:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
রুমা মোদক

গল্পকার, নাট্যকার

অন্ত্যজ জীবনের জহুরি
শিল্পকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

অন্ত্যজ জীবনের জহুরি

গল্প কি জীবন বলে, না কি জীবন গল্প বলে? না কি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক, কিংবা আবশ্যিক। জীবন ব্যক্ত না হলে অব্যক্ত থাকে ইতিহাস। ইতিহাসের উপাদান মানুষ। গল্প তাই আদিম মানুষের সমবয়সী।

ধরুন শব্দ নেই বাক্য নেই সেই চিত্রটির কথা, দ্য লাস্ট সাপার। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি  রং তুলিতে যা এঁকে গেছেন, এওতো এক গল্প। ঠিক কতো শব্দে তা প্রকাশ করা যেতো। কিংবা সালভাদর দালির সেই বিখ্যাত পরাবাস্তব ছবি দ্যা পারসিস্টেন্স অব মেমোরি যা বলতে পারে একজন ভাষ্যকার ঠিক কতোগুলো শব্দে তা প্রকাশ করতে পারতো? শিল্পকর্ম বা চিত্রকলা বা সাহিত্য ঠিক কতোটুকু ধারণ করতে পারে জীবনের অন্তর্গত ভাষ্য, রূঢ় কিংবা কোমল।

লেখক লেখার আগে যে একটি বীজ তাঁর ভেতরে অঙ্কুরিত হয়, তার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় লেখক কতোটা নৈর্ব্যক্তিকতার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন, কী অভীষ্ট কাজ করে চরিত্র নির্বাচনে কিংবা আখ্যান বয়ানে? লেখক যে শ্রেণির মানুষের আখ্যান লিখবেন, তার ঠিক কতোটা কাছে গেলে তাঁর যাপন জানা যায় ঘনিষ্ঠভাবে, যা না জানলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে౼ পৌঁছায় না বহুতর ডাক, রয়ে যায় ফাঁক।

সেলিম মোরশেদ কেনো তাঁর আখ্যানের চরিত্র নির্বাচন করেন হেমাঙ্গিনী কিংবা সখিচানের মতো অপ্রচলিত অন্ত্যজকে। এ কি বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্র ছোটগল্প কিংবা তার পরবর্তী তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল কিংবা হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখের পরম্পরা? গল্পকার তিনি যে শ্রেণি থেকেই উঠে আসুন, অন্ত্যজ জীবনকে রূপায়িত করেই সাহিত্যে স্থায়ী আসন পোক্ত করেন। সেলিম মোরশেদ কি কেবলই তার উত্তরাধিকার বহন করছেন। কী বলে তাঁর গল্পের নির্মাণ কৌশল, শব্দচয়ন এবং উপসংহার? পাঠক চলুন, দেখি তাঁর দুটো চরিত্রের গন্তব্য, কতোটা তা বাস্তব, বাস্তবের অধিক বাস্তব, ঘা মেরে ভদ্রস্থ উদাসীনতাকে আহত করার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মূলত যে অসুন্দর আমাদের ভদ্রস্থ রুচি অনুমোদন করে না, আমরা অন্ধের প্রলয় অস্বীকারের মতো তা অস্বীকার করে যাই। লেখকচেতনা যখন অনুসন্ধিৎসু এবং সৎ, দায়বদ্ধ এবং অকপট। সাহসী এবং নিজস্ব শব্দ ও ভাষায়, সৃজনশীলতা ও লক্ষ্যে আত্মবিশ্বাসী আপসহীন, তিনি তখন কলম ধরেন, তখন বাংলা সাহিত্যে জন্ম নেয় ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’। জন্ম নেয় হেমাঙ্গিনীর মতো চরিত্র। এই চরিত্র নির্মাণে পর্যবেক্ষণ চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না কি চিন্তা চালিত করে পর্যবেক্ষণকে।

