:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নাঈমা সিদ্দিকা

আবৃত্তি শিল্পী, নির্দেশক

আমার সময়ের: প্রসঙ্গত সেলিম মোরশেদ
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

আমার সময়ের: প্রসঙ্গত সেলিম মোরশেদ

সেলিম মোরশেদকে নিয়ে লিখতে যেয়ে ভাবছি কোন দিক দিয়ে লিখব। তিনি আমার দেখা একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল মানুষ। আমি নিজে সক্রিয় সাহিত্য না করলেও বেশিরভাগ সাহিত্যিক পাঠসভা বা আড্ডাগুলোতে আমার বিচরণ ছিল খুব। সেলিম মোরশেদকে দেখা যেত কোনো কোনো আলোচনাসভাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। একটি কথা মনে পড়ছে এখন, একবার লেখক রাখাল রাহার একটি বইয়ের আলোচনাসভাতে সেলিম মোরশেদ-এর আলোচনা আমাকে নাড়া দিয়েছিলো বেশ। তিনি তাঁর আলোচনার শুরু করলেন বইটিতে মোট চরিত্রের সংখ্যা এবং তাদের নিজস্ব পারসপেক্টিভে কী এবং কেন, সেখান থেকে। বইটি আমার পড়া ছিল, কিন্তু তাঁর আলোচনা, একটি বই কিভাবে পড়তে হয়, চিন্তা করতে হয় তার একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছিল আমার মনে। তাঁর সঙ্গ যারা পেয়েছেন তাঁরা জানেন তিনি কতখানি স্বতুস্ফূর্ত হতে পারেন আর কত বিষয়-এর ওপর তাঁর অবাধ দখল। তিনি কথা বলেন কোনো বিষয়ে নিজের বোঝাপড়া থেকে। এজন্যে সেসব শুনতে তথ্যের বোঝার মতো লাগে না বরং সেটা হয়ে ওঠে গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর অনেক কথাই আমার মাথার উপর দিয়ে যায়। তিনি সেটা বোঝেন, প্রায়ই নিজের বোঝাপড়ার অবস্থান থেকে অনেক নিচে নেমে আমি দেখেছি অন্যদের সাথে অসাধারণ নিপুণতায় যোগ স্থাপন করতে। বন্ধু অথবা যে কোনো পরিচিত মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতাও তার অসাধারণ, যারা তাঁর ভালোবাসা পেয়ে ধন্য হয়েছেন তাঁরা জানেন।

সেলিম মোরশেদ এর-কাটা সাপের মুণ্ডু বইটি আমাকে বহুদিন ভাবিয়েছে। মানবচরিত্রের অসীম সাহস এবং ক্ষমতা যা সে নিজেই হয়তো জানত না একটি বিশেষ অবস্থায় না পড়লে সেটা আমরা পাই এখানে। হেমাঙ্গিনী কোনোদিন কল্পনাও হয়তো করেনি সে কোনোদিন সাপ খাবে— কিন্তু পরিস্থিতি তাকে তার এই সাপ খাওয়ার মতো অসীম সাহসী করে দেয়। সে নিজেই জীবনের কোনো এক পরিস্থিতিতে নিজের এই নতুন লড়াকু ক্ষমতা আর, সাহস প্রত্যক্ষ করে। এই গল্পটিতে একটি লাইন আছে ‘খুপরির ভেতর মাটির লেপা চুলোয় আগুনের নীলচে আঁচ রবীন্দ্রনাথ পুড়িয়ে দিয়ে মরা হাড়ের অস্তিত্ব সারা খুপরিতে ছড়িয়ে দিয়েছে’। এই লাইনটি অসাধারণ একটি মেটাফোর। তাঁর আরেকটি গল্প সখিচান উল্লেখ করবার মতো যেখানে সখিচান তার আত্মসম্মান-এর জন্যে লড়েছিল। ব্যক্তির আত্মসম্মান চলে গেলে সে কতটা অসহায় আবার একই সাথে হিংস্র হয়ে ওঠে তার বয়ান যেন এই গল্পটিতে আছে। রক্তে যতো চিহ্ন পড়েছিলাম অনেক আগে। তখন চমকে গিয়েছিলাম রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক দল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ঘিরে যেন এক রাজনৈতিক জীবনের জীবন্ত আখ্যান। রাজনীতির সাথে যারা জড়িত অথবা যারা কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেন তারা প্রত্যেকেই নিজেকে দেখতে মূল চরিত্রের সাথে নিজেকে মেলাতে পারবেন।

সেলিম মোরশেদ-এর চরিত্রের আরেকটা দিক হল তিনি খুব বিস্মিত হতে পারেন। খুব সাধারণ আড্ডাতেও ঠিক কোন কথাটা পিক করতে হবে সেটা তিনি জানেন। তাঁর ব্যক্তিত্বটাই এমন তাঁর সাথে কিছুদিন যারা চলবেন—তাঁদের শুধু সাহিত্যিক রুচিই নয়, সৃজনশীলতারও বিকাশ ঘটবে।

