:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

কবি, অনুবাদক

সেমো’র সংস্পর্শে, উজানস্রোতে
শিল্পকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সেমো’র সংস্পর্শে, উজানস্রোতে

এক. উজানপানে ধাই…

ভৈরববিধৌত অঞ্চল যশোরাদ্য দেশে—যে মানুষটি কী এক অসাধারণ আকর্ষণে আমাদের মোহিত করেছিলেন, সবিশেষ আত্মজ হয়ে উঠেছিলেন— সেই সেমোকে নিয়ে কথা বলাটা আর কারোর জন্যে না হোক— আমার জন্য যথেষ্ট ঝুঁকির। আবার আনন্দেরও। তাঁর সাথে সংশ্রবে অনেকের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে। যাপিত জীবনে সফল হতে পারিনি—এ অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা। প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিন্তা-চেতনায় শামিল হওয়ার খেসারত নাকি আমার আধেক জীবন!

সেসব থাক। একটু বলি। আমি যে পরিবারের সন্তান—সেখানে আরেকটা সুযোগ ছিল আমার বড় মোল্লা-পুরুত হওয়ার। কারণ পিতাজি ছিলেন এই অঞ্চলে খুব নামকরা মাওলানা। আমি যেহেতু পিতার লাইন ধরিনি— তাই এঁদের অনেকেই বলেছেন,আমি আমার জীবনকে বিসর্জন দিয়েছি। তাঁরা মনে করেন, গোল্লায় গিয়ে বিষ অর্জন করেছি। সবারই গল্প থাকে কিছু হতে পারা, কিছু না-হতে পারার। যেমন অমলকান্তি’র কষ্টটা আমরা জানি। অমলকান্তি নাকি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। কিন্তু সে রোদ্দুরও হতে পারেনি।

বৈষয়িকভাবে যে উঁচু মাকামে বা তবকায় আমার থাকার কথা— তা না হয়ে জীবনে বিষ-অর্জনই কি শুধু করলাম? প্রশ্নটা ঘুরে ঘুরে আমাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে। নানাভাবে বন্ধুত্বের খাতিরে আমরা যেসব মনিষ্যির সাথে মিশেছি—তাদের ভাবনায় হতে পারে বোলতায় রূপান্তরিত হয়েছি। যেমনটি রুমির কবিতায় উপমা হয়ে বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। ‘ফুল থেকে মধুমক্ষিকা আহরণ করে মধু, আর বোলতা বিষ।’

আমার জীবনে কি এর সাজুয্য রয়েছে? যে জীবন বহন করেছি—তার তাৎপর্যটা এখনো আমি যুঝে নিতে পারিনি।

তবে এখনও উজানেই গন্তব্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে শেষ-মেশ। সেই রুচিকে বদলাতে পারিনি। তাই ব্যর্থতা আমাকেও গ্রাস করে আছে। সুবিধাবাদের জিহ্বা একটু লকলক করলেই, আবার নিজেকে কোটরে স্থাপন করি। সেই আজব কোটরেই তর্জনী উঁচিয়ে রক্ষা করি ‘প্রাণভোমরা’।

তখন নব্বই দশকের শুরু। আর্টের প্রতি মোহগ্রস্ত। চিন্তাবিকাশের জন্য আলাদা বন্ধুবলয়ে  শরিক হলাম। বন্ধ দুয়ার খুলে তুমুল আলো-হাওয়ায় যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছি মনে হল। নিজের খোলা দরজায় যেখানে আমি প্রহরী, সেখানেই এক সিংহপুরুষ নিশ্চিতভাবে সেলিম মোরশেদ।

সেমো তিনি একজন ব্যর্থ পুরুষ। আমার চে’ যোজন যোজন দূরত্বে তাঁর ব্যর্থতা। সবাই যেটা পারে, সেটা তিনি পারেন না। এটা কি ব্যর্থতা না? তার মানে আমাদের পরিচিতজনরা যখন সবাই সুযোগ নিচ্ছে, বৈষয়িকভাবে স্ফীত হচ্ছে— তখন তিনি তরুণদের প্রশ্রয় দিয়ে নিজেকে শূন্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের সংসার, সন্তান সবকিছু তছ-নছ। তবু তিনি চিতা, দার্ঢ্য।

আঠাশ-ঊনত্রিশ বছরের সংশ্রব বা সহবতে এটাই প্রামাণ্য দলিল। তিনি কখনো আপোষ করতে পারেননি। এটা করতে না-পারাটাই তাঁর জীবনের বড় ব্যর্থতা!(?)

