:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

কাশবনের বাড়ি ও একটি ময়ূরপাখি

কাশবনের বাড়ি ও একটি ময়ূরপাখি

শরৎকাল এলেই আমার খুব শৈশবের বাড়ির কথা মনে পড়ে। তাছাড়া শরৎ আমার জন্মঋতু বলে আরো বেশি কেমন কেমন লাগে। ইচ্ছে করে আকাশভর্তি শাদা মেঘের কাগজে জলরং দিয়ে ছবি এঁকে দিই।

তো আমার শৈশবের প্রথম যে বাড়িটি আমি দেখেছি, যে বাড়িটি বানানোর পর সম্প্রসারণের কথা আমার মনে আছে সেই বাড়িটি আমার নানাবাড়ি কিংবা আমার দাদাবাড়ি নয়। সেই বাড়িটি একান্তই আমাদের ছিলো। ওটা আমার বাবা বানিয়েছিলেন। আমার বাবা তার ভাইদের নিজের ভাগের সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে মাতামুহুরী নদীর চরে একটা জমি কিনে নিজে একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। দোতলা বাড়িটির বাহিরে কাঠ আর ভিতরে বাঁশের বেড়া, উপরে ঢেউটিন আর সিমেন্টশিটের ছাউনি।

আমাদের বাড়ি ঘিরে ছিলো কাশবনের বিস্তার। আমি ছিলাম আর বকুল ছিলো। আমরা পিঠেপিঠি ভাইবোন। বয়স চারপাঁচ হবে। বকুল আমার এক বছরের বড়। আমরা দুজনে দিনমান ঘুরে বেড়াতাম কাশবনে। আর শরৎকাল এলে তো আনন্দের সীমা থাকতো না। পুরা কাশবন হয়ে থাকতো শাদা। যেনো উল্টে থাকতো মেঘের আকাশ। আর আমরা দুইজন আকাশের নীল। ততোদিনে হয়তো দুয়েকবার পথের পাঁচালি সিনেমাটা দেখে ফেলেছি। আমাদের কাশবনে রেললাইন ছিলো না। কিন্তু কাশবনের মধ্যে আকাশছোঁয়া টেলিগ্রাফের তারের থামগুলি ছিলো যেনো বা আকাশছোঁয়া। আমরা ওইগুলির গোড়ায় কান লাগিয়ে শুনতাম অলৌকিক ট্রেনের শব্দ। টেলিগ্রাফের তারে বাতাস লেগে অদ্ভুত শব্দকম্প তৈরি হতো ধাতব থামগুলিতে।

পুরা কাশবন হয়ে থাকতো শাদা। যেনো উল্টে থাকতো মেঘের আকাশ। আর আমরা দুইজন আকাশের নীল। ততোদিনে হয়তো দুয়েকবার পথের পাঁচালি সিনেমাটা দেখে ফেলেছি। আমাদের কাশবনে রেললাইন ছিলো না। কিন্তু কাশবনের মধ্যে আকাশছোঁয়া টেলিগ্রাফের তারের থামগুলি ছিলো যেনো বা আকাশছোঁয়া। আমরা ওইগুলির গোড়ায় কান লাগিয়ে শুনতাম অলৌকিক ট্রেনের শব্দ। টেলিগ্রাফের তারে বাতাস লেগে অদ্ভুত শব্দকম্প তৈরি হতো ধাতব থামগুলিতে।

