লকডাউন কবিতাপুঞ্জ
অজস্র সকাল থাকে না মহামারি দিনে
ডাকছি অবেলায়
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসে গেয়ে উঠুন
এমন একটা ঝড় উঠুক, আর সেই সাথে
গার্সিয়া মার্কেস বইয়ে দিন সাত দিন সাত রাত্তিরের
উথাল-পাথাল স্যাপোনিফিকেশন-
সাবানজলের হন্তারক বৃষ্টি!
স্পিলবার্গের কল্পকাহিনী ছেড়ে
মেঘের মেশিনে তরতরিয়ে উঠুক বৈশ্বিক ফারেনহাইটের শিখা অনির্বান
লহমায় গুঁড়িয়ে দিতে বিমারি মুসিবত।
মহামারী থেমে গেলে
কেউ কেউ আর আসব না শহর জংগমে – শাহবাগে, বাংলা মোটরে
কারো কারো সাথে
হয়ত শেষ দেখা চিহ্নিত হয়ে আছে
দূরের ক্যালেন্ডারে;
ত্রয়োদশ পুনর্মিলনীতে গরহাজির কিংবা
ক্লাবের সান্ধ্য আড্ডায় আসোনি যারা
নর্থ এন্ডে কফির নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলে যারা
হয়ত শেষবার আমাদের দেখা হল না।
যদিও সন্ধ্যা যদিও ঘরবন্দি কোনো এক ক্লাস্টারে
বোদলেয়ারের মতো আজ আমি স্বাধীন মেঘের জমিদার
ডাকছি তোমাদেরকে ঐ উঁচুতে
আরো আরো উঁচুতে
সকল লেখার শেষে
আকাশ থেকে
ঢেউগুলো তো জলের পলি।
জলের কাছে
ঢেউগুলো বেশ প্রভাবশালী।
জলের বুকে
আকাশ দেখ নীল নয়না।
ঢেউয়ের বুকে
আকাশখানি ছদ্মবেশী।
আয়না জুড়ে
জলের পারদ গড়িয়ে পড়ে।
আয়না ভাংগা
প্রভাবশালী চন্দ্রমুখী।
পারদ-পলির
শার্শিজুড়ে জলের স্মৃতি।
ছায়াবাজি
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে।
ঝরোকাতে
দাঁড়িয়ে আছে অভিমানী।
শেষ লাইনে
বিম্বিত কার ছায়াখানি।
ঘুমিয়ে গেলে তুমি
(বন্ধু আবদুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সালের জন্য)
আমাদেরকে রিহার্সালে ডেকে তুমি দরজা এঁটে ঘুম দিচ্ছ, আহা কতই না অর্থবহ হতে পারত এবারের পহেলা বৈশাখের গান- তাপস নিঃশ্বাস বায়ে!
পৃথিবীর সব বড় বড় শহরের সকল স্নায়ুগুচ্ছ উদ্বেল, আর তুমি ঘুমাতে গেলে!
ভালবাসাতেও নোঙ্গর ফেলছ না, নাকি তরুণ দিনের দক্ষ অভিনেতার মত ঘুমের ছলে চোখ বুঁজে আছ!
আমাদের গলা শুকিয়ে আসছে, জিহ্বা ভারি হয়ে আছে না বলা কথাগুলো গিলে ফেলতে গিয়ে, ভাগাভাগি করে ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর চোখগুলো এখন খরাতপ্ত কার্তিকের মাঠের মতো শুকনো।
তোমার নিবিড় পরিচর্যার কেবিনের মাথার বালিশ থেকে আশা কিংবা ভবিষ্যৎ খুব বেশি দূরে প্রসারিত হয়নি আর, পৃথিবীর কঠিন বিব্রতকর প্রশ্নগুলো অবান্তর হয়ে গেছে রাত পোহাবার আগেই। আলিঙ্গন, করমর্দন সবই অসাড়। এখনো বিশ্বাস করি না তুমি হারিয়ে যেতে পারো।
হায়, তুমি ঘুমিয়ে গেলে!
আমাদের আলিঙ্গনে তুমি চিরদিন আছ, এটা আজ থেকে এক মায়াবী আবিষ্কার হয়ে থাকবে।
বড্ড ক্লান্ত এই নিদ্রা তোমার, কে আর শীতল বিছন দিবে এনে, কোন ধন্বন্তরি তোমাকে জাগাবে আবার!
