

নীল চুলের মেয়েটির চোখ দুটি যেভাবে বাঁচিয়েছিলেন সেলিম মোরশেদ
আলোচনার বিষয় হিসেবে আস্ত গল্পটাই নিজের হাতে লেখে ছেড়ে দেওয়া গেলে ভালো হতো। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পাঠের পর তাঁর এক রাশিয়ান ভক্ত এমন কাণ্ডই তো করেছিল। এর চেয়ে ভালো পাঠক আর কে থাকতে পারে? আমারও ইচ্ছে করছে সেলিম মোরশেদের ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল’ গল্পটা দাঁড়িকমা-সহ পুরোপুরি লিখে ফেলতে। যখন লেখা শেষ হবে, তখন তা কি আমার গল্প হয়ে উঠবে, নাকি সেলিম মোরশেদের? আমাদের হয়ে যাবে না ওটা? এই গল্পের শক্তিটাই হচ্ছে, আমাদের হয়ে ওঠার মধ্যে। অনেক গল্প আছে, ট্রাঙ্কের কাপড়ের ভেতর ন্যাপথলিন রাখার মতো গল্পকারের একান্ত সম্পত্তি হয়ে রয়ে যায়। আবার অনেক গল্প আর গল্পকারের থাকে না; পাঠকের হয়ে ওঠে। খুব কম গল্প আছে যা একসঙ্গে গল্পকার ও পাঠকের হয়ে যায় চিরন্তনভাবে, ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল’ গল্পও তেমন।
এই সার্বজনীনতার কারণ সম্ভবত কাব্যিকতা। ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ কি এক মহাকাব্য নয়? প্রচলিত ধারণায় বৃহদায়তনের এক উপন্যাস বটে। কিন্তু কথাসাহিত্যের আগে লেখা হলে তা নিশ্চিত মহাকাব্য হিসেবেই বিবেচিত হতো। আজ আমরা যে নীল চুলের মেয়েটিকে স্মরণ করছি, এই গল্পও যেন এক কালোত্তীর্ণ দীর্ঘকবিতা পাঠের আনন্দ এনে দেয়। কিন্তু সেলিম মোরশেদ তো কবিতা হিসেবে লেখেননি গল্পটা! তবুও কেন কবিতার বিষয় এলো! চলে আসে; অজ্ঞাতসারেই চলে আসে। আরও একটা বিষয় হচ্ছে, গল্প শুরুর ভঙ্গিমা। সেলিম মোরশেদের অন্যান্য গল্পের আরম্ভটা এগিয়েছে স্বাভাবিকভাবে শুরুর পর। তবে এই গল্পের শুরু যেন রূপকথার মতো, ‘যে কথাগুলো বলবো তা এক পুরনো শহরের গল্প। সভ্যতা ও কৃষ্টিতে ভরা। জগৎজোড়া স্বীকৃতি। শহরের সকল অধিবাসীরাই ভাবতো তারা সৎ আর জানতো তারা বিবেকসম্পন্ন। পাশাপাশি তারা ছিল ভয়ানক বিদ্যাদর্পী।’
এই যে মুখটা, এ যেন ঠাকুরমার ঝুলির কোনো গল্পের শুরু। আয়েশি ভঙ্গিতে ঠাকুরমা তার নাতি-নাতনিদের নিয়ে খুব ভয়ঙ্কর কোনো গল্প শুরু করেছেন। যার পরিণতির জন্য অধীর আগ্রহে ঢোক গিলছে সবাই। একবিংশ শতকের মানুষ তার স্মৃতিময় রূপকথাকে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু মনের অজান্তেই সে বয়ে বেড়ায় তেমন একেকটি গল্প। গল্পের ভেতর থেকে আসলে কেউ মুক্ত নয়। যখন বিপদ সামনে চোখ রাঙায় আমরা ভাবি, এই তো পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার এলো বলে অথবা কোনো দৈববলে এক মুহূর্তে হয়তো গ্রহণ করবো মুক্তির স্বাদ। মুক্তির স্বাদের চেয়ে সুমিষ্ট ও আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে? আর নীল চুলের মেয়েটিকে সেভাবেই মুক্তির স্বাদ এনে দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন সেলিম মোরশেদ। শহরের এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের হাতে বন্দী নীল চোখের মেয়েটি যখন মুক্তির পথ খুঁজছে তখনই রাজকুমার সেলিম মোরশেদের আগমন। গল্পকার সময়ের এক বিশাল আয়না নিয়ে হাজির এই গল্পে। রূপকাশ্রিত ও নিদারুণ তীব্র, যা সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক।
এ যেন আমাদের শহর, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা বিষয়-আশয়। অথচ যা আমরা দেখি না। দেখলেও অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন না হওয়ায় কিংবা লোভে অন্ধ ও বোবা হয়ে যাওয়ায় বলতে পারি না। অর্থাৎ এটা আমাদের অন্ধত্বের গল্প। এই অন্ধত্বের মুক্তি কোথায় তবে? নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে বাঁচতে চেয়েছে তার ভেতর?
