:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সেলিম মোরশেদ

কথাসাহিত্যিক

খসরু ভাই, নিমপাতায় গা ধোয়াবে কে?
আলোকচিত্র: কামরুল হাসান মিথুন

খসরু ভাই, নিমপাতায় গা ধোয়াবে কে?

মুহম্মদ খসরু, খসরু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো ৩০ বছর আগে। চার/পাঁচ ঘণ্টা আগে (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) খসরু ভাই মারা গেলেন। জেলা শহরে থাকায় বছর তিনেক দেখা হয়নি।

লে-ম্যানদের সোসাইটিতে মৃত্যু-পরবর্তী যে মূল্যায়ন হয়, স্মৃতিচারণে যে চল, মুহম্মদ খসরু সেই গদবাঁধা ছকে না। ব্যক্তিজীবন-শিক্ষাজীবন-কর্মজীবন-সমাজজীবন– শ্রেণি উত্তরণের জন্য কিলবিল করে এগিয়ে যাওয়া– খসরু এসবের বাইরে। সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত-যশোপ্রার্থী এমন কেউ নেই, যারা তাঁকে চেনেন না। যারা ভালোবাসেন, নিশ্চয় বুঝতে পারবেন কী বলতে চাচ্ছি।

পরিচয়ের আগে নামটা শুনেছিলাম: ‘একজন লোকের পাঁচটা ঠেলাগাড়ি লাগে ঘর পাল্টানোর সময়।’ ‘কেন?’ ‘বইয়ের জন্যে।’ ‘শুধু বইয়ের জন্যে।’ ‘হ্যাঁ।’ ‘আর কী করেন?’ ‘ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সংস্থায় (বিসিক) ছোটো চাকরি করেন।– ক্যামেরাম্যান।

‘সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা।’ ‘সুস্থ বলতে কী?’– বহু বছর লেগেছিলো বুঝতে। পারিপার্শ্বিক ক্যামোফ্লেক্সে এই সরব মানুষটি ফিল্মের ‘ইনটিলেকটচুয়াল মন্তাজ’-এর কৌশল দিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিলেন কর্মবিন্যাসের পরবর্তী আকাঙ্ক্ষা। চারপাশ এটা বুঝেও ‘অস্পষ্ট’ করে রেখেছিলো দায়িত্ব এড়ানোর জন্যে। উপরন্তু যা বলতো তা এমন:
১. খসরুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। ২. খসরু বইয়ের ব্যাককভার পড়ে। ৩. খসরু অদক্ষ। ৪. খসরু বিয়ে করতে পারলো না। ৫. খসরু খিস্তিখেউড় করে।

অঞ্জন, তারেক (মাসুদ, শাহরিয়ার), সাজ্জাদ, ঢালি, শিবলী, হাসান, সূর্য, মিথুন– সকলেই প্রায় পাগলের মতো খসরু ভাইকে ভালোবাসতো, কথা শুনতো।

অন্যরা তো বটেই– আমরাও খসরু ভাইয়ের স্নেহমিশ্রিত গালি থেকে রক্ষা পাইনি। অনেকের মতো তাঁর স্ক্রিপ্ট নিয়ে, অর্থের জন্য, ব্যক্তিগতভাবে কয়েকটা জায়গায় গিয়েছিলাম। তারা কী কী বলেছিলেন মনে আছে।

মুহম্মদ খসরুর মৃত্যুপরবর্তী কিছু লোকদেখানো কাজ হবে। এই চল্লিশ বছর তাঁকে নিয়ে তেমন কিছু হয়নি। অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ প্রথম তাঁর একটা সংখ্যা মুহম্মদ খসরুকে উৎসর্গ করেন। গাণ্ডীব-এর একটি সংখ্যা, পরে, তপন’দা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি লাইন লিখে উৎসর্গ করেছিলেন। ‘প্রতিশিল্প’ সম্পাদক মারুফুল আলম ২০১০ সালে সেই একইভাবে ৭ম সংখ্যাটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। ব্যস, এই পর্যন্তই। বলা ভালো, খসরু নিয়ে যারা ওইসব কথা বলতেন, সমাজ যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, তাতে তাদের কথা মিথ্যা না। শুধু বলবো, ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আঁহা-উঁহু করবেন না।

