অন্যদের কোনও কথাই আমরা মন দিয়ে শুনি না : হারুকি মুরাকামি
ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখালেখি আর প্রায় তিন ডজন বই প্রকাশ হবার পর এটা বলা যায় যে মুরাকামি উপযুক্ত সময়েই সাড়া দিয়েছেন; তার অদ্ভুত, স্বতন্ত্র, সৌন্দর্যময়, মর্মভেদী উপন্যাসগুলি, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ থেকে ‘আফটার ডার্ক’ বিশ্বব্যাপী পেয়েছে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা, অনূদিত হয়েছে আটচল্লিশটিরও বেশি ভাষায়!
‘৭৮-এর পয়লা এপ্রিলে, তিনি টোকিও’র জিংগু বেসবল মাঠের পেছনে, ঘাসে ঢাকা ছোট পাহাড়ে ঘুরতে এলেন। মুরাকামি কি উপন্যাস লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন?
তাঁর স্মৃতিকথা ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং’-এ যেভাবে বলেছেন, তা থেকে অনুমান করা যায় এই বিপুল পরিমাণ সৃষ্টি হয়ত অসম্ভব ছিল, দৈনিক ৬০টি সিগারেটে আসক্ত কোনও ব্যক্তির কাছে যা আসলেই এক অকল্পনীয় ব্যাপার; প্রতিদিন সে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়, মাইলের পর মাইল দৌড়ে গল্পগুলিকে তুলে নিতে পারে সময়ের হাত থেকে।
শহরের একেবারে কেন্দ্রে, ম্যানহাটান হোটেলের লবি’র অল্প-আলোয়, শরীরের ঘুমের জড়তা মুছে, খানিকটা দৌড়ে এসে, কিছুক্ষণ লিখে, আরেকটি সাক্ষাৎকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে, ঊনষাট বছর বয়সী দীপ্তিমান উপন্যাসিক ব্যাখ্যা করছিলেন কবে, কীভাবে শুরু করেছিলেন তার লেখালেখি; শুনে মনে হচ্ছিল এ এক ব্যাপক বিস্তৃত জীবন। মুরাকামি বলছিলেন কীভাবে জীবনযাপনের নীতিগুলিকে নিয়ে তার ভাবনা শুরু হয়েছিল। ‘আমার একটা থিওরি আছে’, কথা বলছিলেন গভীর মন্দ্র স্বরে, ‘আপনি যদি তীব্রভাবে জীবনের আটপৌরে দিনগুলিকে যাপন করেন, তাহলে আপনার কল্পনাশক্তিও তীব্র হবে। কল্পনার যে-শক্তি আমরা আমাদের জীবনে বহন করে চলি, সেই শক্তিটুকু কার্যকর থাকবে। তাই আমি প্রতিদিন ভোরে জেগে উঠি, প্রতিটি দিন, তারপর আমি আমার লেখার টেবিলে বসে পড়ি, লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।
মুরাকামি বলছিলেন কীভাবে জীবনযাপনের নীতিগুলিকে নিয়ে তার ভাবনা শুরু হয়েছিল। ‘আমার একটা থিওরি আছে’, কথা বলছিলেন গভীর মন্দ্র স্বরে, ‘আপনি যদি তীব্রভাবে জীবনের আটপৌরে দিনগুলিকে যাপন করেন, তাহলে আপনার কল্পনাশক্তিও তীব্র হবে। কল্পনার যে-শক্তি আমরা আমাদের জীবনে বহন করে চলি, সেই শক্তিটুকু কার্যকর থাকবে। তাই আমি প্রতিদিন ভোরে জেগে উঠি, প্রতিটি দিন, তারপর আমি আমার লেখার টেবিলে বসে পড়ি, লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।
