তিনটি গজল
আমার প্রেমকে অমর বানিয়ে দাও
রূপান্তর ও কিছু কথা : সৈয়দ তারিক
হোটোঁ সে ছুলো তোম, মেরা গীত অমর কর দো
হিন্দি-উর্দু গান তেমন একটা শোনা হয়নি কখনও। কেমন যেন একটা অরুচি ছিল আমার এই বিষয়ে সব সময়। পরবর্তী কালে সুফি ভাবধারায় সম্পর্কিত হবার পর ফারসি-উর্দু কাওয়ালি ও হিন্দি ভজন শুনেছি এবং এগুলোর সুর-লয়-তাল ও গায়কের ভাবের প্রকাশে মুগ্ধ হয়েছি, ধ্যানস্থ হয়েছি।
কিন্তু আমার বাল্য-তারুণ্য-যৌবনে তেমন একটা প্রণয় অনুভব করি নাই উর্দু বা হিন্দি গানের দিকে। বাল্যকালে অবশ্য ‘হাম তোম এক কামড়িমে বন হ্যায়’ না কী যেন গান জনপ্রিয় ছিল, আমরাও মজা পেতাম। বন্ধ ঘরে দুজন মিলে কী করছে ভেবে বালকসুলভ মজা পেতাম। আর ‘সোচা কাভি এয়সা হো তা কেয়া হো’– এর অর্থ ‘ছুচু করে এমন কী হইছে?’— এরকম কিছু একটা বুঝে অনাবিল ফুর্তি লাভ করতাম। অথচ গজল প্রায় সারাদিন বাজত ক্যাসেটে আমাদেরই গৃহে। আমার পিতা অনুরাগী ছিলেন গজলের। মেহেদি হাসান, গোলাম আলি ও পঙ্কজ উদাসের গান শুনতেন তিনি সজোরে। কিন্তু আমি প্রায় কানই দিতাম না এইসবে। বরং খানিকটা বিরক্তই হতাম।
তবে আমার যৌবনে আশির দশকে একটি গান হঠাৎ শুনতে পেয়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম : ‘হোটোঁ সে ছুলো তোম, মেরা গীত অমর কর দো’। জগজিৎ সিং গেয়েছেন গানটি। গানটির সুর এতই মর্মস্পর্শী যে মনের কোনো সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে তীব্র ঝংকার তুলত, হৃদয় বেদনার্ত হয়ে উঠত। গানটির কথা বুঝি নাই কখনও। এখন ভাষান্তর করতে গিয়ে অর্থটা জানা হলো।
‘প্রেম গীত’ নামে একটি হিন্দি ছবির গান এটি। ছবিটা মুক্তি পায় ১৯৮১ সালে। এর পরিচালক ছিলেন সুদেশ ঈশ্বর। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন জগজিৎ সিং। ছবিটা হিট করে। গানটা হিট করে তার চেয়ে বেশি। ছবিটার প্রধান আকর্ষণ ছিল ওই গানটি। গীতিকার হলেন ইন্দিভার। এইটা তার কলমি নাম। আসল নাম শ্যামল বাবু রায় (১৯২৪ – ১৯৯৭)। ষাটের দশকে তিনি হিন্দি ছবির অন্যতম প্রধান গীতিকার ছিলেন। প্রায় তিনশ ছবির জন্য হাজার খানেক গান লেখেন তিনি। গানটিতে সুরারোপ করেন জগজিৎ সিং এবং তিনিই গান।
আমাকে তোমার দুই ঠোঁট দিয়ে ছোঁও
আমার গানকে অমর বানিয়ে দাও;
হও তুমি, প্রিয়ে, আমার প্রেমার্থিনী,
আমার প্রেমকে অমর বানিয়ে দাও।
বয়সের নাই সীমানা এখানে কোনো
সারা জনমের কোনো বন্ধনও নাই,
কাউকে যখন ভালোবেসে যায় কেউ
দেখে সে কেবল তার সে হৃদয়টাই;
এই রীতিতেই চলো তুমি ওগো প্রিয়
এই রীতিকেই অমর বানিয়ে দাও।
এক আকাশের সব শূন্যতা নিয়ে
একলা রয়েছে আমার হৃদয়ভূমি,
ঝমঝমাঝম পায়েলের ধ্বনি নিয়ে
আমার জীবনে এসো তুমি এসো তুমি।
আমাকে তোমার নিঃশ্বাসটুকু দাও
সঙ্গীত তুমি অমর বানিয়ে দাও,
সঙ্গীত তুমি অমর বানিয়ে দাও
