

…আমার যাপিত জীবনের সাথে যেভাবে সহযোগীমূলক মনোভাব পোষণ করছেন, কেউ তা করে না: সেলিম মোরশেদ
পারভেজুর রহমান: ‘সাপলুডু খেলা’ যদিও উপন্যাস, তবু একটা সময়ের ডকুমেন্টারি— এই মন্তব্য কতখানিক যথার্থ? আপনার কি মনে হয়?
সেলিম মোরশেদ: কথাটা সত্য। ইতিহাসের সেইসব উপাদানগুলো যা আত্মস্থ হয়ে চরিত্রের সংলাপে এসেছে। অর্থাৎ চরিত্রের মিথস্ক্রিয়ায় সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথাগুলো এলো। HISTORY থেকে HI-টা বাদ দিলে STORY থাকে। আখ্যানের বিন্যাসও এজন্য অন্যরকমও হয়েছে।
পারভেজুর রহমান: বর্ণনায় টানা গদ্যে লেখা। আপনি এটিকে ‘এন্টি-ন্যারেটিভ’ আখ্যান বলছেন, কেন?
সেলিম মোরশেদ: একটি কাহিনি, আখ্যান, বিষয় বা বিষয়বস্তুর কন্সিস্টেন্সি অর্থাৎ আদি-মধ্য-অন্ত’র যে প্রথাগত ঐক্যের বন্ধন, সেটা অন্তর্গত পর্যায়ে নানা ট্রিটমেন্টের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। উপরিকাঠামো দিয়ে নয়। আবহ-কেন্দ্রিক বা ঘটনায় পাতা কে পাতা যে বর্ণনা এটা করা হয়নি। মনে হয়েছিল দাবিও করে না। এই অর্থে আমি এটাকে এইভাবে বলেছি।
পারভেজুর রহমান: চরিত্রগুলোকে মনে হয়েছে তার নিজের মতো করে বিস্তৃত হয়েছে। লেখকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবল লেখক যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। তাই রিপোর্টিং মনে হয়েছে অনেক সময়। এটা রীতি অনুসারে কোন ধারার অন্তর্ভুক্ত?
সেলিম মোরশেদ: যেহেতু একটা নিটোল কাহিনি তৈরি করার ইচ্ছা ছিল না, ফলে চরিত্রগুলো নিজের মতো করেই চলেছে। নিজেও বোধহয় অজ্ঞাতে দেখতে চেয়েছিলাম, চরিত্রগুলো আমার দেখাটা নিচ্ছে কিনা। একজন উন্নত পাঠকই পারেন এই ধারাটিকে বিচার করতে, আমি হয়তো না।
পারভেজুর রহমান: এইরকম একটা আখ্যান বা উপন্যাস পাঠক-জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, অল্পসংখ্যক জন এর পাঠক, আপনার কী মনে হয়? কোনো টার্গেট রিডার আছে কিনা?
সেলিম মোরশেদ: তিরিশ-চল্লিশ বছর লেখার পরে একজন লেখকের তো নিজস্ব একটা পাঠকগোষ্ঠী থাকেই। সেটা কোন গোষ্ঠী সেটা হয়তো বিশ্লেষণ করা সবসময় হয়ে ওঠে না। সেখান থেকেও পাঠকের নানারকম মতানৈক্য কিংবা মতৈক্য থাকে। তো পাঠক-জনপ্রিয়তার কথা ভেবে এটা লিখিনি আমি। জনপ্রিয় না হবার সম্ভাবনাটাই বেশি। অনুগামী পাঠক যাঁরা, এ বইটার উপরে উনিশ বছর ধরে কম-বেশি তাঁরা লিখেছেন। আমার যতগুলো বই, তার ভেতরে সবচেয়ে বেশি এই উপন্যাসটির উপরেই লেখা হয়েছে। বিক্রি, সেটা তো ক্রিটিক্যাল বিষয়। বলতে পারব না। একজন বুদ্ধিমান প্রকাশকের দায়িত্ব সেটা।
পারভেজুর রহমান: আখ্যানটি কোনো পরিচ্ছেদে বিভক্ত না। সাধারণ উপন্যাসে যা থাকে। বর্ণনার টেকনিকে—কখনো তৃতীয় পুরুষ থেকে উত্তমপুরুষে, আবার সেইখান থেকে তৃতীয় পুরুষে অনিয়মিত ভাবে পর্যায়ক্রমে বলে গেছেন । যেই সময়ে আপনি লিখেছেন সেই সময়ে এটা নতুনত্বই বলা চলে। এই টেকনিক আপনি তখন কিভাবে পেলেন? আর পাঠকের জন্য কতখানি সহনীয়— এই চিন্তাটা কাজ করেছিল কিনা?
