:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোশতাক আহমদ

কবি, গদ্যকার

একটি কবিতার স্মৃতি
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

অক্ষরবন্দী জীবন-১৩

একটি কবিতার স্মৃতি

চোখ রেখেছি তোমার চোখে
তুমি আমার অনেক কিছু
(অমিত চৌধুরী, তুমি আমার অনেক কিছু, চোখ রেখেছি তোমার চোখে, ১৯৮৪)

আশৈশব কাতরতা ছিল রঙের প্রতি, অথচ পরিধেয় ছিল সাদা-কালো কিংবা ধুসর। কবি ছিলাম তো, স্ববিরোধ আর কোমল বিদ্রোহের বীজ ছিল অন্তর্গত স্বভাবে। আমাদের তারুণ্যে কতইনা রঙ ছিল ক্যাম্পাসে! গান ছিল, কবিতা ছিল, ক্রিকেট ছিল, ব্যাডমিন্টন ছিল, ক্যান্টিন ছিল, মোজাম্মেল চত্বর ছিল; সমান্তরালে ছিল অসুখের মিছিল আর লাশ কাটা ঘর। আমরা আমাদের জগৎটাকে রঙিন রাখতে সচেষ্ট থাকতাম। প্রতিবছর সাংস্কৃতিক সপ্তাহে বছরের সব রঙের কুঁড়িগুলো একসাথে ফুটে উঠতো যেনবা। আমরা বিতর্ক সঙ্গীত নৃত্য দেয়ালিকা ইত্যাদির সাথে একক-দ্বৈত-বৃন্দ আবৃত্তির প্রতিযোগিতা করতাম। তিতাস আর দিশা আপা বনাম নাসরিন আপা আর আমি দ্বৈত আবৃত্তির প্রতিপক্ষ হতাম। একবার আমরা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘নীলকন্ঠ’ কবিতার ‘হেই ডি হাই ডি হাই!’ এর হাওয়াই দ্বীপের মোহিনী মূর্চ্ছনায় দর্শকধন্য হলেও হেরে গেলাম বিচারকদের বিচারে। পরের বার (নব্বই এর উত্তাল দিনগুলোর মুখোমুখি, উৎসবের শ্লোগান হলো ‘আমরা আবহমান ধ্বংসে ও নির্মাণে’) কণ্ঠে নিলাম ‘রাতের চাদর দিয়ে ঢেকে দাও আলোর কফিন’ (নোটনের জন্য শোক, খোন্দকার আশরাফ হোসেন)। তিতাস- দিশা এবারে নিয়ে এলো ‘চোখ রেখেছি তোমার চোখে’ অমিত চৌধুরীর ‘চোখ রেখেছি তোমার চোখে’ কবিতার বই থেকে; বইটি ছিল ফয়সলের সংগ্রহে। কে হারলো কে জিতলো তা বলার চেয়ে জরুরি হচ্ছে, সেই কবিতা নব্বই এর উত্তাল সময়ের বিপরীতে সবাইকে জয় করে নিল। নাকি ‘এখন একটু চোখে চোখ রাখো/দিনগুলো ভারি দামালো’র (শঙখ ঘোষ) নব্বই-সংস্করণ খুঁজে নিয়েছিল সবাই! আসলে, আমাদের হৃদয়গুলো ছিল কোমল-পেলব, মিছিল-শ্লোগানে চাপা-পড়া নিজেদের অনেক কথাই ওই কবিতায় খুঁজে পেতাম।

সেই রোমান্টিক কবির আজ বয়স হয়েছে। সে জন্যেই কি তিনি রোমান্টিকতা বিসর্জন দিলেন?– না। এই বয়সে কবিদের পৃথিবী নানা রঙের স্বর্গভূমি হয়ে ওঠে। আমার জননী- জন্মভূমি- স্বর্গাদপী-গরিয়সী কবিকে সে সুযোগ দেয় নাই। কবিকে কেন আজ ‘ধোঁকাবাজ-ধোঁকারাজ’দের শ্রাদ্ধ করতে হচ্ছে? – আমি জেনেছি। কিন্তু আমার মহাদেশে মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা ক্যাম্পাসের বন্ধুরা সে কথা না হয় না জানুক; ওরা ‘তুমি আমার অনেক কিছু’র স্মৃতি চর্চায় সুখী থাকুক।