গল্পকার সেলিম মোরশেদ কি হেমাঙ্গিনীকে চেনেন? তিনি কেন হেমাঙ্গিনীকেই অনুসন্ধান করেন তাঁর গল্পের চরিত্র হিসাবে। ‘কেন লিখি’-তে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তিনি যখন গল্পের চরিত্র খুঁজতে যান, তখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘চাষি, মাঝি, জেলে, তাঁতিদের পীড়িত ক্লিষ্ট মুখ। লেকের জনহীন স্তব্ধতা ধ্বনিত হতো ঝিঁঝির ডাকে, শেয়াল ডেকে পৃথিবীকে স্তব্ধতর করে দিতো, তারারা চোখ ঠারতো আকাশের হাজার ট্যারা চোখের মতো, কোনদিন উঠতো চাঁদ। আর ওই মুখগুলি – মধ্যবিত্ত আর চাষাভুষো ౼ ওই মুখগুলি আমার মধ্যে মুখর অনুভূতি হয়ে চ্যাঁচাতো – ভাষা দাও – ভাষা দাও।

আমি কি জানি ভাষা দিতে?…

সেলিম মোরশেদ সেই দুঃসাহসী ভাষ্যকার। যিনি ভাষা দিতে জানেন। যিনি শুরুই করেন অভিনব, অপ্রচলিত ভাষায়, ‘চাটাইয়ের অপরিণত ত্রিকোণ ছিদ্রে পিঁচুটিভরা চোখে সামনের জামগাছ সমেত সক্কালের সুচিক্কণ টানটান রোদে মুহূর্তে সজ্ঞান হেমাঙ্গিনী জেগে উঠে পা ভেঙে ভেঙে খুপরি ছেড়ে বড় রাস্তার মোড়ে এলো।’ সকালের সুচিক্কণ টানটান রোদের দ্যোতনাময় বাক্যে রাবীন্দ্রিক নামের হেমাঙ্গিনীকে খুপরিতে আবিষ্কার করে আমরা নড়েচড়ে বসি এক নতুন পাঠাভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে। খুপরিতে যার বাস তার নাম হেমাঙ্গিনী! অচেনা জীবনপাঠের যাত্রী হওয়ার প্রস্তুতি সত্ত্বেও এমন প্রথাবিরোধী প্রারম্ভিকতায় কোন আখ্যানের শুরু প্রথম পাঠকে চমকে দেয়। হতচকিত করে।

তারপর সেলিম মোরশেদ পাঠককে যে ভ্রমণের সঙ্গী করেন তার বাঁকগুলো রাস্তার মানুষের উপস্থিতির মতোই উৎকট। শুরুতে যে ধাক্কা দিয়ে গল্পের শুরু, যাত্রাপথের ধাক্কাগুলো আরো বীভৎসতা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে যে আমরা ভয়াবহ অস্তিত্বের সংকটে অপ্রস্তুত হয়ে যাই। শেষটায় যেন টাল সামলাতে না পেরে তাবৎ সুন্দরের মুখে, এস্টাবলিশমেন্টের মুখে থুথু ছুড়ে দিয়ে অনুভব করি নিজেদের শিরা ধমনিতে তপ্ত গরল লাভা, খেদের, ক্ষোভের, বিবমিষার। মানবজন্মের প্রতি খেদ, ক্ষোভ আর বিবমিষা।

বনেদি নামের অধিকারী হেমাঙ্গিনীকে মুসলমানেরা পয়সা দিয়ে অফিসে যায়। আমরা জানতে থাকি পেটে যতোই খিদে থাকুক, এতে ভদ্র সমাজের ভদ্র বাচ্চাদের মোজা পরে স্কুলে যাওয়ার নৈমিত্তিকতায় কোন ছেদ পড়ে না। এই একটি বাক্যে এক নির্মম সোশিও পলিটিক্যাল ন্যারোটিভ গল্পকার আলগোছে পাঠকের মস্তিষ্কে সুচতুর কৌশলে ছেড়ে দেন। পাঠকের কাছে লাইনটি হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক বোধ হলেও নির্দয় বাস্তবতার চিত্রকল্প তৈরি করতে এর চেয়ে সহজ অথচ শরের মতো তীক্ষ্ণ উপমা বুঝি আর হয় না।