সেলিম মোরশেদ: আমার কোনো লেখা কখনো পাঠকের দিকে তাকিয়ে হয় না। আমার মনন থেকে হয় আর আমার চিন্তা থেকে। টোটাল বিষয়টা খুব যে পরিকল্পিত বা পরিকল্পনা করে লেখা তা না। লেখার যে বিভিন্ন কারিগরি দিক আপনি অবলোকন করেছেন, নিশ্চয়ই তা হবে লেখকেরই উদ্ভাবন। এ ছাড়া আর কী বলবো?
পারভেজুর রহমান: যেহেতু ‘সাপলুডু খেলা’ একটা নির্দিষ্ট সময়ের গল্প তবু বর্ণনায় এবং সংলাপের ভিতর দিয়ে ব্যক্তিসঙ্কট, শ্রেণিদ্বন্দ্ব, ইতিহাসক্রম, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মবোধ, কমপ্লেক্স, রাজনৈতিক দর্শন, ক্রাইসিস এবং অস্থিরতা—সব মিলে পুরো একটা ট্রাজেডিক মহাকাব্য যেন। কিন্তু ট্রাজেডি হয়েও আশাবাদী, আপনার মন্তব্য কী?
সেলিম মোরশেদ: আসলে যে অর্থে আমরা সাহিত্যে আশা-নিরাশা বলি তার থেকে বেরিয়ে এসে একটা কথা বলা যায়, ১৯ বছর আগে যখন লিখেছিলাম, আমি নিজেও এখন অবাক হই, সে বাস্তবতার উপাদানগুলো এখনও আছে। বই কতটা সফল তার চেয়েও জরুরি মনে হয়, এই বাস্তবতা কবে পাল্টাবে! আমরা কি আরো নিম্নমুখী হচ্ছি?
পারভেজুর রহমান: এই আখ্যানের চরিত্রগুলো রূপকের আড়ালে বাস্তবিক, তাদের প্রায় সকলেই বর্তমান। বদলেছে তাদের জীবন যাপন, দর্শন এবং আদর্শ। এটা সময়ের পরিবর্তনের কারণ কিনা? যদি তাই হয় তাহলে সেই সময় (যখন আখ্যানটা লেখা হয়) আর এই সময়ের পার্থক্য কিভাবে দেখেন? চরিত্রগুলোকেও কিভাবে মূল্যায়ন করেন।
সেলিম মোরশেদ: খুব একটা পার্থক্য দেখি না। তবে কয়েকটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তারতম্য ঘটিয়েছে। শেষমেশ একই রকম লাগে।
পারভেজুর রহমান: তখন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলো বিশেষ করে নারী-পুরুষের জৈবিক সম্পর্কের ধরন বদলাচ্ছিল। লেজবিয়ানিটি বা হোমোসেক্সুয়ালিটি’র প্রকাশ হচ্ছিল। যৌনতাও এই আখ্যানে প্রচ্ছন্ন, বা ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আপনি এটাকে এড়িয়ে গেছেন কিনা? কেন?
