

সুব্রত-র সাথে বসবাস
সময়টা ২০১১, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে প্রবেশ করা আমি, স্কুলজীবন থেকে চলচ্চিত্র নিয়ে দেখা স্বপ্নের পোকাটা ধীরে ধীরে মাথার উপর জেঁকে ধরেছে— এরই মাঝে চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি-র হাত ধরে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবার সৌভাগ্য হয় আমার, সেইসাথে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের মানুষগুলোর সান্নিধ্যে আসার এক অসাধারণ সুযোগ তৈরি হল। প্রয়াত চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ স্যারের সাথে আমার পরিচয় ২০০৯ সালে একটা ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সে— সেই থেকে তাঁর প্রতি, তাঁর গল্প বলার প্রতি, তাঁর বাচনভঙ্গির প্রতি আর তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতি এক ভালবাসার সৃষ্টি।
আমার এখনো মনে আছে স্যারের মৃত্যুর খবরটা যখন পাই তখন আমি খোলা মাঠে বসা, তাঁর প্রতি আমার ভালবাসার কথা সবাই জানত, আমার মা আমাকে প্রথমে ফোনটা দিয়ে তাঁর চলে যাবার খবরটা দেন।
এর পর আসে ২০১২, খবর পেলাম ক্যাথরিন ম্যাম তাঁর সাথে কাজ করার জন্যে কিছু মানুষ খুঁজছেন। এর পর তার সাথে যোগাযোগ, ছোট একটা ইন্টারভিউ এবং আমার কাজে যোগদান।
তখন স্যারের কাজের এক বিশাল দরজা আমার সামনে খুলে যায়। ধীরে ধীরে যেন নতুন করে আবিষ্কার করছিলাম সবকিছু, ঠিক এই সময় আমার চোখে একটা চিত্রনাট্য পড়ে, উপরে লেখা ছিল ‘সেলিম মোরশেদ-এর সুব্রত সেনগুপ্ত’ গল্প অবলম্বনে তারেক মাসুদের চিত্রনাট্য ‘সুব্রত সেনগুপ্ত ও সমকালীন বঙ্গসমাজ’, আর এভাবেই আমার সাথে সুব্রত সেনগুপ্তের পরিচয়, প্রথমবার যখন পড়লাম তখনি অনেক ভাবনার জন্ম দিল, একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব খেলা করে গেল, নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছিলাম ভিন্ন ভাবে ভিন্ন মতন করে।

পরের কিছুদিন আমি গল্পটা নিয়েই ভেবেছি। সুব্রত কী এবং সুব্রত কেন? সামজিকতার বন্ধনে তো আমি সুব্রতকে ভালো বলতে পারি না, আবার সুব্রত তো খারাপ কিছু করেনি, নিজেকে সামলে নিয়ে প্রতিনিয়ত সমাজের শেকল ভাঙতে চেয়েছে কখনো সচেতনভাবে বা কখনো অবচেতন মনের বিপ্লবী হয়ে। এভাবেই সুব্রত’র প্রতি আমার ভালোবাসা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত নেই একদিন-না-একদিন আমি কাজ করবই এটা নিয়ে।
পাঁচ বছর ধরে আঁকড়ে রাখা এই স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করি ২০১৭ সালে। শুরু হয় নতুন করে পথচলার। আবার চিত্রনাট্য পড়া শুরু হয়, শুরু হয় সব নতুন করে সাজানোর।
তবে এই মুহূর্তে এসে মনে হল সুব্রতকে জানার জন্যে সুব্রত’র স্রষ্টাকে জানাও জরুরি আর তখন শুরু হয় আমাদের সেলিম মোরশেদ স্যারের গল্পের সাথে পরিচয়। টিমের সবাই আমরা স্যারের বইগুলো কিনে পড়া শুরু করলাম। মনে হল সুব্রতকে যেন আবার আর একবার নতুন করে চিনলাম, তার বৈপ্লবিক চেতনা কিছুটা হলেও জানলাম, প্রশ্নগুলোকে বুঝলাম।
তবে সুব্রত সেনগুপ্তকে নিয়ে আমাদের এই চলমান জার্নিটা ঠিক সহজ হয়নি। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাণ বেশ কঠিন একটা বিষয়। সেটা বাজেট নির্ধারণ করা শুরু করে লোকেশন বা আর্টিস্ট নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করেছিলাম সুব্রতকে, বিশ্বাস করেছিলাম আমাদের স্বপ্নকে এবং এভাবেই আমাদের সুব্রতকে নিয়ে পথচলার শুরু।