আমার গানকে অমর বানিয়ে দাও।
দুনিয়া আমার কাছ থেকে চুরি করে
নিয়েছে যা কিছু ছিল কাছে প্রিয়, আর
সকলেই শুধু জিতেছে আমার কাছে
আমিই কেবল হেরে গেছি বারবার;
তোমার হৃদয় হারিয়ে আমার কাছে
আমার বিজয় অমর বানিয়ে দাও।
শুনুন- ‘হোটোঁ সে ছুলো তোম’
তু মেরি গুলফাম হ্যায়
১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ছবি ‘অগ্নিস্বাক্ষী’-র গান এটি। গানটি গেয়েছেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি ও কুমার শানু। গীতিকার হলেন সমীর অঞ্জন। তার আসল নাম শীতলা পাণ্ডে। সমীর বলিউডের সবচেয়ে ব্যস্ত গীতিকার। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গানের রচয়িতা হিসাবে গিনেজ বুকে তার নাম আছে। তার জন্ম ১৯৫৮ সালে। ব্যাংকে ঢুকেছিলেন চাকরিতে। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারেন যে ব্যাংক তার জগৎ নয়। আশির দশকের শুরুতেই বোম্বেতে চলে যান তিনি জীবিকার সন্ধানে। সিনেমার গীতিকার হিসেবে পেশাসফল হন তিনি। তার পিতা অঞ্জনও বিখ্যাত গীতিকার ছিলেন।
তোমাকে প্রথম দেখবার পর হতে
আমার দুঠোঁটে কেবল একটি নাম।
ও প্রিয়া, ও জান, তুমিই আমার
পুষ্প, গোলাপধাম।
প্রেয়সী আমার ফুলের চেয়েও
ঢের বেশি রূপবতী।
প্রেয়সী আমার চিত্তহারিণী
আর সে তো লীলাবতী।
আমার দু চোখে তোমার চেহারা
অবিরাম ভেসে যায়,
সকালে ও সন্ধ্যায়।
তোমার প্রেমেই মনে হয় আমি
হচ্ছি পাগলপ্রায়।
তোমার বাহুর বন্ধনে এসে
এই যৌবন ভরে গেল সৌরভে।
কর্ম আমার সময় কাটানো
তোমাকেই ভেবে ভেবে।
ও প্রিয়া, ও জান, তুমিই আমার
পুষ্প, গোলাপধাম।
শুনুন- ‘তু মেরি গুলফাম হ্যায়’
হোশওয়ালন কো খবর ক্যায়া
গানটি জগজিৎ সিং গেয়েছেন অ্যাকশনধর্মী বলিউডি ছবি ‘সারফরস’ (১৯৯৯)-তে। এটির রচয়িতা নিদা ফাজলি। পুরো নাম : মুকতিদা হাসান নিদা ফাজলি। জন্ম তার ১৯৩৮ সালে। হিন্দি ও উর্দু ভাষার খ্যাতনামা কবি, গীতিকার ও সংলাপ রচয়িতা। সাহিত্যে অবদান রাখবার জন্য ২০১৩ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে।
দিল্লিতে জন্ম তার একটি কাশ্মিরী পরিবারে। গোয়ালিয়রে বড় হন ও সেখানেই পড়াশোনা করেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বাবাও উর্দু ভাষার কবি ছিলেন। দেশবিভাগের আঠার বছর পর ১৯৬৫ সালে তার পিতৃপরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। ফাজলি ভারতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জীবিকার সন্ধানে মুম্বাইতে চলে গিয়েছিলেন। পরিবারের সাথে এই বিচ্ছেদ তাকে সারাজীবন বেদনাবিদ্ধ করেছে।
তরুণ বয়সে একবার এক মন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলেন এক গায়ক সুরদাসের ভজন গাইছে। রাধা তার সখিদের কাছে কৃষ্ণবিরহে তার মনোবেদনা ব্যক্ত করছিলেন। মানুষের মধ্যকার নিবিড় প্রেমবন্ধন বিষয়ক এই পদ শুনে ফাজলি অনু্প্রাণিত বোধ করেন। তিনিও কবিতা লিখবেন, এই ইচ্ছা জাগে তার মনে।
