:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোশতাক আহমদ

কবি, গদ্যকার

শহীদ খুরশীদ লাইব্রেরি

শহীদ খুরশীদ লাইব্রেরি

গত পর্বে পড়ুন- প্রথম ঈদসংখ্যা

সেই যে ক্লাস সেভেনে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে ছুঁতে পেরেছিলাম শহীদ খুরশিদ স্মৃতি পাঠাগার নামের বিশাল এক স্বপ্নকে, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে সেই লাইব্রেরির স্মৃতি লিখতে গিয়ে পাশ কাটাতে হলো, নিজেকে বোকা বোকা লাগছিল, কেননা লেখা শুরু করবার আগে ভেবেছিলাম স্মৃতিগুলো অবিকল উদ্ধার করে আনতে পারব; আর আদতে কিছু বইয়ের নাম ছাড়া কিংবা কিছু মলাটের স্মৃতি ছাড়া অন্য কোনো কিছুই মনে পড়ছিল না–পাঠস্মৃতি তো একেবারেই না।

শহীদ খুরশীদ আলী মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন, তাঁর নামেই লাইব্রেরি। লাইব্রেরি থেকে আমরা বই ইস্যু করতে পারতাম, কিন্তু সব বই নয়; কিছু কিছু বই লাইব্রেরিতে বসেই পড়তে হত। মনে হয়, একসাথে একটি করে বই ইস্যু করা যেত। তো, একবার ইস্যু করলাম ‘বই পড়া ভারি মজা’–বইটা আমাদের আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের জন্য দরকারি বই ছিল; সম্ভবত হরফের বিবর্তন, আলতামিরা গুহার গুহাচিত্র–এসব বিষয় নোট করবার জন্য ইস্যু করেছিলাম। বইটা ক্লাস এইটের এক সিনিয়র ভাই ( সাজ্জাদ ভাই) দেখে ‘নেক্সট’ নিলেন, মানে, আমার পড়া হলে তাকে দিতে হবে। আমি আমার কাজ শেষ করে বইটা জমা দিয়ে ইস্যু করে ফিরলাম ‘ইশপ’স ফেবলস’ কিংবা ‘শাহরিয়ারের অ্যাডভেঞ্চার’। পরে সেই সিনিয়র ভাই যখন জানালেন আমি তাকে ডজ দিয়ে বইটা জমা দিয়ে দিয়েছি, আমাকে জেরাটেরা করেছিলেন দুজন মিলে–সাজ্জাদ ভাই আর রাসেল ভাই ( তাঁর মানে, রাসেল ভাইও হয়তো বইটার ‘নেক্সটের নেক্সট ছিলেন), মৃদু কোনো একটা শাস্তিও দিয়েছিলেন মনে হয়। আমি ইচ্ছে করেই ভুলে যাওয়ার ভান করে বইটা জমা দিয়ে দিয়েছিলাম, কেননা জমা দিলে আরেকটা বই পাওয়া যাবে, অন্যদিকে সিনিয়র ভাইদের হাতে হাতে বই ঘুরতে থাকলে তো আমার ভবিষ্যৎটাই ঝরঝরে হয়ে যাবে!

জসীমউদ্‌দীনের ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’ পড়বার কথা মনে পড়ে। ছুটির দুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে কবির সাথে সাথে সেকালের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আতিথেয়তা নিয়েছি; এত সহজ-সরল ভাষায় লেখা সে বইয়ের মর্ম সেদিন বুঝতে পারিনি। অনেক বছর পর কবির ‘জীবনকথা’ পড়তে গিয়ে তাঁর সহজ জাদুকরি ভাষার স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল। আমার প্রতারিত স্মৃতি থেকে কোনোভাবেই আর একটা বই পড়ার স্মৃতি মুছে যায়নি, সেটা হচ্ছে ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’।