এখন বন্ধু বান্ধবীরা অধিকাংশই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা মহাদেশে। আমি এই বাংলায় রয়ে গেছি, বহু ক্রোশ ঘুরে ফিরে শেষে সমুদ্র-সারস। তিতাস মাহমুদ বন্দরে বন্দরে ধাক্কা খেয়ে এখন আমেরিকায় ডাক্তারি করে। এখনো পহেলা বৈশাখে মায়ের কাছে ফেরার আকুতিভরা মহাদেবীয় পংক্তিমালা আবৃত্তি করে- ইউটিউবে পাঠালো সেদিন সবাইকে। দিশা আলী এখন ইথিওপিয়ার জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। নাসরিন কাদেরও বিদেশ- বিভুঁইয়ে, মানুষের মানসিক ব্যাধির নিদান দিয়ে থাকেন। এখনো ওরা আমার নতুন কবিতা নিয়ে আগ্রহ দেখান। এখনও, এই একুশ বছর পরেও, আমরা সেই অমিত-লাবণ্যভরা হীরের টুকরো কবিতাটির স্মৃতিচারণ করি ফেসবুকে। ক্যাম্পাস-কাঁপানো স্মৃতিজ কবিতা এখন ফেসবুকের নীলাভ পৃষ্ঠায়। সেই কাব্যগ্রন্থের গর্বিত মালিক (বইটা অবশ্য জনগণের সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল) ফয়সলকে কি লন্ডন শহরের বিশ্রী বৃষ্টির দিনে কবিতাটির স্মৃতি হঠাৎ এক পশলা দোলা দিয়ে যায়?

একুশ বছর পর, আমার সৌভাগ্য, কবিকে পেয়ে গেলাম হঠাৎ করেই, ব্যস্ত কোলাহলে দরিয়ানগরের ঘর্মাক্ত চা-খানায়। দেখলাম, ‘মূল্যায়ন’ আজও বের হচ্ছে। কুড়ি বছর আগে আমার ‘বালিকার উৎসব’ ছাপা হয়ে আমাকে একদিন উৎসবের উপলক্ষ এনে দিয়েছিল পত্রিকাটি। আজ মেঘ না চাইতেই জল! কবির সাথে ক.বি.র (কবিতা বিশ্বাস) পরিণয় কাহিনীও জানা হলো। সেই রোমান্টিক কবির আজ বয়স হয়েছে। সে জন্যেই কি তিনি রোমান্টিকতা বিসর্জন দিলেন? – না। এই বয়সে কবিদের পৃথিবী নানা রঙের স্বর্গভূমি হয়ে ওঠে। আমার জননী- জন্মভূমি- স্বর্গাদপী-গরিয়সী কবিকে সে সুযোগ দেয় নাই। কবিকে কেন আজ ‘ধোঁকাবাজ-ধোঁকারাজ’দের শ্রাদ্ধ করতে হচ্ছে?– আমি জেনেছি। কিন্তু আমার মহাদেশে মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা ক্যাম্পাসের বন্ধুরা সে কথা না হয় না জানুক; ওরা ‘তুমি আমার অনেক কিছু’র স্মৃতি চর্চায় সুখী থাকুক। আমরা যারা এ দেশে রয়ে গেছি, তারাই না হয় দেখবো কবিকে অকাব্য-অসুরের আগ্রাসনের শিকার হতে; এটাই কি নিয়তি! দেশ মাতৃকার কাছে কবির জীবন আরেকটু নিরাপত্তা পাবার অধিকার কি রাখে না?

কবিতা ও ‘মূল্যায়ন’ নিয়ে অমিত চৌধুরীর অপত্য স্নেহ আর নিরন্তর উদ্যমের ছায়া দেখতে পাওয়া যায় বিষয়ভিত্তিক একনিষ্ঠ প্রকাশনাগুলোয়। বিশেষ সংখ্যাগুলো (শিবনারায়ন সংখ্যা, নজরুল- সুফী জুলফিকার- বিনোদবিহারী সংখ্যা, বুলবুল চৌধুরী সংখ্যা ইত্যাদি) তাঁর শ্রমলব্ধ সম্পাদনার স্বাক্ষর রেখেছে। বিরল ঘটনা হচ্ছে, বাংলাদেশে ছোট কাগজের ভ’বনে একটি জেলা শহর থেকে ৩৫ বছর ধরে নিরলসভাবে মানসম্মত ‘মূল্যায়ন’ বের হচ্ছে এবং প্রতিটি সংখ্যাতেই সম্পাদকের অপ্রকাশের ভার নিয়ে হাজির হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয় রুচিশীল পাঠকদেরকে। কোন মন্ত্রে সচল থাকেন একজন পোড়-খাওয়া সত্যবদ্ধ সম্পাদক, আমার জানা নেই।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.