সাহিত্য-সংস্কৃতির সূতিকাগারখ্যাত এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তাকাঠামোটাই স্বাধীনতাপ্রিয়। নৃ-তাত্ত্বিকভাবেই বোধ হয় এমনই। তা পুনর্বার প্রোজ্জ্বল হল কতিপয় তরুণের কাছে সেদিন।

এখানের হাওয়ায় এস এম সুলতান, মধুসূদন, ফররুখ, আজীজুল হকের মতো গুণী কবি সাহিত্যিকদের কথা শোনা যায়। সেই শোনার মধ্যে সংস্কৃতির জড়তাকে ছিন্ন করার প্রণোদনা জাগরিত হয়। কেননা তাদের নির্মাণ-বিনির্মাণের কুশলতায় সমৃদ্ধ হয়েছে এই জনপদ।

আদমকে এই মাটির সন্তান করে তোলার প্রচেষ্টা সুলতানের, মধুসূদনের ‘রাবণ বিনির্মাণ’, ফররুখের নতুন ভাব ও ভাষানুসন্ধান এবং আজীজুল হকের শব্দদ্যোতনায় ‘চিন্তার সাম্প্রতিকতা’র সুনিপুণ বিন্যাস—সৃষ্টিউল্লাসে দৃঢ় করে তারুণ্যকে।

সেই উদ্দীপ্ত তারুণ্যের সামনে— গৌরবময় যশোরে নব্বই দশকে ভাঙা-গড়ার সংস্কৃতির মেলবন্ধনে সেলিম হয়ে ওঠেন অনিবার্য ব্যক্তিত্ব। কবি মারুফুল আলম,পাবলো শাহি, অসিত বিশ্বাস, দুর্বাশা দুর্বার, তরুণ ভট্টাচার্য্য, টিটো জামান, মাশুক শাহি, মহিউদ্দীন মোহাম্মদ, সৈকত হাবিব, শেখ সিরাজউদ্দীন, মাসুমুল আলম, অতীন অভীক, ওয়াহিদুজ্জামান অর্ক, কবির মনি, মহসীন রেজা, সাদি তাইফ, আজিমুল হক, চিত্রশিল্পী মোজাই জীবন সফরী, তাবিথা পান্না, সাহিদুর রহমান, অন্যুন পৃন্স, জন প্রভুদান প্রমুখের কাছে নিপুণভাবেই উপস্থাপিত হয়েছিলেন তিনি বা আমাদের সেলিম ভাই। তার প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবনাকে লালন করে উজানপানে ধেয়ে যূথবদ্ধ আন্দোলনের মন্ত্রণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেকে।

সবাই একসাথে থেকে সোৎসাহে লিখেছেন— কবিতা, গল্প, নাটক, গান, চিত্রনাট্য, নৃত্যনাট্য। এঁকেছেন ছবি, করেছেন আবৃত্তি।

এসব করে সফলতা কোথায়? আমি জানি না। তবে এটা বুঝেছি তখন সাপের মুখে পা দিয়ে আমরা নেচেছি। ডিঙ্গা ভাসিয়েছি সাগরে। সফলতার উত্তর অন্যভাবে খুঁজেছি।

বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি ঢোলকমলের। তাঁর গানের চরণে যেমনটি রয়েছে— বন্ধুর পিরীতি যেন ঢোল কমলের বিষ।…

