:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আহ্‌মেদ লিপু

প্রাবন্ধিক

সংগঠকের (সাহিত্যিকের) সংগঠন ও তৎসংশ্লিষ্ট ভাবনা
অলংকরণ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সংগঠন ও বাঙালি

সংগঠকের (সাহিত্যিকের) সংগঠন ও তৎসংশ্লিষ্ট ভাবনা

Nothing is definable unless it has no history.
— Friedrich Nietzsche 

The philosopher is not a citizen of any community of ideas, this is what makes him a philosopher.
— Wittgenstein

তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, একজন গুণী-জনপ্রিয় মানুষ। আমাদের অভিজ্ঞতায় জনপ্রিয়তার মধ্যে যে-সকল বৈশিষ্ট্য দেখি, তাঁর মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। দার্শনিকভাবে বললে, তাঁর জনপ্রিয়তায় শুধু পরিমাণই (Quantity) নেই, আছে গুণও (Quality)। জীবন ও জগৎ নিয়ে তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছেন, হয়তো মৌলিক নয় কিন্তু তা একান্ত ব্যক্তিক। তিনি একই সঙ্গে পারফর্মিং আর্টস ও রিয়াল আর্টস-এর কুশীলব। তিনি পারফর্মিং আর্টস-এ যতটা দক্ষ কুশীলব রিয়েল আর্টস-এ ততটা নন। এজন্যই তিনি উপস্থাপনায় ঈর্ষণীয় সফলতা দেখাতে পারলেও কবিতা সৃজনে ততটা পারেননি। জনপ্রিয় শিক্ষক হলেও অ্যাকাডেমিক বিষয়ে প্রবন্ধ বা গ্রন্থ প্রণয়নে তিনি সক্ষম হননি। নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলনের সফল নেতৃত্ব দিলেও, কিংবা সফল সম্পাদক হলেও, গল্প উপন্যাস কিংবা নাটক রচনায় ততটা পারঙ্গম নন। তিনি মূলত প্রবন্ধের নামে একধরনের মুক্ত গদ্যরচনায় (Essay) বিশেষভাবে পারঙ্গম। সম্ভবত এ ব্যাপারে তিনি নিজেও ওয়াকিবহাল, তাই তিনি নিজেকে একজন সাধারণ মানের সাহিত্যিক বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না। কর্মসূত্রে, কিছুটা আবেগের কারণে তাঁকে সাংগঠনিকতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এখনও যাচ্ছেন। তিনি দেখেছেন প্রচুর, মিশেছেন বিস্তর বাঙলা-ভাষাভাষীদের সঙ্গে। আর আমাদের জাতীয়তা তো ভাষাকেন্দ্রিক-ই। এছাড়া দেশ ও দেশের বাইরের হরেক আকার-প্রকারের সংগঠন পর্যবেক্ষণের সুযোগ তাঁর হয়েছে। হয়েছে এদের কর্মপদ্ধতি ও ফলাফল অবলোকনের সুযোগ। আলোচ্য গ্রন্থ সংগঠন বাঙালি তাঁর পরিণত বয়সের রচনা।


যা
বলা হয়েছে (ওয়ে অফ ট্রুথ)

শুরুতেই তিনি ন্যচারাল বিইঙ-এর লিগ্যাল বিইঙ তৈরির কারণ ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। চেষ্টা করেছেন লিগাল বিইঙ-এর (সংগঠনের) একটি প্রায়োগিক সংজ্ঞা দাঁড় করাতে। তারপর তিনি ন্যাচারাল বিইঙ-এর সঙ্গে লিগ্যাল বিইঙ-এর সম্পর্ক নির্ধারণে ন্যাচারাল বিইঙ-এর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য কিরূপ ভূমিকা রাখে সে-সম্পর্কে তাঁর মতামত উদাহরণসহ বিশদভাবে জানাচ্ছেন। এরপর তিনি আলোচনা করেছেন ন্যাচারাল বিইঙ-এর পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে। আলোচনা করেছেন নেতৃত্বের ধরন ও এর কার্যকারিতা নিয়ে। তাঁর নির্দেশিত পরিচালনা পদ্ধতি, নেতৃত্বের ধরন ও এর কার্যকারিতা নিয়ে। এসবের সমন্বয়ে লিগাল বিইঙ-এর একটি কাঠামোর চিত্র অংকন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পরিশেষে তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন লিগাল বিইঙ-এর উত্তরাধিকার নিয়ে।

