:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

খালিদ স্যার ও অলৌকিক বৃক্ষের দেশ
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ স্মরণ

খালিদ স্যার ও অলৌকিক বৃক্ষের দেশ

খালিদ স্যার আর নেই। নিশ্চয়ই আকাশের ওপারে বসেও তিনি ভাস্কর্য বানান এখনো, এখনো লাল লাল বৃক্ষ ও পাতার ছবি আঁকেন।

খালিদ স্যার মানে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, ‘অপরাজেয় বাঙলা’ ভাস্কর্যের ভাস্কর। তার নাম আমি ছোটবেলা, মানে প্রাইমারি ইশকুল থেকেই জানি। কেমন করে? বৃত্তি পরীক্ষার অবজেকটিভ কোশ্চেনের গাইডে তার নাম ছিল— অপরাজেয় বাঙলা ভাস্কর্যের ভাস্কর কে? উত্তর: সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ

তো, তার সঙ্গে আমার কোনো দিন দেখা হতে পারে, ভাবিনি। অনেক বছর পর, কুড়ি বছর পর, যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হই, তখন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। চেহারার মধ্যে কেমন খ্যাপাটে ভাব, লাল দুই চোখ, লম্বা চুল। ফার্স্ট ইয়ারে তিনি আমাদের স্কাল্পচারের মডেলিং ক্লাস নিতেন। মানে কাদা দিয়ে মডেল বানানো।

পার্টস-স্টাডি ক্লাস ছিল। আমাদের একেকটা ক্লাস তখন দুই সপ্তাহ। কাদামাটি দিয়ে আমরা হাত-পা এই সব বানাচ্ছিলাম খালিদ স্যারের ডিরেকশনে। আমি বানাচ্ছিলাম হাত, একটা মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। কয়েক দিন পর একদিন দুপুরবেলা স্যার সবার কাজটাজ ভালো করে চেক করলেন। যখন দেখলেন আমাদের ক্লাসের দুইটা মেয়ে ঠিকমতো কাজ করেনি, কাজের মধ্যে যথেষ্ট অবহেলার ছাপ, দায়সারা গোছের—স্যার ভয়ানক রেগে গেলেন, কিন্তু রাগটা ওইভাবে প্রকাশ করলেন না, তবে মেয়ে দুইটাকে বকা দিলেন এবং ওই দিনের মতো ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। তারপর নিজেও বের হয়ে গেলেন।

পরদিন সকালে স্যার ক্লাসে এলেন। মুখে এক দিনের না কামানো দাড়ি, টকটকে লাল চোখ। আমাদের সবাইকে দাঁড় করালেন, আমরা স্যারকে ঘিরে দাঁড়ালাম। মেয়ে দুটিকে বললেন, ‘দেখো, কালকে তোমাদের বকা দিয়ে আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি, ঠিকমতো খাইনি; দেখো, দাড়ি কামাইনি…তোমরা এমন কেন?’ স্যারের চোখে পানি। তারপর আমাদের সকলকে যে কথাগুলো বললেন তা আমার কানে এখনো বাজে।

তার পরদিন সকালে স্যার ক্লাসে এলেন। মুখে এক দিনের না কামানো দাড়ি, টকটকে লাল চোখ। আমাদের সবাইকে দাঁড় করালেন, আমরা স্যারকে ঘিরে দাঁড়ালাম। মেয়ে দুটিকে বললেন, ‘দেখো, কালকে তোমাদের বকা দিয়ে আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি, ঠিকমতো খাইনি; দেখো, দাড়ি কামাইনি…তোমরা এমন কেন?’ স্যারের চোখে পানি। তারপর আমাদের সকলকে যে কথাগুলো বললেন তা আমার কানে এখনো বাজে। মাইকেলেঞ্জেলোর কথা বললেন, কেমন করে সিসটিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে ফ্রেস্কো করতে করতে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলেন। মোজার্টের কথা বললেন, অ্যামাদিউস মোজার্ট। তার ডেথ সিম্ফনি কম্পোজ করতে গিয়ে কীভাবে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন, সেই সব কথা, শিল্পের জন্য সাধনা করতে গিয়ে জীবন দেওয়ার কথা…। তারপর মোজার্টের বায়োপিক, ‘অ্যামাদিউস’ দেখতে বললেন।

স্যার বলার কয়েক দিনের মধ্যেই আমি ‘অ্যামাদিউস’ সিনেমাটা দেখে ফেলি। এর আগে আমি মোজার্ট সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, কেবল তার কিছু কম্পোজিশন শুনেছি। ‘অ্যামাদিউস’ দেখতে দেখতে আমি তলিয়ে গেলাম, কষ্ট হলো ভয়ানক।