আমার মনে আছে একবারের কথা। আজিজুল হক, নকশাল বিদ্রোহের শেষসূর্য— তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— ‘জনযুদ্ধ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ সম্পর্কে। ”প্রচল স্রোতের উল্টোদিকে বা উজানে রূপালি পুঁটিগুলোকে উঠে আসতে দেখেছেন? এই আসার লড়াইটা মূলত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।” এভাবেই বলেন তিনি। আমিও হয়তো সেই উজানেরই একটি ছোট্ট পুঁটি।

সেমো তিনি একজন ব্যর্থ পুরুষ। আমার চে’ যোজন যোজন দূরত্বে তাঁর ব্যর্থতা। সবাই যেটা পারে, সেটা তিনি পারেন না। এটা কি ব্যর্থতা না? তার মানে আমাদের পরিচিতজনরা যখন সবাই সুযোগ নিচ্ছে, বৈষয়িকভাবে স্ফীত হচ্ছে— তখন তিনি তরুণদের প্রশ্রয় দিয়ে নিজেকে শূন্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের সংসার, সন্তান সবকিছু তছ-নছ। তবু তিনি চিতা, দার্ঢ্য।

দুই. যূথবদ্ধতার প্রাকপাঠ

মজা জলাধারের কি কোনো দাম আছে? না। তাই তরুণেরা মজা জলাধারকে স্রোতময়-গতিশীল করে। ধ্বজাকে সামনের পানে নিতে বদ্ধপরিকর তারা। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছিল।

তখন এখানকার দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান—যশোর ইনসটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি ও যশোর সাহিত্য পরিষদে আলাদাভাবে সাহিত্য আসর হত। পাবলিক লাইব্রেরিরটার নাম ছিল ‘শনিবাসর’। সাহিত্য পরিষদেরটা ‘রবিবাসর’। সপ্তাহের দুটো দিন সাহিত্যকর্মীরা তাঁদের কর্মযজ্ঞ হাজির করতেন। পাঠ করতেন। কেউ বিচারকের আসনে বসে ভুলচুক ধরিয়ে দিতেন। তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-পর্যালোচনা চলত অনেকক্ষণ ধরে।

যশোর সাহিত্য পরিষদের রবিবাসরে কোনো কোনো দিন হাজির থাকতেন পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি আজীজুল হক। তাঁর হাতে বহু প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। তাঁর আকাঙ্ক্ষাটা বোঝা যেত। তিনি চাইতেন, এখানকার তরুণেরা যেন আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠেন। তাঁকে কখনো সুবিধাবাদীর ভূমিকায় দেখা যায়নি। সে কারণে আমরা বলতাম— তিনি কার্যত অপ্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতাকে লালন করেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তা ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।

তাঁর কথা আনছি আরেকটা কারণে। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা ব্রিজের উত্তরপাশে তখন ‘কালপত্র বইসমাবেশ’ নামে বিভূতোষ রায়ের একটা বইয়ের দোকান ছিল। যেটা মূলত চালাতেন কবি সৈকত হাবিব। এখানে দিনের অধিকাংশ সময় সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত বিভিন্ন জন হাজির হতেন। গুণীজনেরা আসতেন দেশের নানাপ্রান্ত থেকেও।

আজীজুল হক ও সেলিম মোরশেদকে আমরা একসাথে পেয়ে অনেকদিন জমজমাট আড্ডা দিয়েছি।

আমরা যারা নিয়মিত রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আড্ডা মেরেছি কালপত্রসহ বিভিন্ন জায়গায়— তাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি লিটলম্যাগ নিয়ে নতুনভাবে ভাবার চেষ্টা চালাতে থাকেন। কেননা যশোরে চর্যা, শালপ্রাংশু, প্রমা, বিবর, স্বরবর্ণ, প্রহর-এসব নামে অনেক লিটলম্যাগ ছিল।

তার পরেও আবার নতুন করে কেন? তখন আমাদের মধ্যে একটা অতৃপ্তি কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, এগুলো বড় কাগজের সাহিত্যপাতায়, কিংবা সমাজে অন্যকোথাও সুবিধা নেয়ার জন্য পা-দানি তৈরি হচ্ছে।