সেলিম মোরশেদ-এর বাঘের ঘরে ঘোগ বইটি সম্ভবত অনুবাদ হয়েছিল ইংরেজিতে। মনে পড়ছে, একবার তাঁর কোনো এক বইয়ের অনুবাদের কাজ চলছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একজন অধ্যাপকের সাথে। আমি তখন গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করি। পরে সে কাজ কতদূর এগিয়েছিল জানা নেই। তাঁর সাপলুডু খেলা উপন্যাসিকাটি একটি আন্তর্জাতিক মানের লেখা। তিনি যেন তাঁর সব লেখনীক্ষমতা এখানে উজাড় করে দিয়েছেন। এই লেখাটির ভাষা আমার কাছে স্বতন্ত্র লেগেছে। অন্য লেখার ভাষা থেকে আলাদা। খুব নিরেট বুনন। অসংখ্য উপমা এবং জীবনদর্শনে ঠাসা, যেমন একটি লাইন— ‘আমি মানুষ। আমার শূন্যতা সত্য।…….. মহান কর্তব্যের দোহাই দিয়ে তার শূন্যতা পূরণের অবকাশ নাই।’ একটি উপমা অনেকটা এরকম বিকেলটা নড়ে উঠলো দুই ভুরুর মাঝখানে টিপ যেমন নড়ে উঠে। কী সূক্ষ্ম তাঁর দেখা! বইটি আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত হওয়া দরকার এরকম একটি ভাবনা থেকে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রহমান ম মাহবুব ভাই সেলিম মোরশেদ-এর সাপলুডু খেলা বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন অনেক ধৈর্য নিয়ে। মাহবুব ভাই অনেক ব্যস্ততার মধ্যে শুধু বইটি অনুবাদই করেননি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষককে দিয়ে এডিটও করিয়েছিলেন। এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে আমি কিভাবে যেন জড়িয়ে যাই। এরমধ্যে আমি দেশের বাইরে চলে আসি আমার স্বামীর উচ্চশিক্ষার জন্যে। আমি নিজেও কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়া শুরু করি। তখন মাহবুব ভাই এবং আমি চিন্তা করলাম আমেরিকা থেকে সেটা প্রকাশ করা যায় কিনা। আমেরিকাভিত্তিক ডোরান্স প্রকাশনা সংস্থা-র সাথে আমি যোগাযোগ করি। তারা ম্যানুস্ক্রিপ্ট সাবমিট করতে বলে। সেটা করার প্রায় এক মাস পর একটা কল পাই যে, তারা বইটি ছাপতে চায়, তবে তারা নিজেদের এডিটর দিয়ে এডিট করাবে। পশ্চিমা দেশে বই এডিটিং বেশ উঁচুদরের একটা প্রফেশন এবং প্রফেশনাল এডিটরদের পারিশ্রমিকও অনেক বেশি। যাইহোক, আমি পড়াশুনা, নতুন সন্তানের মা হওয়া এবং একইসাথে স্বামীর পড়াশুনা সব মিলে আর বইটির প্রকাশনা বিষয়ে এগোতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে অবশ্যই বইটি প্রকাশিত হবে সে আশা রাখছি।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, যিনি নিজে বিস্মিত হতে জানেন না তিনি অন্যকেও বিস্মিত করতে পারেন না। সেলিম মোরশেদ-এর চরিত্রের আরেকটা দিক হল তিনি খুব বিস্মিত হতে পারেন। খুব সাধারণ আড্ডাতেও ঠিক কোন কথাটা পিক করতে হবে সেটা তিনি জানেন। তাঁর ব্যক্তিত্বটাই এমন তাঁর সাথে কিছুদিন যারা চলবেন—তাঁদের শুধু সাহিত্যিক রুচিই নয়, সৃজনশীলতারও বিকাশ ঘটবে। তার প্রমাণ আমি নিজে। আমি আবৃত্তির লোক, আবৃত্তি ভালোবাসি। আমি ‘আবৃত্তি নির্বাণ’ নামে একটি বই সম্পাদনা করেছিলাম— তার অনুপ্রেরণা ছিল সেলিম মোরশেদ। আমার মনে হয়েছে, যে মাধ্যমটিতে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি সে মাধ্যমটির প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে। এইরকম দায়িত্ববোধ তাঁকে দেখে তাঁর নিজের ক্ষেত্রটির প্রতি দায়িত্ববোধ দেখেই আমার ভেতরে তৈরি হয়েছে।

সেলিম মোরশেদ লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন করেন সেটা আমরা জানি, এক্টিভিস্ট ব্যক্তি সেলিম মোরশেদকে আমার কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে। মিডিয়াতে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজের স্বার্থ আদায় করবার রুচি কল্পনাও করা যায় না তাঁকে দিয়ে। তাঁর চেয়ে নিচু মানের লেখকেরা যেভাবে নানারকম সাহিত্য পুরস্কারের জন্যে লালায়িত তখন তাঁকে দেখেছি ঈর্ষণীয় প্রতিভা নিয়েও অটল পাহাড়ের মতো সংযত আর নির্লোভ। হাস্যোচ্ছলে কখনো হয়তো বলেছি— এসব আন্দোলন করে তিনি কত কী কী হারাচ্ছেন, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যুত্তরে তিনি শুধু মৃদু হেসেছেন। এ যুগে বিশেষ করে বাংলাদেশে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় গত দুই দশকে হয়েছে সেখানে এমন নিরেট মানুষ প্রায় অসম্ভব। আদর্শের জন্যে জীবন দেয় যারা তাদের উচ্চতা তো আকাশছোয়া। সে আদর্শ ভুল বা ঠিক হোক তাতে কী আসে-যায়। তিনি নিজে একজন সাহসী যোদ্ধা, তাঁর সাথে যারা থাকেন তাঁরাও নিজের অজান্তেই সৃজনশীল তো বটেই সাহসীও হয়ে ওঠেন। সেলিম মোরশেদ-এর শত আয়ু কামনা করি। তিনি আমাদের আরো ভালো লেখা উপহার দেবেন এই আশা করছি। শুভকামনা।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!