীল ও ভাবুকদের জন্য অন্যতম মুক্ত এলাকা। খুব সস্তায় পাওয়া যেত চা, ছোলা-মুড়ি ইত্যাদি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও কেউ সাধারণত উঠে যেতে বলত না সেখান থেকে। তখনকার সেই আড্ডা থেকেই তাঁর এই মনোভাব সম্পর্কে আমার জানা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে তখনই আমার যুক্ততা খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক; আমি ছিলাম সেখানকার ভাতাভোগী কর্মী। বন্ধু পারভেজ হোসেন এবং শহিদুল আলমও যুক্ত ছিলেন একই ভাবে। পঁচাশি সালের দিকে স্বল্প সময়ের জন্য যুক্ত হয়েছিলেন সাজ্জাদ শরিফও। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল হলেও ওখানে যেতেন ঢাকার তখনকার আবেগী লিটল ম্যাগাজিন-ফিলসফার তপন বড়ুয়াও! ওখানকার আড্ডায় প্রায়শই পাওয়া যেত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, অনিন্দ্য-সম্পাদক হবিব ওয়াহিদ, ‘গাণ্ডীবে’র মূল বাহক সম্প্রতি প্রয়াত হোসেন হায়দার চৌধুরী, গল্পকার চলচ্চিত্রকার তারেক শাহরিয়ার, চলচ্চিত্রকার জাহিদুর রহিম অঞ্জন, চর্যাপদ-সম্পাদক আযাদ নোমান, কবি শান্তনু চৌধুরী ও কবি শোয়েব শাদাবকে… কয়জনের নাম বলব? সকলের কথা যে মনেও পড়ছে না এই মুহূর্তে! তার চেয়ে প্রসঙ্গত যাঁর নাম মনে পড়বে তাঁর কথাই বলব না হয় এখানে!
যে কোনো আন্দোলনেরই একটা পলিটিক্স থাকে। তাঁর লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেরও তা আছে। ফলে তাঁর এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা অনেকেই সংগত মনে করবেন। কিন্তু আমি মনে করি প্রকৃত সাহিত্যিক প্রধানত উপলব্ধ অন্তর্সত্যের ভাষ্যকার। সেজন্যেই তিনি পলিটিক্সকে শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করে যান। সাহিত্যিককে তাই অনেক সময়ই নিজের বাস্তবতারও বিরুদ্ধতা করতে হয়। সেলিম মোরশেদের পক্ষের মানুষ হয়েও এখানেই তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ।
১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে আমরা যারা আড্ডা দিতাম তাদের মধ্যে সেলিম মোরশেদই ছিলেন বিবাহিত। কিছুদিন পরে তারেক শাহরিয়ার যুক্ত হয়েছিলেন সেই তালিকায়। তার কিছুদিন পরে যোগ দিয়েছিলাম আমিও। আমাদের আড্ডা কয়েকবার সেলিম মোরশেদের বাসায়ও সম্প্রসারিত হয়েছিল। চোখে ভাসছে তাঁর ফুটফুটে শিশুপুত্র সঞ্চয় প্রথমের (এখন প্রয়াত) ঘরজুড়ে ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য আর ওর কবিতা বলা! ঢাকা মহানগরীতে একটা ভালো চাকরি না থাকলে তখনও টিকে থাকা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য! সেই সময়ই সেলিম মোরশেদ দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে দেশের কোনো জাতীয় দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখবেন না। কারণ এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক আধার। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিকতাকে তিনি নিজের জন্য অগ্রহণযোগ্য মনে করলেন।
মনে পড়ে তখন থেকেই সেলিম মোরশেদের নির্দেশিত প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরোধিতার সংজ্ঞায় আমি পুরোপুরি আস্থা পাইনি। তবে লেখক হিসেবে নিজেকে মুক্ত রাখার পক্ষে তাঁর যে দৃঢ় অবস্থান তার প্রতি সেই যে শ্রদ্ধা জন্মেছিল আমার তা এখনো অটুট আছে। জীবন ও জীবিকার চাপে তিনি কখনো প্রলুব্ধ হননি। যাপন করে গেছেন মুক্তপ্রাণ লেখকের জীবনই। সম্ভবত এই সূত্রেই তাঁকে আশির দশক ও উত্তরকালের লেখকদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সম্মান তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমার যত সমালোচনাই থাকুক সেলিম মোরশেদের ব্যাপারে তাঁর অবস্থানগত সূত্রে এই মূল্যায়নের সঙ্গে আমার খুব একটা দ্বিমত নেই।