বাস্তবত— এ-ভাবনায় জারিত হয়ে ভিন্ন মাত্রার একটা পত্রিকা করা যায় কীভাবে তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। আমরা—কবি মারুফুল আলম, অসিত বিশ্বাস, সৈকত হাবিব, মহিউদ্দীন মোহাম্মদ পরস্পর মতবিনিময় করে একটা প্রকৃত লিটলম্যাগের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হই। এ মর্মে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের সাথে চলে আলোচনা-পর্যালোচনা।

তবে সবাইকে লেখালেখির জন্য তৈরি হতে বললেও আমরা দুজন—মারুফ ও আমি ভাবতে থাকি খুবই বৈশিষ্ট্যময় পত্রিকা করা যায় কীভাবে সেটা নিয়ে। মারুফ বার বার দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন শক্তিশালী লিটলম্যাগের উদাহরণ টেনে আনতে থাকে। তবে আমাদের কাছে প্রথমভাগে বড় উদাহরণ হিসেবে আসে ‘গাণ্ডীব’ পত্রিকাটি। এটি সংগ্রহ করি সম্ভবত যশোরের একটি সংবাদপত্রের এজেন্টের কাছ থেকে।

মারুফ জানায় ‘গাণ্ডীবে’ যশোরের একজন বড় লেখক আছেন। তাঁর নাম সেলিম মোরশেদ। তিনি ভীষণ রাগী মানুষ। তাঁর কাছ থেকে কোনো পরামর্শ নিতে পারলে ভালো হত।

মারুফকে বললাম— আমরা কি পারব ওরকম পত্রিকা করতে? বলল— ‘কেন না? আমরা অবশ্যই পারব।’ ও কখনো হারার লোক না।

আমি আর মারুফ একদিন শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোতোয়ালি থানার মোড় পর্যন্ত এসেছি। ও আমাকে বলল, ‘আমরা যে পত্রিকাটি করতে যাচ্ছি তাতে একসাথে সবাই পাঁচবছর মতো লিখব, এই ফাঁকে কেউ কোথাও কোনো পত্রিকায় লেখা দেব না। আমি বললাম, ঠিক আছে তাই হবে। আমার কিছুটা আলস্য ছিল। তবে ওর সাথে থেকে সাহসী হয়ে উঠতাম ক্ষণে ক্ষণে।

এভাবে চিন্তার আদান-প্রদান চলতে থাকে। একদিন রবিবাসর-শেষে পরিচয় হল সেলিম মোরশেদের সাথে। খুব রাশভারী লোক। মোটা গোঁফঅলা। শব্দের প্রক্ষেপণ খুবই চমৎকার। মারুফুল আলম আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

শুরু হল আলাপচারিতা। আমরা তাঁকে একটা পত্রিকা করব বলে সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। তিনি আমাদের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলেন। তাঁকে আমরা অনুরোধ করলাম একটা গল্প দিতে। তিনি বললেন, কার্যক্রম দেখে তার পর আমি লেখা দেব। পরে অবশ্য তাঁর ‘বদ্ধ’ গল্পটি দিয়েছিলেন আমাদের।

ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে আড্ডা। কখনো কালপত্রে, কখনো টাউল হল মাঠে (মুন্সী মেহেরুল্লাহ ময়দান)। আড্ডায় হাজির হতে থাকলেন শহরের সৃজনশীল তরুণেরা। সবাই উদ্বুদ্ধ। সেমো’র কথায়, আলোচনায় মন্ত্রমুগ্ধ। আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে এসে জড়ো হই। দিনের অনেকাংশ কালপত্রে কাটে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হাজির হতাম সকলে।

পত্রিকার কাজ এগোতে থাকে। সম্পাদনা পরিষদ করা হল পত্রিকাটির। পরিষদে মারুফুল আলম, অসিত বিশ্বাস, সৈকত হাবিব ও মহিউদ্দীন মোহাম্মদ এই চারজনকে রাখা হল। অন্য কারোর পরে ভরসা করা যাচ্ছিল না।