বুকের সাথে হাত লেপ্টে থাকায় হেমাঙ্গিনী ভদ্রলোকদের কাছে বিশ্বস্ত। ততোক্ষণে পাঠকের জানা হয় হেমাঙ্গিনী ভিক্ষুক, ভিক্ষাই তার ক্ষুন্নিবৃত্তির মাধ্যম। যেহেতু সে লিঙ্গপরিচয়ে নারী, এই ক্ষুন্নিবৃত্তির সবচেয়ে নিকৃষ্টতম পেশাটির জন্য তার নারীত্বকে অপমান থেকে আড়াল কিংবা নিরাপদ রাখার জন্য হাতের মতো প্রয়োজনীয় অঙ্গটিকে বিসর্জন দিতে হয় হাতিয়ার হিসাবে। ঢেকে রাখতে হয় নারীত্বের লক্ষণগুলি। যাতে সে বিশ্বস্ত হয়ে উঠে ভদ্রলোকের কাছে এবং ভদ্রলোকগণ౼যাদের নিজের উপর যতোটা ভরসা তারচেয়েও বেশি ভরসা নারীটির অক্ষমতায়।

লেখকচেতনা যখন অনুসন্ধিৎসু এবং সৎ, দায়বদ্ধ এবং অকপট। সাহসী এবং নিজস্ব শব্দ ও ভাষায়, সৃজনশীলতা ও লক্ষ্যে আত্মবিশ্বাসী আপসহীন, তিনি তখন কলম ধরেন, তখন বাংলা সাহিত্যে জন্ম নেয় ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’। জন্ম নেয় হেমাঙ্গিনীর মতো চরিত্র।

এর  মাঝে পাঠক হেমাঙ্গিনীর আরো অক্ষমতার কথা জানতে পারে যে তার পায়েরও চারটি আঙুল নেই। এখানে গল্পকার বিশ্বাসের মতো যোগ করে দেন এক কুসংস্কারজাত মিথ।  এ হেমাঙ্গিনীর শ্রেণি এবং তদজাত অজ্ঞানতার বিশ্বাস। কিন্তু তিনি এভাবে সেটি পাঠকের মাঝে ছুড়ে দেন, পাঠক ক্ষণিক বিভ্রান্ত হয়। এ কি লেখকের মনোজগৎজাত সংস্কার? পরক্ষণেই ভ্রম ভাঙে। তিনি যে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষটির কথা বলছেন, মূলত তিনি হয়েছেন তাঁর অন্তর্যামী। এবং বিশ্বস্ত কথক। ফলে এমন নির্বিকারভাবে বাক্যটি জুড়ে দিতে পারেন।

মূল গল্পটি শুরু হয় হেমাঙ্গিনীর একটি সাপ দেখার মধ্য দিয়ে। নির্বোধ প্রাণীর মতো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেয়ে বড় কোনো সংকট যার দৃশ্যমান জীবনে নেই, জীবনের ভয়ে যে ভিখিরি পুনর্বাসন কেন্দ্রে যায় না, রাষ্ট্রীয় আগ্রাসী নির্দয় ভূমিকা তাঁকে আতঙ্কিত করে। ভিখিরি কমানোর অমানবিক রাষ্ট্রীয় নীতির বলি হবে সে। সারাদিনে যার রোজগার হয় মাত্র ত্রিশ পয়সা। যা দিয়ে সে একখানা রুটির অর্ধেক খেতে পারে, যাতে তার পেটের তীব্র খিদের এককোণাও পূর্ণ হয় না। প্রথম সাপ দর্শনে মনে হয় বুঝি সেই অভুক্ত অর্ধভুক্ত জীবন হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত।

