:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোশতাক আহমদ

কবি, গদ্যকার

সে এক স্বপ্নের জগত, সে এক মায়ার জগত

সে এক স্বপ্নের জগত, সে এক মায়ার জগত

অক্ষরবন্দী জীবন : চলমান বৃক্ষ ও ’৮৫-র বইমেলা এর পর থেকে-

শহীদ খুরশীদ লাইব্রেরি ফেলে এসে যে কলেজ লাইব্রেরিটা পেলাম, প্রথম দর্শনে সেটা আমার পছন্দ হল না এবং সেটাই ছিল শেষ দর্শন। সেই লাইব্রেরীতে অকালপ্রয়াত চন্দনের নামে তার পরিবার থেকে একটি কর্ণার করে দিয়েছিল।

এদিকে আমার ফেলে আসা বন্ধুরা শহীদ খুরশীদ লাইব্রেরির যৌবনকাল উপভোগ করছে। মামুন, মূর্তজা, হায়দার, সিদ্দিকীরা পাল্লা দিয়ে কবিতার বই পড়ত- নির্মলেন্দু গুণের ‘নির্বাচিতা’, হুমায়ুন আজাদের ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, শামসুর রাহমানের সমুদয়, কহলিল জিবরান, জীবনানন্দ কাব্যসম্ভার, রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কিংবা ‘সুকান্ত সমগ্র’। বাবুল ভাইকে জিবরান পড়তে দেখেছিলাম; আমি ভাবতাম এইসব উচ্চমার্গের কবিতা পড়তে পড়তে একদিন তাঁর মতিভ্রম হতে পারে! অনেক বছর পর আমাদের ছোট ভাই সিয়াম অনুবাদ করেছিল জিবরানের রত্নভাণ্ডার।

যা বলছিলাম, আমার বন্ধুরা তখন ক্রিকেট খেলার মাঠে দর্শক সারিতে লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়ার পর্ব পেরিয়ে আসছে। মোস্তফা আমিনকে ক্রিকেট মাঠে বসে হূমায়ুন আহমেদের ‘নিশিকাব্য’ পড়তে দেখেছি। আর জাহিদ খান যেহেতু নিজেই কবিতা লিখত, তার আর তেমন কবিতার বই পড়ার প্রয়োজন ছিল না। আমি সেদিন মাইকেলের বাড়ি গিয়ে মাইকেল ভাস্কর্যের সাথে ছবি তুলেছি, প্রবাস থেকে জাহিদ খান সেই ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আস্ত একটা ইংরেজি সনেট লিখে পাঠাল! পরে আমি হিসেব করে দেখেছিলাম, আমিও একই সমান্তরালে প্রায় একই পাঠ্যসূচিতেই ছিলাম কিন্তু তফাতটা এই যে ওদের সাথে পাঠ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিতে পারিনি। আমি তখন আহমেদ রফির সাথে সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় শক্তির ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ বইয়ের আলোচনা পড়ে সরাসরি নসাসে গিয়ে সেই বই কিনে নিয়ে আসি, পড়ি সুনীলের কবিতা। আমার ফুফাত ভাই কবি মুহাম্মদ সামাদের বন্ধু, তিনি পড়তে বললেন ‘একজন রাজনৈতিক নেতার ম্যানিফেস্টো’। বলাকার সামনে থেকে একদিন পেয়ে গেছিলাম সস্তায়।

মামুন, মূর্তজা, হায়দার, সিদ্দিকীরা পাল্লা দিয়ে কবিতার বই পড়ত- নির্মলেন্দু গুণের ‘নির্বাচিতা’, হুমায়ুন আজাদের ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, শামসুর রাহমানের সমুদয়, কহলিল জিবরান, জীবনানন্দ কাব্যসম্ভার, রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কিংবা ‘সুকান্ত সমগ্র’। বাবুল ভাইকে জিবরান পড়তে দেখেছিলাম; আমি ভাবতাম এইসব উচ্চমার্গের কবিতা পড়তে পড়তে একদিন তাঁর মতিভ্রম হতে পারে! অনেক বছর পর আমাদের ছোট ভাই সিয়াম অনুবাদ করেছিল জিবরানের রত্নভাণ্ডার।