পত্রিকাটির নাম কী হবে? তাই নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। কজন কয়েকটি নাম প্রস্তাব করলেন। পরে সেলিম ভাই আর মারুফ মিলে ফাইনাল করলেন, পত্রিকার নাম হবে ‘প্রতিশিল্প’। শেষমেশ পত্রিকাটি প্রকাশ পেল ‘৯৪-এর মার্চে। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা অতটা আশাব্যঞ্জক না হলেও—ওয়েলডান হাফডান হয়েছিল।

এরপরের ইতিহাস তো জানেন সকলে। গাণ্ডীবের স্থলে প্রতিশিল্প হয়ে উঠল বাংলাদেশের কার্যত অন্যতম ছোটকাগজ। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র। সেলিম ভাই আর আমাদের পথচলা যূথবদ্ধভাবে চলতে থাকল সেই থেকে।

মাত্র তাঁর বয়স আঠারো যখন—সেলিম চৌধুরী নাম নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন যিনি—সেই তিনি খ্যাতির মোহ ত্যাগ করে, সবকিছু ছেড়েছুড়ে—তাঁর একটাই ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল প্রকৃত ছোটকাগজ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া। আমরা তাঁর সেই চিন্তার সাথে যুগপৎভাবে থেকেছি।

সেলিম ভাই আমাদের নিয়ে যে কাজটি শুরু করলেন তা হচ্ছে— সবাইকে মেধা-মননে প্রস্তুত করা। মাটির ঋণ হয়তো শোধ করতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রথম প্রথম সেটাই মনে করতাম। আমরা পড়াশুনো শেয়ার করতাম তাঁর সাথে। তিনি আমাদের হরপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ভীমসেন যোশী, ওস্তাদ আলউদ্দীন খাঁ, বিসমিল্লাহ খাঁ, উদয়শংকর সম্পর্কে যেমন বলতেন, একই সাথে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হোর্হে লুইস বোর্হেস, সল বেলো, দস্তয়ভস্কি, জেমস জয়েস, আলবেয়ার ক্যামু…

তিন. মর্মর মুখরিত সন্ধ্যায়…

মানুষ হল অমিত সম্ভাবনাময়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক সংঘর্ষের। এমন অনেক বাক্য মননে ফেরি করে অনেক রাতে ফিরেছি বাড়ি। যশোরে অবস্থান করলেই সন্ধ্যায় সেলিম ভাইয়ের ঠিকানা ছিল টাউন হল মাঠ। সেখানেই চিন্তাবিনিময় হত। মুখরিত সন্ধ্যাগুলো অতিবাহিত হয়েছে সদানন্দে। তাঁর কথাগুলো স্মরণে রাখার চেষ্টা করতাম সবসময়।

সেলিম ভাই আমাদের নিয়ে যে কাজটি শুরু করলেন তা হচ্ছে— সবাইকে মেধা-মননে প্রস্তুত করা। মাটির ঋণ হয়তো শোধ করতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রথম প্রথম সেটাই মনে করতাম। আমরা পড়াশুনো শেয়ার করতাম তাঁর সাথে। তিনি আমাদের হরপ্রসাদ চৌরাশিয়া, ভীমসেন যোশী, ওস্তাদ আলউদ্দীন খাঁ, বিসমিল্লাহ খাঁ, উদয়শংকর সম্পর্কে যেমন বলতেন, একই সাথে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হোর্হে লুইস বোর্হেস, সল বেলো, দস্তয়ভস্কি, জেমস জয়েস, আলবেয়ার ক্যামু, কাফকা, ইয়ুং, পাভলভ, জ্য লুক গদার, আদুর গোপালকৃষ্ণাণ, ঋত্বিক ঘটক, আইজেনেস্টাইন, আন্দ্রে তারকাভোস্কি, পিটার বিকসেল, নিকোনার পাররা, স্যামুয়েল বেকেট, ব্রেখট—এরকম অনেকের বিষয়ে পড়ার তাগাদা দিতেন। তাঁর আলোচনায় উঠে আসতেন সুবিমল দা। অমিয়ভূষণ মজুমদারের কথাও আসত  প্রায়শ।