তাঁর ঘরে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে বস্তির সবচেয়ে সুস্থ ও সুঠাম পুরুষ মসি। কিন্তু চুলায় রান্নার কিছু নেই। সেই চুলায় পুড়ছে রবীন্দ্রনাথ। জীবনের নগ্ন প্রয়োজনে খিদে আর অস্তিত্বের সংকটে রাবীন্দ্রিক নান্দনিকতা বড়োই অকেজো অপ্রয়োজনীয়। চুলার পাশে অসহায় পড়ে থাকে হেমাঙ্গিনীর সংসার, তোবড়ানো মগ, জং ধরা বটি দা নিতান্ত প্রাসঙ্গিক আয়োজন কিন্তু নেই সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন খিদের খাদ্যটাই।

অভুক্ত হেমাঙ্গিনী দেখে সাপের চর্বিযুক্ত পেট। যে জীবনের আতঙ্ক হেমাঙ্গিনী থেকে আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় মনে হয় বুঝি সাপটি আমারই মাথার উপর গোলপাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে, আমাকে অস্থির করে উদ্বিগ্নতা, ভয়, আতঙ্ক। বুঝি লাফিয়ে পড়লো! ঠিক তখন নিপুণ বিমূর্ততায় লেখক ইশারা রেখে যান, হেমাঙ্গিনীর পূর্বের খাবারের স্মৃতি দিয়ে। তাঁর জন্মদায়িনী মা দেহ বেচে খেতো যে, বয়স ফুরালে লোমওঠা মাদী কুকুরের মতো জলা থেকে ধরে আনা চ্যাং আর পুরানা নাঙের ভিক্ষে দেয়া চালে রান্না ভাতের স্মৃতি আমাদের মুহূর্তে আতঙ্কের বোধ থেকে বিযুক্ত করে। আমরা পুনরায় বিভ্রান্ত হই, ঠিক এই সময়ে তিনি সেই চ্যাং আর ভাতের বয়ান দিচ্ছেন কেনো! এই বিভ্রান্ততায় আমরা জানি গোলপাতার ফাঁকে উঁকি দেয়া নক্ষত্রবিন্দু সূর্য হয়ে হেমাঙ্গিনীর চোখের ভিতর জ্বলে। মুহূর্তের জন্য তা সমাপাতনে সুকান্তের ঝলসানো রুটির সমার্থক হয়ে ওঠে হয়তো গল্পকারের সচেতনে কিংবা অচেতনে।

হেমাঙ্গিনী ভয় পায়। কিসের ভয়? মৃত্যুর? যে মৃত্যুর ভয়ে সে ভিখারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে যায়নি। এমন একটি সম্ভাবনাই তো উদ্রেক হবে পাঠকের পূর্ব পাঠের অভিঘাতে। এই হিমশীতল মৃত্যুর আতঙ্কে আমরা নিশ্চিত ভুলে যাবো, হেমাঙ্গিনী ক্ষুধার্ত। আর সুনিপুণ নির্মাতা সেলিম মোরশেদ আমাদেরকে হেমাঙ্গিনীর জীবনের সংকটে রেখে তৈরি করতে থাকেন তাঁর উদ্দীষ্ট পরিণতি। পাঠক কি তার আঁচ পায়?

এমন সময় সাপটা নড়েচড়ে উঠে। হেমাঙ্গিনীর বোধ হয় সে শ্মশানে পোড়া মৃতদেহ যার চুল পোড়ার গন্ধে সাপটি নড়ে উঠে। ভয়, আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা সব ছাপিয়ে পাঠক হঠাৎ তখন একটা কিনারা পায়, হেমাঙ্গিনী সাপের পেটের দিকে তাকিয়ে আছে ভয়ে নয়, লোভাতুর দৃষ্টিতে। তবু সে দৃষ্টির অনুবাদ করার দুঃসাহস নেই পাঠকের। তবে কি এবারে কিছু আঁচ করা যায়, কি ঘটতে যাচ্ছে হেমাঙ্গিনীর খুপরিতে। পাঠক মুখোমুখি হতে যাচ্ছে কী বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার?