তাঁর মতে স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালির জাতীয় জীবনের যে সময় তা সংগঠন তৈরির। অসংখ্য কার্যকর সংগঠন তৈরির মাধ্যমেই কেবল আমাদের রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে। অর্থাৎ কি-না দেশ(কান্ট্রি) রাষ্ট্র (স্টেট) হয়ে উঠতে পারে, যার মূল গাঠনিক ভিত্তি মানুষের ইচ্ছাশক্তি। কিন্তু বাঙালির জীবনে সংগঠন একটি নতুন অভিজ্ঞতা এবং এতে সে ঠিক স্বচ্ছন্দ নয়। কারণ, এখানকার উর্বর ভূমি ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে তাকে টিকে থাকার জন্য তেমন কোনো কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয় না যতটা হতে হয় অনুর্বর শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষদের। বৈরী বাস্তবতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকাতে শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষদের জীবনে সংগঠন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাই তারা প্রয়োজন ও দীর্ঘ অভ্যস্থতাহেতু সংগঠনে বেশ স্বচ্ছন্দ। সংগঠনের ঠিক কোন স্তরে তার অবস্থান তা ভালো মতো অনুধাবনে সক্ষম। তিনি বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার মূলে আত্মকেন্দ্রিকতাকে খুঁজে পেয়েছেন। এই আত্মকেন্দ্রিকতা জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য ও ভূমির উর্বরতাজনিত কারণে সৃষ্ট। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত অসহায়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা (যা মূলত আলস্য থেকে উদ্ভূত) ও আত্মঘাতের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে স্বাস্থ্যগত দুর্বলতাহেতু উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্ম। আর, তিনি দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী করেছেন বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুকে। এখন আবহাওয়ার ভিন্নতা প্রকৃতি-সৃষ্ট বৈষম্য, মানব-সৃষ্ট নয়।

তিনি পারফর্মিং আর্টস-এ যতটা দক্ষ কুশীলব রিয়েল আর্টস-এ ততটা নন। এজন্যই তিনি উপস্থাপনায় ঈর্ষণীয় সফলতা দেখাতে পারলেও কবিতা সৃজনে ততটা পারেননি। জনপ্রিয় শিক্ষক হলেও অ্যাকাডেমিক বিষয়ে প্রবন্ধ বা গ্রন্থ প্রণয়নে তিনি সক্ষম হননি। নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলনের সফল নেতৃত্ব দিলেও, কিংবা সফল সম্পাদক হলেও, গল্প উপন্যাস কিংবা নাটক রচনায় ততটা পারঙ্গম নন।

উপরন্তু তিনি মনে করেন এই অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিও বাঙালির সাংগঠনিক বাজে পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁর মতে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি জড়, স্থবির ও চলৎশক্তিহীন। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উৎপাদন ক্ষমতা সামন্ত-শোষণ, জমির নির্দিষ্টতা ও উর্বরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখানে জীবন অনেকটাই গতিহীন। এর তুলনায় পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনময়, কর্মমুখর ও নতুনত্বে প্রাণচঞ্চল। তাই এখানে সাংগঠনিকতা অনিবার্য।