লেখালেখি নিয়ে বলছিলেন যখন, মুরাকামিকে তখন এক নিঃসঙ্গ অস্তিত্ববাদী মনে হচ্ছিল, কিংবা এক পেশাদার খেলোয়াড়, মনে হচ্ছিল এক উদ্বুদ্ধকারী বক্তা। ধীর লয়ে, যেন এখনই গভীর প্রশান্তিতে জীবনের মন্ত্র উচ্চারিত হবে, এমনভাবে বলছিলেন- ‘লেখাকে মনে করুন অন্ধকার কক্ষে যাওয়ার মত কিছু। আমি সেই অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করলাম, কক্ষের দরোজাটি খুলে ফেললাম, সেখানে কেবল অন্ধকার, আর অন্ধকার। বিপুল সে অন্ধকারে অবশ্যই কিছু দেখলাম আমি, কোনও কিছু স্পর্শও করলাম, তারপর ফিরে এলাম আলোয়, পৃথিবীতে, ফিরে লেখার টেবিলে বসে পড়লাম।’
একটানা কথাগুলি বলে মুরাকামি হঠাৎ এক বিরতি নিলেন যেন গির্জায় প্রার্থনারত মানুষরা দীর্ঘ নীরবতায় মগ্ন, তারপর, তিনি কিছু দরকারি শর্তের কথা বললেন, কিছু আবশ্যকীয় শর্ত-‘আপনাকে শক্তিমান হতে হবে, নাছোড়বান্দা হতে হবে, বেপরোয়া হতে হবে। যা লিখতে চাইছেন সে সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। সবই করতে হবে, যদি আপনার সেই অন্ধকার কক্ষে ঢুকবার ইচ্ছে থাকে।’
এমনকি, মুরাকামি যখন জাপানেও থাকেন না, তখনও তিনি কঠোর কিছু নিয়ম মেনে চলেন। খুব ভোরে জাগেন, কয়েক ঘণ্টা লেখালেখি করেন, দৌড়ান আর বিকালগুলি কাটতে থাকে সাহিত্যের অনুবাদে। এর মধ্যে তিনি অনুবাদও করে ফেলেছেন ‘দ্য গ্রেট গেটসবি’, ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই, এবং অধুনা রেমন্ড চ্যান্ডলারের ‘ফেয়ারওয়েল, মাই লাভ’। এই বইগুলি।
মুরাকামি সেইসব মানুষের কথা লেখেন, জীবনভর যারা পার্শ্ববর্তী পথ দিয়ে দৈবক্রমে হেঁটে যায় কিংবা উদ্ভট, অস্বাভাবিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা তাড়িত হয়। তার ‘কাফকা অন দ্য শোর’ হলো কথা বলতে পারে এমন বেড়ালদের নিয়ে, ‘আফটার দ্য কোয়েক’-এ আছে নিজেকে অতিকায় ব্যাঙ মনে করা এমন এক মানুষের গল্প, যার মনে হচ্ছে সে টোকিও’র ওপর থেকে কথা বলছে।
যদিও তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তী জীবন যাপন করেন, তবুও, মুরাকামি জানেন নিয়তি কীভাবে আমাদের জীবন বদলে দেয়। দুটি ঘটনা তার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল; ৮০’র শেষের দিকে ঘটেছিল প্রথম ঘটনাটি, ভয়ানক মাত্রার এক ভূমিকম্প। তিনি যেন ক্লান্ত কিংবা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, এমন স্বরে হাঠৎ বলে উঠলেন, ‘পিঠ চুলকোতে চুলকোতে পান করে যাওয়া’। কথাটা বললেন টোকিও’র লেখকসমাজকে উদ্দেশ্য করে, যে-সমাজে তিনি নিজেকে বিবেচনা করেন একজন আউটসাইডার। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান, তারপর লেখেন যুগ সৃষ্টিকারী উপন্যাস-‘নরওয়েজিয়ান উড’।
এই অভিজ্ঞতা তাকে বদলেও দেয় অনেকখানি। বিপর্যস্ত মানুষদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে চরিত্রদের নিয়ে লিখতে হয়। ‘জানেন, এরকম বহু মানুষ আছেন যারা অন্যের কোনও কথা মন দিয়ে শুনেন না।’ মুরাকামি বলতে থাকেন, ‘অন্যদের কোনও কথাই আমরা মন দিয়ে শুনি না, মনে করি তারা বিরক্তিকর, কিন্তু আমরা যদি কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনতাম, বুঝতে পারতাম গল্পগুলো কত আকর্ষণীয়।’