দুঃসাহসী লেখক তখন যাবতীয় রীতিনীতি প্রথা আচরণকে অগ্রাহ্য করে প্রচ্ছন্ন অথচ অপ্রচলিত ইঙ্গিতে বহুমাত্রিক এবং স্পর্ধিত কথা বলে যান, ‘হেমাঙ্গিনীর দশ আঙুল তখন আরশ এর গায়ে, দ্যুতিহীন জলছাপের স্থিতিকাল….. মুহূর্তকালের উগ্র অসহায়ত্ব তাকে গ্রাস করে…..।’ সর্বগ্রাসী খিদায় কোমল দশ আঙুল প্রার্থনারত নিবেদিত মানবীর নয়। বরং নিজেই নিজের ভাগ্যনির্মাতা, তা হয়তো প্রচলিত ডাইনির সমার্থক।

এখানে গল্পকার অভিনবভাবে কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যবহার করেন, যা একান্তই তাঁর নিজস্ব ক্রাফট। এই ক্রাফট তিনি ব্যবহার করেন পাঠকের পরবর্তী ঘটনাক্রমের প্রস্তুতির জন্য। কিন্তু তবুও সবশেষে যা ঘটে, তার জন্য কি আদৌ প্রস্তুত হয় পাঠক?

অবশেষে সাপটি ধরতে সক্ষম হয় হেমাঙ্গিনী। সাপটি তার হাত পেঁচিয়ে ধরে। আমরা কি তখনো আঁচ করতে পারি কী ঘটতে যাচ্ছে? হেমাঙ্গিনী সাপটি পুড়িয়ে খায়। আর পুড়িয়ে দেয় আমাদের সব শালীন শুভ বোধ। আমরা জানি কিন্তু মানি না, অস্বীকার করি বেঁচে থাকার জন্য পেটের খিদের মতো তীব্র আর কোনো নগ্ন আদিমতা নেই মানুষের। কাটা সাপের মুণ্ডুটা তাঁকে ছেড়ে গেলে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সব ভয়ও কি তাঁকে ছেড়ে যায়। এমনই একটি প্রতীকী ইঙ্গিতে তীব্র স্বরে গল্পকার এবার তাঁর সমস্ত গল্প ফাঁদার অন্তর্গত দর্শনটি উক্ত করেন। ভয়ংকর সাহসী হলেই খেতে পাওয়া যায়। এ কি বাস্তবে সম্ভব? মৃত্যুভয় অতিক্রম করে একটি বিষাক্ত সাপ পুড়িয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করা? এ কি অসম্ভব? রাক্ষসের মতো খিদে যখন অস্তিত্বের টুঁটি চেপে ধরে তখন কি মানুষ আমাদের কল্পনারও অতীত সাহসী হয়ে উঠতে পারে না?

বর্তমান বিশ্ব যে অতিক্রম করছে এক ভয়াবহ অতিমারি, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে জীবনের জন্য হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে যাওয়াতো সেই সত্য আবারও উন্মোচিত করে আমাদের কাছে। যে বাস্তবতা কখনো গল্পের নির্মিতির চেয়েও সত্য কিংবা গল্পও স্পর্শ করতে পারে না সত্যের নির্মমতাকে। মূলত এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রথাসিদ্ধ থিসিসের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন পূর্বক প্রান্তিক হেমাঙ্গিনীর এই এন্টিথিসিস বিপ্লবের নামান্তর। সেলিম মোরশেদ মানবসত্তার সোশিও পলিটিক্যাল এনালাইসিসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে লিখে দেন  ইন্সটিংক্ট কোনো মানবসৃষ্ট শাস্ত্রের ধার ধারে না।

সেলিম মোরশেদ বাংলা সাহিত্যের সেই বিরলপ্রজ কথাকার, তিনি কোটি মানুষের ভীড়ে অনুসন্ধান করেন সেই মানুষ౼যে মানুষ আমরা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই, উপেক্ষা করি। জহুরির মতো তুলে আনেন তিক্ত জীবন, তপ্ত জীবন।

