:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সৈয়দ তারিক

কবি, ভাবুক

সামান্য সান্নিধ্যের অসামান্য উষ্ণতায়
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

একথা সেকথা

সামান্য সান্নিধ্যের অসামান্য উষ্ণতায়

কিছু মানুষ আছেন, যাদের সাথে অল্প দেখা-সাক্ষাতেই একটা সখ্য বা আত্মীয়তা ঘটে যায়। তাদের চিত্তের ব্যাপ্তি বা হৃদয়ের ঐশ্বর্যই অমন। অপরকে তারা আপন করে নিতে পারেন, সম্মানও করতে জানেন। সলিমুল্লাহ খান অমনই একজন মানুষ।

তার কথা প্রথম যখন জানি তখনও স্কুল পার হই নি। দশম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বিষয়ক বই পড়ে চেতনায় উপপ্লব ঘটে গেছে। ধর্মবিশ্বাস বর্জন করেছি। মার্কসবাদে মজেছি। সমাজ-রাষ্ট্র-জীবন-জগত সম্পর্কে ভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে।

খবরের কাগজে একদিন সংবাদ হলো ‘প্রাক্সিস জার্নাল’ নামে একটি সাময়িকীর চলমান সংখ্যা সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কারণ সেখানে একটি প্রবন্ধ ছিল ‘প্রচলিত মুসলিম আইন অবাঞ্ছিত শিরঃপীড়া’ নামে। তখন তো গ্রন্থ বা সাময়িকী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়া বিষয়টাই বিপুল আগ্রহের, তদুপরি এখানে ধর্মবিরোধী অনুষঙ্গ আছে। সুতরাং কমলাপুর স্টেশনের ক্যামলট বুক স্টলের যে পরিচিত সেলসম্যান ছিলেন তাকে গিয়ে ধরলাম পত্রিকাটির একটি কপির ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি দ্বিগুণ দামের বিনিময়ে একটি কপি চুপিচুপি দিলেন আমাকে। সেই জর্নালটির সম্পাদকের নাম ছিল সলিমুল্লাহ খান, যিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এটি ১৯৭৯ সালের কথা।

এরপর ক্রমে জানতে পারলাম, প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি নামে একটি সভার কথা, যেখানে মার্কসবাদ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়। মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ বিখ্যাত ড. আবু মাহমুদ তখন দেশে ফিরে এসেছেন। তিনিও এই সভায় আলোচনা করেন। স্বভাবতই ওই সভায় যোগ দিতে খুবই আগ্রহ বোধ করি। কিন্তু সামনে এসএসসি পরীক্ষা, তার আগে অন্য কিছুতে সময় দেওয়া সম্ভব নয়।

এসএসসি পাশের পর ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে। তখন একদিন গিয়ে হাজির হলাম আজিমপুরের শেখ সাহেব বাজার রোডে এক উকিলের চেম্বারে প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতির সভায়। তখনই প্রথম দেখা সলিমুল্লাহ খানের সাথে। পরিচয় ও উদ্দেশ্য জেনে সাদর সম্ভাষণ করে বসতে বললেন তাদের সভায়। অন্যদের সাথে পরিচয় হয়েছিল তখন। বেশির ভাগকেই ভুলে গেছি। তবে মার্শাল টিটো নামে একজন ছিলেন, সেটা তার নামের কারণে মনে আছে, এবং তিনি আমাকে সিগারেট খাইয়েছিলেন একথাও মনে পড়ে। সভায় কী কী আলাপ হয়েছিল তার কিছু মনে নাই। তবে সভাশেষে সলিমুল্লাহ খান প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি হতে প্রকাশিত মোহন রায়হানের কবিতার বই ‘আমাদের ঐক্য আমাদের জয়’ উপহার দিয়েছিলেন স্বাক্ষর করে। ওই সভায় পরে বোধ হয় আর যাওয়া হয় নি, বা এক-আধবার হয়ে থাকতে পারে।

আশির দশকের শেষের দিকে নাকি নব্বইয়ের প্রথম দিকে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে দেখা হলো সলিমুল্লাহ খানের সাথে। দেশে ফিরেছেন তখন। ভাবছিলাম তিনি কি আমাকে চিনবেন? কারণ তার সাথে আমার দেখা ও কথা তো তেমন বেশি হয় নি। কিন্তু তিনি দিব্যি চিনলেন ও আন্তরিকতার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। ভালো লাগল বিষয়টা।

এরপর বেশ কয়েক বছর তার সাথে আর যোগাযোগ ছিল না। তবে তার কথা মাঝে মধ্যে শুনতে পেতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো জ্ঞান নিশ্চয়ই তার ছিল। কিন্তু তার মেধা ও চিন্তার বিশিষ্টতাই তাকে বঞ্চিত করেছিল বলে শুনেছিলাম। পত্রিকায় মাঝে মাঝে তার কবিতা দেখতে পেতাম। ‘এক আকাশের স্বপ্ন’ নামে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল।

