:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

অন্ধকারের স্মৃতি ও মাল্যবান
ব্যবহৃত চিত্রকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, চায়নিজ ইঙ্ক অন পেপার

অন্ধকারের স্মৃতি ও মাল্যবান

চিঠি কেমন করে শুরু করতে হয় তা আমি জানি না। যদিও আমি এক জীবনে তেরো-চোদ্দো হাজার পৃষ্ঠার কম লিখিনি নিশ্চয়ই। পেয়েছি তারও বেশি। আমার নিজ হাতেই পুড়িয়েছি সাত কেজি চিঠি। সেও অনেকবছর হয়ে গেলো। তারপর মাঝখানে অনেকদিন এইভাবে চিঠি লিখিনি। তোমার কাছে যখন চিঠি লিখতে বসলাম তখন আমার মনে পড়ে গেলো তোমাকে তো আমি সেই ছোটোবেলা থেকেই চিঠি লিখি মনে মনে। হাঁটতে হাঁটতে শূন্যতার ভিতর তোমার সঙ্গেই কথা বলেছি কতোদিন!

প্রিয় মাল্যবান, একদিন তোমাকে বলেছিলাম, ‘ছুটে আসছে ট্রামলাইন; মিলু, তুই বাঁপাশে তাকা। আমি তোর বুকের ভিতর শালবন হয়ে ঝিরিঝির ঝিরিঝির…। তুই কি জানিস, ধনেশের চঞ্চুতে কিসের অসুখ দীঘল হলুদ? তুই কাহাকে স্বাধীনতা দিয়া বাঁধিয়াছিলি বোকারাম? কে এসে কেড়ে নিলো তোর সকল পাখি আর পাখিনীর খড়?’

মাল্যবান, ‘চাঁদ এসে শুষে নাও সূর্যের দাহ। কিংবা সূর্য আসো, খুন করো জোছনার বিরাগ। সেজেছি পশ্চিমের রং। কড়িকাঠে নিভে গিয়েছি আকাশ-প্রদীপ। মাধবীরাতের ক্যাম্পফায়ার জ্বলে ওঠে আরও পরে, কোথাও সঘনবনের অস্থিরতায়। পতিত দিনের রোদে ভরে গেছে হাওয়াচর পাখিদের চোখের প্রাচীর, রোদের উরুমূলে চাক চাক ছত্রাকসুখ। দেয়ালের ছায়ায় রক্তরহিত তপ্ত ভোরের উদ্ভাস, আমাদের মাছঘুম—অন্তর্গত হাহকার নিঝুম।’ এইসব কথা আমার পুরুষপাখি বইতে লেখা আছে। পুরুষপাখি সেও আমি। তোমার কবিতা থেকে কাক হয়ে উড়ে এসে এইখানে কখনো ময়ূর হয়ে গেছি। আমার পালকে পালকে সতেরো হাজার চোখ খুঁজে ফেরে কার মুখ, আমি জানি না। হয়তো তোমার তাকে, ‘যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ কোনোদিন দেখিনি…’

তখন আমি হয়তো বছর বারো হবো। তখন আমি শৈশবরহিত একলা শ্রাবণ। তখন আমি ভিড়ের ভিতর ভয়ানক নৈসঙ্গ। তখন আমি হট্টগোলে ব্যাপ্ত নৈঃশব্দ্য। তখন আমি বিরান বনভূমিতে একা পাহাড়ের অভিমান। তখন আমি পাহাড়ের দেহে গোপন নির্ঝর। তখন একদিন বইয়ের পাতায় তুমি এসে চলে যাওয়ার সময় বললে, ‘আবার আসিবো ফিরে… সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায় দেখিবে ধবল বক…।’ এইই প্রথম তোমাকে আমার পড়া। তখনো তোমাকে দেখিনি কিছুই। দেখিনি ভীরু ভীরু চোখের অন্ধকারে ডুবে আছে আলোর চরাচর। আমার মাথার ভিতর ঢুকে গেলো শঙ্খচিল, কিশোরীর ঘুঙুর আর লাল পা। আমি তখনো জানতে পারিনি—এর থেকে আমার মুক্তি নেই।