পরিচয়ের আগে নামটা শুনেছিলাম: ‘একজন লোকের পাঁচটা ঠেলাগাড়ি লাগে ঘর পাল্টানোর সময়।’ ‘কেন?’ ‘বইয়ের জন্যে।’ ‘শুধু বইয়ের জন্যে।’ ‘হ্যাঁ।’ ‘আর কী করেন?’ ‘ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সংস্থায় (বিসিক) ছোটো চাকরি করেন।– ক্যামেরাম্যান।

অঞ্জন তখন পুনায়, তারেক মাসুদ আমেরিকায়, ঢালি চট্টগ্রামে, সাজ্জাদ শরিফের তখন চাকরির শুরু। চাকার বাবুল দেশে নেই। পুরোনো ঢাকার রব, শিবলী, হাসান, আমি বছরের পর বছর খসরু ভাইয়ের সঙ্গে চলেছি। সন্ধ্যায় আড্ডা দিয়ে রাতে মদ খেতে যাওয়া। খসরু ভাই আমাকে চিনিয়েছিলেন পুরোনো ঢাকার আবগারির দোকান, মেথর পট্টি– সেখানে বিক্রেতার এক বিখ্যাত উক্তি– যা আমরা বলতাম, ‘দিন যায় কথা থাকে, পাকে পাকে।’ বড়ো গুহ্য বাক্য; অলিতে গলিতে খুব কম দোকানই আছে যেখানে খসরু ভাই নেননি। দেশি বাংলা মদ কোথায় ভালো, জানতেন। দিনের পর দিন আমরা খসরু ভাইয়ের সঙ্গে চলেছি। খিস্তির অতলরেখায় যে শিখার আলো, তাতে নিনাদিত হয়ে যা অর্জন করেছি তা দৃশ্যমান না, একান্তই অন্তর্গত। খসরু ভাই স্বীকৃত কৃর্ত্তিমান কেউ না, কোনো বড়ো বৃত্ত না, বরং এমন এক বিন্দু অথবা এমন এক কাণ্ড, যার শাখা-প্রশাখা পরোক্ষে ছড়ানো বহু দূর, নিজেও জানতেন না।

‘দিনে শাদা, রাতে লাল।’– এক নম্বর লেসেন।
‘মদ কম থাকলে বেশি পানি দিয়ে সময় নিয়ে খাবে।’
‘তাড়াতাড়ি ধরাতে চাইলে দুই পেগ একসঙ্গে খাবে।’
‘ব্লাকআউট হলে গলাটা শুকাবে, লুজ মোশন হবে।’
‘বমি হ’লে, বিরতি দিয়ে, আবার খাবে।’

আস্তে, গোপনে, অতি ধীরে জানলাম, ধ্রুপদী এই নামের একটা ঢাউস, বিশ্বচলচ্চিত্রের ওপর অসাধারণ বিশ্লেষণের একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ষাট দশকের শেষ দিকে। সত্তরের শুরু থেকে দুই হাজার দশ পর্যন্ত, বুক সাইজের, এই পত্রিকাটি দুই বাংলায় সমমর্যাদা পেয়েছিলো। সত্তরের মাঝামাঝি দেশে ‘ফিল্ম আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন– যা বিজয়ের মুখ দেখেছিলো– খসরু ভাই ছিলেন সেই আন্দোলন সক্রিয় একজন। ফিল্মকে নাইন সিস্টার্স মিডিয়া বলা হয়। এই আন্দোলন সাংস্কৃতিক অগ্রগতির একটা বড়ো ভিত। ‘চলচ্চিত্র পত্র’ এই নামে সিনেমা বিষয়ক আরেকটি পত্রিকা দীর্ঘদিন প্রকাশ হতো তাঁর সম্পাদনায়। ভারতবর্ষের চারজন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাতা: রাজেন তরফদার, ঋত্বিক কুমার ঘটক, শামা জায়েদি, আদুর গোপাল কৃষ্ণান তাঁদের এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন মুহম্মদ খসরু। ‘সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়’ নামে উলুখড়-এর প্রথম গ্রন্থ হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়।

