

‘কন্সপ্রেসি অফ সাইলেন্স’ অথবা সেলিম মোরশেদ প্রসঙ্গে যা বলা জরুরি
বাংলা ছোটগল্পের ভূগোল ভেঙেচুরে দুঃসাহসিকভাবে যিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনিই সেলিম মোরশেদ। তবে প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, কাজটি আদতেই সহজ ছিল না। ছোটগল্পের ভবিতব্য নির্ণয়ে তাঁর দীর্ঘ পঠন-পাঠন, পর্যবেক্ষণ এবং প্রস্তরবৎ ঋষিসুলভ ধ্যানমগ্নতা এক্ষেত্রে অবশ্যই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ তেমনই সাক্ষ্য দেয় বৈকি! তবে দুঃখজনক হচ্ছে, মাত্র ২১ বছর বয়সের মধ্যেই এই গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো লেখা হলেও গ্রন্থটি তারও আরো একদশক পরে বন্ধুজন মুসা কামাল মিহির কর্তৃক ‘শব্দশিল্প’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
হ্যাঁ, তার পর, তার পর দীর্ঘ নীরবতা… কন্সপ্রেসি অফ সাইলেন্স! না, কেউ কোনো কথা বলছে না, বলবে না, কথা বলা নিষেধ যে! কেননা সেলিম মোরশেদ যে বাজারচলতি প্রচল ও ছোট-ছোট বাক্যে ‘পুতুপুতু গপপো’ ফাঁদতে না-পছন্দ করেন আর সেই হেতু তিনি ইতোমধ্যেই তাঁর সহযোদ্ধা-বন্ধুদের সুপরিকল্পিত শিল্প-চিন্তা, আস্থা-ভালোবাসা, দ্রোহ এবং পরামর্শে আশির বিশুদ্ধ সাহিত্যপত্র ‘গাণ্ডীব’সহ আরো দু’একটি (অনিন্দ্য,সংবেদ…) কাগজকে কেন্দ্র করে আরম্ভ করেছেন লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টও। পাঠিকা, লক্ষ করুন, এখানে ‘আরম্ভ’ শব্দটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। আর তা এইজন্য যে, এর পূর্বে যেসমস্ত কাগজ এই ভূখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে মূলত সেগুলো আর যা-ই হোক তার ৯৯.৯৯ ভাগই লিটলম্যাগাজিন নয়! বড়জোর সেগুলোকে রুচিশীল সাহিত্য সংকলন বলা যেতে পারে। ফলত সেই কাগজগুলোতে গবেষক নামধারী বিরাট বিরাট ‘ড’ বিন্দু গো-এষকেরা সাহিত্যিক অনুবীক্ষণে যে ‘দ্রোহ’ আবিষ্কার করেন, সেইগুলোতে আমরা তন্ন তন্ন করে শিল্পের প্রতি কমিটমেন্টের লেশমাত্র খুঁজে না পেলেও সংকলনগুলোতে তাদের অপ্রাপ্তির সাময়িক আস্ফালন ও দিশাহীন অসহ আর্তনাদ কিন্তু আদৌ আমাদের চক্ষু এড়ায় না!
যাক সেসব, তো ওই সময়ে সহযোদ্ধা লেখকবন্ধুদের আস্থা, ভালোবাসা ও সহযোগিতায় সেলিম মোরশেদ তাঁর শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার যৌক্তিক প্রয়োগ ঘটিয়ে প্রচল ও বাজারি লেজুড়বৃত্তি-রহিত সাহসী, সংহত এবং তেজোদৃপ্তময় যথার্থ লিটলম্যাগাজিনের স্বপ্ন আঁকতে চাইলেন। স্রোতের বিপরীত এই সন্তরণে তখন স্বপ্নবাজ যেসব লেখক-শিল্পী-সম্পাদক-প্রকাশক তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন: তপন বড়ুয়া, শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, সাজ্জাদ শরিফ, বিষ্ণু বিশ্বাস, ঢালী আল মামুন, হাবিব ওয়াহিদ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, জুয়েল মাজহার, তারেক মাসুদ, আযাদ নোমান, শহিদুল আলম, তারেক শাহরিয়ার, পারভেজ হোসেন, শামসুল কবীর, কফিল আহমেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, হোসেন হায়দার চৌধুরী, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, সৈয়দ তারিক, আহমেদ নকীব, রোকন রহমান, শাহেদ শাফায়েত, ব্রাত্য রাইসু প্রমুখ।