কখনো গ্রামসি, লুনাচারস্কি, ট্রটস্কি, স্ট্যালিন, মাওজে দাং, খ্যাম্বো, জ্যাক দেরিদা, জ্যাঁ ককতো—আরো কত কত গুণী মানুষের কথা বলতেন—তার ইয়ত্তা নেই।

কথার প্রসঙ্গক্রমে সতীর্থদের কথা খুব বলতেন। সাজ্জাদ শরিফ, শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, আহমেদ নকীব, রোকন রহমান, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, হাবিব ওয়াহিদ, মুহাম্মদ খসরু, তপন বড়ুয়া—এঁদের কথা ঘুরে ফিরে আসত।

কখনো সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সুমন রহমান, এবাদুর রহমান, ব্রাত্য রাইসু—তাদের কথা বলতেন কবিতা গল্পের আলোচনায়। আবার পারভেজ হোসেন, মামুন হুসাইন, নাসরীন জাহান, তারেক মাসুদ, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, তারেক শাহরিয়ার, শহিদুল আলম, মুসা কামাল মিহির, হোসেন হায়দার চৌধুরী—এঁদের কথা যে কতবার ঘুরেফিরে এসেছে তা বলা যাবে না।

তাঁর আলোচনায় উঠে আসত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আল মহমুদ, শওকত আলী প্রমুখের কথা।

সেলিম মোরশেদ অত্যন্ত প্রখর স্মৃতির মানুষ। যার কথা যখন বলেন অত্যন্ত সচেতনভাবেই তার পূর্ণাঙ্গটা এক লহমায় বলে ফেলেন। তাঁর কাছ থেকে অন্য তরুণদের মতো আমিও বহুকিছু শিখেছি। এখনও শিখি।

তিনি একটা জিনিস স্পষ্ট বলতেন, ব্যাপক পঠনপাঠন ছাড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া যায় না। ছোটকাগজ-অলাদের পড়ার বিকল্প নেই। আমরা তাঁকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতাম। এসবই করতাম প্রতিষ্ঠানবিরোধী মুভমেন্টের স্বার্থে।

টাউন হলের মর্মর সন্ধ্যাগুলো চিন্তা-চেতনায় শাণিত করেছিল তরুণদের। যাদের এখন অনেকের বয়স ৪০ থেকে পঞ্চাশের ভেতরে। কেউ বা পঞ্চাশ পেরিয়েছে। বিকল্পধারার লেখালেখিতে মনোযোগী হয়ে লিখছেন নিয়মিত। প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিন্তায় এখনো শাণিত। এই আড্ডায় আরো পরে সামিল হয়েছিলেন— নাভিল মানদার, অভিজিৎ বসু, বিপুল বিশ্বাশ, আশিক রেজওয়ান, মিনু মৃত্তিক, বাবুল কল্যাণ। এছাড়া যুক্ত হয়েছিলেন আদিত্য শাহীন, মিলন মাযহার, শাহীনুর রহমান, মুবাশ্বির আলম মজুমদার, হাবিব আহসান, শাহ্জালাল খান প্রমুখ।

বিভিন্ন সময় সঙ্গ দিয়েছেন শিল্প অন্তপ্রাণ বিভুতোষ রায়, শিকদার খালিদ, রাশেদ সুলতান, উইলিয়াম হাসান, ময়েজ উদ্দীন লিটন, গুণী ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদ। বরাবরই উজ্জ্বল উপস্থিতি তখন থেকে এখনো অবধি গুণীচিত্রকর সোহেল প্রাণনের। আজও সারথি সবাই। প্রত্যেকে নিরন্তর শিল্প ও সাহিত্য সাধনায় মগ্ন।

সেলিম মোরশেদের কল্যাণে বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব তখন যশোরে এসেছেন। আমাদের আড্ডায় হাজির হয়েছেন যুক্তাক্ষর পত্রিকার সম্পাদক পশ্চিমবাংলার কবি গৌতম চৌধুরীসহ অনেক সুসাহিত্যিক। তাঁদের অনেকের কথা এখন আর মনে নেই।