একসময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হন। সেই সময় বামপন্থী ভাবাপন্ন যুবকদের মার্কিন দেশে যাওয়াটা একটু চোখে লাগার মতো ব্যাপার ছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার নামটি উল্লেখ না করে তার গমনের বিষয়ে একটু সরস সমালোচনা করেন। যতদূর মনে পড়ে সংবাদ-এর ‘সময় বহিয়া যায়’ কলামে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক বছর পরে সলিমুল্লাহ খান সেই লেখার খেই ধরে জবাব দিয়েছেন তার একটি লেখায়।

আশির দশকের শেষের দিকে নাকি নব্বইয়ের প্রথম দিকে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে দেখা হলো সলিমুল্লাহ খানের সাথে। দেশে ফিরেছেন তখন। ভাবছিলাম তিনি কি আমাকে চিনবেন? কারণ তার সাথে আমার দেখা ও কথা তো তেমন বেশি হয় নি। কিন্তু তিনি দিব্যি চিনলেন ও আন্তরিকতার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। ভালো লাগল বিষয়টা।

এরপর তিনি ক্রমে নানা লেখা, আলোচনা, বক্তৃতা, লাকাঁ ইন্সটিটিউট, আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, গ্রন্থ রচনা, টক শো এইসব বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দর্শন-রাজনীতি-সাহিত্য-সমাজ ইত্যাদির একজন উজ্জ্বল ভাষ্যকার হিসাবে জ্ঞানের দেশনা ছড়িয়ে যেতে লাগলেন। মাঝে মধ্যে হঠাৎ কোনো-কোনো অনুষ্ঠানে তার সাথে দেখা হয়ে গেলে তার উষ্ণ প্রীতিময় ভাব বিনিময়টুকু অনুপ্রেরণীয় মনে হয়। তার দু একটা বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছে। তার পাঠ ও মনস্বীতার ব্যাপ্তি আমাদেরকে আলোকের পথে উদ্বুদ্ধ করে।

বুদ্ধিজীবী হিসাবে তার তৎপরতা ও মহত্ত্ব সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভব করেছি যখন হঠাৎ একদিন ফরহাদ মজহার নিরুদ্দেশ হলেন, গুম হয়ে যাচ্ছিলেন, পরে নাটকীয়ভাবে তাকে পাওয়া গেল, আরও কত-কী কাহিনি হলো। সেই জটিল সময়ে একমাত্র তাকেই দেখেছি টেলিভিশনে ওজস্বিতার সাথে একজন কবির পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করতে। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করেছি সেদিন। বিশেষত যখন ফরহাদ মজহারের সাথে তার বেশ একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধ অনুধাবন করা যায়, তখনও এই স্বতঃস্ফূর্ততা ও সততা খুব সম্মানযোগ্য।

সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে সৈয়দ তারিক। আলোকচিত্র: শোয়েব সর্বনাম।

সম্প্রতি তার ষাটতম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হলো। তিনি আরও দীর্ঘকাল আমাদেরকে জ্ঞান-যুক্তি-মুক্তি ও ভালোবাসার এষণায় উদ্বোধিত করবেন, এই কামনা করি।

সংযোজন :
সলিমুল্লাহ খান আমার জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ভূমিকা রেখেছিলেন। হয়তো সেটা তিনি নিজের অজান্তেই করেছিলেন।

প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতির সভায় গিয়ে তার সাথে প্রথমবার দেখা হবার পর নানা কথার মাঝখানে তিনি হঠাৎ জিগেশ করলেন, ‘আপনি কি কবিতা লেখেন?’
কেন জিগেশ করেছিলেন তা আমি জানি না। উত্তরে বলেছিলাম, ‘আগে লিখতাম, এখন আর লিখি না।’

আমার এই জবাবটির একটি শানে নজুল আছে।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়বার সময় হতে আমার কবিতা লেখার শুরু। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়বার সময়ে বাল্যপ্রেমের থরথর কালে প্রতিদিন দশটা করে প্রেমাত্মক কবিতা লিখতাম আবেগবিধুর ভাষায়। সেই প্রেমটি ভেঙে যায় ও আমার কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে যায়। দশম শ্রেণীতে পড়বার সময় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ পড়ে আমার মন কঠোরভাবে বস্তুবাদী হয়ে ওঠে। কবিতা নামক ভাবালুতা ও কল্পনাপ্রবণতা পরিত্যাজ্য বলেই মনে হয়। এরকম একটা পটভূমিকায় আর কিছুদিন পরে সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমার ওই সাক্ষাৎপর্ব এবং তার জিজ্ঞাসা ও আমার জবাব।

তখন সলিমুল্লাহ খান মন্তব্য করলেন, ‘কবিতা তো লিখতেই হবে। কার্ল মার্কসও কবিতা লিখতেন।’ এ কথা বলে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

কিন্তু তার ওই মন্তব্যটি আমার অবচেতন মনে ছাপ ফেলে। গোপন রসায়নে মন আমার আবার কবিতামুখী হয়ে ওঠে। একসময় আবার আমি কবিতা লিখতে শুরু করি।

সুতরাং অর্ফিউসের বীণা বাজানোর মতনই সলিমুল্লাহ খান কবিতার দুনিয়ায় আমাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন, এ কথা বলা যায়। এই হেতু তার প্রতি আমার নিরন্তর অভিবাদন।

৪ ডিসেম্বর ২০১৮

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.