সেলিম মোরশেদ: আসলে আমাকে আল মাহমুদ একদিন প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার লেখায় আমি একটা জিনিস কম পাই, সেটা হলো সেক্স। তুমি কি সেক্স নিয়ে লিখতে ভয় পাও? আমি বলেছিলাম, তা না। আমি হয়তো আপনার মতো ডিল করতে পারি না। আসলে বিষয়টা আমি যেটা বলতে চেয়েছি বা এখনও চাইছি, আমি সবসময় মনে করি সেক্স এবং পলিটিক্স ডিল করা এশিয়ান লেখকদের জন্যে ইউরোপের লেখকের তুলনায় কঠিন। বিষয়বস্তু খুব স্পর্শকাতর। এবং এ বিষয়বস্তুতে মূল আখ্যানের যে লক্ষণসমূহ সেগুলো গন্তব্যমুখী হতে ব্যাহত হয়। সেক্ষেত্রে বোধহয় আখ্যান যতটুকু দাবি করে ততটুকুই আমি লিখতে চাই। আমি তাই-ই লিখেছি।
পারভেজুর রহমান: চরিত্রগুলো সবাই অস্থির। অতি সেন্সেটিভ, ইনফিরিয়র কমপ্লেক্স প্রায় সবার মধ্যে। একেকজন দার্শনিক যেন। নিজেদেরকে বুঝছেন না। কী করবে বুঝতেও পারছেন না, আর বুঝলেও কিছু করছেন না, অথচ নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে আছেন, কিন্তু চিন্তায় ব্যাপক ও পুরো বিশ্ব নিয়ে ভাবছেন। এই কমপ্লেক্স বা ক্রাইসিস কি সেইসময়ে এতই প্রকট ছিল?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ চারপাশে এতোটাই প্রকট ছিল। প্রবলভাবে তারা সেন্সেটিভ ছিল। মিডলক্লাসের সেই অংশ নিয়েই সাপলুডু যে অংশ র্যাডিকাল কিন্তু রেভুলেশনারি না।
পারভেজুর রহমান: একটা সময়কে ধরতে গেলে সেই সময়ের সমাজের সব শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, এই উপন্যাসে মধ্যবিত্তই প্রাধান্য পেয়েছে। অন্য শ্রেণি খানিক অস্পৃশ্য থেকেছে, আপনি কি একটা শ্রেণিকেই ধরতে বা বুঝতে চেয়েছিলেন কিনা?
সেলিম মোরশেদ: হয়তো-বা তাই কিছুটা। একটা সময়ের বিভিন্ন বিভক্তিও থাকে। তার কোন অংশটা নিয়ে কাজ হচ্ছে সেখান থেকেই বিচারটা দরকার।
পারভেজুর রহমান: এই উপন্যাস নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন। সেই দিকে যাচ্ছি না, শুধু লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা মন্তব্য ‘লেখাটা পড়ে মনে হয়েছিল, আপনি রোগা আর রাগী কেউ।‘ আপনি রোগা নন, তো রাগী কি? মনে হয়েছে আখাতারুজ্জামান ইলিয়াস সাহেব পজেটিভ অর্থেই বলেছেন।
সেলিম মোরশেদ: ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পটা পড়ে সম্ভবত এরকম বলেছিলেন তিনি। সাপলুডু খেলা পড়ে নয়।
পারভেজুর রহমান: তো পাঠক সেলিম মোরশেদের ‘সাপলুডু’র পাঠ-প্রতিক্রিয়া কী?
সেলিম মোরশেদ: পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমার মনে হয়েছে ট্রিলজি হতে পারে। বা এর আরো নানা দিক নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
পারভেজুর রহমান: উপন্যাসের কোনো চরিত্র আপনাকে টানে বেশি? কেন?
সেলিম মোরশেদ: এটা আমি ভাবিনি। তবে সলোমন চরিত্রটা এতো ঘিরে রাখে যে অন্য চরিত্রগুলোর প্রতি আমি যথেষ্ট মর্যাদা দিলেও ভাবার অবকাশ হয়নি। সলোমনের পরে যদি কোনো চরিত্র পাঠক হিসেবে আমার কাছে কিছুটা গুরুত্ব নেয়, সেটা কিঞ্চি দেমা।
পারভেজুর রহমান: মূল চরিত্রে পয়গম্বর সোলায়মানের সঙ্গে ট্রান্সফরমেশন আছে শেষের দিকে। নামের মিলের কারণেই কি এটা হয়? অন্য নাম ব্যবহৃত হলে এই ট্রান্সফরমেশন হত কিনা?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, একই রকম হতো। নামের মিলের সাথে বিষয়টা কাকতালীয়।
পারভেজুর রহমান: অনেকেই বলেন এটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। কতটুকু সত্য?