মনে পড়ছে এক না-হওয়া বইয়ের কথা। কবিবন্ধু উবাইদুল্লার সাথে আমার অনেক পরিকল্পনা ছিল, স্বপ্ন ছিল। নাম ছাপানোর ছলে বার্ষিকীতে আলতামিরার গুহাচিত্র নিয়ে লিখেছিলাম যৌথভাবে, ইচ্ছে ছিল কোনো একদিন এক মলাটে কবিতার বই করব দুই বন্ধু মিলে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশুনা করছি, তখন সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায়।

হায়দার, পার‌ভেজ আর মূর্তজারা কিন্তু বই পড়েই তৃপ্ত ছিল না, ওরা মার্ক টোয়েনের ধরনে লাইব্রেরি গড়ার কায়দায় ওই লাইব্রেরি থেকে সুবিধামত নিশিকুটুম্বের মতো বই সরিয়েও রাখত। জ্ঞান তৃষ্ণার অন্তত কমতি ছিল না। নিশিকুটুম্বের কথা এই বেলা বলা না হলে ভুলে যাব। একবার ট্রেনে মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’ পড়তে পড়তে চাঁটগা পৌঁছলাম। আমার সিটের পিছনে একটা ডিম লাইট পড়ে ছিল, আশ্চর্য হয়ে পরে দেখলাম, আমি সেটা নিশিকুটুম্বের চোরের কায়দায় সরিয়ে ফেলেছিলাম! বা‌তিটা আসলে অকে‌জো ছিল! ঢাকাতে চিকিৎসার নাম করে এসে গুলিস্তান থেকে পুঁথি (রাস্তার কবিতা) কিনে নিয়ে যেত কেউ কেউ, সুর করে হল্লা করত অবসরে। ছোটবেলায় আমি ‘ভূট্টোর ফাঁসির কবিতা’ (পুঁথি) পড়েছি।

মামুন একটা খতিয়ান দিয়েছিল, কবিতা পড়তে পড়তে ওদের কালজয়ী ক্লাসিকগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে যায়; টলস্টয় আর দস্তয়েভস্কি পড়ে চারপাশটাকে চিনতে শেখে ওরা। মাসুদ রানা- কুয়াশা কিংবা বনহুর পড়ে পড়ে অভ্যস্ত একাকী পথ চলা থেকে বিশাল জীবনের বহুমাত্রিকতায় পা দিয়ে চোখ গেল ধাঁধিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ হয়ে মতি নন্দীর ‘ফুটবল’ পর্যন্ত দাবড়ে বেড়িয়েছে শরীফ কিংবা আমিনুল। শহীদ খুরশীদ স্মৃতি লাইব্রেরির দুপুরগুলোতে আমার বন্ধুরা এইভাবে রূপান্তরিত হতে থাকে, বিহ্বল হতে থাকে।

ফজলু আতিক কিংবা খায়ের যখন পাঠ্যপুস্তকের উচ্চতর রেফারেন্স খুঁজত, মামুনের সাথে তখন বন্ধুত্ব হয়ে গেল এজরা পাউন্ড আর টি এস এলিয়েটের; বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বোদলেয়ারের ‘ক্লেদজ কুসুম’ পড়ে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় ছেঁড়া জুতো পরে ফ্লানিউর হয়ে নাচা কিংবা ফুটপা‌তের চা‌য়ের কা‌পে চুমুক দি‌য়ে ইতিহা‌সের ক্যাফে‌গু‌লোতে চ‌লে যাওয়া – সে এক স্বপ্নের জগত, সে এক মায়ার জগত কিংবা সে এক মতিভ্রমের জগত!

 


প্রচ্ছদ : রাজিব রায়

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.