গাব্রিয়েল মার্কেস কিংবা শহীদুল জহিরের গল্পের কাছে আমাদের বারবার ফেরার বাসনার মূল কারণ বোধহয় জীবনকে খুব কনক্রিট হিসেবে না দেখা। কনক্রিট হিসেবে দেখলে আমাদের আই-লেভেল কেবল ব্যক্তিকে দেখে। ব্যক্তির পোশাক-পরিচ্ছেদ বা তার সামাজিক মর্যাদাকে দেখা যায়। আর যখন তা গল্পের বাইনোকুলার হাতে দেখা হয় তখন ভেতরের কলকব্জাও চোখে পড়ে। এই দেখা ড্রোন দিয়ে উপর থেকে দেখার মতো। ক্যামরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে দেখা— খুব অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন না হলে দেখা বা উপলব্ধি করা অসম্ভব। সেলিম মোরশেদের ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল’ তেমনই এক গল্প।
এক মিথ্যা ও অহমিকায় ভরা শহরে একদিন দেবদূতের মতো এক যুবক নেমে আসে। যে প্রবল সাহসিকতায় প্রচল সমস্ত কিছুকে অগ্রাহ্য করে সত্যকে ঘোষণা করে। কিন্তু পরিণতি হিসেবে তার জন্য লেখা থাকে মৃত্যু। তারপর নীল চুলের মেয়েটি একজন অবজার্ভার হিসেবে দেখে শহর কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে। এক সত্যবান যুবককে হত্যা করার অপরাধে শহরের এতদিনের সমস্ত ধ্যান-ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। লোভী জনগণ, যারা ছিল সর্বদা অন্ধ তারা আরও বেশি অন্ধ ও লোভী হয়ে ওঠে। যার পরিণতি অপেক্ষা করছে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ওপর। তখন নীল চুলের মেয়েটি লোভে অন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে ছুটে যায়।
এ যেন আমাদের শহর, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা বিষয়-আশয়। অথচ যা আমরা দেখি না। দেখলেও অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন না হওয়ায় কিংবা লোভে অন্ধ ও বোবা হয়ে যাওয়ায় বলতে পারি না। অর্থাৎ এটা আমাদের অন্ধত্বের গল্প। এই অন্ধত্বের মুক্তি কোথায় তবে? নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে বাঁচতে চেয়েছে তার ভেতর? মুক্তি খোঁজার আগে বিশাল এক আয়নার সামনে আপাদমস্তক নিজেকে দেখে নেয়া যাক। তেমন এক অন্তর্গত আয়নার প্রতিবিম্ব যেন সেই যুবক, যে আইন-বহির্ভূতভাবে লাশ হয়ে গেছে রাষ্ট্রের হাতে। সে-সব লোভী বাসিন্দাদের একজন আমরা, যারা দিনদিন আরও লোভী হয়ে উঠছি। আর নীল চুলের মেয়েটি এক অমীমাংসিত রহস্য।