এবার পাঠ করি সখিচানকে।

হাসপাতালের লাইটপোস্টের উপর বসে থাকা একটি ঝিমমারা রাতের পাখি দেখে যে গল্পটির শুরু হয়, গল্পের শুরুতে আমাদের পরিচয় হয় সখিচানের সাথে। তখনো আমরা জানি না সখিচান কে, কী তাঁর পেশা। বরফের অজস্র কুচি নীরবে ভেঙে ভেঙে ঢুকছে যে হিম তা আমাদের গায়েও বিঁধে ভাঙা কাচের কুচির মতো। সখিচানের জবানীতে আমরা জানি,   মানুষ তাকে যেভাবে দেখে, সেই দেখার ভঙ্গিতে আমাদের জানা হয় এমন এক পেশার সাথে সে জড়িত, যা অপ্রচলিত। শুধু তাই নয়। সে অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য। তাঁর স্ত্রী দুলারী, কন্যা ফাল্গুনীকে নিয়ে তাঁর যে সংসার তা আড়াল করে থাকে মৃত্যুর মতো অনিশ্চয়তা।

চাকরির শেষদিনে তাঁর ঘরে বসেছে মদের আসর। সখিচানের পেশার আবশ্যিক অনুষঙ্গ এই নেশা। এই আসরে যাদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়, হারাধন, গোবিন্দ, মনোহর তাদের ছাপিয়ে আরেক অদৃশ্য চরিত্র গল্পে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে౼সে হলো রামপিয়ারী। রামপিয়ারী এক বিমূর্ত প্রেম হয়ে জুড়ে থাকে সখিচানের জীবনে। দুলারীর সাথে গার্হস্থ্য জীবন কাটাতে কাটাতে সখিচান উপলব্ধি করে, সংসার মানে পাওয়া না পাওয়া নিয়ে একে অপর থেকে দূরে সরে যাওয়া।

সখিচানের প্রেমে রামপিয়ারী দেখেছিলো উন্মত্ততা আর সখিচান শুনেছিলো মৃত্যুর করতালি। রামপিয়ারী মোহ, দুলারী মায়া। শেষ পর্যন্ত কি গল্পটি এক অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের প্রেমের আখ্যান? অপঘাতে মৃত্যু, লাশকাটার বিচিত্র দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে যেখানে সখিচানের ব্যক্তি হাহাকার মুখ্য হয়ে থাকে?

কতো জীবন দেখে সে লাশকাটা ঘরে, অপূর্ব সুন্দরী, সদ্য মা হওয়া নারী, আত্মঘাতী। মেয়েকে বিয়ে করা বাপ। কী বিচিত্র। কী ভয়াবহ। জীবনের এই রূঢ় নগ্নতা লাশকাটা ঘরে না ঢুকলে এভাবে জানা অসম্ভব। জানা অসম্ভব অপূর্ব সুন্দরী নারী, সদ্য মা হওয়া নারী যখন আত্মঘাতী হয় তখন কেমন মৃতদেহের ফেঁপে উঠা স্তনে ফোটে শুভ্র ফেনিল দুধকণা। জানা হয় মৃত্যুর সাথে আজন্ম বসবাস করে বলেই কালো অসুন্দর নারী কখনো আত্মঘাতী হয়ে লাশঘরে আসেনি। জীবন লড়াই করতে করতে চেনা হয়, চেনা হয় অপমান, অপঘাত বঞ্চনায়। কিন্তু লাশকাটা ঘরে যেভাবে জীবনের এই  ট্রাজিক মাহাকাব্যগুলো জানা হয়, জানা হয় উদোম লাশ ফেঁড়ে ভেতরে বেদনার মতো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমেত, তেমন কি আর জানা হয় কোনোভাবে?