মুহম্মদ খসরু। ড্রয়িং: সেলিম মোরশেদ। ২০০৫।

‘অয় মিয়া, এতো বন্ধু বন্ধু করো, বন্ধু হয় না।’
‘ওই যে ছোটোকালে শুনছি, কণ্ঠশিল্পী, মহিলা, ‘ও বন্ধুরে’… ব’লে যে টান দিতো…।’
‘ওর মাঙ-পোদ এক হয়ে গেছে।’
‘ওদের সঙ্গে তোমার এই চোদন-পোদন ঠিক না।’
‘কারা?’
‘ভান করো, না বোঝো না?’
‘বলেন–’
‘ওই যে, দুম্বা তারেক (তারেক শাহরিয়ার), খচ্চর তারেক (তারেক মাসুদ), মতির কবি (সাজ্জাদ শরিফ), বানরের হাড় (হাসান)।’
‘কী বললে?’– ‘চ-পা– (ছফা ভাই)।’
ওরা কাছে গেলে আবার সব ঠিক।

‘উলুখড়’ দোকান পেয়েছে আজিজ মার্কেটের নিচের তলায়। অল্প কয়েকটি বই দিয়ে তাক গুছিয়ে রাখে। বন্ধুরা বসি। সাগর নীল খানের সমবয়সি ভাই-বোনরা আসে। কথাশিল্পী নাসরীন জাহান দুপুরবেলা ঘুরতে ঘুরতে এসেছেন। খসরু ভাই হঠাৎ হাজির। আড্ডাটা জমবে। ‘পুরোনো ঢাকার গলিতে সারাদিন মায়েরে চুদি-মায়েরে চুদি– কে কার মায়েরে যে চোদে… শুরু করলেন। পাশে বইয়ের দোকান ছিলো মান্নান হীরা ভাইয়ের। নাসরীন ঘুরে এলেন। খসরু ভাই বিপ্লবীদের নৈতিক জীবন নিয়ে কথা বলছিলেন। একটা মানুষও তার বিচারে ঠিক না, মহাজ্বালা! নিজে সক্রিয়ভাবে রাত-দিন কাজ করি। কাহাতক আর! অন্যায় হয়ে গেলো : ‘খসরু ভাই, এতো কথা বলেন, চাকরিটা তো ছাড়েননি, পেনশনের টাকা তো সোনালী ব্যাংকে। গ্রামে জমি আছে– একা মানুষ– কই, জমি তো ব্যাচেননি?’ নির্বাক হয়েছিলাম খসরু ভাইয়ের উত্তরে: ‘আমি তোমার মতো স্ত্রীর ভাত আর বাবার জমির ওপর নির্ভরশীল না। জমি বেচে ফিল্ম বানাবো, ওই ধরনের প্রেমিক আমি না।’ পরিবেশটা নীরব হয়ে গেলো। খসরু ভাই এভাবে বলতে পারলেন! অতটা হয়তো লাগতো না, যদি খসরু ভাই তাঁর প্রকৃতির বাইরে এমন পরিশীলিত ভাষার আশ্রয় না নিতেন।

খসরু ভাই আমাকে ‘শ্রুতিধর’ উপাধি দিয়েছিলেন।

বহু পরে নাসরীন জাহানের মন্তব্যটা আমাকে আরো ব্যথিত করেছিলো।– ‘দোষটা কিন্তু খসরু ভাইয়ের না, উনি অপমানিত হয়েছেন।’ বিষয়টা নিয়ে ভেবেছিলাম, অসম সমাজ বাস্তবতায় একজন আত্মঘাতী বিপ্লবীও সমসত্তা বজায় রাখতে পারে না। স্ববিরোধিতার সমন্বয় কোথায়, কতটুকু বুঝতে হবে।

দিনের পর দিন আমরা খসরু ভাইয়ের সঙ্গে চলেছি। খিস্তির অতলরেখায় যে শিখার আলো, তাতে নিনাদিত হয়ে যা অর্জন করেছি তা দৃশ্যমান না, একান্তই অন্তর্গত। খসরু ভাই স্বীকৃত কৃর্ত্তিমান কেউ না, কোনো বড়ো বৃত্ত না, বরং এমন এক বিন্দু অথবা এমন এক কাণ্ড, যার শাখা-প্রশাখা পরোক্ষে ছড়ানো বহু দূর, নিজেও জানতেন না।