তোমার একান্ত ঘুমে আমাদের প্রবেশাধিকার নাই আর।
ওদিকে আমাদের শুকনো দৃষ্টিগুলো দেখছিল, একটি আলোকিত গ্রহ ছিটকে যাচ্ছে কক্ষপথের বাইরে,
সারা রাত ডাকলেও কথা শুনল না, বুঝতে চাইল না প্রার্থনা কিংবা কান্নার ভাষা।
তুমিও জাগবে না আর।
অতএব ঘুমাও, জানালায় ভেসে আসা স্বর্গের ছোট্ট টুকরোটি চোখে মেখে
ক্লান্তিহর এই নিদ্রা
৯৯, ৯৮, ৯৭, ৯৬, ৯৫ …
ভেড়ার পালের মতো ভেসে যাওয়া নক্ষত্রের ঝাঁক –
উপগ্রহের মতো দিনপঞ্জি চক্কর দেয়া
পঞ্চাশোর্ধ বন্ধুদের বুকচাপা বেদনাগুলো।
ঘুমাও –
আজ ঘুমিয়েছ অবশেষে;
কাল পুনরুত্থান হবে অন্য রূপে।
[ব্রায়ান প্যাটেনের কবিতার ভাব অবলম্বনে ]
নিদ্রিত পরিবারের খোঁজ
ছাদ আর উঠোনের লতাপাতায় অন্ধকার ঘন হয়ে এলে
ঠাণ্ডা পেপসির তৃষ্ণা নিয়ে ফ্রিজ খুলতে আসব;
সন্তর্পনে বুকশেলফের পিছন সারি থেকে
ছবির এ্যালবাম উল্টানো শেষ হলে
তোমার চাবির গোছা খুঁজে
শেষ পাণ্ডুলিপির দুটো বানান শুধরে নিব;
উপস্থিত পেনসিল দিয়েই নতুন একটা লাইন বসিয়ে যাব
‘নদীমাতৃক’ কবিতাটির শেষে।
আমাকে যে চিঠিগুলো লিখেছিলে – নীল, হলুদ
খামগুলোয় হাত বুলিয়ে
মেয়েদের শিয়রে দাঁড়াব একবার
অপূর্ব নিদ্রিত মুখদুটো দেখব বলে।
প্রেমিক
সরব অনুপ্রাসের মতো আমাদের নাম জপ করত
পাড়ার সকল ছেলেমেয়ে,
গাছে গাছে ছুরিকাহত আমাদের আদ্যক্ষর –
পরস্পর যুক্ত হবার ইংগিতময় প্রতীকে;
স্মৃতিদীর্ণ জবার পাপড়ি
কুয়াশা সিরিজের বিয়াল্লিশ পৃষ্ঠায়।
বুকপকেটে সেলাই করা উপেক্ষিত কবিতা ঘিরে
পল্লবিত বেহুদা অভিমানের পুঁইলতা;
পালিয়ে গেলে কে আর দেখে মুখের রং বদল!
বানান দেখার ছল করে কতবার আগাপাশতলা
লিচু গাছের ছায়ায় লেখা কবিতার ঘোর;
শনের ঢিবিতে এক ব্যান্ডের রেডিওতে অবরে সবরে
সৈনিক ভাইদের দুর্বার!
এত বছর পরেও তোমার মুখের রং
লিটমাস পেপারের মত বদলে গেল;
সামাজিক দূরত্ব থাকলেও চিরকালই
কখনো আমি কি বহিরাগত ছিলাম!
বৃষ্টি নেমেছে, কর্নেল
মাকোন্দো চরাচর জুড়ে বৃষ্টি নেমেছে, কর্নেল!
এই অন্তহীন ধারাপাত ত্রিকালদর্শী —
পুষ্পবৃষ্টি!
হলুদ ফুলের ধারা
লাতিনের জলা অরণ্য থেকে
সমুদ্র আর মহাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে
জাভা দ্বীপে জিপসিদের সমুদ্র সমাধি ছুঁয়ে
আরো ঢের কর্তব্য সেরে
নির্ভুল গন্তব্য নিয়েছে খুঁজে
মেহিকোর বোগেনভিলিয়াঘেরা তীর্থভূমি।
স্বপ্নদীর্ঘ পথে, ভুলভুলাইয়াতে
কত বিষণ্ন গণিকা, কুটিল দাদিমা, সরলা এরিন্দিরা
প্রাচীন বংশের লেজবিশিষ্ট সন্তান, কলাবাহী ট্রেন
সিড়িংগেমার্কা দালাল লোকটা
আর জন্মের বৃষ্টি।
হলুদ ফুলে মোড়ানো নৈবেদ্যের এই গ্লোব
আসমান থেকে কেমন উত্তল দেখাচ্ছে কর্নেল?