বলে রাখা জরুরি যে, এরই ধারাবাহিকতায় নব্বই দশকে লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অ-বাণিজ্যিক ধারার অগণন ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়। নব্বই এবং এর পরবর্তীতে প্রকাশিত কাগজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: শিরদাঁড়া, প্রতিশিল্প, দ্রষ্টব্য, চর্যাপদ, পত্তর, ঘণ্টা, পূর্ণদৈর্ঘ্য, রিভাইব, বালুচর, ড্যাফোডিল, নিসর্গ, লিরিক, ক্যাথারসিস, মানুষ, দ, বাউণ্ডুলে, কালধারা, ১৪০০ সুদর্শনচক্র, ওঙ্কার, গন্দম, কারুজ, শব্দপাঠ, গ্রন্থী, পুষ্পকরথ, কালীদহ, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, বিকাশ, সুনৃত, মৃৎ, কথা, বিবিধ, খড়িমাটি, চালচিত্র, শুদ্ধস্বর, পত্তর, নৃ, নদী, ভ্রূণ, চারবাক, কফিন টেক্সট, জঙশন, লাস্টবেঞ্চ, ঢোল সমুদ্দুর, ওপেন টেক্সট, সূর্যঘড়ি, ডানার করাত, বিন্দু, পড়শি, শাব্দিক, সপ্তক, শূন্য…
তার পর দীর্ঘ নীরবতা… কন্সপ্রেসি অফ সাইলেন্স! না, কেউ কোনো কথা বলছে না, বলবে না, কথা বলা নিষেধ যে! কেননা সেলিম মোরশেদ যে বাজারচলতি প্রচল ও ছোট-ছোট বাক্যে ‘পুতুপুতু গপপো’ ফাঁদতে না-পছন্দ করেন আর সেই হেতু তিনি ইতোমধ্যেই তাঁর সহযোদ্ধা-বন্ধুদের সুপরিকল্পিত শিল্প-চিন্তা, আস্থা-ভালোবাসা, দ্রোহ এবং পরামর্শে আশির বিশুদ্ধ সাহিত্যপত্র ‘গাণ্ডীব’সহ আরো দু’একটি (অনিন্দ্য,সংবেদ…) কাগজকে কেন্দ্র করে আরম্ভ করেছেন লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টও।
এই, এইসব, শিবের গীত এইজন্য যে নব্বই দশকে এসে বাংলাদেশের লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টে অনিবার্য একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। হ্যাঁ পাঠিকা, সেটিই হচ্ছে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’। বলাই বাহুল্য, এদেশে নব্বই দশকে লিটলম্যাগাজিন ‘প্রতিশিল্প’-ই সর্বপ্রথম এই দার্শনিক ধারণাসিক্ত নান্দনিক প্রত্যয়টি সগৌরবে উপস্থাপন করেছিল আর এখানেও অনিবার্যভাবেই লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের ভূমিকাই ছিল সর্বপ্রধান। মুভমেন্টের এই নবপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে নানানভাবে আরো যারা সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন: দুর্বাশা দুর্বার, মারুফুল আলম, কবির মনি, মহিউদ্দীন মোহাম্মদ, মজনু শাহ, মোজাই জীবন সফরী, অসিত বিশ্বাস, শামীম কবীর, জহির হাসান, সেলিম রেজা নিউটন, শাহরিয়ার ইমতিয়াজ, শিমুল মাহমুদ, আদিত্য কবীর, কামরুজ্জামান কামু, ঈশান জয়দ্রথ, সাগর নীল খান, টোকন ঠাকুর, মুজিব মেহদী, লুবনা চর্যা, শাহীনুর রহমান, টিটো জামান, তরুণ ভট্টাচার্য, সুহৃদ শহিদুল্লাহ, কামরুল হুদা পথিক, মোবাশ্বির আলম মজুমদার, সৈকত হাবিব, সৈয়দ মুশতাক আলি মাসুম, হাফিজ রশিদ খান, শরীফ শাহরিয়ার, পাবলো শাহি, এজাজ ইউসুফী, শাম সোলমান, জিললুর রহমান, মাসুমুল আলম, অতীন অভীক, মহসীন রেজা, মোশারফ খোকন, রাকা জেসমিন, আহ্মেদ লিপু, ফরিদা হাফিজ, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া, আবু মুসা চৌধুরী, আউয়াল আহমেদ, সিকদার ওয়ালিউজ্জামান, ওয়াহিদুজ্জামান অর্ক, আশিক আকবর, আহমেদ সায়েম, জ্যাকি ইসলাম, রিজোয়ান মাহমুদ, আশরাফ রোকন, সরকার আশরাফ, সাজিদুল হক, চন্দন কৃষ্ণ পাল, মাশুক শাহী, নভেরা হোসেন, নাভিল মানদার, সঞ্চয় প্রথম, রুবিনা রিনি, অনুপ চণ্ডাল, শেখ সিরাজ উদ্দিন, সাদি তাইফ, আদিত্য শাহীন, আজিমুল হক, মিনু মৃত্তিক, মিলন মাযহার, শওকত হোসেন, বিপুল বিশ্বাশ, আশিক রেজওয়ান, রিসি দলাই, টাবিথা পান্না, রথো রাফি, অভিজিত বসু, মাসুদ আশরাফ, রাজা সহিদুল আসলাম, মাসুদুল হক, ফখরুল আলম