তখন আমি হয়তো বছর বারো হবো। তখন আমি শৈশবরহিত একলা শ্রাবণ। তখন আমি ভিড়ের ভিতর ভয়ানক নৈসঙ্গ। তখন আমি হট্টগোলে ব্যাপ্ত নৈঃশব্দ্য। তখন আমি বিরান বনভূমিতে একা পাহাড়ের অভিমান। তখন আমি পাহাড়ের দেহে গোপন নির্ঝর। তখন একদিন বইয়ের পাতায় তুমি এসে চলে যাওয়ার সময় বললে, ‘আবার আসিবো ফিরে… সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায় দেখিবে ধবল বক…।’ এইই প্রথম তোমাকে আমার পড়া। তখনো তোমাকে দেখিনি কিছুই।

তারপর তোমাকে প্রথম জেনেছিলাম অবসরের গান, ‘এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেকদিন জেগে থেকে ঘুমোবার সাধ ভালোবেসে।’ তখন কি আমি সপ্তমশ্রেণি? মনে পড়ে না তেমন। হতে পারে। গ্রামের বইয়ের দোকান থেকে আমি তোমার শ্রেষ্ঠ কবিতা কিনেছিলাম মনে আছে, দাম নিয়েছিলো ৪৫ টাকা মনে হয়। এখনো আছে। ১৯৯৩ সাল হবে।

তুমি একদিন এসে আমার কানে কানে বললে, ‘কাকের চোখ পৃথিবীতে সব থেকে সুন্দর?’
আমি শুধালাম, ‘কেমন করে?
আর তুমি বললে, ‘কাকচক্ষু জল।’
সেই থেকে আমি কাক হলাম। কাক মানে কাকপাখি। তোমার সুদর্শন যেনো বা উড়িতেছি চিরদিন সন্ধ্যার বাতাসে।

স্মৃতি আর সন্ধ্যার আরক্ত অন্ধকার। মাল্যবান! তোমাকে মনে পড়ে। মনে আছে, তোমাকে অনেক দিন কোনো চিঠি লিখি না। এই জ্বরাক্রান্ত শরীরে সহসা তোমাকেই মনে হলো কেনো তা বলা কঠিন। প্রকৃত অর্থে মনে হলো তোমার মৃত্যু এবং হারিয়ে যাওয়ার কথা। যখন গিয়েছিলো ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ—তখন বুঝি তোমার মরার সাধ জেগেছিলো মনে?

সেদিন ভরা বিকেল ছিলো। দিগন্তের সোনালি রং ছিলো শাহরিক ধোঁয়ায় ম্নান। ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিট, কলকাতার একতলা বাড়িটার সামনে বুড়ো নিমগাছ বাতাসে কাঁপছিলো ধীর ধীর। নিমগাছের ডালে একটা লক্ষ্মীপেঁচা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলো নাকি দুচোখ বুজে? কতোদিন হলো এইবাড়িতে? তুমি মনে করতে চাও না। স্বরাজ পত্রিকার চাকরি তোমাকে এইখানে তাড়িয়ে এনেছে—নাকি দেশভাগ; নাকি পরিবার, নাকি লাবণ্য? শিরীষের ডালপালা নেই কিছু—আছে ধুধু গড়ের মাঠ। ধানসিড়ি হারিয়ে গেছে কবে কালীগঙ্গায়!