দেখতে দেখতে
ফৌজের স্মৃতি, না পাওয়া চিঠিপত্র, সিয়েস্তার দুপুর
কলেরা অতিমারীর দিনে প্রেম
ধুসর হয়ে আসে
দু চোখে জন্মাতীত ইলশেগুঁড়ির ঝড়!
[গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মৃত্যুদিবসের বিলম্বিত নৈবেদ্য। আমি তাঁকে ভালবেসে কর্নেল ডাকি।]
চিনির পাহাড়
পথচলতি পিঁপড়ে দুটো পরস্পর এন্টেনা ছুঁয়ে
কুশল বিনিময় করছে
চিনির পাহাড়ের খোঁজে দ্রুত ফিরে গেল যে যার পথে
আমাদের দেখা হল বিমানের শব্দ মাথায় নিয়ে
কুশল বিনিময় ভেংগে ভেংগে যায়
চাপা পড়ল হাই হ্যালো
অশ্রুত রবীন্দ্র সংগীত
আমাদের একটাই পথ ছিল
যার শেষ মাথায় কোনো সমৃদ্ধ পাহাড় নেই
ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে তুমি রিকশায় উঠে বসলে
শহরের মহামারি
রিট্রিট শেষে
বিবর্জিত শহরে আবার
সংখ্যালঘু পরিব্রাজক;
রুদ্ধশ্বাস ডেন্টাল চেয়ারে
শক্ত চোয়ালের ফাঁকে
ঠাণ্ডা সায়ানাইড।
অধিকরণ
একটা উদ্দেশ্যবিহীন জানালা গড়ার ইচ্ছায় তোমার তোলা সূর্যাস্তের ছবিগুলোর প্রশংসা করেছিলাম, উচ্চারণমাত্র দখলে এনেছিলাম তোমার আঁকা ‘নীল শহর’ কিংবা ‘লাল চাকা’র প্যাস্টেল প্রতিলিপি। এদিকে আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় পুলিশের ইউনিফরম পরা ঘুণপোকা ঘুরে বেড়ায়।
অতঃপর আমাদের ইচ্ছার প্রতিকূলে একটা উদ্দেশ্যবিহীন সম্পর্কে না জড়িয়ে নিপাট সামাজিক দূরত্বে – তেহাই তুলবার আগেই লুপ্ত করে দিয়েছি লুব্ধক ডুগডুগি।
অবশ্য কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছাড়াই – তোমার নামাঙ্কিত মুদ্রায় আজও ব্যাসবাক্যসহ সমাস মিলছে, পদ্যের বীজধান মেলে অকাল মৌসুমে, অধিকরণে বিভক্তি নাই কোনো। আর ওই ছবিদুটো মুছে ফেলবার বিষয়টা?– তাহলে কী করে ঘুরাতাম আমাদের বিষাদের শহরে রক্তিম বাসনার চাকা!
জন্মদিন নিরর্থক হয়ে গেলে
জন্মদিন নিরর্থক হয়ে গেলে
ভাষাহীন রাত্রিতে নিম্নচাপ ঘনায়; সে সব ছাপিয়ে
ভাস্কর চক্রবর্তীর জিরাফের বর্ণমালা লতিয়ে উঠে;
লিখতে হয় দাঁত চেপে, শাদা পৃষ্ঠায়
অবজ্ঞার ধুলো ঝেড়ে —
অজস্র সকাল হয়তো থাকবে না উত্তর- পঞ্চাশের মহামারি দিনে।
পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা সংখ্যা চিহ্নিত শাদা জমিনে,
প্রাচীন কবির মতো- হাসতে হাসতে
বিষ মাখিয়ে দিয়ে যাব,
পাঠক তুমিও মরবে বিনে পয়সার কবিতা পড়ে!
তবে যদি অন্যমনস্কতায় অপঠিত পাতা মুড়ে
শিথান বরাবর ফেলে রাখা যায়
নিশ্চিত আরো কয়েক ঋতু সূর্য উঠবে ব্যালকনিজুড়ে।
একদিন বিষ ঝেড়ে অভিশাপের পদাবলি ঘুরে দাঁড়াবে
চার রঙা প্রচ্ছদ ফুঁড়ে, সান্ধ্যভাষায়
চোখ রাখবে বিভিন্ন পাঠকের চোখে।
জন্মদিন নিরর্থক হয়ে গেলে মৃত্যুময় গান হোক।