:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
জাহিদুর রহিম

গদ্যকার, সমালোচক

আমি তব সাথি, হে শেফালি শরৎ নিশির স্বপ্ন…
প্রচ্ছদ: খালেদ চৌধুরীর অলংকরণ অবলম্বনে

আমি তব সাথি, হে শেফালি শরৎ নিশির স্বপ্ন…

১.
বাঙালি তরুণ-তরুণীদের প্রেমে পড়ার পূর্বে অবশ্যই সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাসটি পড়ে নেওয়া উচিত।
বই পড়ার জীবনে বই পড়ে আমি আনন্দ নিয়ে কেঁদেছি, এমন বই আর পাইনি। সৈয়দ মুজতবা আলীর বৈচিত্র্যময় অনেক লেখার পরিসর থাকলেও শুধু ‘শবনম’ উপন্যাসটিই তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে চির অমর করে রাখতে পারে বলেই মনে করি আমি।
‘শবনম’ গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে ৩ বৈশাখ ১৩৬৭ থেকে ১১ ভাদ্র ১৩৬৭ পর্যন্ত ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘শবনম’ প্রথম গ্রন্থাকারে বের হয় অধুনালুপ্ত ত্রিবেণী প্রকাশন কলকাতা থেকে, ১৯৬০ সালে। প্রথম সংস্করণের পৃষ্ঠাসংখ্যা ২১৯, দাম পাঁচ টাকা।
‘শবনম’ তিন খণ্ডে সমাপ্ত, তবে এর কোনো খণ্ডেরই কোনো নাম নাই। তাই এর অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সম্বন্ধে কাঁচা পাঠকের ধারণা সুস্পষ্ট হওয়া কঠিন। সম্ভবত এ কারণেই মুহম্মদ এনামুল হক আমাদের মতো কাঁচা পাঠকদের জন্য বলেছিলেন, ‘উপন্যাসখানা নয়বার পঠন বাঞ্ছনীয়।’
মুখবন্ধ লিখেছেন তিনি, ‘শবনম’কে গদ্য বলতে নারাজ, একে সাহিত্যের কোন ধারায় ফেলা যায় সেটা নিয়ে তিনি কনফিউশনে আছেন। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয় ‘শবনম’ হল গদ্যের আদলে লিখা একটা অসাধারণ প্রেমের কবিতা। ভাবের হিসাবে একে আমার কবিতা বলতেই ভাল লাগে। ড. এনামুল হক তাঁর মুজতবা আলোচনায় ‘শবনম’কে কবিতাই বলেছিলেন! কিন্তু বর্ণনার সুবিধার্থে আমি এটাকে ‘উপন্যাস’ই বলছি এখানে!

‘শবনম’ এক অনবদ্য সুকুমার সাহিত্য, ইংরেজিতে যাকে বলে বেলে-লেটার। তবে এটি উপন্যাস কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক । তিনি বলেছিলেন, “ইহা কি উপন্যাস? হঠাৎ এই প্রশ্নটি মনে উদয় হইল কেন? দেখিতেছি, ইহাতে ‘নায়ক’ (মজনূঁন), ‘নায়িকা’ (শবনম) অদৃশ্যপ্রায় ক্ষীণ-সূত্র নির্ভর একটি ঘটনা (কাবুলে বাচ্চা-ই-সাকার উত্থান-পতন) এমনকি সংলাপ (আসলে ‘প্রলাপ’) ও ট্র্যাজেডি বা বিষাদান্ত্য পরিণতি (প্রকৃতপক্ষে ‘বিরহ’) প্রভৃতি উপন্যাসসুলভ যাবতীয় বস্তু বর্তমান। তথাপি এই জাতীয় একটা অদ্ভুত প্রশ্ন মনে জাগিয়া উঠিল কেন? কারণ ঘটনাপ্রবাহসঞ্জাত চরিত্র সৃষ্টিই উপন্যাসের মূল উপাদান এবং ইহাই ইহাতে অনুপস্থিত। তবে, ইহা কি একখানি নাটক? না, তা কিছুতেই নহে। কারণ নাটকের কোন লক্ষণই ইহাতে বর্তমান নাই। তবে ‘শবনম’ কি সাহিত্যের চির অভিজাত শাখা-কাব্য? কিন্তু, ছন্দোবদ্ধ কাব্য তো ইহাতে দেখিতেছি না। কি করিয়া ইহাকে কাব্য বলিব? তথাপি মন সোল্লাসে বলিয়া উঠে, ভাবমধুর ও রসঘন বাক্যের সমাহার যদি ‘কাব্য’ নামে অভিহিত হয়- তাহা পদ্যে রচিত হউক বা গদ্যে লিখিত হউক- ‘শবনম’ নিশ্চয়ই একখানা ‘কাব্য’-না, একখানা সৃষ্টিমুখর প্রেমকাব্য।”