শেষ কয়েকবছর তুমি চরম অর্থকষ্টে ছিলে। ‘দেশ’ পত্রিকা তোমার ছয়টি কবিতা বাতিল করে ফেরত পাঠিয়েছিলো। অতি তুচ্ছ কারণে একটার পর একটা চাকরি হারিয়েছো। আমি জানি তোমার হয়তো চাকরি ভালো লাগতো না। আসলে তুমি চাইতে না বলেই তোমার চাকরি থাকতো না। লাবণ্যর অসুস্থতা, পরিবারের ভার তোমাকে অস্থির এবং ক্রমশ অসহায় করে তুলেছিলো। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভাড়াবাড়ির একটা ঘর সাবলেটও দিয়েছিলে গোপনে, একজন নর্তকীর কাছে। আচ্ছা, তুমি কি সেই নর্তকীকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখোনি? হয়তো না। তখন তো তোমার লেখাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আর সে নর্তকীতো বলতে গেলে তোমার লেখা-পড়ার পরিবেশ এবং সকল নৈঃশব্দ্যই ভেঙে দিয়েছিলো।

তোমার সেই বাসাবাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে না…। অরবিন্দকে বলেছিলে বেশ কয়েকবার, কয়েকবার। সে নিশ্চয়ই অন্য একটা বাড়ি খুঁজে বের করবে। কিন্তু কখন যে করবে?

সেদিন নিমগাছের পাশ ঘেঁষে তুমি রাস্তায় ওঠে এলে। হাওয়ায় দুলছিলো তখন নিমফুলের শাদাটে-বেগুনি ঘ্রাণ। একটা সকরুণ পেঁচার মুখ। জলার হাওয়ায় তোমার শরীর জুড়োবে? অলোক আসবে। তার সঙ্গে কথা, তার সাথে প্রতিদিন একাকীত্ব। তুমি ফিরছিলে নিমগাছের ঘরে। ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিট। ল্যান্সডাউন ফিরে গেছে ব্রিটেনের রাস্তায়। কলকাতার ল্যান্সডাউন এখন সারদা বসু।

ইদানীং তোমার নাম থেকে আনন্দ বাদ দিয়ে তোমাকে জীবনদাশ নামে লিখি। কখনো গোপনে তোমাকে মাল্যবান বলে ডাকি। মাল্যবান কেনো বলি সে তুমি ভালোই জানো। তুমি আসলে তোমারই মাল্যবান। একলা একা ঘরে কবিতার কথা ভাবতে ভাবতে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে কেউ এসে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে নেয় না শয্যায়।

প্রিয় মাল্যবান, তোমার বৃষ্টি নিয়ে তেমন কবিতা নেই। তোমার সমগ্র কবিতা খুঁজলে দুইতিনটা বৃষ্টির কবিতা পাওয়া যাবে। কেন এমন করেছিলে? আমার একবার মনে হয়েছিলো, রবিনাথ বৃষ্টি নিয়ে এতো কবিতা গান লিখে ফেললো বলেই তুমি আর বর্ষার রূপ লিখতে যাওনি। তুমি আসলে বর্ষাকে উপলব্ধি করেছিলে সকল ঋতু এবং অস্ফুট শূন্যতার ভিতর দিয়ে। কেননা কোনো বাঙালির পক্ষে বর্ষাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর তোমার কবিতায় হেমন্ত এলো, এলো শরৎ, এলো শীত। এইসব ভালো লেগে গেলো আমার। তোমার অন্ধকার চোখের ভিতর তখন ঘুমিয়ে পড়ছে ধীরে উত্তরের সকল বনাঞ্চল। সারারাত ঘাই হরিণী ডাকে, তুমি ক্যাম্পে শুয়ে আমারই মতোই বুকের ভিতর লিখে যাচ্ছো গুলির শব্দ। তুমি ‘ক্যাম্পে’ কবিতা লিখলে। আর সজনীকান্ত-সহ অনেকে বললো, ‘ইহা অশ্লীল।’ আর মূর্খ কলেজ কর্তৃপক্ষ তোমার চাকরি কেড়ে নিলো। কেমন করে বুঝবে ওরা গভীর বনের মধ্যে রক্তের ভিতর রক্তক্ষয়ী সেই সৌন্দর্যের কথকতা? ওরা তো কেউ তোমার মতো করে ঘাই হরিণীর ডাক শোনেনি কোনোদিন। অথচ আমার মনে হয়েছে সজনী আসলে তোমার ক্ষমতাকে ঈর্ষা করতো। দেখো, তোমার শম্ভুনাথের শেষ দিনগুলিতে সজনী খুব চেষ্টা করেছিলো তোমাকে বাঁচানোর। কিন্তু পারেনি। ভূমেনও জানে এইসব। কারণ তখন ভূমেন শম্ভুনাথের ডাক্তার। সেও আশা করেছিলো তুমি বাঁচবে। সজনী হয়তো গোপনে কেঁদেছিলো তোমার জন্য।