আমিনুল খুব দ্রুত পড়তে পারত, সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাসম্ভার ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে পড়তে দেখেছি ওকে; আমি তিন থেকে চার লাইন পড়তে না পড়তেই ওর সেই পৃষ্ঠা পড়া হয়ে যেত! ধীরগতিতে পড়ার জন্য কত বই না পড়ে সারেন্ডার করে গেছি! ওর কাছ থেকে মুজতবা আলীর বই নিয়ে দেখেছি–বেড়াতে বেড়াতে, লিখতে লিখতে, গড়াতে গড়াতে সৈয়দ মুজতবা আলী চলে যাচ্ছেন কাহিনির শাখা-প্রশাখায়, জলে-ডাঙায়, ডালে-পাতায়, শিরা-উপশিরায়। আধা পৃষ্ঠা-এক পৃষ্ঠা অন্যতর রসে খেই হারিয়ে আবার ফিরে পাচ্ছেন সংবিৎ; লিখছেন–‘সে কথা আরেক দিন হবে’, আর ফিরে যাচ্ছেন কাহিনির সুতো ধরতে! জিয়াউদ্দিন পড়ত ক্ষুধার্তের মতো! কত দিন দেখেছি উপুড় হয়ে পড়ে আছে অবধূত, কালকূট কিংবা জরাসন্ধ নিয়ে। আর আমি ভেবেছি, লেখকদের নাম এ রকম অদ্ভুত রকমের হয় কেন! ওই জরাসন্ধের বই আবার দোতলা থেকে রিজওয়ান এসে নিয়ে যেত। আমাদের কলেজ লাইব্রেরিতে খায়ের তরফদারের নামটা খোদাই করে রেখে আসতে পারলে ভাল হতো। ফ্রি টাইম শুরু হয়ে গেলে ও সবার আগে দৌড়ে লাইব্রেরিতে চলে যেত, নানা রকমের বই থেকে নোট নিত (পৌরবিজ্ঞান সম্পর্কে ভ্যাটেল কী বলেছিলেন ইত্যাদি); একটু এক্সক্লুসিভ কিছু নিজের খাতায় টুকে নিতে পারলে কোনো কোনো বই আবার ভিন্ন আলমিরার বইগুলোর পেছনে লুকিয়েও রেখে আসত। এমনিতে সে তার অবসর সময় কাটাতে ভালোবাসত ডেল কার্নেগির ‘বড় যদি হতে চান’-জাতীয় বইপত্র পড়ে। আমরা ডা. লুৎফর রহমানের নীতিকথাগুলো (উন্নত জীবন, মহৎ জীবন) অবশ্যপাঠ্য হওয়াতে এমনিতেই জেরবার, কে আবার আরও বড় হতে চায়, যেখানে বড় হবার জন্য হাতে আমাদের অনেক সময়! শাহীন ছিল সেবা প্রকাশনীর একনিষ্ঠ পাঠক। ওর কাছে সেবার প্রতিটি বইই থাকত, রানা থেকে শুরু করে অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন –স-অ-ব! আমি যদি ওর কাছ থেকে ধার করে কিছু কিছু বই পড়ে রাখতাম, তাহলে আমার বাংলাটা নিশ্চিতভাবে আরও ঝরঝরে হতে পারত!

ওর কাছ থেকে মুজতবা আলীর বই নিয়ে দেখেছি–বেড়াতে বেড়াতে, লিখতে লিখতে, গড়াতে গড়াতে সৈয়দ মুজতবা আলী চলে যাচ্ছেন কাহিনির শাখা-প্রশাখায়, জলে-ডাঙায়, ডালে-পাতায়, শিরা-উপশিরায়। আধা পৃষ্ঠা-এক পৃষ্ঠা অন্যতর রসে খেই হারিয়ে আবার ফিরে পাচ্ছেন সংবিৎ; লিখছেন–‘সে কথা আরেক দিন হবে’, আর ফিরে যাচ্ছেন কাহিনির সুতো ধরতে!

জসীমউদ্‌দীনের ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’ পড়বার কথা মনে পড়ে। ছুটির দুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে কবির সাথে সাথে সেকালের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আতিথেয়তা নিয়েছি; এত সহজ-সরল ভাষায় লেখা সে বইয়ের মর্ম সেদিন বুঝতে পারিনি। অনেক বছর পর কবির ‘জীবনকথা’ পড়তে গিয়ে তাঁর সহজ জাদুকরি ভাষার স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল। আমার প্রতারিত স্মৃতি থেকে কোনোভাবেই আর একটা বই পড়ার স্মৃতি মুছে যায়নি, সেটা হচ্ছে ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’। আমার মনে হয়েছিল, এই একটামাত্র বইয়ের ভেতরে আমি বিশ্বটাকে উন্মোচিত হতে দেখছিলাম; বইটা পড়ে রাতারাতি আমি যেন বড় হয়ে গেলাম।

গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য হ‌চ্ছে, আমা‌দের সাহিত্যের শিক্ষক র‌ফিক কায়সার স্যা‌র সেই সত্ত‌রের দশ‌কের শে‌ষের দি‌কেই তাঁর ‘কমলপুরাণ’ গ্রন্থের জন্য খ্যতিমান হ‌য়ে‌ছি‌লেন আর তাঁর আরেকটা খ্যা‌তি ছিল হুমায়ূন আহ‌মে‌দের ‘শঙ্খনীল কারাগা‌রে’ বই‌য়ের প্রবে‌শিকায় তাঁর অমর সেই পঙ‌্‌ক্তি দু‌টো, “দি‌তে পা‌রো এনে এক‌শো ফানুস/ আজন্ম সলজ্জ সাধ/ এক দিন আকা‌শে কিছু ফানুস ওড়াই।” দুটো বইই লাইব্রেরিতে ছিল, কিন্তু সেই ‘কমলপুরাণ’ সেই বয়সেও নাড়াচাড়া করেছি, এই বয়সে সংগ্রহ করে রাখলেও বিষয়বস্তুর গভীরে আর প্রবেশ করতে পারলাম কই!

সেই লাইব্রেরী সমৃদ্ধ ছিল এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে, চিত্রশিল্পের ছয় খণ্ডের বিরল এনসাইক্লোপেডিয়াতে, বিশ্বসাহিত্যের বাংলা অনুবাদে (যেমন, মপাসাঁ পড়েছি আমি, ডন কুইক্সটের মিনি ভারসন পড়েছি)। জনৈক তোসাদ্দেক লোহানি সম্পাদিত প্রতিদিন গাছ থেকে একটা করে সোনার আপেল খোয়া যাওয়ার রূপকথা ছেড়ে এসে আনমনা এনসাইক্লোপেডিয়ার পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমরা যেন বিশাল এক রূপকথার রাজত্বে পৌঁছে যেতাম!

 

চলবে…

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.