অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ
এক অন্তর্লীন অনুভূতির আখ্যান
ছোটগল্প সাহিত্যের এমন এক আদুরে শাখা যা পৌষের এক চিলতে রোদের মতো ঝিকিয়ে উঠে ধূসর করোটির অলিগলিতে অনেকক্ষণ রেশ রেখে যায়। সমাপ্তির পরেও ঝিলমিল ডানায় ভর করে উড়তে পারে অনুভূতির জলফড়িং হয়ে। স্মৃতি ভদ্রের ‘অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ’ গ্রন্থটির গল্পগুলোও সেরকমই। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পেন্সিল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত এই বইটি তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ।
শব্দের মোহনীয় অর্কেস্ট্রায় বিমুগ্ধ পাঠের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বলে লেখকের এবারের বইটির জন্য সাগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। এবারেও তিনি পাঠকহৃদয়কে জুড়িয়ে দিয়েছেন। দশটি গল্পের এই সংকলনের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, প্রাসঙ্গিক ভাবনার অকপট অথচ স্বভাবসুলভ শব্দের অলংকারে সজ্জিত প্রকাশ এই গ্রন্থটির বিশেষত্ব।
‘আবর্তন ‘ গল্পটি শুরু হয় একটা পলেস্তারা খসে পড়া বাড়ির বর্ণনা দিয়ে, চারপাশে জংলা আর বুনোগাছের আড়াল যেখানে আলোর পথ আটকে রেখেছে বহুদিন। পুরনো সেই বাড়ির মতোই পুরনো মানসিকতার লোক বাড়িটির কর্তা। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা লোকটি সামান্য আয়ে সংসারের খরচ চালান। রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ হাতে মায়ের দীর্ঘশ্বাস মলিন দেয়াল ছুঁয়ে ফিরে আসে বারবার। বাড়ির সদ্য কৈশোর পেরুনো ছেলে তমাল এমন দিনযাপনে হাঁপিয়ে ওঠে। হয়ত তাই অবচেতন মন ওকে নিয়ম বদলে দেয়ার মিছিলে নামতে তাড়া দেয়। দিনশেষে বাড়ি ফিরেও তমাল বদলে যাওয়ার স্লোগান শোনায় বাবাকে। নিরীহ এই পরিবারের এমন সরব ছেলেটাই একদিন রাজপথে হারিয়ে যায়। শ্যাওলা ধরা দেয়ালের বাড়িটায় সেই একই দুঃখমলিন দিন আবর্তিত হতে থাকে। লেখক খুব দক্ষতার সাথে সেই আবর্তনের গাঁথা শুনিয়েছেন। তবে গল্পের সমাপ্তিটা আরো ব্যাপ্তি দাবি করে। তমালের হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটায় গল্পকার হয়তো আরো একটু তুলির ছোঁয়া দিতে পারতেন।
‘সম্মুখে কৃষ্ণপক্ষ’ এই গ্রন্থের অন্যতম শক্তিশালী গল্প। রাধা, শিউলি গাছ আর স্কুলমাঠের সাথে শিবু রোহিদাসের কথোপকথন গল্পের গভীরতর বক্তব্যকে বাঙময় করে তোলে। যুগ-যুগান্তরের বঞ্চনা আর নাম বদলের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা এই গল্পটির এক একটি অংশের সুর আমাকে মোহবিষ্ট করেছে।
‘উত্তরাধিকার’ গল্পটি পড়ে পাঠকের হৃদয় আর্দ্র হয়। ছেলের অনুরোধ সত্ত্বেও নিজের শেকড়ের প্রতি ভালবাসাকে উপেক্ষা করে রাজিয়া বেগম দূর প্রবাসে চলে যেতে পারেন না। বরং সেই ভালবাসার বীজ উত্তরপুরুষের মনে বপন করে দেন তিনি। সুন্দর মায়াবী একটা গল্প যার সমাপ্তিটা আশাব্যঞ্জক।
‘চতুষ্কোণ’ গল্পটির থিম অভিনব। সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বগুলো সুনিপুণভাবে বিবৃত হয়েছে গল্পের চরিত্রগুলোর কথোপকথনের মাধ্যমে। গল্পের চমৎকার গতির গুণে শেষ অব্দি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় পাঠককে। সমাপ্তিতে এসে অরনীর মাধ্যমে আসল সত্যটা উন্মোচিত হয়। চমৎকার এই গল্পটি মুগ্ধতার রেশ রেখে যায়।