উপন্যাসটির মূল কাহিনিতে লেখক একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সাথে এক বাঙালি যুবকের প্রেমকাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। অস্থিতিশীল আফগানের প্রেক্ষাপটে একটা নিখুঁত পবিত্র প্রেমের উপন্যাস। দিনের বেলা সবকিছু স্বাভাবিক চললেও রাতের স্বপ্নময় পরিবেশে অবধারিতভাবেই শবনম তার পবিত্রতা আর হেঁয়ালি নিয়ে উপস্থিত হতো।

কয়েকজন সাহিত্যসমালোচকের মুখে আমি এই বইয়ে বর্ণিত সম্পূর্ণ কাহিনি সত্য বলে শুনেছি। তবে সত্য হোক আর কল্পনা হোক, আমি মনে করি প্রত্যেকটি তরুণ-তরুণীর জীবনেই এই বইটির কাহিনিবিন্যাস চরমভাবে সমান্তরাল। উপন্যাসটির মূল কাহিনিতে লেখক একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সাথে এক বাঙালি যুবকের প্রেমকাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। অস্থিতিশীল আফগানের প্রেক্ষাপটে একটা নিখুঁত পবিত্র প্রেমের উপন্যাস। দিনের বেলা সবকিছু স্বাভাবিক চললেও রাতের স্বপ্নময় পরিবেশে অবধারিতভাবেই শবনম তার পবিত্রতা আর হেঁয়ালি নিয়ে উপস্থিত হতো।

‘শবনম’ শুধু উপন্যাস নয়, যেন উপন্যাসের ঠোঙায় পাওয়া কবিতাও নয়, আত্মজৈবনিক বলেও কয়েকবার মনে হয়েছে। হয়তো মুজতবা তাঁর অনুকরণীয় লেখায় আমাকে বোকা বানিয়েছেন অথবা উপন্যাসের ছলে অত্মজীবনী লিখে গেছেন, জানি না কোনটা ঠিক। কিন্তু আমি যা-ই ভেবে নিই, তাতে কী-বা এসে গেল!

যার বর্ণনায় উপন্যাসটি রচিত, তার নাম মজনুন। বাংলাদেশের সিলেট থেকে আফগানিস্তানের কাবুল শহরে তিনি এসেছেন কলেজে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে। তার সাথে থাকেন এক ভৃত্য আবদুর রহমান, যাকে আমরা সৈয়দ সাহেবের অন্য আরও রচনায় পাই। মজনুন সাহেব প্রথম দর্শনেই প্রেমে মজনু হয়ে যান সর্দার আওরঙ্গজেবের কন্যা শবনমের। শবনমের প্রতি তার প্রেমের গভীরতা অনুভব করা যায় শুধু বিরহের ব্যাপ্তিতে। বিরহবেদনার অন্ধকার, গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে আর মাঝে মাঝে মোমের আলোয় ক্ষণিকের জন্য তা দূর হয়ে যায়। শবনম মানেই যে শরতের শিউলি, রাত শেষ না হতে ঝরে পড়াই তার নিয়তি; শরৎ নিশির স্বপ্ন। প্রেমের সমাপ্তি যে কেবল বিরহেই সম্ভব। সেই বিরহে প্রেমিক কখনো অভ্যস্ত হতে পারে না…, চাইলেও পারে না।

শবনম । সৈয়দ মুজতবা আলী । প্রচ্ছদ: খালেদ চৌধুরী । প্রকাশক: স্টুডেন্ট ওয়েজ । মূল্য: ১৫০ টাকা।