মুক্তি, রিষিণ পরিমল, হাবিব আহসান, স্বদেশবন্ধু সরকার, মাহবুব কবীর, চিনু কবির, শামীমুল হক শামীম, সুমন সুপান্থ, মোস্তাক আহমাদ দীন, শোয়াইব জিবরান, আরশাদ সিদ্দিকী, রাজীব নূর, রশীদ হারুন, সাইদ উজ্জ্বল, শামীম ফারুক, ইউসুফ বান্না, আব্দুস সামাদ টোকা, নৃপ অনুপ, শাওন আকন্দ, শামীম নওরোজ, মালেকুল হক, সফিয়ার রহমান, খোকন কায়সার, ফজলুর রহমান বাবুল, মেহদিউর রহমান টুটুল, ইফতেখার হেলাল, জফির সেতু, পাঁশু প্রাপন, সনত বেলাল, আহমেদুর রশীদ, নিবারন মুনশি, মাহবুব মোর্শেদ, লাকু রাশমন, শামীম শাহান, লাভলু হীরা, অন্যূন পৃন্স, নির্লিপ্ত নয়ন, শাহীন মমতাজ, মাঈন মজুমদার, অনন্ত উজ্জ্বল, সামীম আরা, আরণ্যক টিটো, তানভীর রাতুল, ফরহাদ নাইয়া, জন প্রভুদান, তিতাশ অধিকারী, ফয়সাল আদনান, মনিরুল মনির, বিপ্লব বিপ্রদাস, চঞ্চল নাঈম, সৈয়দ তৌফিক উল্লাহ, শিশির আজম, শাফি সমুদ্র, কবীর আলমগীর, কায়সার মাসুম, চারু পিন্টু, আহমেদ মওদুদ, তানজিন তামান্না, সাম্য রাইয়ান, মাহবুব হাসান, ঋষি এস্তেবান, সাহিদুর রহমান, রুদ্র শায়ক, অরণ্য শর্মা, কাজী টিটো, লিটু রেজোয়ান, জ্যোতি পোদ্দার, আরেফিন অনু, আতিকুর রহমান মিলু, জোসে প্রাপন, আব্রাহাম তানিম…
তো, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি-স্বার্থের ওপরে উঠে লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টের এই নবপর্যায়ে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’-কে অনেকেই কিন্তু মেনে নিতে সক্ষম হননি। অবশ্য এর নানাবিধ বিচিত্র কারণও রয়েছে। যারা রুচিশীল সাহিত্যের নামে বড়কাগজের সাথে গাঁটছড়া বাধতে সীমিতসংখ্যক কাগজ প্রকাশ করে তার দু’এক কপি আবার শাহবাগেও ঝুলিয়ে রাখতেন, কেউ কেউ সাংস্কৃতিক ধান্দাবাজি অব্যাহত রাখতে আবার কেউ কেউ বাজারি পুরস্কার/খ্যাতি/প্রচারের লোভ সামলাতে পারেননি, আবার কেউ কেউ তো ইতোমধ্যেই লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টেরই আদর্শ পরিত্যাগ করে বিগ হাউজের সারভেন্টে পরিণত হয়েছেন— ফলত তারা যে এটির বিরোধিতায় প্রাণপাত করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনেরই কেউ কেউ আবার ভণ্ড-বিপ্লবীর মতন প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থরক্ষার্থে শুধুমাত্র বইমেলাতেই সক্রিয়তা প্রদর্শনে উঠে-পড়ে চূড়ান্ত অশ্লীলতায় সৌখিন বিপ্লবী সেজে হাস্যকর কত কীই-না করে থাকেন!
অতএব, এক্ষণে বলা জরুরি যে, লিটলম্যাগাজিনের ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ মুভমেন্টের কারণে সেই সময় থেকেই মূলত কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ এমত ঘরের শত্রু বিভীষণ টাইপ ফেক-বিপ্লবী ও বাজারি মালদের অবিকল্প টার্গেটে পরিণত হন। ফলত, যেন লেখক ‘সেলিম মোরশেদ’ না ধর্মে না জিরাফে কোত্থাও নেই! হ্যাঁ, ‘চুপ চুপ চুপ, একদম চুপ, কথা বলো না।’
সেই হেতু, আর বক বক নয়। তদুপরি, পরিশেষে এটিও বলা জরুরি যে, গত শতকে কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ প্রসঙ্গে যে ‘কন্সপ্রেসি অফ সাইলেন্স’-এর সূত্রপাত হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাঁর প্রকৃত অনুরাগী পাঠকদের ক্রমজাগরণে এই শতকে তা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। হ্যাঁ, আমার ধারণা, অবশ্যই এটি ভাঙবে, আরো ভাঙবে — আর কে না জানে ‘মেঘচিল’-এর এই আয়োজন তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অনন্তর, হে ধৈর্যবান পাঠক, প্রণাম!