:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
শওকত আলী : প্রদোষকালের প্রাকৃতজনেরা

আনন্দ পাঠ

শওকত আলী : প্রদোষকালের প্রাকৃতজনেরা

শওকত আলী। হাজার বছর আগে আত্রেয়ী তীরের যে মৃৎশিল্পী গুরুর আদেশ অমান্য করে দেবপীঠে সুষমাময়ী শবর কন্যা, প্রণয়দীপ্ত ব্যাধ রমণী, মমতাময়ী ধীবর জননী তৈরি করেছিলেন, সেই ‘শ্যামাঙ্গ’ এই অশীতিপর শব্দশিল্পীরই অংশজাত। শ্যামাঙ্গ তার রাজ অনুগ্রহপ্রাপ্ত গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করেছিল, ব্রাত্য মুখচ্ছবির অপরাধ কী? ঔপন্যাসিক শওকত আলীর তৈরি অন্যতম প্রধান চরিত্রটি মৃত্যুর মুখেও নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় থাকা মানুষ। প্রদোষে প্রাকৃতজনের দুস্কালের দিবানিশি পরিচ্ছেদের শেষ অংশে স্বধর্মী ও প্রাকৃতজনেরা যখন দলে দলে যবনদের ধর্মের কাছে নিরাপত্তার আশ্রয় গ্রহণ করছিল, শ্যামাঙ্গ তখন ‘মৃত্তিকাশ্রয়ী ধর্ম ত্যাগ করার অর্থ নিজেকেই ত্যাগ করা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে নিরাপত্তা।

উপন্যাসের শুরুতে রয়েছে গুরুগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েও শ্যামাঙ্গ ব্রাত্যজনের মুখচ্ছবির বন্দনা করেই পাঠককে জানিয়ে দিয়েছিল, নতজানু হওয়া শিল্পীর ধর্ম নয়। সেই শিল্প বন্দনাই ছিল শিল্পের ভেতর দিয়ে শ্যামাঙ্গের বিশ্বরূপের সাথে সংযোগ তৈরি এবং রাজশাসনে নিগৃহীত প্রাকৃতজনদের জন্য প্রতিবাদ।

শওকত আলী প্রধান চরিত্র হিসেবে শ্যামাঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়ে গেলেও আমার কাছে বসন্তদাস কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শওকত আলী এই দুই চরিত্রের সাথেই ঘটনার সংযোগ ঘটাতে চেয়েছেন সমান গুরুত্বের সাথে। শ্যামাঙ্গ আর বসন্তদাসের কখনো দেখা হয়নি অথচ দুজনই এক আদর্শ যাপন করে ভূমিকা রেখেছেন ভিন্ন ভিন্ন পন্থায়।

প্রদোষে প্রাকৃতজন নিয়ে আমার নতুন কিছু লেখার নেই। বহুল আলোচিত বই নিয়ে লেখা যায়ওনা এত সহজে। তবু তৃতীয়বার পাঠে শ্যামাঙ্গ আর বসন্তদাসকে নিয়ে এমন মনে হলো বলে ইচ্ছে হলো এখানে একটু কথা বলতে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই বইটা আমি প্রথমবার পড়তে চেয়ে পারিনি, হয়ত বয়সের জন্য। এবার তৃতীয়বার পড়ে মনে হলো বছর দশ বাদে আবারও পড়তে পারব।

উজবুট গ্রামে তাঁরা এসেছেন অন্য দুই গ্রাম থেকে। দুজনই প্রাকৃতজনদের সমব্যথী আর উভয়েই সে সময়ের সামন্ত রাজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তবুও সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র। একজন প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলতে স্বশরীরে অংশ নিয়েছেন, অন্যজন যাত্রা করেছেন চেতনার নির্দেশনায়। একজন বিশ্বের সাথে মিলতে চেয়েছেন শিল্প সত্তার ভেতর দিয়ে অন্যজন পূর্ণতা খুঁজেছেন, বর্তমান ক্রিয়ায় নিজের উপস্থিতিতিতে।

বিশ্বরূপের সাথে মানুষের সংযোগ তৈরির সবচেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মের অর্থে।
“এই বড়ো শরীরটির সঙ্গে পূর্ণভাবে মিলিবে ইহাই ছোটো শরীরের একান্ত সাধন-অথচ আপনার ভেদটুকু যদি না রাখে তাহা হইলে সে মিলনের কোনো অর্থই থাকে না। আমার চোখ আলো হইবে না, চোখরূপে থাকিয়া আলো পাইবে, দেহ পৃথিবী হইবে না দেহরূপে থাকিয়া পৃথিবীকে উপলব্ধি করিবে, ইহাই তাহার সাধনা। বিরাট বিশ্বদেহের সঙ্গে আমাদের ছোটো শরীরটি সকল দিক দিয়া এই যে আপনার যোগ অনুভব করিবার চেষ্টা করিতেছে এ কি তাহার প্রয়োজনের চেষ্টা?… প্রয়োজনের চেয়ে বেশি একটা জিনিস আছে- প্রয়োজন তাহার অন্তর্ভুক্ত, সেটা আর কিছু নহে, পূর্ণতার আনন্দ। চোখ আলোর মধ্যেই পূর্ণ হয়, কান অনুভূতিতেই সার্থক হয়।” (ধর্মের অর্থ)।

আপাতত এটুকুই থাক। প্রদোষে প্রাকৃতজন নিয়ে আমার নতুন কিছু লেখার নেই। বহুল আলোচিত বই নিয়ে লেখা যায়ওনা এত সহজে। তবু তৃতীয়বার পাঠে শ্যামাঙ্গ আর বসন্তদাসকে নিয়ে এমন মনে হলো বলে ইচ্ছে হলো এখানে একটু কথা বলতে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই বইটা আমি প্রথমবার পড়তে চেয়ে পারিনি, হয়ত বয়সের জন্য। এবার তৃতীয়বার পড়ে মনে হলো বছর দশ বাদে আবারও পড়তে পারব।

বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ নিয়েও এমন ঘটেছিল। যে বই পড়তে যেয়ে ‘আমি’ মানুষটা বদলে ফেলতে ইচ্ছে করে, দেখা গিয়েছে সে বই-ই হয়ত পনেরো ষোলো বছর বয়সে হাতে নিয়ে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে সরিয়ে রেখেছিলাম। প্রদোষে প্রাকৃতজনের মতো কয়েকটা ভালো উপন্যাস অনেকদূর পৌঁছে দেয় একটি ভাষার সাহিত্যকে।

২১ জানুয়ারি ২০১৯

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.