যে যেভাবেই ভাবুক বা বলুক আমার পর্যবেক্ষণ— উন্মুক্ত ময়দানে ঘাসের ‘পরে বসে তরুণদেরকে শাণিত করতে সেমো নিজেকে ব্যয় করেছিলেন উদারচিত্তে। এটা না করলেও পারতেন। তাতে হয়তো তাঁর আরো লেখালেখি বৃদ্ধি পেত। কিন্তু যূথবদ্ধ আন্দোলনের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো তিনি।

আগেই বলি, আমরা সেলিম মোরশেদকে কাছে পেয়ে যারপরনাই প্রাণিত হয়েছিলাম। যে কারণে ‘প্রতিশিল্প’র প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়— ‘আশির দশকের ছোটকাগজ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা;‌ ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’র জনক সেলিম মোরশেদ জড়িত হলেন আমাদের সঙ্গে। যিনি আশির দশকের গল্পের প্রকরণের পাল্টাধারা তৈরী করেছেন।’

চার. প্রসঙ্গত পাল্টা কথার সূত্রমুখ

বাংলাদেশে এখনো দেখি অনেকে প্রশ্ন করেন প্রতিষ্ঠান ও অপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। অনায়াসে তর্ক জুড়ে দেন। তাদের কাছে কোনো স্বচ্ছ কনেসেপ্ট নেই বোধহয়। আশি এবং নব্বই দশকে মূলত এই আন্দোলন চাঙ্গা হয়েছিল। নানারকম প্রশ্ন উঠে আসছিল তরুণদের কাছ থেকে। যারা একসময় শামিল ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে তারা উটপাখির চরিত্র অবলম্বন করতে থাকলেন। তুমুল বালিঝড়ে মাথা গুঁজে দিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে— অন্ধ হলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকবে না। সুধীন যেমনটি ‘উটপাখি’ কবিতায় বিবৃত করেছেন। ‘প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত, বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা।’ – এই অবস্থা সেলিম ভাইয়ের সেদিন থাকেনি। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম তিনি— ‘সে-পাড়া-জুড়নো বুলবুলি নন’। এই ধ্বংসের দায়ভাগে আমরা সমান অংশীদার। সুতরাং ‘আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার’ যেহেতু রয়েছে, সেহেতু ভবিষ্যতের তরুণদের সামনে বিষয়গুলো স্বচ্ছ হওয়া দরকার।

আগেই বলি, আমরা সেলিম মোরশেদকে কাছে পেয়ে যারপরনাই প্রাণিত হয়েছিলাম। যে কারণে ‘প্রতিশিল্প’র প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়— ‘আশির দশকের ছোটকাগজ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা;‌ ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’র জনক সেলিম মোরশেদ জড়িত হলেন আমাদের সঙ্গে। যিনি আশির দশকের গল্পের প্রকরণের পাল্টাধারা তৈরী করেছেন।’

পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা বেরুনোর কিছুদিনের মধ্যেই তোড়জোড় শুরু হল দ্বিতীয় সংখ্যা করতে হবে। যথা-আজ্ঞা কাজ শুরু। সব কাজ যখন শেষ পর্যায়ে, তখন আমরা সেলিম ভাইকে প্রস্তাব করলাম মুভমেন্টের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দিতে না পারলে নানারকম সুবিধাবাদী লোকজন ঝামেলা পাকাচ্ছে। প্রকৃত ছোটকাগজ না এমন কিছু জঞ্জাল তৈরি করে কিছু ব্যক্তি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে লেখালেখি হওয়া দরকার। আমরা তাঁকে প্রস্তাব করলাম— আপনার সাথে সবাই মিলে কথা বলব বা আলাপচারিতা করব। এর সারনির্যাস ছাপা হবে প্রতিশিল্পে। সেইমতো পাল্টা কথার সূত্রমুখের সূচনা। [প্রসঙ্গত, কোনো এক ব্যক্তির একক প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এটা না। কেউ একজন দাবি করেন— তার প্রশ্নের উত্তরেই নাকি সেমো এসব কথা বলেছিলেন। তাছাড়া তার দাবি প্রতিশিল্পের শুরুতে ইশতেহারের মতো যেটা লেখা হয়েছিল সেটার রচয়িতা তিনি। এমন দাবি যিনি করেন তিনি চূড়ান্ত মিথ্যা বলেন।]