অধ্যাপক আবুল ফজল, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ও স্ত্রী উম্মে কুলসুম। ছবি: সংগৃহীত

ফার্স্ট ইয়ারের পর বিষয় ভাগ হয়। আমাদের চারুকলায় ছিল তিনটা বিষয়। পেইন্টিং, প্রিন্টমেকিং আর স্কাল্পচার। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রথম ১০ জন পেইন্টিং পায়। বাকিরা প্রিন্টমেকিং কিংবা স্কাল্পচার। তো, যেহেতু আমি পেইন্টিং পেয়ে গেলাম, নিলাম। আর অনুষঙ্গী বিষয় হিসেবে নিলাম স্কাল্পচার।

খালিদ স্যার স্কাল্পচারে পোর্ট্রেট বানানো শেখাতেন। তো, ইয়ার ফাইনালে আমি পোর্ট্রেটে হাইয়েস্ট মার্ক পেয়ে গেলাম। ক্লাসমেটদের মধ্যে কেউ কেউ কানাকানি করল যে খালিদ স্যারের সঙ্গে আমার খাতির আছে, তাই আমাকে নম্বর বেশি দিয়েছেন। আমি হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারলাম না। কারণ, খালিদ স্যারের সঙ্গে কেউ খুব না মিশলে তাকে মনেই রাখতে পারতেন না। আর আমি ক্লাসে স্যারেরা থাকলে ক্লাসের মধ্যেই থাকতাম না। স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেই ক্লাসে ঢুকতাম।

খালিদ স্যারের সঙ্গে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের নয়টি বছরের চারবার কি পাঁচবার গিয়ে কথা বলেছি এবং প্রতিবারই তিনি আমাকে চিনতে পারেননি, আমি আমার পরিচয় দিয়ে কথা বলেছি, মানে বলেছি, আমি আপনার ছাত্র, আমার নাম এই ইত্যাদি।

একদিন সন্ধ্যায় ক্লাস শেষে আমি জারুলতলায় ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে আছি, অন্যমনস্ক। হঠাৎ শুনলাম কেউ আমাকে ডাকছে, ‘অ্যাই ছেলে, অ্যাই…।’ আমি দেখলাম খালিদ স্যার হাতের ইশারায় ডাকছেন। আমি তড়িঘড়ি করে ‍উঠে গিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়ালাম।

স্যার বললেন, ‘তোমার কি খিদা লাগছে?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, স্যার।’ স্যার ‘চলো’ বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঝুপড়িতে গিয়ে বসলেন।

বললেন, ‘কী খাবা?’ বললাম, ‘স্যার পাউরুটি খাব এক পিস।’ তখন পকেটে টাকাপয়সা তেমন থাকত না, ফলত বিকেলে কিছু খাওয়া হতো না প্রায় দিনই।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের চিত্রকর্ম। ছবিসূত্র: ডেইলি স্টার

স্যার বললেন, ‘পাউরুটি খাবে কেন, কেক খাও।’ আমি চুপচাপ স্যারের সামনে বসে রইলাম। স্যার দোকানিকে আমার জন্য কেক আর কলা দিতে বললেন আর তার নিজের জন্য চা। স্যার চা খেতে খেতে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন।

তোমার নাম কী?

নির্ঝর।

তুমি কবিতা পড়ো?

জি পড়ি, স্যার।

আল মাহমুদের কবিতা পড়েছ?

পড়েছি, স্যার।

সোনালি কাবিন?

হ্যাঁ স্যার।

আরেকটা কেক খাও।

আমি আরেকটা কেক খেতে খেতে স্যার আমার জন্য চায়ের কথা বলে উঠে চলে গেলেন। তারপর স্যারের সঙ্গে আর তেমন কথা হয়নি।

একদিন আমি সেন্ট্রাল মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ল ফ্যাকাল্টির নিচে দেখলাম রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর ক্যানভাস রেখে স্যার ছবি আঁকছেন। তখন রাস্তার পাশে সারি সারি গাছে সোনালু ফুল ফুটে ছিল। ভাবলাম, স্যার বুঝি সোনালু ফুল আঁকছেন। কাছে গিয়ে দেখি স্যারের ক্যানভাসভর্তি অরণ্য। অরণ্যভর্তি গাছ। গাছের ডালপালা, পত্রপল্লব, কাণ্ড সব টকটকে লাল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম স্যারের পেছনে দাঁড়িয়ে। আমার অস্তিত্ব টের পেলেন না। আমার ভ্যানগঘের কথা মনে হলো। স্যার তন্ময় হয়ে তার ক্যানভাসে আঁকছিলেন অলৌকিক বৃক্ষের দেশ।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.