বইটি বিক্রি হল আশাতীত সংখ্যক কপি; মুরাকামি বললেন, হাসতে হাসতে-‘দু’বছরে বিশ লাখ কপি। কিছু মানুষ তখন তাকে আগের চেয়েও বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলেন।
‘ইন্টেলেকচুয়ালরা বেস্টসেলার অপছন্দ করেন।’
মুরাকামি আরও দূরে সরে গিয়েছিলেন, আমেরিকায়। তারপর এল ‘৯৫, এ বছর জাপানের অর্থনীতিতে নেমে আসে বিপর্যয়; সাবওয়েগুলোয় সন্ত্রাসীরা গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটায়, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে, অর্থাৎ- মানবিক বিপর্যয়। তখন, মুরাকামিও জাপানে ফেরেন। পুরো বছর ধরে শুনেন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা। মুখে মুখে শোনা সেই ইতিহাস অবলম্বনে লেখেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’। এই অভিজ্ঞতা তাকে বদলেও দেয় অনেকখানি। বিপর্যস্ত মানুষদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে চরিত্রদের নিয়ে লিখতে হয়। ‘জানেন, এরকম বহু মানুষ আছেন যারা অন্যের কোনও কথা মন দিয়ে শুনেন না।’ মুরাকামি বলতে থাকেন, ‘অন্যদের কোনও কথাই আমরা মন দিয়ে শুনি না, মনে করি তারা বিরক্তিকর, কিন্তু আমরা যদি কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনতাম, বুঝতে পারতাম গল্পগুলো কত আকর্ষণীয়।’
এই উপলব্ধি ধারণ করে, মুরাকামি শুধু যে তার চরিত্রগুলিকেই ভিন্নরকমভাবে উপস্থাপন করেছেন তাই নয়, কতগুলি বন্ধ জানালা খুলে দিয়েছেন। খোলা জানালা দিয়ে তিনি তার চরিত্রগুলিকে কিছু না কিছু দেখাচ্ছেন, বারবার।
বছরে দু’মাস মুরাকামি পাঠকের চিঠিপত্রের উত্তর দেন।
মুরাকামি বলেন : ‘আমি শুধু পাঠকদের সঙ্গেই কথা বলতে চাই, তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে চাই।’
তারপর, তিনি সেই খোলা জানালাগুলি বন্ধ করে দেন। তার লেখার পদ্ধতিগুলি, পুনর্বার শব্দের ঢেউয়ের ভেতর কম্পন জাগাতে চায়, তিনি চান তার পরবর্তী বইটি যেন আগের চেয়ে আলাদা হয়, সম্পূর্ণরূপে। আগে যা লিখেছেন তারচেয়েও যেন ভাল হয়। তার স্থির বিশ্বাস হঠাৎ এমন একটি বিশেষ মুহূর্ত আসবে, যখন মহৎ কোনও উপলব্ধিতে পৌঁছবেন তিনি।
‘তাৎপর্যময় সেই উপলব্ধি আমাকে বারবার লেখায় ফিরিয়ে নেবে, যা কিছু অনুভব করছি, সেসব লিখতে। মুরাকামি তার প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন- ‘সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি। বই লেখার জন্য এমন গভীর একটি অনুভবই যথেষ্ট। মানুষ তার জীবনকালে এমন অনুভূতি কেবল একবারই পায়, কিন্তু অধিকাংশই ব্যাপারটা ধরতে পারেন না।’