দুই হাজার একে ব্যক্তিগত ইশতেহার সংক্রান্ত আমার একটা বই : ‘পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গো’– উৎসর্গ করেছিলাম খসরু ভাইকে, লিখেছিলাম– ‘রক্তাক্ত রাবণ।’

কলকাতায় গিয়ে হোটেল নিলামে উঠি। কিডস্ট্রিট, নিউমার্কেটের কাছে। বইমেলায় যাবো। গেট পেরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থ, একটা টাঙ্গা, তার উপরে চড়ে খসরু ভাই যাচ্ছেন, মাথায় হ্যাট, কালো সানগ্লাস আর ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগ। শাসনব্যবস্থা পরিদর্শনের লর্ড কার্জনের মতো লাগছিলো।

‘ওই খসরু ভাই’
‘কি মিয়া চলে আইসো।’

সুবিমল দা’র টেবিলের একটু দূরে খসরু ভাই দাঁড়িয়ে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। সুবিমল দা’কে বললাম, ‘আপনি গদার চিনিয়েছেন, ঋত্বিকের মূল্যায়ন করেছেন। খসরু ভাই চিনিয়েছেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের প্রধান পুরুষ হীরালাল সেনকে। সুবিমল দা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আমি তাকে চিনি অনেক আগে থেকেই।’ তারপর ‘সান এন্ড মার্ডার’ বইটা আমাকে লিখে দিলেন। ফেরার পথে খসরু ভাই বললেন, ‘তোমার মতো চতুর্থ শ্রেণির একজন লেখক বাংলাদেশ-ভারত যে এক করে দিলো।’

কিছুদিন পর খসরু ভাই কেরাণিগঞ্জে চলে গেলেন। সপ্তাহে দুই দিন ঢাকায় আসেন। হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। মদ খাওয়াটা কমে গেল। মুহম্মদ খসরু এতোটাই নিস্পৃহ, আমরা ছাড়া অন্য কোনো পরিমণ্ডল তার ছিলো না। এসে– পছন্দের কেউ থাকলে তবে পানশালায় যেতেন। আমার বন্ধুদের অনেক পরিসর। ‘লোনলিনেস’ যে ‘গিফট’– দায়িত্বশীল স্বামী হবার চেয়ে ছন্নছাড়া প্রেমিক শিল্পী হওয়ার প্রধান শর্ত– এটা ভুলে গেছে বন্ধুরা। খসরু ভাইয়ের মতো অবাধ কেউ না। কালেভদ্রে বন্ধুদের সঙ্গে বসলে দেখি, গেটের তালা বন্দ হবে, সকালে অফিস, বাসা থেকে ফোন ইত্যাকার।

বারকালচারে যে ওয়াইল্ড প্লেজার– খসরু ভাই তাপটা নিতে জানতেন।

নীলক্ষেতের পানশালায় ঝোলা থেকে বাঁশি বের করে কোমল সুর তুলতেন।

এই সবের ভেতরে, ঝোলা থেকে বের করে দিতেন দুটো বই। সিরিয়াস বইগুলো বাদ দিয়ে বলি : সমরেশ বসু এবং সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘জানমারি’‘দশদিন পর’– একই ধরনের টেক্সট প্রায়ই। এর ঐক্য এবং বৈপরিত্য লাইন টু লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে সাতদিনের মধ্যে বই দুটো ফেরত দিতে হবে। ফেরতের দিনক্ষণ এ-দিক ও-দিক হলে নির্মমতার মাত্রাটা কম ছিলো না। কতো বই যে পড়িয়েছেন! বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি কোনোদিনই দেখা হতো না, তাঁর সঙ্গ না পেলে।

গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমাদের জন্যে, এমনও ঘটেছে, প্রস্রাবের চাপ অনুভব করলেও খসরু ভাই বলতেন, না– ‘আর কয়েক মিনিট, বসো।’

কোন্ আশীর্বাদে কার আশীর্বাদে এমন ভাই বন্ধু শিক্ষক এমন সন্ত মানুষ– কালের ভাগ্য যে আমাদের এতোটাই কাছাকাছি ছিলো; আর বাঁশির সুর রাগিণীর গভীর মীড় আর গমকে তাঁর উপস্থিতি ছিলো অনুভবের অটুট বন্ধন।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.