

সেলিম মোরশেদ ও তার গল্প নিয়ে অল্প কথা
সেলিম মোরশেদ আমাদের সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক। আমি যখন ঢাকায় নবাগত, বলছি উনিশ শ ছিয়াশি সালের গোড়ার দিকের কথা, সে সময় সেলিম ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ গল্পকার বন্ধু সাহিত্য করার উদ্দেশ্যে বেশ সংগঠিত। এটা আমি বুঝতে পারি ঢাকাস্থ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, বাংলা মটরের জহুরা মার্কেটে ও শাহবাগের পাপ্পু রেস্টুরেন্টে (অধুনাবিলুপ্ত) তাদের যেসব আড্ডা ছিল সেগুলোতে যোগ দিয়ে। তপন বড়ুয়া সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘গাণ্ডীব’ ও হাবিব ওয়াহিদ সম্পাদিত ছোট কাগজ ‘অনিন্দ্য’কে কেন্দ্র করে সেলিম মোরশেদ ও তার নবীন গল্পকার বন্ধুরা, লক্ষ করি, অল্প দিনের ভেতরেই কেবল সুসংগঠিতই হলেন না, টান টান আত্মবিশ্বাসে রীতিমতো বলীয়ান হয়ে উঠলেন।
প্রসঙ্গত পারভেজের একটা কথা মনে পড়ছে। পারভেজ হোসেন তখন বলতেন, গল্প লিখে যদি কমপক্ষে একশ বছর বাঁচা (মৃত্যুর পর) না যায় তাহলে আর লেখা কেন! কিন্তু সেলিমকে আমার ওই সময় পারভেজের চেয়েও বেশি পোটেনশিয়াল লেখক মনে হত। তার জীবনদৃষ্টি, লাইফস্টাইল, পাঠাভিজ্ঞতা ও কথাবার্তা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল লেখালেখির সেই প্রথম অধ্যায়েই। যদিও আমার প্রথম পরিচিতি কবি হিসেবেই, উত্তরকালে আমি গল্পকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছি। এর অর্থ গল্পের বীজ আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আর সেজন্যেই বোধ হয় নবীন গল্পকারদের আড্ডায় মাঝেমধ্যে সামিল হতাম। ততোদিনে আমি সেলিম মোরশেদের তো বটেই, পারভেজ হোসেন, শহিদুল আলম, তারেক শাহরিয়ার, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, মাখরাজ খান, শামসুল কবীর, মামুন হুসাইন, কাজল শাহনেওয়াজ ও নাসরীন জাহানের একাধিক ছোটগল্প পড়ে ফেলেছি। কথাসাহিত্যের সন্ধিৎসু পাঠকবৃন্দ নিশ্চয় জানেন এই লেখকদের সম্বন্ধে, কম-বেশি যাই হোক। এবং এদের ভেতর অল্প কয়েকজন-যে জীবনভাবনা ও ভাষারীতির বিশিষ্টতায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পেরেছেন পরবর্তী তিরিশ বছরে এটাও, আশা রাখি, তাদের অজানা নয়। এই কথাকার দলের ভেতর সেলিম মোরশেদকে অবশ্যই আমি এগিয়ে রাখব। রাখব প্রধানত তিনটি কারণে।
সেলিম মোরশেদের গল্প-উপন্যাসের ভাষা কাহিনিধর্মী নয়। প্রচল অর্থে তা ঠিক ‘বাংলা কথাসাহিত্যের ভাষা’ও নয়। এবং উপস্থাপনভঙ্গিও গতানুগতিক নয়। সেদিক থেকে দেখলে সেলিমকে আমার কমলকুমার ও সন্দীপনদের গোত্রভুক্ত বলেই মনে হয়।
এবার আমি সেই কারণগুলো ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে সেলিমের অনন্যতার জায়গাসমূহ যথাসাধ্য তুলে ধরব।
১. গোড়া থেকেই লক্ষ করেছি, সেলিম বিখ্যাত হওয়ার অশ্লীল প্রতিযোগে নামেননি। অনেক বছর ধরে নিজেকে ভেতরে-ভেতরে প্রস্তুত করেছেন। জনপ্রিয় লেখকেরা নয় বরং জগদীশ গুপ্ত, অসীম রায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার, গুণময় মান্না, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের মতো ভেতরসন্ধানী ব্যতিক্রমী শৈলীর কথাসাহিত্যিকরা তার বিশেষ পছন্দের।