তোমাকে আমি কখনো মিলু বলে ডাকি। কখনো আনন্দ বলে ডাকি, যদিও তোমার জীবনে কোনো আনন্দ ছিলো না বিষণ্নতা ছাড়া, তারপরও তোমার নাম জীবনানন্দ। ইদানীং তোমার নাম থেকে আনন্দ বাদ দিয়ে তোমাকে জীবনদাশ নামে লিখি। কখনো গোপনে তোমাকে মাল্যবান বলে ডাকি। মাল্যবান কেনো বলি সে তুমি ভালোই জানো। তুমি আসলে তোমারই মাল্যবান। একলা একা ঘরে কবিতার কথা ভাবতে ভাবতে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে কেউ এসে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে নেয় না শয্যায়। যেমন বনলতা সেনকে আমার মনে হয় কল্পনা, তোমার কল্পনা। তোমার জানলা দিয়ে দেখা শাদামেঘের আকাশবাড়ি। অথচ কোথাকার কোন আকবর আলি না কে এসে বললো বনলতা আসলে নাটোরের একটা গণিকা। বণিকের মাথায় ঘুরে বেড়ায় কেবল বণিতা, ব্যাপারটা হয়তো ওই রকম। সে কেমন করে বুঝবে কবির কল্পনার ভিতরও আছে আদিগন্ত যন্ত্রণার ধানক্ষেত, যে ধানক্ষেত দিনশেষে সূর্যকে পেটের ভিতর নিয়ে ঘুম যায়।

সেইদিন ধেয়ে আসছিলো একটা লোকজনে ভর্তি ট্রাম। তুমি তারও অনেকদিন আগে লিখেছিলে বোধহয়, ‘একখানা মোটর-কার এসে—গাড়লের মতো কেশে’ এই জাতীয় একটা কবিতা। অথবা লিখেছিলে, ‘একটা মোটরকার খটকা নিয়ে আসে।’ মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিশ, যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর আলোর সন্তানদের মধ্যে তার নাম সবচেয়ে প্রথম। একটা অন্ধকার জিনিশ: পরিষ্কার ভোরের বেলা দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে মাঠে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে ‘১৯৩৪ এর মডেল একটা মোটরকার ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে।’ তেমনই একটা মোটরগাড়ি ট্রামের রূপ ধরে আসে, তুমি টের পাও না। ট্রাম যাবে বালিগঞ্জ। বালিগঞ্জে ট্রামের কী কাজ?

অলোকের সঙ্গে কী কথা তোমার? কবিতার কথা? সে তো তুমি নিজেই লিখে রেখেছো। অনেকদিন লেখো না তুমি। অলোকের কাছে কি টাকা ধার করবে? তোমার গায়ের রং গাঢ় শ্যামল। তোমার ভিতর ছিলো রাইমাধব। অলোকের সঙ্গে কি দেখা হলো? সুবোধের সঙ্গে কী কাজ। জয়া স্টোর এর সামনে কি জেব্রাক্রসিং ছিলো? কী ভাবছিলে তুমি? তোমার হাতে কি বাজারের ব্যাগ, আর বগলে ছাতা ছিলো? ছিলো না হয়। ছিলো আসলে দুহাতে দুই থোকা ডাব। ডাবের রং কচি লেবুপাতার মতন।