প্রেম শব্দটি শুনলেই আমাদের ছেলেমেয়েদের মনে যে রকম একটা আবহ তৈরি হয়, এই উপন্যাসটিতে সে রকম কোনো ঘটনার ঘনঘটা নেই। চিরাচরিত প্রেমের উপন্যাসও নয় এটি। মুজতবা আলী ‘শবনম’ আখ্যানটিতে সম্পূর্ণ নতুন ও হৃদয়গ্রাহী এক উপস্থাপন ভঙ্গিতে প্রেমের এক শাশ্বত রূপ তুলে ধরেছেন আমাদের জন্য।

‘শবনম’ উপন্যাসে সৈয়দ মুজতবা আলী রুচিহীন কিছু লেখকের চোখেও কাঠি নাড়া দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। যেসব লেখক বাস্তবতা আর আধুনিকতার নাম করে উপন্যাস আর সাহিত্যের ভেতরে পাশবিক নগ্নতাকে টেনে নিয়ে এসে আমাদের তরুণ-তরুণীদের শুধু দৈহিক প্রেমের শিক্ষা দিয়ে থাকেন, সেই লেখকদের গালে চপেটাঘাত দিয়ে মুজতবা আলী এই উপন্যাসটিতে মানবিক প্রেমের শিক্ষা দিয়েছেন সুনিপুণভাবে।

২.
উপন্যাস পাঠে দেখা যায়, এর আরম্ভ একটি নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে, ‘বাদশা আমানুল্লার নিশ্চয় মাথা খারাপ।’ এর মধ্য দিয়েই সামগ্রিক উপন্যাসের একটা ক্ষীণ রেখাচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। পাতার পর পাতা পড়ে যেতে থাকলে ধীরে ধীরে আমরা দেখতে পাই, নায়কের প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠা। প্রেমিক শব্দটির সাথে হয়তো প্রবল শব্দটি মানানসই নয়, তারপরও এ উপন্যাসের নায়কের ভেতরে একটা অভ্যন্তরীণ প্রবলতা দেখতে পাই, এবং তার কারণও খুঁজে পাই উপন্যাসের শেষ খণ্ডের সমাপ্তিপূর্ব অনুচ্ছেদের (সপ্তম) শেষে, ‘কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা সে নয়- অথচ ইন্দ্রিয়ই সেখানে তন্মাত্র হয়ে আছে।’
অর্থাৎ লেখকের বর্ণিত প্রেম সাধারণ প্রেম নয়, হয়ওনি। কামের চশমা পরে ‘মোহকে’ যারা ‘প্রেম’ বলেন, এ প্রেম সেই প্রেম নয়। ‘শবনম’-এর প্রথম খণ্ডে এমনই এক প্রেম ধীরে ধীরে জন্মলাভ করে থাকে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডই অনেক বড়, এখানে প্রেমের তীব্রতাও প্রখরতম। এখানে এসেই কালিদাসের সেই অমর উক্তির তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম হয়, ‘হে সৌভাগ্যবান মুক্তা, তুমি একবার মাত্র লৌহশলাকায় বিদ্ধ হইয়া প্রিয়ার বক্ষঃস্থলে বিরাজ করিতেছ; আর হতভাগ্য আমি বিরহ-শলাকায় শতবার ছিদ্রিত হইয়াও সেই স্থলে স্থান করিয়া লইতে পারি না।’

প্রশ্ন জাগে, এখানেই কী ‘শবনম’ শেষ হলো? পাঠক হয়তো খুশি না হয়েই প্রশ্ন করবেন, ‘একদিন আসবে না শবনম?’ ‘শবনম’ আসবে, নিশ্চয়ই আসবে, হৃদয়ের অমরাবতীতে, চৈতন্যের পরপারে। ‘শবনম’-এর ফিরে আসার সেই খণ্ডটি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে যাননি, তুলে রেখেছেন পাঠকের জন্য। সে-ই থেকে পাঠক আজও লিখে চলেছে ‘শব্নম’-এর ফিরে আসার খণ্ডটি, কখনো চোখের জলে, কখনো বৃথা আস্ফালনে আবার সব ফুরিয়ে গেলে কেবল এইটুকু আশা নিয়ে, ‘একদিন আসবে না শবনম।’