এইসময় তিনি মির্জা গালিব ও মির তকি মিরের কবিতার সারবস্তু ভালো করে আত্মস্থ করেন। মিরা বাই ও কবিরের ভজনের ভাব তাকে মুগ্ধ করে। টি এস এলিয়টের কবিতা, গোগল ও চেখভের কথাসাহিত্য তার সাহিত্যবোধকে সমৃদ্ধ করে।
ধর্মযুগ ও ব্লিৎস পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে। তার কাব্যশৈলী সিনেমানির্মাতা এবং হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের লেখকদের আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন মুশায়েরায় কবিতা পড়বার আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। তার গজল, নজম ও দোহায় মৌখিক ভাষা ও ভঙ্গি ব্যবহার করেন তিনি। কঠিন বা জটিল শব্দ ও শৈলী এড়িয়ে সহজ ও সাবলীল করে তোলেন তার কবিতা। এইটা তার কবিতাকে খুব জনপ্রিয় করে তোলে। সিনেমায় তার লেখা গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটে। তার সমকালীন ষাট দশকের কবিদের নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক লেখা লেখেন। এর ফলে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সাহির লুধিয়ানভি, আলি সরদার জাফরি ও কাইফি আজমি’র মতো কবিরা খুব ক্ষেপে যান তার উপর।
নিদা ফাজলির কবিতায় মনের নানারকম ভাব ফুটে উঠেছে। তিনি মনে করেন অন্তরপ্রেরণা ও সৃষ্টিশীল অনুভূতিই কবিতার উৎস। চিত্রকর কিংবা বাদকের মতোই কবিরও অনুভূতি। অন্যদিকে সিনেমার জন্য গান লেখা খানিকটা যান্ত্রিক ব্যাপার, যা চিত্রনাট্য ও পরিচালকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হয়। তিনি অবশ্য জীবিকার প্রয়োজনে সিনেমাগীতি রচনার কাজটিকেই গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে তার কবিতার বই প্রথম প্রকাশিত হয়। শৈশবের স্মৃতিকাতর বিষয়আশয়ের চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ তার কবিতা। জীবনের দ্বন্দ্বসঙ্ঘাত, উদ্দেশ্য সন্ধান, মানব সম্পর্কের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বলা ও করার মধ্যে বৈপরীত্য, হারিয়ে যাওয়া বিষয়ের জন্য বেদনা— এইসবই তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু।
নিদা ফাজলি ২০১৬ সালে প্রয়াত হন।
হুঁশিয়ার লোক জানতে পারে না
বেহুঁশি আবার কোন ব্যাপার।
প্রেমে পড়লেই বুঝতে পারবে
জীবন আসলে কোন ব্যাপার।
চোখে পড়ে চোখ তোমার আমার
ঝলমল করে ওঠে বাতাস।
জেনেছি আজকে কাকে বলে প্রেম,
এটা কোন জাদুকরি ব্যাপার।
খোলামেলা ওই চুলের গুচ্ছ
ঋতুকে শেখায় কবিতা আর,
ঝুঁকে-পড়া চোখ আমাকে বলল
মদমত্ততা কোন ব্যাপার।
ঠোঁট নেড়ে তাকে বলতে পারিনি
আমার দিলের কেমন হাল।
সে তো কখনই বুঝল না হায়
এই নীরবতা কোন ব্যাপার।
শুনুন- ‘হোশওয়ালন কো খবর ক্যায়া’