তিনি সংগঠন পরিচালনার জন্য (নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে সবচাইতে বড় সংগঠন রাষ্ট্র) রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় আস্থা রাখেন। রাষ্ট্রপতিকে তিনি বেনিভলেন্ট হিসেবে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানে ইচ্ছুক। আর সামাজিক সংগঠনগুলোতে তিনি রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির আদর্শে সভাপতিভিত্তিক ভাবে গড়ে তোলার পক্ষপাতী; যেখানে সাধারণ সম্পাদকের তুলনায় সভাপতি অধিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবেন। তাঁর মতে এতে সংগঠনগুলো তুলনামূলকভাবে কার্যক্ষম হয়ে উঠবে। আর সংগঠনের উত্তরাধিকার নির্বাচনে তিনি নিটশে-পন্থী। শক্তি ও তুলনামূলক অধিক মেধার সমন্বয় অথবা প্রকৃতি সৃষ্ট বৈষম্য এক্ষেত্রে সহায়। তাঁর মতে একটি সংগঠন সফল হয় কয়েকটা কারণে—

এক. ওই সংগঠনের কর্মীদের সামনে একটি উজ্জ্বল ও অর্থপূর্ণ লক্ষ্য তুলে ধরতে পারলে; দুই, সেই লক্ষ্যের দিকে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্নময়ভাবে জাগিয়ে তুলতে পারলে; তিন. এই উদ্যোগকে সক্রিয় রাখার মতো বস্তুগত সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলে, চার. (আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলে) কর্মীদের সামনে লাভের মুলো উঁচিয়ে রাখতে পারলে।


যেভাবে
বলা হয়েছে (ওয়ে অফ রিপ্রেজেন্টেশন)

১. তিনি কান্টশিয়ান জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। যেখানে জ্ঞানের শুরু হয় অভিজ্ঞতা থেকে কিন্তু বুদ্ধি এর পূর্ণতা দেয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় জানি, তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক ও স্বপ্নদ্রষ্টা। এছাড়াও তিনি কর্মসূত্রে টেলিভিশন-অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক, শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সাংগঠনিকতায় অভ্যস্ত ছিলেন।

২. তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের ধরন Ethico-Cognitive Parallalism প্রবণতা যুক্ত। ফলে, বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে ভাসা ভাসা ধারণা পাওয়া গেলেও অনুপুঙ্খভাবে তেমন কিছু জানা যায় না। এটা তাঁর সাহিত্যিক মনস্তত্ত্বের প্রকাশ। যেমন—

ক. […] সমষ্টিগত সমৃদ্ধি এমন এটা জিনিস যাকে… [ পৃ. ১৮]

খ. […] সংগঠন দুর্বল মানুষের জিনিস নয়। [পৃ. ৩৩]

গ. […] ভীরুতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব আর হীনমন্যতা অন্তর্গতভাবে খুবই কাছাকাছি জিনিস। [পৃ. ৩৯]

ঘ. […] পৃথিবীর যাবতীয় সাফল্যের জ্বলজ্বলে আলোকে পায়ের নিচে অকারণে মাড়িয়ে খানখান করে দেবার জন্য এমনি অবোধ নির্মমতা নিয়ে এর প্রতীক্ষা করে। [পৃ. ৪১]

ঙ. […] উৎসব আর কর্মসূচি জিনিস দুটি কী… [পৃ. ৫২]

চ. […] ঘরে-বাইরে নিষ্ঠুর শীতের হাওয়া সারাক্ষণ লকলকে চাবুকের মতো তাদের ছিন্নভিন্ন করত। [পৃ. ৬৩]

ছ. […] এই সমস্যাটিকে আজ আমাদের শক্ত দাঁতে কামড়ে ধরতে হবে। [পৃ. ৬৬]

 

৩. বক্তব্য উপস্থাপনে কোথাও কোথাও তিনি অতিসরলীকরণের ও ভ্রান্ত সরলীকরণের আশ্রয় নিয়েছেন। বিরল হলেও কোথাও কোথাও বাক্য গঠনে বিপর্যয় ঘটেছে। দু’একস্থানে স্ব-বিরোধও নজরে পড়ে।