এ খণ্ডে অগ্নি আছে, দহন আছে, জ্বালা আছে, আত্ম্যভিমান আছে, আত্মসংবরণও আছে এবং শেষ পর্যন্ত প্রেমের একটা দুর্দমনীয় প্রকাশও আছে। প্রেমের আকৃতিতে এই খণ্ডের আরম্ভ এবং মিলনেই, আরও স্পষ্ট করে, ভাব-সম্মিলনেই এর শেষ। প্রেমের পরিণতিবহ ইঙ্গিত লইয়াই ‘শবনম’-এর দ্বিতীয় খণ্ডের আরম্ভ আর তা ‘শবনম’-এর জবানিতে প্রকাশ পায়, ‘আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।’

এই ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রেম পরিণতি লাভ করে ‘শবনম’-এর তৃতীয় খণ্ডে। তাও ‘শবনম’-এর মুখেই অপ্রত্যাশিতভাবে শোনা গেল, ‘তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।’ এরই দৃশ্যকাব্য বহিঃপ্রকাশ উপন্যাসে ঘটেছে। বিরহের পর ‘মিলন’ সকাম, মিলনের পর ‘বিরহ’ নিষ্কাম। বোধ করি এ কারণেই বাংলার বৈষ্ণবেরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘ভাব-সম্মিলন’। ‘শবনম’-এর তৃতীয় খণ্ডে প্রেমের নিষ্কাম ভাবমূর্তিটিই অঙ্কিত হয়েছে, চিরবিরহের একটি ছোট্ট ইঙ্গিতের সাহায্যে, ‘…কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা সে নয়- অথচ ইন্দ্রিয়ই সেখানে তন্মাত্র হয়ে আছে।’

প্রশ্ন জাগে, এখানেই কী ‘শবনম’ শেষ হলো? পাঠক হয়তো খুশি না হয়েই প্রশ্ন করবেন, ‘একদিন আসবে না শবনম?’ ‘শবনম’ আসবে, নিশ্চয়ই আসবে, হৃদয়ের অমরাবতীতে, চৈতন্যের পরপারে। ‘শবনম’-এর ফিরে আসার সেই খণ্ডটি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে যাননি, তুলে রেখেছেন পাঠকের জন্য। সে-ই থেকে পাঠক আজও লিখে চলেছে ‘শব্নম’-এর ফিরে আসার খণ্ডটি, কখনো চোখের জলে, কখনো বৃথা আস্ফালনে আবার সব ফুরিয়ে গেলে কেবল এইটুকু আশা নিয়ে, ‘একদিন আসবে না শবনম।’

আপনি যখন এই উপন্যাসটি পড়তে থাকবেন, তার কয়েক দিন যাবৎ সকাল-সন্ধ্যা আশপাশে শত শত শবনমকে কল্পনায় পাবেন আপনি। আপনার বাহ্যিক জগৎটা ঠিকঠাক থাকলেও আপনার কল্পনার জগৎকে শবনমেরা তাদের পবিত্রতা আর ভালোবাসা দিয়ে অবধারিতভাবেই আলোড়িত করবে চরমভাবে।

‘শবনম’ মানেই হলো একরাশ মুগ্ধতা, যা উপলব্ধির জন্য শবনমের বর্ণিত কবিতাগুলো উপলব্ধি করা বাঞ্ছনীয়। ‘শবনম’ এক বোতল অদ্ভূত শরাব, যা পান করলে মরণের আগপর্যন্ত নেশা লাগা অবশ্যম্ভাবী!

 

দোহাই:

  1. ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত ‘শব্নম’ উপন্যাসের তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত।
  2. ড. এনামুল হক, ‘শবনম আলোচনা’।
  3. মুজতবা সাহিত্য রূপবৈচিত্র্য, নুরুর রাহমান খান।
  4. সৈয়দ মুজতবা আলী- মনস্বী ও মজলিশী- স্বাতী ভট্টাচার্য্য।
  5. প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ মুজতবা আলী, গোলাম মুস্তাকিম।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.