খুব সীমিত বাজেট এবং সীমিত রিসোর্স নিয়ে আমরা আমাদের কাজটা চালিয়ে যেতে থাকি কিন্তু আমরা কখনো আমাদের কাজে ঘাটতি দেইনি। সেটা চার বার লোকেশন রেকি থেকে শুরু করে প্রি-প্রোডাশনের যাবতীয় কাজ আমরা করে গেছি— যতটা সৎ থাকা যায় কাজের প্রতি, ততটা সৎ থেকে।
তবে সবকিছুর মিশেলে আমরা বেশ বড় একটা অপরাধ করে ফেলি। আমাদের হঠাৎ খেয়াল হয় এই ডামাডোলে আমরা সুব্রত সেনগুপ্তের স্রষ্টাকেই তো জানাইনি যে আমরা তাঁর সৃষ্টিকে ধারণ করার চেষ্টা করে চলেছি। খুব ভয় নিয়েই এবং কিছুটা সাহস সঞ্চয় করেই তাঁকে আমরা জানাই এবং তাঁর কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থনা করি। কিছুটা মনখারাপ উনি হয়তো করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্নেহের পরশ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেননি। আর ঠিক এই কারণেই সেলিম মোরশেদ স্যারের প্রতি আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থেকে যাব। আর এর পর থেকে আমাদের ভালোলাগার মধ্যে আর একটা নাম যুক্ত হয় সেটা হল সেলিম মোরশেদ।
এতদিন তাঁর সৃষ্টিকে পড়েছি-জেনেছি, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে সেলিম মোরশেদকে আমরা আবিষ্কার শুরু করলাম। শান্ত গলায় বলা তাঁর কথা, তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাদের মুগ্ধ করলো, আর কিছুটা আফসোস বাড়াল প্রথম থেকেই যদি তাঁর স্নেহের ছায়াতলে আমরা যেতাম হয়তো আমাদের কাজটা আরো সহজতর হত। জানি না বইয়ের সুব্রতকে কতটুকু জীবন্ত আমরা করতে পেরেছি, কিন্তু আমাদের শতভাগ দিয়েই চেষ্টা করে গেছি, আমরা কখনো বিশ্বাস করিনি সুব্রত সেনগুপ্ত একটি কল্পনার চরিত্র, আমাদের বরাবরই মনে হয়েছে সুব্রত’র বসবাস আমাদের মধ্যেই, এই সমাজের মধ্যেই। আমরা সুব্রতকে দাঁড়িপাল্লায়ও মাপতে চাইনি, চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে ভিন্ন সংযোজন থাকলেও সুব্রত’র চারিত্রিক স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা আমরা করেছি। আমরা হয়তো পুরোপুরি প্রফেশনাল টিম রাখতে পারিনি কিন্তু আমাদের প্রফেশনালিজম-এর জায়গাটাই হল আমাদের আবেগ— অর্থের অভাবে আমাদের কাজ বন্ধ করতে হয়েছে অনেকবার। হয়তো যখন শেষ করার দরকার ছিল সেটা পারিনি, কিন্তু আমরা একবারও থামিনি এবং থামতে চাইওনি। স্বপ্নটা লালন করে চলেছি এবং এর বাস্তবায়নও আমরা করব।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সবাই আমরা জানি— কিছুটা অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়াচ্ছি আমরা সবাই। আর এই অনিশ্চয়তার যাঁতাকলে আমাদের চলচ্চিত্রটিরও একদম শেষ পর্যায়ে এসেও আবার থামতে হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি এই বাধাও আমরা উৎরে যাব এবং খুব শীঘ্রই পর্দায় আমরা সুব্রত সেনগুপ্তকে আনতে পারব।