৪. বক্তব্য উপস্থাপনের প্রয়োজনে তিনি যে সব উদাহরণ, দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তা মূলত সাহিত্য থেকে নেয়া। মাত্র এক জায়গায় তিনি আকবর আলী খানের গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন, অন্যত্র উল্লেখ করেছেন রেহমান সোবহানের একটি সাক্ষাৎকারের।

৫. তাঁর মতে, ‘দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ আজ মাস্তান; যে যার জায়গায়। লুণ্ঠন আর এই জাতি আজ প্রায় সমার্থক’ (পৃ. ১৬)। উৎপাদনের চারটি উপাদান : ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন। তিনি মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। যদি তিনি সরাসরি উৎপাদকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষর দিকে তাকাতেন তাহলে দেখতেন শ্রমের নায্য পাওনা তারা বুঝে পায় না। তাদের শ্রম শোষণ করেই ধনী আরো ধনী হয়।

৬. জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি-বাংলাদেশী বিতর্কে তাঁর অবস্থান বাঙালির পক্ষে। যদিও তাঁর সংগঠন নিজস্ব ভূমির মালিক হয়েছে বাংলাদেশীদের সময়কালে। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বচ্ছতার জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ।

৭. তাঁর মতে, ‘বাঙালিরা প্রায় চিরকাল রয়ে গেছে সবরকম সংগঠনের বাইরে’(পৃ. ২৪)। ধর্মকে একটা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করলে উপর্যুক্ত ভাষ্যে অতিসরলীকরণ প্রবণতা দেখা যায়।

৮. তাঁর মতে, ‘আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা ওই দখলদার বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলে নিজেদের বাঁচিয়েছিল এক অমর্যাদাকর উপায়ে—ওই বিদেশিদের এদেশীয় দালালে পরিণত হয়ে’ (পৃ. ২৫)। শুধু সাহিত্যের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে বিদ্যাসাগর, নজরুল, আহমদ শরীফ প্রমুখ কি তাই ছিলেন? কিংবা আহমদ ছফা বা আবদুল হক? আপাতদৃষ্টিতে তাঁর ভাষ্যে ভ্রান্তসরলীকরণ, নিদেনপক্ষে অতিসরলীকরণ দৃশ্যমান।

সংগঠন ও বাঙালি by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে নানা সময়ে প্রকাশিত বইটির ৩টি সংস্করণ
মূল্য: ১৬০ টাকা।

৯. তাঁর মতে, এন.জি.ও.গুলোর ‘আমাদের সমাজের কাছে কোনোরকম জবাবদিহিতাও নেই। বিদেশ থেকে ফান্ড আসছে আর তার সঙ্গে আসছে বিদেশি ব্যবস্থাপনা। তাই দিয়ে যান্ত্রিকভাবে, মানুষের ইচ্ছা-অনুভূতিকে উপেক্ষা করে এগুলো তৈরি হচ্ছে এবং চালু থাকছে। বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসাগুলো যে কারণে এদেশে পাল তোলা নৌকার মতো তরতরিয়ে এগিয়ে যায়, এরাও অনেকটা সে কারণেই বেঁচে আছে’(পৃ. ৩৬)। এন.জি.ও’র পক্ষাবলম্বন আমাদের ইচ্ছে নয়, শুধুমাত্র যুক্তি চর্চার স্বার্থেও যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব, তাঁর প্রতিষ্ঠান-ও এন.জি.ও হিসেবেই নিবন্ধিত। এর দৃশ্যমান ব্যয়ের খাত থাকলেও আয়ের তেমন কোনো খাত দৃষ্টিগোচর হয় না। এটা প্রকাশ্য যে, তাঁর প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রভৃতি বিদেশি সংস্থা থেকে অনুদান নেয়। তাহলে লোকজন যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, এক সময় ‘প্রগতি’ বা ‘রাদুগা’ যে ভূমিকা পালন করত তাঁর প্রতিষ্ঠানও তথাকথিত উন্নয়ন-সহযোগীদের একই রকম এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যাবে? উপরন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনায় না নিয়ে পরিণত মনস্তত্ত্বের পুস্তক প্রাপ্তির বন্দোবস্ত করেছে। যে-কোনো সাধারণ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের এই কাজ করার কথা না, উচিতও না।