পরে তো সেটা পরিশিলীতভাবে গ্রন্থ আকারে ২০০২ সালে ‘প্রতিশিল্প’ বের করে। এ বইটিতে অনেক বিষয়ের উত্তর খুব গোছালোভাবে দেয়া আছে। এগুলো প্রত্যেকের পড়া দরকার। এই বইয়ে অনেকের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। কার কী অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ’ সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলা যায়। আরেক অর্থে পথনির্দেশিকা হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকদের তালিকা। নব্বই দশকের কবি ও গল্প লেখকদের সম্পর্কে দেয়া আছে সুস্পষ্ট ধারণা।

এই বইয়ের আরেকটা ফজিলত হল— সেলিম মোরশেদের লেখালেখি বোঝার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় বটে। এই বইটি উৎসুক লোকজনের সংগ্রহ করা উচিত। এর ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার।

আজও  সমাজে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন এবং ছোটকাগজের প্রয়োজনীয়তা যেহেতু ফুরিয়ে যায়নি, বরং পুঁজির ব্যাপক স্ফীতিতে অনুভূত হচ্ছে; তাই কথার পীঠে কথা হওয়া দরকার। নতুন মাত্রায়, নতুন ভাবে সেই আগুন সবখানে ছড়িয়ে দিতে কিংবা কথার সূচনা পুনঃপুনঃ করতে অনবদ্য পুস্তক ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ’।

 

পাঁচ. সমাপিকা বা যে সত্য উচ্চারি বারে বার…

মানুষ অতিশয় স্মৃতিপ্রিয়। সেই অর্থে আমিও তার বাইরে নই। সেদিনের সেই মন্ত্রমুগ্ধ দিনগুলো যেমন মনে পড়ে, সাথে অনেক গভীর কষ্ট। সেলিম মোরশেদের একমাত্র পুত্রের শিক্ষক হয়েছিলাম ক্ষণকাল। খুবই প্রতিভাধর এক কবি। সঞ্চয় প্রথম। তাকে পড়াতাম ক্লাসের বই। কখনো কখনো ছন্দশাস্ত্র। আরো অনেক কিছু শেয়ার করতাম। সেলিম ভাই বাবা হিসেবে ছিলেন খুবই দায়িত্বশীল। তবু অনন্তের কাছ থেকে তাকে ফেরানো যায়নি।

অনেক গভীর কষ্ট তিনি ভেতরে ভেতরে লালন করলেও কখনো কাউকে বুঝতে দেননি। মুভমেন্টের স্বার্থটাকেই জীবনে বড় করে দেখেছেন। এজন্য কিশোরবয়সে বা তরুণবয়সে তাঁর যে সংশ্রবে থেকেছি মনে হয়—জীবনে অনেক বড় পাওয়া। কবি মুন্সী মেহেরুল্লাহ্‌র একটা কথা আছে— ‘ভাবো মন দমে দম, রাহা দূর বেলা কম।’ এই যে রাহা বা রাস্তা তা এখনো অনেক দূর বাকি, কিন্তু সময় অতি সংক্ষিপ্ত। মনকে শ্বাসপ্রশ্বাসে সেটাই ভাবতে বলি। ভাবতে বলি মনুষ্যসকলকে।

আমাকে নিয়ে সেমো’র অনেক চাওয়া ছিল, যা আমি পূরণ করতে পারিনি। যেটা মুভমেন্টের অনেক কাজে আসত। সেই আফসোসহ বিগত সোনালি অতীতকে মনে করে ‘পলাতকা’য় সুধীন দত্তকে কণ্ঠস্থ করি—

“কী যেন হারায়ে গেছে জীবন হতে,
কী যে তার বুঝিবে কে বা কেমন মতে।
শুধু জানি এইটুক,
কী এক বিপুল দুখ
ভ’রে দেছে সারা বুক গোপন ক্ষতে।
কী যেন হারায়ে গেছে জীবন হতে।।’

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!