তবে এ-কথা ঠিক যে, সেলিম মোরশেদের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির মৌল ব্যবধান রয়েছে। তাত্ত্বিক দিক থেকে অনেকবার তাঁর সঙ্গে তর্কও করেছি এ নিয়ে। আমার ধারণা প্রাতিষ্ঠানিকতার অবয়ব প্রসঙ্গে তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থানের সঙ্গেই আমার সামান্য যা পার্থক্য। আমি নিজে যে প্রাতিষ্ঠানিকতা বা এর বিরোধিতা খুব একটা বুঝেছি তা দাবি করি না; তা সত্ত্বেও আমিও তাঁর মতোই জীবনবাস্তবতার অজুহাত তুলে মানবিকতা-বিরোধী কায়েমি স্বার্থবাদিতার প্রাতিষ্ঠানিকতায় রুদ্ধ থাকতে রাজি নই। আমিও মুক্ত মন নিয়েই সাহিত্যসাধনার পক্ষে। সচেতন ভাবেই আমি চেষ্টা করি মনকে মুক্ত রেখে সাহিত্যচর্চা করতে। এই অবস্থান বিবেচনায়ই সেলিম মোরশেদের সঙ্গে মূলত আমার ঐক্য। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষে তাঁর যে বিপ্লবী অবস্থান তার সংস্কৃতি নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন রয়েছে। যেমন তিনি সমালোচনা গ্রহণ তো দূরের বিষয়, শুনতেও রাজি নন। যাঁদের তাঁর সমালোচক হবার কথা তাঁরা প্রত্যেকেই হয়তো তাঁর শত্রু নন। বুদ্ধিগত উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা থেকেও যে সমালোচকেরা সমালোচনা করতে পারেন তাতেও তাঁর ঘোরতর অনাস্থা। বিপ্লবীদের মতো তিনি চান কেবল তাঁর উপলব্ধির প্রতি নিঃসংশয় আনুগত্য। তাঁর সঙ্গে সুদীর্ঘ কালের পরিচয় ও বন্ধুতা সূত্রে আমার মুক্তমন তাঁকে এভাবেই বুঝেছে।
যে কোনো আন্দোলনেরই একটা পলিটিক্স থাকে। তাঁর লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেরও তা আছে। ফলে তাঁর এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা অনেকেই সংগত মনে করবেন। কিন্তু আমি মনে করি প্রকৃত সাহিত্যিক প্রধানত উপলব্ধ অন্তর্সত্যের ভাষ্যকার। সেজন্যেই তিনি পলিটিক্সকে শেষ পর্যন্ত অতিক্রম করে যান। সাহিত্যিককে তাই অনেক সময়ই নিজের বাস্তবতারও বিরুদ্ধতা করতে হয়। সেলিম মোরশেদের পক্ষের মানুষ হয়েও এখানেই তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ।
লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে তাঁর অবস্থানের সততা নিয়ে আমার প্রশ্ন কখনোই নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষে তাঁর সংগ্রামের যে প্রকৃতি তাতে সে সংগ্রাম প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্ত থেকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে কতটা মুক্ত থেকে বাস্তবে করা সম্ভব তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সেজন্যই আমি জীবন যাপনে তাঁর মতো ছুঁৎমার্গী হতে রাজি নই। সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে জীবনের অবসান নয়, বরং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য যুদ্ধ জারি রাখতে আমি টিকে থাকতে চাই। আমিও লেখকসত্তার প্রাতিষ্ঠানিকতামুক্ত থাকার পক্ষে। কিন্তু তার জন্য বিপ্লবী হতে হলে নিজের জীবন যাপনে ন্যূনপক্ষে যতটা অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি হিসেবে লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে তার পরিচয় আমরা দিতে সমর্থ নই। এই বাস্তবতাকে আমাদের বুঝতে হবে। তা না হলে ভ্রান্তিতে ডুবতে হবে আমাদের।
আরেকটা কথা, পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগাজিন- বাস্তবতা আর বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন-বাস্তবতার মধ্যে রাষ্ট্রসংস্কৃতিগত বড় পার্থক্য রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাদেশে বৌদ্ধিকতার সংস্কৃতিগত দিক থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানের মতো মনে হয় এমন যা গড়ে উঠেছে তা আসলে লুটেরাদৃষ্টির ঐক্য। বাংলাদেশে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বলে যেগুলোকে সেলিম মোরশেদ চিহ্নিত করেন সেগুলোও বড় কর্রেপোরেটদের মতো উদার সংস্কৃতির অধিকারী হতে পারেনি। এদের ধরনধারন ছোটখাট মাস্তানের মতো! এইসব আধা কর্পোরেটদের সঙ্গেও সংগ্রামের জন্যই আমাদের আরো অনেক বেশি বুদ্ধিগত সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। আমরা কেউই তা পারিনি; সেলিম মোরশেদও নয়।
সেলিম মোরশেদকে আমি শ্রদ্ধা জানাই তিনি যোদ্ধা বলে। এই যুদ্ধে তিনি জয়ী হতে পারবেন কিনা তা কারো জানা নেই; কিন্তু লড়াই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন মহান সংশপ্তকের মতো। আমার সত্তার শুদ্ধ অংশ তাই তাঁকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারে না!