তুমি কখনো টিউশনি করেছো একসঙ্গে বেশ কয়েকটা। তোমার অর্থকষ্ট যায়নি। আবার কখনো ইনস্যুরেন্স কোম্পানির দালালিও করেছো। টাকা ধার করেছো সম্ভব-অসম্ভব প্রায় সকল সূত্র যেমন ভাইবোন, ভাইয়ের বউ, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, স্কটিশ ইউনিয়ন, সঞ্জয়, সত্যপ্রসন্ন, বিমলাপ্রসাদ, বাণী, প্রতিভা-সহ আরো অনেকের কাছ থেকে। আবার শোধও করেছো তার অনেকটাই ভেঙে ভেঙে। তোমার মৃত্যুর কয়েকমাস আগে স্বরাজ পত্রিকার হুমায়ূনের কাছে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলে পরপর। একটা চিঠিরও কোনো প্রত্যুত্তর পাওনি তুমি। তুমি তোমার প্রিয় হুমায়ূনকে চিঠিতে বলেছিলে,

‘আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কোনোকিছু যা শেষ বিচারে একটা কোনো জিনিশের মতন জিনিশ;—কিন্তু, ভাগ্য এমনই যে, আজ তার পেটের-ভাত জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে, যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’

কিন্তু শেষপর্যন্ত হুমায়ুন কিছুই করেনি। অথচ তার অনেক সুযোগ ছিলো। অন্তত অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে তোমার একটা চাকরি সে জুটিয়ে দিতে পারতো। হয়তো ভেবেছিলো আরেকটা চাকরি পেলে সেটাও তুমি রাখতে পারতে না। অবশ্য তুমি অর্থাভাবে, মানসিক দুশ্চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে ট্রামের তলায় চাপা পড়ে মরে যাওয়ার অনেকদিন পর তোমাকে মরণোত্তর সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারটা পাইয়ে দিয়েছিলো। যা মরার ওপর খাড়ার ঘা হিশেবেই প্রকট হয় আমার চোখে। এইসব কথা আমাকে ভূমেন বলেছে।

তোমার আসলে সংসার করাই উচিত ছিলো না। সে কথা তোমার নিশ্চয়ই মনে হয়েছে পরে। আমার যেমন মনে হয়। আর ধরো লাবণ্যেরই বা কী দোষ? তারও তো একটা সুস্থ-স্বাভাবিক আটপৌরে সংসারে জীবনযাপনের স্বপ্ন ছিলো, অধিকার ছিলো। তারও তো ক্ষিধে ছিলো। সে তো আর তোমার মতো কবি ছিলো না, সেতো রক্ত-মাংসের মানুষই ছিলো। তোমার কি মনে হয় না, তুমি তার প্রতি সব দায় পালন করো নাই? দেখো এখন তোমার অন্ধ ভক্তরা লাবণ্যকে ছেড়ে কথা বলে না। বেচারা লাবণ্য!

তোমাকে তো কেউ বুঝতে পারতো না। কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে যে বিড়াল আঁচড় কাটে তার মধ্যে যে সৌন্দর্য তা তোমার সঙ্গে বসে কেউ দেখার ছিলো না।

একদিন অনেকদিন আগে তোমার মা আমাকে বলেছিলো, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’
আমি মনে মনে বললাম, ‘জানি না তো!’
বাতাস এসে বন্ধ করে দিলো আমার বইয়ের জানলা। তারপর অনেকদিন গেছে, আমি অপেক্ষায় থেকেছি। কুসুমকুমারী তার মিলুর কথা আমাকে না বলেই একদিন হারিয়ে গেলো, আমার বইয়ের পাতা থেকে। তারপরও মনে মনে প্রতীক্ষায় থেকেছি। তারপর একটি নিঃশব্দ ট্রামে চড়ে তুমি এসেছিলে। তোমার হাতে একটা শাদা হাওয়াই মিঠাই।

