:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

হেমলতা, হেমলতা
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

হেমলতা, হেমলতা

ভেবেছিলাম তোমাকে দোলনচাঁপা কিনে দিব। কিন্তু কাউকে বিক্রি করতে দেখলাম না। ফুলের দোকান থেকে কিনতে ভালো লাগে না, তাই কিনলাম না। ফুলের দোকান দেখলে আমার ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র কথা মনে পড়ে। কারণ ওই সিনেমা দেখার পর প্রথম আমি জানতে পারি বাঙলাদেশেও ফুল বিক্রি হয়, ফুলেরও দোকান থাকে। আমি তখন ওই রকম একটা ফুলের দোকানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম যেখানে শাবনূরের মতো কেউ ফুল বিক্রি করছে। তারও আগে শৈশবে কোনোদিন আগে ‘সিটি লাইট’ সিনেমা দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম সারাদিন।

তুমি তো জানোই আমার ভুলে যাওয়ার অসুখ আছে। বইয়ের নাম, বিষয়, কাহিনি, মানুষের নাম, সিনেমার কথা রোজ রোজ আরো কতো কিছু যে ভুলে যাই—তার ইয়ত্তা নাই। এই অসুখের চিকিৎসা হোক তাও আমি চাই না। কারণ স্মৃতি আর বিস্মৃতির মধ্যকার যে ধোঁয়া ধোঁয়া পৃথিবী আমার—সেই পৃথিবীর আলো-আঁধারি আমি উপভোগ করি।

একবার বইমেলায় একটা ছেলে এসে আমাকে তার নাম বললো। তারপর বললো, ‘আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি, আপনার সঙ্গে আমার গতবছর পরিচয় হয়েছিলো। চিনতে পারছেন?’ আমার প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিলো, আমি মনে করার চেষ্টা করছিলাম। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। ছেলেটা ‘অহ্’ বলে কষ্ট পেয়ে চলে গেলো। ভাবলো হয়তো আমি ইচ্ছে করেই চিনতে পারছি না। এমন অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। অস্বস্তি হয়, আবার মজাও পাই। একদিন আমার বউ বললো, ‘তুমি তো সব ভুলে যাও’ ইত্যাদি। তো, আমি বললাম, ‘আমি ভুলে যাই ঠিকই করি। ভুলে না গেলে তোমার স্যারের মতো কোটেশন ছাড়া কিছু লিখতে পারতাম না। হিহিহি।’

সে বললো, ‘মানে কী?’

বললাম, ‘তোমার স্যার একবার একটা দুইহাজার শব্দের প্রবন্ধ লিখেছিলো, সেটা একটা কাগজে ছাপাও হলো। পড়ে দেখলাম সেটাতে দেড় হাজার শব্দ কোটেশনের ভিতর বাকি পাঁচশো তার নিজের। হাহাহা…’

সেই থেকে হেমলতা আমার মাথার ভিতর। প্রথম ঢাকায় এসে পরিচিতজনদের দ্বারে দ্বারে চাকরির জন্যে ঘুরেছি। চাকরি না পেয়ে বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট লিখেছি, পণ্যের কপি লিখেছি। কম টাকায় বানান ঠিক করা আর পাণ্ডুলিপি এডিটিং-এর কাজ করেছি, বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি। অনেকে কাজ করিয়ে টাকা দেয়নি। এমনও ঘটনা আছে প্রচ্ছদের ক্রেডিট প্রকাশকের ছেলের নামে গেছে…।

যাইহোক এত কথা বলার পেছনের কারণ হেমলতা। হেমলতার কথাও আমি স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝখান থেকেই বলবো।

আমার বউ আমাকে খুব মাঝেমধ্যে বলে যে আমাকে নাকি দেখতে অনেকটা সত্যজিতের ‘অপরাজিত’-এর অপুর মতো লাগে। শুনে আমার খুব রাগ লাগে। কারণ আসলে ‘পথের পাঁচালী’র অপুকে ভালো লাগে সিনেমার ক্ষেত্রে। কিন্তু ‘অপরাজিত’-এর অপুকে ভালো লাগে না সিনেমায়। বিভূতির ‘অপরাজিত’-এর যে অপু তাকে ভালো লাগে। কারণ সেই অপুর সঙ্গে একদিন দূর থেকে হেমলতার দেখা হয়েছিলো। অপু কলকাতায় যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা আশ্রয় আর মেস হারিয়ে উঠেছিলো খুব সম্ভবত একটা ওষুধ কারখানার দোতলার ছোট্ট একটা গোডাউন টাইপ ঘরে, আরেকজনের সঙ্গে। ওই ঘরের জানলা দিয়ে আরেকটা জানালা দেখা যেতো। সেই জানলায় প্রায় একটা কিশোরীর মুখ দেখা যেতো, চোদ্দোপনেরো বয়স। মায়া মায়া বিষণ্ন উদ্ভ্রান্ত মুখ, শ্যামলা রং, কোকড়া চুল। সে অপুকে দেখতো। একদিন সে তার জানলার একটা কপাটে খড়িমাটি দিয়ে লিখলো, ‘হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে।’ সেই থেকে হেমলতা আমার মাথার ভিতর। প্রথম ঢাকায় এসে পরিচিতজনদের দ্বারে দ্বারে চাকরির জন্যে ঘুরেছি। চাকরি না পেয়ে বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট লিখেছি, পণ্যের কপি লিখেছি। কম টাকায় বানান ঠিক করা আর পাণ্ডুলিপি এডিটিং-এর কাজ করেছি, বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি। অনেকে কাজ করিয়ে টাকা দেয়নি। এমনও ঘটনা আছে প্রচ্ছদের ক্রেডিট প্রকাশকের ছেলের নামে গেছে…।

ওই সময়গুলিতে আমিও অনেকটা অপুর মতো পরিবেশ আর অবস্থাতেই ছিলাম। সারাদিন রোদ ঘুরে ওই রকম একটা জানলায় হেমলতার মুখ খুঁজতাম। আমার মাথার মধ্যে ঘুরতো সেই একটি বাক্য, ‘হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে।’

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.