১০. তিনি ‘সমালোচক বা ক্রিটিক’ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না। তাঁর মতে, অকর্মণ্য এই লোকেরা বলে ‘ভালো হত আরো ভালো হলে’(পৃ. ৪২)। তিনি সম্ভবত সমালোচকদের সঙ্গে নিন্দুকদের পার্থক্য পুরোপুরি অনুধাবনে সক্ষম হননি। সমালোচকরা কোনো কাজের শক্তিশালী ও দুর্বল উভয় দিকের অন্বেষণ করেন। এর ভিত্তিতে কাজটির কীভাবে আরো শ্রেয়তর হতে পারত সে সম্পর্কে মন্তব্য করেন। আর, নিন্দুকেরা শুধুমাত্র দুর্বলতাকেই বিবেচনায় নেয়।

১১. বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘ভুলগুলোকে শনাক্ত করতে হবে— কীভাবে সে ভুলগুলোকে কমিয়ে আনা যায় তার পথ বের করার জন্যে (শক্তিশালীকেও খুঁজতে হবে সেগুলোকে বাড়িয়ে তোলার জন্যে)’ (পৃ. ৪৫)। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি অর্ধেক খালি গ্লাসই দেখেছেন, অর্ধেক পূর্ণ নয়। না হলে তিনি জাতির শক্তির অন্বেষণ ও এর বর্ধিতকরণের কথা ব্রাকেটের ভেতর বলতেন না। তবে তাঁকে নেতিবাদী মানুষ মনে করারও তেমন কোনো কারণ নেই। সাহিত্যিক-মনস্তত্ত্বের মানুষটি অ্যাক্টিভিস্টের কাজ করতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েই হয়তো একে অপনোদনের কথা ভেবেছেন। দার্শনিক মনস্তত্ত্বের হলে উল্টোটাই ভাবতেন। কেননা আমরা জানি, অন্ধকার মানে আলোর অভাব। ধীরে ধীরে অন্ধকারের অপনোদন নয়, আলোর পরিমাণ বাড়িয়েই অন্ধকারকে দূর করতে হবে।

১২. প্রায় প্রত্যেক অ্যাক্টিভিস্টের মতো তিনিও বাঙালিকে গালি দিয়েছেন। তিনি উদ্ধৃতি কমার ভেতরে রেখে বলেছেন, ‘অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব।’

১৩. অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি বুদ্ধি ও জ্ঞানকে সমার্থক হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। অনেকে যেমন কাণ্ডজ্ঞান ও জ্ঞান-কে সমার্থক হিসেবে দেখে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এদের পার্থক্য বেশ স্পষ্টরূপে অনুধাবন করেছিলেন। তাই তিনি পৃথকরূপে উচ্চারণ করেছিলেন জ্ঞানের কথা ও ভাবের কথা’র। বাঙালি ভাবের কথায় বেশ সিদ্ধহস্ত কিন্তু জ্ঞানের কথায় তেমন নয়। যদি জ্ঞানের কথায় সিদ্ধহস্তই হত তাহলে বিদেশি ব্যবস্থাপনায় এদেশে সংগঠন ও ব্যবসার ক্রমোন্নতির কথা তিনি উল্লেখ করতেন না। তাহলে এদেশীয় চিরায়ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই যুগোপযোগী মনে করতেন। উদাহরণ আরো বাড়ানো যায়, কিন্তু আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আসলে মানবজ্ঞান দুই ভাগে বিভক্ত—ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক। সাহিত্য একটি ব্যক্তিক মানবিক জ্ঞান, যেখানে ব্যক্তির আবেগ অনুভূতি মোটেও ফেলনা নয়। তিনি হয়তো অনবধানতাবশত ব্যক্তিক মানবিক জ্ঞানকেই সার্বিক মানবিক-জ্ঞান হিসেবে ভ্রম করেছেন। একটু আগ বাড়িয়ে বলা যায়, বাঙালি সাহিত্যিক-মনস্তত্ত্বের জাতি হলেও অল্পসংখ্যক সাহিত্যিক-ই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে পেরেছেন।

আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সিংহপুরুষেরা তৈরি হয়ে আসেন; আর আমাদের এখানে সিংহপুরুষেরা (Lion personality) প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এমনও দেখা গেছে, এখানে সিংহপুরুষেরা বিভিন্ন সংগঠনে প্রবেশ করে ইঁদুর হয়ে বের হয়ে এসেছেন। এর কারণ কী সে বিষয়ে তিনি কোনো মতামতই জানাননি।

১৪. তিনি পুস্তকটি উৎসর্গ করেছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে। ‘যাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা ও দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উৎকণ্ঠা’য় তিনি মুগ্ধ। হয়তো সঠিক লোককেই তিনি চিনেছেন! শুধুমাত্র পত্রিকা সম্পাদনাতেই যদি তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা নিঃশেষিত হয়ে যেত তাহলে তিনি নিশ্চয় অ্যাসিড নিক্ষেপ, সন্ত্রাস, মাদকবিরোধী প্রচারণা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য সহযোগিতা-য় অর্জিত নৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে আর্মিব্যাকড সরকারকে জনপ্রিয় ও নৈতিকভাবে বৈধ করার প্রচেষ্টা চালাতে পারতেন না।

১৫. তিনি সংগঠন পরিচালনায় বেনেভোলেন্ট ডিকটেটরের (রাজর্ষির) উপর আস্থা রাখতে চান। কারণ এতে সংগঠনের কার্যক্ষমতা বাড়বে। এ কথায় সত্যতা অবশ্যই নিহিত আছে। তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হল : যোগ্যতা সম্পন্ন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিকশিত না হওয়ায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় না। কয়েক প্রজন্মের নেতৃত্বে উন্নয়নের গাণিতিক গড় করলে দেখা যায়, যেখানে স্বাভাবিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে সেখানে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে; তারা শ্রেয়তর ভালো করেছে।

১৬. ক্ষমতা ন্যাচারাল বিইঙ-কে (মানুষ) দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। তিনি যেহেতু নেতৃত্বকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানে আগ্রহী তাই ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে রক্ষিত হবে সে-বিষয়ে স্পষ্ট প্রস্তাবনা জরুরি ছিলো; কিন্তু তা রক্ষিত হয় নি। এমনকি পরোক্ষভাবেও তেমন কিছু বলেননি।

১৭. সব কিছুরই একটা ঋণাত্মক দিক থাকে, তা যত গৌণই হোক না কেন। সংগঠনেরও নিশ্চয় তেমন দুয়েকটি দিক আছে। কেউ কেউ বলতে চান ক্ষেত্র বিশেষে লজিক্যাল বিইঙ ন্যাচারাল বিইঙ-এর অস্তিত্বের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে। এ বিষয়ে তিনি কোনোই মতামত দেননি।

১৮. আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সিংহপুরুষেরা তৈরি হয়ে আসেন; আর আমাদের এখানে সিংহপুরুষেরা (Lion personality) প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এমনও দেখা গেছে, এখানে সিংহপুরুষেরা বিভিন্ন সংগঠনে প্রবেশ করে ইঁদুর হয়ে বের হয়ে এসেছেন। এর কারণ কী সে বিষয়ে তিনি কোনো মতামতই জানাননি।