পুরনো জং ধরা ট্রাংকে তোমার সাতান্নটি খাতা পাওয়া গেছে, জানো? কেনো তুমি অইসব লুকিয়ে রেখেছিলে। না, হয়তো যত্ন করেই রেখেছিলে। ভূমেন ওইসব ছাপিয়ে দিয়েছে, ‘দিনলিপি’ নাম দিয়ে। অনেক টাকা দাম। কিনতে পারিনি বের হওয়ার পর, একেকটা একহাজার আশি টাকা করে। ছুঁয়ে দেখে এসেছিলাম অনেকবার। পৃষ্ঠা উল্টিয়েও দেখেছি। অসীম বলেছে, তার চাকরি হলে আমাকে একখণ্ড কিনে দেবে। তোমার ডায়েরি মানে তো আর দিনলিপি নয়, কী পড়েছো, না পড়েছো, কার কবিতা পড়ে কী মনে হয়েছে তাইই লিখে রেখেছো। ভূমেন করেছে কী জানো, তুমি যেইসব লেখা পড়ে সেই সম্পর্কে লিখেছো ওইসব লেখাও অনেকাংশ ছাপিয়ে দিয়েছে তোমার দিনলিপির ভিতর। তাই অনেক মোটা হয়ে গেছে। অনেক দাম। চারখণ্ডের দাম চারহাজার তিনশো কুড়ি টাকা। অথচ কী অভাবের মধ্যেই না তুমি ছিলে কলকাতার শেষ কবছর। এখন তোমার দিনলিপি কেনার সামর্থ্য আমার হয়েছে, অসীমের চাকরি হয়েছে। এখন চাইলেই ঘরে এনে রাখতে পারি। কিন্তু কেনো জানি আর কিনতে ইচ্ছে করে না। কেমন কান্না কান্না লাগে!

তোমার আসলে সংসার করাই উচিত ছিলো না। সে কথা তোমার নিশ্চয়ই মনে হয়েছে পরে। আমার যেমন মনে হয়। আর ধরো লাবণ্যেরই বা কী দোষ? তারও তো একটা সুস্থ-স্বাভাবিক আটপৌরে সংসারে জীবনযাপনের স্বপ্ন ছিলো, অধিকার ছিলো। তারও তো ক্ষিধে ছিলো। সে তো আর তোমার মতো কবি ছিলো না, সেতো রক্ত-মাংসের মানুষই ছিলো। তোমার কি মনে হয় না, তুমি তার প্রতি সব দায় পালন করো নাই? দেখো এখন তোমার অন্ধ ভক্তরা লাবণ্যকে ছেড়ে কথা বলে না। বেচারা লাবণ্য!

মাল্যবান, অনেকে মনে করে, তুমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমি কে, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো? ইত্যাকার প্রশ্নের সমুখে মানুষ চিরদিনই ভয়ানক অসহায়। তুমি বলেছিলে, ‘আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?’

এ শূন্যতা কি কেবলই তোমার? না, এই শূন্যতা আমারও যে অস্তিত্বের যন্ত্রণাকে প্রতিনিয়ত উপলব্ধি এবং ধারণ করে। আর এই শূন্যতা থেকেই আমিও নিজেকে খুঁজে বেড়াই। আর যে নিজেকে খুঁজে বেড়ায় সে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। যেমন, তুমি আর শূন্যতা মিলে আমাকে কবিতা দিকে তাড়িত করেছো। আমি সুন্দরের ভিতর, গীতবিতানের ভিতর, শশীর ভিতর, নীলের ভিতর, প্রিসলিনের ভিতর, লিথির ভিতর, সুধার ভিতর, বেদনা ও বাদলের ভিতর, ধূলিকণার ভিতর, চাঁপাবন ও অভিমানের ভিতর, রক্তের ভিতর, অনিন্দ্য ও মৃন্ময়ীর ভিতর, রতি ও রূপের ভিতর, লাবণ্য ও ক্লান্তির ভিতর, মদের ভিতর, ধূম্র ও মরীচিকার ভিতর কবিতাকে খুঁজেছি। পেয়েছি কিনা জানি না। কেননা আমার এই সন্ধান আর শেষ হয় না। আমার সন্ধান ঝরে যায়—স্মৃতি; আমার সন্ধান আঁকে বিস্মৃতি।