২. আমরা বড় কাগজে নিজেদের লেখা পত্রস্থ হওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু সেলিম মোরশেদ দৈনিক/মাসিক পত্রিকার সাহিত্যপাতায় নিজেকে বিক্রি করেননি কখনোই। লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সুদৃঢ় অবস্থান ও সাহিত্যিক সততার প্রশ্নে তার এই জেদ বাংলাদেশে বড় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
৩. সেলিম বাস্তববাদী ঘরানার লেখক। তার গল্প–উপন্যাসে জীবনের কঠিন, অসহনীয় বাস্তবতা ধরা দেয় নিরাবেগী ও নিরাসক্ত লিখনভঙ্গিতে। তার গল্পের মানুষজনের মর্মবেদনার রূপকে বোধ হয় চামড়া উঠে যাওয়া বীভৎস কুকুরের চেহারার সাথে তুলনা করা চলে। কিন্তু এটুকু বললেই তাকে পুরোপুরি বর্ণনা করা হয় না। তার গল্পের জগৎ আরও বিস্তৃত।
একদিকে কঠিন বাস্তবতা, অন্যদিকে ফ্যান্টাসির উপাদান এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে রূপকথার আমেজ সেলিম মোরশেদের গল্পে এনেছে নতুন ধরন। ফলে তা এক বিশেষ জাতের স্বাদ উপহার দেয় বটে। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পটিই ধরা যাক। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হেমাঙ্গিনী। হেমাঙ্গিনী ভিখারিনী। তার আর্থিক দৈন্য এতটাই প্রকট যে, এক পর্যায়ে সে তার গোলপাতা-ছাওয়া ঘরে আশ্রিত বিষধর সাপকে চুলার আগুনে পুড়িয়ে খেতে বাধ্য হয়। তারপর আহার-উত্তর বিশ্রামের সময় ভাবে, সাহস থাকলে মানুষ খেতে পায়। এই উপলব্ধি শুধু একজন হেমাঙ্গিনী বা তার স্রষ্টার নয়, বিপুল ক্ষুধার্ত বিশ্বের অমোঘ অনুভব এটা। এখানেই গল্পটি ভিন্ন তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়। ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল’ গল্পে বাস্তবতার মেকি চেহারার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন লেখক। এটা করতে গিয়ে রূপকথা ও ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। বোর্হেস-এর গল্পে এ জাতীয় কৌশল লক্ষ করা যায়।
‘সুব্রত সেনগুপ্ত’ সেলিমের প্রথমদিকের একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। একটি তরুণের বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন ও অনুভবের গাঢ় চিত্রায়ন আছে এতে। প্রথমযৌবনের উপলব্ধিও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তুলে আনা হয়েছে। এই গল্পের আঙ্গিকে যদিও সুবিমল মিশ্র’র ছায়া আছে, তা সত্ত্বেও, জীবনভাবনা ও দৃষ্টিকোণের বিচারে গল্পটি শেষ পর্যন্ত সেলিমশোভন।
সেলিম মোরশেদের গল্প-উপন্যাসের ভাষা কাহিনিধর্মী নয়। প্রচল অর্থে তা ঠিক ‘বাংলা কথাসাহিত্যের ভাষা’ও নয়। এবং উপস্থাপনভঙ্গিও গতানুগতিক নয়। সেদিক থেকে দেখলে সেলিমকে আমার কমলকুমার ও সন্দীপনদের গোত্রভুক্ত বলেই মনে হয়। সেলিম ইতোমধ্যে যথেষ্ট বিখ্যাত। কিন্তু আমার ধারণা তার কথাসাহিত্যের নিজস্বতা ও ওজন পুরোপুরি বুঝবার জন্য পাঠকদের একটা বড় অংশকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।