১৯. অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় (বিশেষত ব্যক্তিক মানবিক জ্ঞানচর্চায়) ব্যক্তি সংগঠনের শক্তিকে নিজের শক্তি বলে ভুল করে। ফলে তার কণ্ঠ উঁচু হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সংগঠনচ্যুত হয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হলে সে অনুধাবন করে তার প্রকৃত কণ্ঠস্বর। আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে এমন ঘটনা হরহামেশাই দৃষ্টিগোচর হয়। অর্থাৎ, অনেক সময় সংগঠন কৃত্রিমভাবে পরিমাণকে গুণ-রূপে প্রদর্শনে প্রয়াসী হয়। তিনি এমন ঘটনার ভালো-মন্দ কোনো দিক নিয়েই দৃষ্টিপাত করেননি।

২০. লেখকেরা সচরাচর তাঁদের নিজস্ব অবস্থানের চাইতে তুলনামূলক অধিক শক্তিমান লেখকের উদ্ধৃতি নিজের লেখায় ব্যবহার করেন। তিনি এই ক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রমী। নিজের লেখাকেই উদ্ধৃতি কমার ভেতরে অবলীলায় ব্যবহার করেছেন। যেমন—২০ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখিত গল্পটি তিনি বিস্রস্ত জার্নাল-এর দ্বিতীয় পর্বের ১৯৫ সংখ্যক জার্নাল থেকে নিয়েছেন। কিংবা ‘আমরা স্বপ্ন দেখি গণতন্ত্রের, কিন্তু স্বস্তিবোধ করি একনায়কতন্ত্রে’র(পৃ. ৭৩) সঙ্গে তাঁর বিস্রস্ত জার্নাল প্রথম খণ্ডের ৬৪ সংখ্যক জার্নালের হুবহু মিল বিদ্যমান ।

২১. তাঁর দেখার চোখ আছে বলেই দেখতে পান—

প্রায়ই সংগঠনকে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে ভুল করি। সংগঠনের জন্য যে আত্মোৎসর্গ করি তাকে সংগঠনের জন্য আমাদের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বলে ধরে নিই। [পৃ. ৫৬]

এদেশের দার্শনিকেরাও আবেগে উদ্বেলিত, কবি ও ভাবালু। বলিষ্ঠ জীবনবোধ ও উজ্জ্বল হৃদয়াবেগের জায়গায় একধরনের অস্থির তরল উত্তেজনাকে আমরা আমাদের ঈশ্বর বানিয়েছি। [পৃ. ৫৬]

 

জীবন-জগৎকে দেখবার পথ ও পদ্ধতি নির্বাচনের স্বাধীনতা একজন ন্যাচারাল বিইঙ-এর জন্মগত অধিকার। এক ফোঁটা চোখের জলকে কেউ দেখেন বেদনার্ত হৃদয়ের আর্তি হিসেবে, আবার কারও দৃষ্টিতে তা গ্রন্থিরস। যিনি বেদনার্ত হৃদয়ের আর্তি হিসেবে দেখেন তিনি কবি আর যিনি গ্রন্থিরস হিসেবে দেখেন তিনি বিজ্ঞানী। তাঁদের কারও দেখাই হয়তো সম্পূর্ণ নয়। কিন্তু একজনের পক্ষে উভয়রূপে দেখতে পারা দুরূহ বৈকি। আমরা সমগ্র মানবেতিহাসে মাত্র কয়েক জনকে উভয় গুণাবলিতে গুণান্বিত দেখেছি। ফলে আমাদের যে কোনো দেখাই খণ্ডিত। সে-দেখা অস্ফুট ও অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রমথ চৌধুরীর লেখায় খুঁজে পেয়েছিলেন ঠাঠা রোদ্দুর কিন্তু তাঁর পছন্দ ছিল আলো-আঁধারি। আমাদের পছন্দ যা-ই হোক, আলোচ্য Textটিতে ঠাঠা রোদ্দুর কিংবা আলো-আঁধারি কোনোটাই আমরা পরিপূর্ণরূপে পাই না।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.