কিছু মানুষের জীবন অপেক্ষার বৃত্তে বন্দি থেকে যায়। আশাবরি ইসলামের সেই বৃত্ত ভেঙ্গে বাইরে পা ফেলার গল্পটির নাম ‘বৃত্তের বাইরে’। তবে এতগুলো বছরের অপেক্ষার পর আশাবরি কেন একদিনের সিদ্ধান্তে বাইরে বের হতে মনস্থির করলেন সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করলে, তার ভেতরের দ্বিধা, টানাপোড়েন নিয়ে আরেকটু লিখলে হয়তো গল্পটি আরো হৃদয়গ্রাহী হতে পারতো।
‘নিষাদ’ গল্পের বয়ান মেদুর হলেও গ্রামীণ পটভূমির এই গল্পটি খুব বাস্তব। রোকন মৃধাদের সাথে এমন অন্যায় অহরহ হয়ে থাকে। গল্পের সমাপ্তিটা চমৎকার। রোকনের বিষাদগ্রস্ততাকে বর্ণনা করতে গিয়ে ‘পাঁক” এর ভেতর পদ্মফুল ফুটে উঠার যে দৃশ্যপট লেখক এঁকেছেন তা অনবদ্য। এই গল্পে ঋতুর বর্ণনা বেশ উপভোগ্য। তবে মাঝেমাঝে সেটা গল্পের বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে গেছে।
‘সম্মুখে কৃষ্ণপক্ষ’ এই গ্রন্থের অন্যতম শক্তিশালী গল্প। রাধা, শিউলি গাছ আর স্কুলমাঠের সাথে শিবু রোহিদাসের কথোপকথন গল্পের গভীরতর বক্তব্যকে বাঙময় করে তোলে। যুগ-যুগান্তরের বঞ্চনা আর নাম বদলের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা এই গল্পটির এক একটি অংশের সুর আমাকে মোহবিষ্ট করেছে। উল্লেখ করতে চাইলে প্রায় পুরো গল্পটিই তুলে দিতে হবে, তাই অংশবিশেষ দিচ্ছি,
“কেন গেলাম জল ভরিবারে
যাইতে যমুনা ঘাটে
সেখানে ভুলিলো বাটে
আঁধার গরাসিলো মোরে”
গুনগুন করে গাইতে গাইতে যখন রাধা বাবার পিছে পিছে বাড়ি যায় তখন পুর্ণিমার মতো আলো ছড়ায় রাধা। সে আলোয় অনেকেই অবগাহন করতে চায়। কত কত শুঁয়োপোকা সেই আলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর পাখাবিহীন সেই পোকাগুলো রাঁধার আলোর তেজে পুড়তে থাকে। দূর থেকে সেই শুঁয়োপোকাদের পুড়তে দেখে একটি দু’টি ছায়া গাছের সাথে লেপ্টে যায়। শিবু রোহিদাস একটু পর পর মেয়েকে তাড়া দেয়,’ পা চালাতি হবি মা।’ রাধা তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে ফেলে। আর ঠিক তখনি ওর মনে পড়ে সেই সোনারঙের জুতার কথা।”
‘কালপুরুষ’ গল্পটার থিম পুরনো হলেও পড়তে ভাল লেগেছে। নির্মেদ বর্ণনায় শেষ অব্দি আগ্রহ নিয়ে পড়ার মতো একটি গল্প এটি। ‘উত্তরালয়’ চিরচেনা প্লটের গল্প হতে গিয়েও হয়নি। চমৎকার ঠাসবুনোটের এই গল্পটি পড়ে বিস্মিত হতে হয়। কতভাবে গল্পের গতিপথ বদলে যেতে পারে! লেখকের ভাবনার অভিনবত্ব সত্যিই প্রশংসনীয়।
গল্পকার স্মৃতি ভদ্র খুব অল্প সময়ে পাঠকমহলে তাঁর স্বকীয় অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি পেলব শব্দ দিয়ে কুরুশকাঁটায় নিটোল মানবিক সম্পর্কের গাঁথা রচনা করেন। তাঁর গল্পগুলো এই অস্থির, বিষণ্ণ সময়ের প্রতিচ্ছায়া হয়ে ওঠে যা লেখনভঙ্গির গুণে অবলীলায় পাঠকের মানসচক্ষে বাস্তব দৃশ্যকল্প তৈরি করতে পারে। এই পথ ধরে লেখক ভবিষ্যতে আরো চমৎকার এবং নতুন নতুন থিমের গল্প আমাদের উপহার দেবেন বলে প্রত্যাশা করি।
পড়ুন স্মৃতি ভদ্র’র গল্প- সম্মুখে কৃষ্ণপক্ষ ও উত্তরালয়