একদিন হেমন্তের শেষের দিকে দুপুরবেলা আমি আর বকুল কাশবনের ভিতর সাপের খোলস খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। চারিধার কেমন সুমসাম। মন কেমন করা হিমেল হাওয়া বইছিলো। কাশবনে শন শন শব্দ হচ্ছিলো উচ্চাঙ্গসংগীতের মতো। হঠাৎ শুনলাম শন শন গানের তাল কেটে কেমন খস খস শব্দ, একপাশে কাশবন নড়ে উঠলো। ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি একটি ময়ূরপাখি। পেখম মেলতে গিয়ে কাশের নলে আটকে গেছে পালক। আমি পালক কটা নল থেকে আলতো হাতে ছাড়িয়ে পাখিটিকে বুকে চেপে ধরে একদৌড়ে বাড়ি নিয়ে এলাম। বকুলও আমার পিছে পিছে। মাকে দেখালাম। মা বললো, ‘এটা আমরা পালবো।’ আমরা ময়ূরটিকে ধানচাল যা পেলাম খেতে দিলাম। পানি খাওয়ালাম, তারপর বারান্দায় রেখে দিলাম। খাওয়াদাওয়ার পর পাখিটি বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে পেখম মেললো, ঝলমল করে উঠলো আমাদের দিঘল বারান্দা। তারপর যখন গা ঝাড়লো তখন দুইটা পালক খসে পড়লো। আমরা কুড়িয়ে নিলাম। পালক দুটি গুঁজে রাখলাম বাংলোঘরের বেড়ায়—বেড়ায় একটা বাঁধানো ছবি ছিলো, ওটার দুপাশে। ছবিটা শাদা কাপড়ে সুঁইসুতার কাজ। আমার মায়ের করা। মুখোমুখি দুইটা সবুজ টিয়াপাখি লালরং চঞ্চু। পাখিদুটির মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় নীল সুতায় লেখা ‘এলাহি ভরসা-৭৮৬’।

ছবি : আমাদের সেই প্রথম বাড়ি, পরিত্যক্ত হওয়ার পর। এখন এই বাড়িটি আর নেই।

আমাদের একটা ময়ূরপাখি হলো এইভেবে পাখিটির পাশে অনেকটা রাত জেগে থেকে ঘুমাতে গেলাম। তার পরদিন ভোরবেলা উঠেই আবার পাখিটির সঙ্গে ব্যস্ততা।

দুপুর গড়িয়ে গেলো। আমাদের বাড়ির অদূরে একটা দুষ্টুটাইপ বুড়ো লোকের বাড়ি ছিলো, নাম ভুলে গেছি। মনে আছে লোকটা আফিম খেতো সারাদিন। হঠাৎ সেই লোকের বুড়ি বউটা এসে আমাদের ময়ূরপাখিটিকে নিজেদের দাবি করে বসলো। বললো এটা তাদের ময়ূর, পালিয়ে কাশবনে সাপ খেতে গিয়েছিলো। মাকে আর আমাদেরকে রীতিমতো বকাঝকা করে ময়ূর নিয়ে বুড়ি চলে গেলো। আমি আর বকুল সারাদিন কাঁদলাম।

তারপর দিন আমি আর বকুল চুপচাপ ময়ূরটিকে দেখতে গেলাম ওই বাড়িতে দুপুরবেলা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি ময়ূরের রংবেরঙের পালক সব তাদের বসার ঘরের বেড়ার খাঁজে খাঁজে গুঁজে রেখেছে। আমার খুব কান্না পেলো। বাড়ির চারপাশে ঘরের ভিতর উঁকিঝুকি দিয়ে কোথাও পাখিটিকে দেখতে পেলাম না। তারপর ওই বাড়ির পাশে একটা ডোবার পাড়ে দেখলাম ছোটো ছোটো পালক পড়ে আছে। বকুল বললো, ‘ওই ডাইনি বুড়িটা আমাদের ময়ূরটাকে মনে হয় রেঁধে খেয়ে ফেলেছে।’

সেদিন আমরা ওই বাড়ি থেকে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে পালিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। ৩৫ বছর তো হবেই। আজো কাশবন দেখলে আমার সেই ময়ূরপাখিটির কথা মনে পড়ে। আর বুকের ভিতর কোথাও হুহু করে উঠে।

 

আরও পড়ুন-  রাত্রি মা ও ঘুমগাছের বন


অলংকরণ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.