:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
গৌতম মিত্র

কবি, প্রাবন্ধিক

আলোর অন্ধত্ব বা অন্ধদের সম্পর্কে যে দু’একটি কথা আমি জানি
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত

আলোর অন্ধত্ব বা অন্ধদের সম্পর্কে যে দু’একটি কথা আমি জানি

গল্প শুরুর প্রথম ৫ লাইনের ৬টি শব্দের ওপর নজর পড়ে আমার।

১. সভ্যতা
২. স্বীকৃতি
৩. সৎ
৪. বিবেকসম্পন্ন
৫. বিদ্যাদর্পী
৬. আত্মবিশ্বাস

শব্দ আমরা সৃষ্টি করি। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে সৃষ্টি করি। যে বস্তু বা ভাবনাকে কেন্দ্র করে এই শব্দ, সেই শব্দের তাতে কিছু আসে-যায় না। দৃষ্টি শব্দটি আমাদের সৃষ্টি আবার অন্ধ শব্দটিও আমাদের সৃষ্টি। তাতে দৃষ্টিসম্পন্নতা ও অন্ধত্বের নিহিতার্থের কিছু ইতরবিশেষ হয় না। ঠিক তেমন সভ্যতা, স্বীকৃতি, সৎ, বিবেকসম্পন্ন, বিদ্যাদর্পী ও আত্মবিশ্বাস শব্দগুলোও আমাদের তৈরি।

সেলিম মোরশেদ তাঁর ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো’ গল্পে প্রমাণ করেছেন আপাত ইতিবাচক এই শব্দগুলো কেমন ঠুনকো। অল্প টোকাতেই কেমন ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ে। আসলে আমাদের ‘সভ্যতা’ একটা বন্দোবস্ত। একটা বোঝাপড়া। সহাবস্থান। যখনই সেখানে আঘাত লাগে দেখা যায় ‘উপরিকাঠামো’ কেমন ভঙ্গুর, ভেতরের কঙ্কাল বা অন্তঃসারশূন্যতা বেরিয়ে পড়ে।

সভ্যতা হয়ে যায় অসভ্য, স্বীকৃতি হয়ে যায় অস্বীকৃতি, সৎ হয়ে যায় অসৎ, বিবেকসম্পন্ন হয়ে যায় বিবেকহীন, বিদ্যাদর্পী হয়ে যায় অবিদ্যা এবং আত্মবিশ্বাস হয়ে যায় অবিশ্বাস। তাছাড়া সমস্ত শব্দের মধ্যেই সেই শব্দের বিপরীতমুখী এক খাদ অপেক্ষা করে। এক স্খলন ও বিপর্যয়।

যেমন বুদ্ধিমাত্রই বিকল্পাত্মক, আর বিকল্প হয় অবস্তুগ্রাহী, সেহেতু অবিদ্যাত্মক। অবিদ্যা সংবৃতিরই নামান্তর। অতএব ইহা নিশ্চিত হয় যে বুদ্ধিতে এমন কোনো সামর্থ্য নাই যাহার যাহার বলে সে পারমার্থিক সত্যকে যথার্থরূপে গ্রহণ করিতে পারে।

গল্পটি খুবই সাধারণ। একটি নামহীন শহর ও কিছু নামহীন মানুষ। সেই শহরে একজন আগন্তুক এসেছে। সে বলে, সভ্যতার নামে সেই দেশের মানুষ আসলে বর্বর। মূলত তারা অসহায় ও বিভ্রান্ত। ভীতু ও অন্তরিত ক্লেদে জর্জরিত। তাদের সূক্ষ্ম পারিপাট্য এতটাই নিম্নমানের, যদি এগুলোকে কাচ হিসেবে ধরা হয়, সন্তানেরা তা দিয়ে ঘুড়ির মাঞ্জাও দিতে পারবে না। ফলত যুবকটিকে সেই তথাকথিত সভ্য শহরের নাগরিকেরা মিলে হত্যা করে। যুবকের মৃত্যু এর পর তাদের এক মহাসঙ্কটে ফেলে। তারা জানতে পারে, যদি তারা নিজেদের চোখ উপড়িয়ে ফেলে তবেই তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ লাভ করতে পারবে।

শুরু হয় অন্ধ হওয়ার পালা। যে যার মতো চোখ উপড়িয়ে ফেলে ছুটতে থাকে সেই সম্পদ পাওয়ার লোভে। সম্পদ তো পায়-ই না বরং এর চোখে ওর চোখ লাগিয়ে ফেলে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে। অতঃপর যা হওয়ার তাই হয়। শহরে অগ্নিকাণ্ড, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। শুধু তাই না, কেরানি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি পেয়ে দেখল তাদের কর্তৃপক্ষের ভেতরে রয়েছে পরিমাণবিহীন ফাঁকির প্রবণতা। স্ত্রী দেখল তার স্বামী অসত্য ও অমানবিক আর স্বামী দেখল তার স্ত্রী অবিশ্বস্ত।