প্রতিদিন লাশ কাটার মতো দুঃসাহসী জীবিকার মানুষটি নিজের জীবন কাটানোর লড়াইয়ে আজ চাকরির শেষ দিনে ভীতু, বোধহয় তাঁর মাথা গোঁজার ঠাইটুকু যায় চাকরির সাথে সাথে। এই যে দিন কাটানোর শঙ্কাময় জীবন তাতো মৃত্যুর চেয়েও দুর্বিষহ।

জীবন আঁকড়ে থাকা অপমান হতাশা বেদনা তারা অস্বীকার করতে চায় নেশায় চুরচুর হয়ে, যে নেশার জন্য মানুষের মল থেকে সোনার বার তুলে নিতেও দ্বিধা নেই তাদের। নেশায় ভুলতে চাওয়া পার্থিব জীবনের বেদনার বিমূর্ত অনুভূতির জগতে তারা যখন লাইটপোস্টের উপর দেখে পাখি, বসে আছে হিমের কামড় উপেক্ষা করে ঘাপটি মেরে! এ কি তাদের কাঙ্ক্ষিত সুখ বা নিশ্চিত জীবনের মেটাফর? যে পাখিটি তারা ধরতে চায়, অথচ জানে অধরা এ পাখি ধরতে যাওয়ার প্রচেষ্টার গন্তব্যও হবে মৃত্যুঘর?

মানুষ তাঁর সীমিত শারীরিক সামর্থ্যে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যে সমাজ তৈরি করেছে, সেই সমাজ বৈষম্যের নানা শৃঙ্খলে মানুষকেই জাপটে ধরে, নিয়ন্ত্রিত করে, হত্যা করে। মানুষের জীবন মানুষের হাতেই হয়ে উঠে কীটপতঙ্গ সম। কতো ফাঁকফোকড়ে পিষে দেয়া যায় অনায়াসে। সব মূল্যবোধ, নান্দনিকতা ভেঙেচুরে দেওয়া নির্মম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের চেনা হয় এই নেশার ঘোরে লাশকাটা সখিচানের স্ত্রী সন্তানকে। জানা হয় সোকল্ড ভদ্রলোকের সাথে হোটেলে খেতে গেলেও তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকায়।

জীবনের সকল জব্দ করা সংকটেও সে ভাবে, আসলেই কি তাই যে জল্লাদ সে রাজা। না সখিচান রাজা হতে চায়নি। জল্লাদও নয়। সে প্রেমিক হতে চেয়েছে। দ্যোতনায় সে শুনতে চায় রামপিয়ারীর নূপুরের নিক্কণ। শোনা যায় না। বরং তার বদলে ফিরে ফিরে আসে অপঘাতে মৃত্যুর অশরীরী গোঁ গোঁ।

বাংলা সাহিত্যের জগৎ যখন আচ্ছন্ন নানা নিরীক্ষায়, উপেক্ষিত স্বসমাজ, স্বজাতি, মাটি ও শেকড়। তখন সেলিম মোরশেদ শেকড় খুঁড়েন, সেলিম মোরশেদ সেই অন্ত্যজ অস্পৃশ্য মানুষের কথা বলেন, যে মানুষের শ্রেণি থেকে তাঁর উত্থান নয়, কিন্তু সেই শ্রেণিকে তিনি ধারণ করেন চেতনায়, প্রবল শ্রেণিচেতনায় সেলিম মোরশেদ আমাদের সামনে উন্মুক্ত করেন হেমাঙ্গিনী সখিচানের জীবন আর সংগ্রাম, সেলিম মোরশেদ বাংলা সাহিত্যের সেই বিরলপ্রজ কথাকার, তিনি কোটি মানুষের ভীড়ে অনুসন্ধান করেন সেই মানুষ౼যে মানুষ আমরা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই, উপেক্ষা করি। জহুরির মতো তুলে আনেন তিক্ত জীবন, তপ্ত জীবন। সেলিম মোরশেদের সমতুল্য জহুরি কথাকার সমকালে দৃষ্ট হয় না।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!