অলোকের সঙ্গে কী কথা তোমার? কবিতার কথা? সে তো তুমি নিজেই লিখে রেখেছো। অনেকদিন লেখো না তুমি। অলোকের কাছে কি টাকা ধার করবে? তোমার গায়ের রং গাঢ় শ্যামল। তোমার ভিতর ছিলো রাইমাধব। অলোকের সঙ্গে কি দেখা হলো? সুবোধের সঙ্গে কী কাজ। জয়া স্টোর এর সামনে কি জেব্রাক্রসিং ছিলো? কী ভাবছিলে তুমি? তোমার হাতে কি বাজারের ব্যাগ, আর বগলে ছাতা ছিলো? ছিলো না হয়। ছিলো আসলে দুহাতে দুই থোকা ডাব। ডাবের রং কচি লেবুপাতার মতন। তোমার মাথার ভিতর কি ঘুরছিলো তখন প্রাচীন শকতির মতো কবিতার কোনো চিত্রকল্প, নাকি অর্থের চিন্তা? হাতে টাকাকড়ি নেই। ট্রামের হুইসেল কানে বাজলো না তোমার। ট্রামের চাকা তোমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো পঁচিশ-তিরিশ হাত দূরে। আততায়ী ট্রাম যখন ব্রেক কষলো তখন প্রচণ্ড ধাক্কায় তোমার দেহ ঢুকে গেলো ট্রামের ক্যাচারের ভিতর। পানের দোকানি চুনিলাল যখন লোকজন নিয়ে তোমাকে ট্রামের তলা থেকে টেনে বের করলো তখন তোমার বুকে রক্তের দাগ লেগে আছে, তোমার মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। ভেঙে গেলো পাঁজরের হাড়। কণ্ঠার হাড়ও কি ভেঙেছিলো তোমার? পানের পিকের মতো রাস্তার পিচে লেগে গেলো তোমার রক্ত। কালো পিচের সঙ্গে তোমার রক্ত মিশে কেমন পোড়া সিঁদুরের মতো রং তাকিয়ে ছিলো চেনা সূর্যের দিকে। তুমি তখন অচেতন। তারপর তোমার কবিতা বাতাসে ঘুরে, তুমি যেমন বলেছিলে, ‘কাচপোকা ঘুমিয়েছে—গঙ্গাফড়িং সেও ঘুমে; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছো তুমি।’

তারপর শম্ভুনাথ পণ্ডিতের ওষুধের গন্ধমাখা ঘরে তোমার শাদা শাদা কটা দিন কেটে যায়। নিজের বুকে গুলি করার পর ভিনসেন্টও পড়েছিলো কয়েকদিন হাসপাতালে তোমারই মতো। আর তোমার ফুসফুসের ভিতর ঘুরে ঘুরে ঝেকে বসলো নিউমোনিয়ার নখর। তারপর তুমি ফিরে গেলে তোমার অন্ধকারের কাছে। তোমার বনলতা সেন, প্রিয়তম অন্ধকার, থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার। তারপর কি তোমাকে মর্গে নিয়ে গেলো? মর্গকে তুমি বলেছিলে লাশকাটা ঘর, আটবছর আগে একদিন, ‘শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে কালরাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হলো তার সাধ…’ এইসব। শেষবার তোমার কার মুখ মনে পড়েছিলো, অরুণিমা সান্যালের মুখ? তোমার মাথার মধ্যে ঘুরছিলো নিশ্চয়ই সেইসব লাইন, তুমুল কৈশোরে আমার জানলাবিহীন ঘরের অন্ধকার দেয়ালে খড়িমাটির আঁচড়ে তোমার লেখা কবিতার যেইসব লাইন লিখে রেখেছিলাম, ‘হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি…।’

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.