সেলিম মোরশেদ তাঁর ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো’ গল্পে প্রমাণ করেছেন আপাত ইতিবাচক এই শব্দগুলো কেমন ঠুনকো। অল্প টোকাতেই কেমন ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ে। আসলে আমাদের ‘সভ্যতা’ একটা বন্দোবস্ত। একটা বোঝাপড়া। সহাবস্থান। যখনই সেখানে আঘাত লাগে দেখা যায় ‘উপরিকাঠামো’ কেমন ভঙ্গুর, ভেতরের কঙ্কাল বা অন্তঃসারশূন্যতা বেরিয়ে পড়ে।

নীল চোখের একটি মেয়ে ছিল সেই শহরে। কেবল সে অন্ধ হতে চায়নি। গল্পের শেষে দেখা যায়, সেই মেয়েটি অনুভব করছে যে সে অন্ধ হয়ে যাবে। সে বুঝতে পারে সম্পদ তাকে তীব্র আকর্ষণ করছে। সে পুবের পানে ছোটে। মহান সূর্যের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে চায় না। এমনকি কোনো সম্পদের বিনিময়েও না।

গল্পটি পড়তে পড়তে আমার কেন জানি না হোসে সারামাগো’র ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে। সেখানেও এমনই একটি নামহীন শহর ও নামহীন কিছু মানুষ। রাতারাতি তারা এক মহামারীতে অন্ধ হয়ে যায়। একমাত্র ডাক্তারের স্ত্রী সেখানে চক্ষুষ্মান। এই গল্পটির মতোই একসময় তারাও ফিরে পায় দৃষ্টি। এবং দেখে কোনোকিছুর অবস্থানই আর আগের মতো নেই।

আমার মনে পড়ে অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দি কান্ট্রি অব দ্য ব্লাইন্ড’ গল্পটির কথাও। পনেরো বছর ধরে অন্ধ মানুষদের বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে একজন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি এসে পড়েছে। সে ভাবল, অন্ধদের দেশে সে এবার রাজা হবে। কিন্তু ঘটনাপরম্পরায় সে একসময় বুঝতে পারল অন্ধত্ব একটি আপেক্ষিক পরিস্থিতি মাত্র।

সত্যিই তো আপেক্ষিক। জেমস জয়েস ‘ফিনেগানস ওয়েক’ লেখার মতো একটা দানবিক কাজ করেছেন অন্ধ হয়ে। জেমস জয়েস লিখেছেন, ‘আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হল অন্ধ হয়ে যাওয়া’!

সোক্রেতিস তো মনেই করতেন, যে মানুষেরা চোখ দিয়ে দেখেন তারা সব অন্ধ, কেননা সত্য দেখা যায় না’। রুশো তাঁর ‘এসেজ অন দ্য অরিজিন অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘সংগীতকারের একটা বড় জয় অশ্রুত বস্তুকে তারা আঁকতে পারে, চিত্রকরেরা তো কোনোদিনই অদৃশ্য বস্তুকে আঁকতে পারে না!’

এই দ্বৈততা গল্পটির পরতে পরতে। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া, আমিত্বর আশ্চর্যপ্রদীপ পাওয়া বা অমরত্বের মোমবাতি ছোঁওয়া কোনো বাইরের অভিযান করে সম্ভব নয়। আমাদের ভেতরে আছে এক নিভৃত, বিধুর ও উদাসীন সিঁড়ি। সেখানে পা ফেললেই সব পাওয়া যায়। অথবা কিছু না-পাওয়াই সে পাওয়া।

আমাদের রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে, ‘তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ’! আগন্তুক মানুষটি আসলে আমাদের সবার ভেতরে আছে। নীল চুল মেয়েটির মতো শুধু কেউ কেউ তা টের পায়। তখন বাইরের সূর্য নয়, অন্তরের সূর্য জ্বলে ওঠে। তখন মনে হয়, ‘তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ’!

গল্পটি আসলে প্রতীকী। আমাদের চোখের আলোয় চোখের বাহিরে দেখতে শেখায়। তখন ১০ জুন ১৭৬৯-এ লেখা দিদেরোর একটি চিঠির কথা আমাদের মনে পড়বে:
‘আমি না দেখে লিখছি। …এই প্রথম অন্ধকারে কিছু লিখছি। …জানি না চিঠি হয়ে উঠবে কিনা। যেখানে দেখবে কিছু নেই, শূন্যতা, পড়ে নিও আমি তোমাকে ভালোবাসি’!

সেলিম মোরশেদের ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখদুটি বাঁচিয়েছিলো’ গল্পটি পড়তে পড়তে আমি বারবার শূন্যতায় সেই ভালোবাসা পড়ছিলাম।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!