অবাক জলপান
শহীদ খুরশীদ লাইব্রেরি এর পর থেকে-
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের হাসপাতাল প্রাঙ্গণটি নিবিড় নিসর্গের মাঝে, ২০১১ এমনকি ২০১৬-র পুনর্মিলনীতে গিয়ে আমাদের ব্যাচের দুই রাতের ডেরা ছিল হাসপাতালটি। দুটো-চারটে বই সাথে নিয়ে চার-পাঁচ দিন রোগবালাইয়ের সাথে বোঝাপড়া করবার একটা চমৎকার জায়গা। ক্লাস এইটের শুরুতে একবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম এখানে কর্ণপ্রদাহে। এক সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনি একাদশ শ্রেণির তানভীর হাসান পাতা ভাই দস্তয়েভস্কির ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’ বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে পাশের বেডে শোয়া, বেশ কিছু ঘুমের বড়ি খেয়ে সদ্য আত্মহত্যার ভয় দেখানো এক বড় ভাইকে জীবনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জীবনের জয়গান শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করছেন। পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে আমি আবারও ঘুমের ভান করে কথোপকথনটি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, মহান লেখকের বই কীভাবে আর দশটা ক্যাডেটের চেয়ে ওই ভাইয়াটিকে চমৎকার যুক্তি প্রয়োগ করতে আর জীবনদর্শন শিখিয়েছে। কিন্তু শহীদ খুরশিদ পাঠাগারের মহান লেখকদের বইয়ের তাকে হাত রাখবার আগেই ১৯৮৪-তে আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ চত্বরে।
ক্লাস এইটে আমাদের দ্রুত পঠন ছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘আমার ছেলেবেলা’। সবুজ আর কালোর অনাড়ম্বর মলাটের বইটির প্রথম বাক্য ‘আমি জন্মেছিলাম কুমিল্লায়’– সেই যে বইটির প্রতি একটা একাত্মতা এনে দিল, কবির দাদুর সাথে নোয়াখালী শহর ঘুরে বেড়ানো, শহরের নদীভাঙনের স্মৃতি, তখনকার বনেদি পরিবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘মহিলারা ডাবের জলে পা ধোন’– এই সব টুকরো টুকরো পাঠস্মৃতি আজও মনে পড়ে। এক একটা নতুন, ভালো বই শিশু-কিশোরদের জন্য এক একটা সুজলা সুফলা মহাদেশের মতো।
এক সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনি একাদশ শ্রেণির তানভীর হাসান পাতা ভাই দস্তয়েভস্কির ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’ বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে পাশের বেডে শোয়া, বেশ কিছু ঘুমের বড়ি খেয়ে সদ্য আত্মহত্যার ভয় দেখানো এক বড় ভাইকে জীবনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জীবনের জয়গান শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করছেন। পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে আমি আবারও ঘুমের ভান করে কথোপকথনটি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, মহান লেখকের বই কীভাবে আর দশটা ক্যাডেটের চেয়ে ওই ভাইয়াটিকে চমৎকার যুক্তি প্রয়োগ করতে আর জীবনদর্শন শিখিয়েছে।
যা বলছিলাম, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় একদিন আমাদের অধ্যক্ষ লুতফুল হায়দার চৌধুরী স্যার রফি, মতিন, সম্ভবত জিয়াউদ্দিন হায়দার আর আমাকে পাঠালেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। ওখানে পৌঁছার আগে কিছুই জানা ছিল না। হাজির হয়ে দেখি আমাদের চারজনকে আর বদরুন্নেসা কলেজের চারজন ছাত্রীকে ডাকা হয়েছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কথা বললেন, নির্ধারিত কোনো বিষয়ে না; পাশে ছিলেন আহমাদ মাযহার ভাই। সায়ীদ স্যার একপর্যায়ে বলছিলেন, ‘চল্লিশ কোনো বয়সই না।’ কী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তা আর এই উত্তর-চল্লিশে আমার মনে নাই। আমি কথাটা খুব মানতে পারিনি, কেননা চল্লিশ বছর বয়সী বাবাকে দেখেছি, শিক্ষকদের দেখেছি–সবাই তো আমাদের অনেক বড় আর গুরুজন! তাদের চল্লিশে উপনীত হওয়াটা কোনো ঘটনাই না!
স্যারের দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে (আমরাও কি আলাপে যোগ দিয়েছিলাম, নাকি শুধুই শ্রোতা ছিলাম, তা আর মনে নাই; ছেলেরা মেয়েদের সাথে কোনো বাক্যবিনিময়ও করিনি– মনে আছে) মাযহার ভাই আমাদের সবাইকে এক কপি করে কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ দিলেন এবং বলছিলেন গাদ্দার পাঠের কিছু সুখস্মৃতি। বুঝিয়ে দিলেন, আমাদের বইটি পড়ে পরের বুধবার দুপুরের পর এসে এই বই নিয়ে আলোচনা করতে হবে, আর সেদিন আমরা আরও একটি বই পাব। মন দিয়েই পড়েছিলাম, কিন্তু বই শেষ করে পরের সপ্তাহে এসে আলোচনায় অংশ নেওয়ার সাহস হলো না। এর পরের সপ্তাহে গিয়ে পেলাম সুকুমার রায়ের ‘সমগ্র শিশুসাহিত্য’, লাল প্রচ্ছদে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা হ-য-ব-র-লর বিড়াল মশাই! এই বইটি পড়তে পড়তে আমিও লিখে ফেলেছিলাম একটা হযবরল-জাতীয় লেখা, আর ‘অবাক জলপান’ নাটিকায় নিজেই নানা ভূমিকায় অভিনয় করে ক্যাসেটে বন্দীও করেছিলাম।
এদিকে আমাদের অধ্যক্ষ স্যার সাহিত্যানুরাগী মানুষ হলেও আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ সহপাঠ্যক্রমিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ছেলেরা কলেজের বাইরে এত ব্যস্ত হয়ে যাবে, সেটা চাননি। এভাবে আমাদের পাঠচক্রের বরফ গলবার আগেই পুনর্বরফের নিয়তি দেখতে হলো। সেই থেকে সুকুমার রায়ের বইটি আমার হাতেই রয়ে গেছে।
অলংকরণ : রাজীব রায়