সেলিম মোরশেদ: আধুনিক সমালোচকদের মতে লেখকের সব লেখাই আত্মজৈবনিক। কিন্তু আমি এটাকে তা বলব না। তবে নিজের অনেক বিষয় আশয় তো আছে, সেটা সত্য। তবে আমার চারপাশের ছাপ আমাকে প্রভাবিত করেছে; রাজনীতি, অর্থনীতি, আমার সঙ্গীদের মনোভাব—সেটাই এসেছে।
পারভেজুর রহমান: এর একটা সিক্যুয়াল দাবি রাখে। আপনার কী মনে হয়?
সেলিম মোরশেদ: হ্যাঁ, দাবি তো রাখেই।
আপনার উপন্যাসের সংখ্যা এই একটি। তা-ও ১৮ বৎসর আগে। আপনার আর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা?
সেলিম মোরশেদ: আছে তো অনেকই। কিন্তু হয়ে ওঠে না।
লেখক সেলিম মোরশেদের কাছ থেকে দীর্ঘদিন আমরা কোনো লেখা পাচ্ছি না। অনেকে বলেন, আপনি দশকে আটকে আছেন। সেখানেই আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই চুপ আছেন। বের হতে চাইছেন না। আবার কেউ কেউ অবশ্য বলেন, সরে গেছেন। অথচ আপনি একজন কমিটেড রাইটার। আপনার লেখার ক্ষমতা বিশাল বলে জানি। ভবিষ্যতে কি আশা রাখতে পারি?
সেলিম মোরশেদ: ওই যে বললেন না কমিটেড রাইটার? চেষ্টা করে হয়তো প্রতিবছর একটা করে বই লেখা যেতো। কিন্তু তেমন বই লেখা বা প্রকাশের ইচ্ছা নেই। এটা কোনো সক্ষমতার আওতায়ও পড়ে না। যারা বলছে, এতোদিন যারা আমার সঙ্গে থেকেছে, তারা অনেকেই আমার আগের কাজগুলো ভালো করে পড়েনি। এমনকি ১৯ বছর পরে যে বইটি আপনি প্রকাশ করেছেন, সেটিও দ্বিতীয়বার ভুল শুধরানোর সুযোগ পেয়েও গ্রহণ করলেন না। ফলে পাঠক তৈরি হওয়ার সময়ও তো দিতে হবে। গাদা গাদা বই লিখে শেলফ ভর্তি করার অর্থ দেখি না আমি।
পারভেজুর রহমান: শেষে; আপনি একটা উপন্যাস আমাদের প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, প্রস্তুতি কতদূর আর কবে নাগাদ পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে মনে হয়?
সেলিম মোরশেদ: উড়কি আজ দু বছর আমার কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছে ‘দর্পিত নেকড়ে ও কুমিরগুলো’ নামে গাজীকালু চম্পাবতীর যে আখ্যান বা অন্য একটি উপন্যাস, যা আপনি এবং কবি মোশারফ খোকন—এটির জন্য যা যা করেছেন, করে যাচ্ছেন, আমার যাপিত জীবনের সাথে যেভাবে সহযোগীমূলক মনোভাব পোষণ করছেন, কেউ তা করে না। সেক্ষেত্রে এটা শুধু আশা করবেন বলেই না, এটা সম্মানজনক প্রত্যাশায় রাখতে পারেন যে, বইটি আমি যথাযথ সময়ে দেবার চেষ্টা করব কৃতজ্ঞতার সাথে।
[আপনার নতুন উপন্যাসের অপেক্ষায় আছি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান সময় দিয়েছেন বলে। আবার হয়তো আমরা আলাপ করব আপনার অন্য কোনো লেখা নিয়ে। সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।]

আরো পড়তে পারেন

