:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

অন্য মা ও রক্তজবা
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

অন্য মা ও রক্তজবা

মেয়েটির পরনে শাদাশাড়ি। মেয়েটি সারাদিন উঠানের ধারে বেড়ে ওঠা জবাফুলের বন থেকে রক্তজবা তুলে তুলে কাটিয়ে দেয় সারাবেলা। মেয়েটির নাম বইয়ের মধ্যে লেখা আছে। বইয়ের নাম বলবো না। মলাট ধূসর হয়ে আছে উত্তরের দিগন্তের রূপ।

একজন মিলু কলকাতায় এসে বিপাকে পড়ে যান। তিনি একজন কবি। তার গায়ের রং ঘোর রক্তবর্ণ। তার সংসারে বিরাট অশান্তি—একটার পর একটা চাকরিতে টিকতে না পারা, অভাব। এইসব চিন্তায় তার লেখালেখিই বন্ধ হয়ে যায়। এর কাছে, ওর কাছে চিঠি লিখেন চাকরির জন্য। টাকা ধার করেন। কম ভাড়ায় বাসাবাড়ির সন্ধান করেন।

একদিন সন্ধ্যাবেলা, একহাতে ধরা একটা বন্ধ ছাতা। ছাতার রং কালো। আর হাতে ধরা একজোড়া ডাব। অর্থচিন্তায় অস্থির মিলু রাস্তা পার হচ্ছেন, আর বিদ্যুত চমকের মতো অকারণেই তার মনে পড়ে যায় অরুণিমা সান্যালের মুখ। এই মুখ ভেবে তিনি হাঁটছেন, সমস্ত নীরব কোনো শব্দ তার কানে আসছে না। নিঃশব্দে একটা ট্রাম এসে তাকে চাপা দিয়ে টেনে হিচড়ে কয়েক মিটার টেনে নিয়ে গেলো। তিনি চেতনা হারানোর আগে যে মুখটি তার চেতনায় ছিলো তা অরুণিমা সান্যালের।

শম্বুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মিলুর জ্ঞান ফিরলে মনে পড়ে যায় বরিশালের সেইসব কথা। অরুণিমা সান্যালের সঙ্গে দেখা। তাকে নিয়ে কবিতা লেখা, প্রেম, তারপর ছাড়াছাড়ি এইসব নানা ঘটনা। মনে পড়ে যায় অরুণিমা সান্যাল আসলে তারই দেয়া একটা নাম, সে ছিলো মুসলিম ঘরের মেয়ে; নাম আয়েশা আক্তার।

মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়। কলেজের লাইব্রেরিতে মুখোমুখি বসা মিলু গীতবিতানের ভাঁজে গুঁজে দেয় একটা চিরকুট। আয়েশা খুলে দেখে, তাতে লেখা, ‘তুমি অরুণিমা সান্যাল…’

অরুণিমার মুখ ভাবতে ভাবতে মিলু মারা যান। তার পালস চেক করে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেন যিনি—তিনি ডাক্তার আয়েশা আক্তার, মিলুর অরুণিমা সান্যাল।

শম্বুনাথ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ডাক্তার আয়েশার আন্ডারেই তিনি ছিলেন, একবারও বোঝা যায় না ইনিই অরুণিমা। ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় যখন ডাক্তারের হাত কাঁপে তখন খানিকটা বোঝা যায়।

মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়। কলেজের লাইব্রেরিতে মুখোমুখি বসা মিলু গীতবিতানের ভাঁজে গুঁজে দেয় একটা চিরকুট। আয়েশা খুলে দেখে, তাতে লেখা, ‘তুমি অরুণিমা সান্যাল…’

ডাক্তার আয়েশার চশমার কাচে জমে উঠে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত পউষের ভোর। তার চশমাটা আমি আলতো হাতে খুলে নিয়ে শুধাই চুপিচাপ, ‘মা, মিলুর সঙ্গে তোমার কি আর কখনোই দেখা হয়নি?’

মা চুপিচাপ জানলার কাচের ওপারে তাকিয়ে দেখে ফুরিয়ে যাওয়া দিগন্তের রং।

‘মা, আমার গায়ের রং ঘোর রক্তবর্ণ।’

মা চুপিচাপ জানলার শার্সিতে ভেঙে যেতে দেখে পিঁপড়ের সারি, তাহাদের অগস্ত্য যাত্রা। মায়ের কি মনে পড়ে যায় অগস্ত্য মুনির কথা? আমি মায়ের হাতের একটা আঙুল সেই ছোটোবেলার মতো ডানহাতের মুঠোর মধ্যে ধারণ করি। তারপর তার পায়ের কাছে বসে বামহাতে তার কোলে তুলে দিই আমার প্রথম কবিতার বই। বইয়ের নাম, ‘পাখি ও পাপ।’

ডাক্তার আয়েশার পরনে শাদাশাড়ি, তার স্মৃতি এখন রক্তজবার বন।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.