আমি আঁধারে থাকি : অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর গল্প
আমি আঁধারে থাকি এক নিঃসঙ্গ নারীর জীবন পথ পরিক্রমার স্মৃতিচারণমূলক উপন্যাস। স্টেশন থেকে বৃষ্টিমুখর পথ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছাবার ঘটনার বয়ান দিয়ে গল্পটা চলা শুরু করবে। কেমন এক রহস্যময় ভূমিকায় পাঠক মন উদগ্রীব হবে সামনে কিছু চমক ঘটতে যাচ্ছে এমন ভাবনায়। সেরকম কিছু আদৌ ঘটে কিনা, তা বই পড়ে জেনে নেবার ভার পাঠকের। যাইহোক, সেই বৃষ্টিমুখর সময়কে পাশে রেখে স্মৃতির হাত ধরে গল্পের সূত্রপাত।
উপন্যাসের শুরু থেকে বিষণ্ণতার যাত্রা শুরু। এ আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র নূর ই জান্নাত। নূরের বেড়ে ওঠার মধ্যে ছিল না কোনো প্রশান্তি। তার জন্মক্ষণে ছিল না পরিবার পরিজনের আনন্দধ্বনি। নূরের ক্ষেত্রে ‘আমারও আঁতুড় ছিলো দেবতায় বিধ্বস্ত নীলিমা’ বড়বেশি বাস্তব। মামাতো ভাই তুষারের সঙ্গসুখ ছাড়া পরবর্তী জীবনের জন্য জমিয়ে রাখবার মত সুখময় শৈশব স্মৃতি তাই তার ভাঁড়ারে জমা হতে পারেনি তেমন। আর সে কারণেই উপন্যাসের প্রায় পুরো আখ্যান জুড়ে নূর নিজেকে একই সাথে বঞ্চিত, দুঃখী, নিঃসঙ্গ নারী হিসেবে যেমন ভেবেছে, অন্যদিকে নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে, অর্থনৈতিক মুক্তির পথেও হেঁটেছে জোর কদমে।
উপন্যাসে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা নূরের মতো পাঠকের মনকেও বিষাদে আচ্ছন্ন করে তোলে। ভালোবেসে এই দুঃখী মেয়েটি যাকেই ছুঁয়েছে, সে-ই গেছে ‘দীর্ঘ পরবাসে।’ শৈশব- কৈশোর থেকে চলতে থাকা মৃত্যুর মিছিল নূরকে নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর করে তোলে। নূরের বাবা ঘৃণ্য অপরাধী, দাগী আসামী। জন্মের কিছু পর থেকে অপরাধী বাবা জেলখানায়। যার কাছ থেকে একমাত্র সন্তান হিসেবে আদর আহ্লাদের কোনো স্মৃতি তার মস্তিস্কের কোষ জমা করতে ব্যর্থ। মানসিক বিকারে আক্রান্ত মায়ের সাথেও বাস্তবে গড়ে ওঠেনি কোনো সখ্যতা। শুভাকাঙ্খী হিসেবে ফুপু ফজিলা, সেলিনা আপা, ছোট কাকা, রেহনুমা, প্রিয়ংকা’র মত কিছু মানুষ নূরের আঁধার জীবনে আলো ছড়িয়েছেন। তাকে জীবনের মহা সড়কে পৌঁছে যাবার নিরন্তর সাহস যুগিয়েছেন।
নূরের মায়ের অপ্রকৃতস্থ অবস্হার অজুহাতে বাবা হেদায়েত উল্লাহ কিশোরী রেহনুমাকে বিয়ের মানসে মা-মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সেখানেই মারা যায় মা। নূর বড় হতে থাকে মামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে। দুবছরের বড় মামাতো ভাই তুষারের সাথে প্রেমে পড়ার অপরাধে হতে হয় আরো বেশি নিগৃহীত। নূরকে জোর করে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার চেষ্টা চলে। ‘কত কী যে সয়ে যেতে হয় ভালোবাসা হলে’ এমন বোধে নূর তখন ভীষণ রকমের আক্রান্ত। তাই মামীর অত্যাচার মেনে নিয়েও সে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে সেখানে।
আমি আঁধারে থাকি এক নিঃসঙ্গ নারীর জীবন পথ পরিক্রমার স্মৃতিচারণমূলক উপন্যাস। স্টেশন থেকে বৃষ্টিমুখর পথ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছাবার ঘটনার বয়ান দিয়ে গল্পটা চলা শুরু করবে। কেমন এক রহস্যময় ভূমিকায় পাঠক মন উদগ্রীব হবে সামনে কিছু চমক ঘটতে যাচ্ছে এমন ভাবনায়। সেরকম কিছু আদৌ ঘটে কিনা, তা বই পড়ে জেনে নেবার ভার পাঠকের।
অন্ধকারে আলোর দিশা নিয়ে পাশে থাকা কিশোর প্রেমিক তুষারের মর্মান্তিক পরিণতি এক সময় তাকে বাবার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। গড়িয়ে যাওয়া সময়ের হাত ধরে ছোটো কাকার উৎসাহে আবার পড়াশোনায় মন দেয় নূর। কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হয় সমবয়সী রাকিবের সাথে। রাকিবের তুমুল প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করে তুষারের স্মৃতিকে পাশে রেখেই। কিন্তু সেই চিরন্তন সামাজিক বাঁধা, আর ভীতু প্রেমিকের শেষমেশ ড্যাডি’স বয় হবার চূড়ান্ত ইচ্ছায়, সে ‘প্রেম মরে যায়’।
আঘাতে কেউ কেউ ফিরে পায় বাঁচবার নেশা। নূরের আশেপাশের শুভাকাঙ্খী মানুষগুলোর কাছ থেকে সে জীবনের পাঠ শিখে নেয়। তার জানা হয়ে যায় নারী শুধুমাত্র একদলা মাংসের পিণ্ড না। স্বামী সংসার নামের বৃত্তের বাইরেও সে স্বাধীন আনন্দে যাপন করে যেতে পারে তার অনন্য জীবন। জীবনকে সেই স্বাধীনতায় ছেড়ে দেবার জন্য নূর চাকরি নিয়ে চলে যায় রাজশাহী। যেখানে তাকে জীবনের আরো কিছু আনন্দ পাঠ দেবার জন্য আছেন প্রিয়ংকা নামের অনন্য এক চরিত্র।মানুষ মাত্রই স্ববিরোধী, এমনটা বার বার ঘটতে দেখা যায় নূরের মধ্যে। যে নূর নিজের চিন্তার বৃত্ত ভেঙে বাঁচার আনন্দ আঁকড়ে বাঁচতে চায়, অবলীলায় বলে, ”জীবনে মাঝে মাঝে ভাবনার গতিপথ পাল্টাতে হয়। তাহলেই মুক্তি”। কিংবা যে মানুষ নিজের সাথেই নিজে একটা মীমাংসায় পৌঁছে যায়, ”এমন কোনো সময় নেই যেখানে লুকিয়ে আছে সব আনন্দ, এমন কোনো আকাশ নেই যেখানে বিষাদের মেঘ নেই, এমন কোনো পৃথিবী নেই যেখানে ঝলমলে সুনীল আকাশ” সেই মানুষটাই যখন নির্ঘুম একাকী রাতে সঙ্গীহীনতার অস্বস্তিতে ডুঁকড়ে ওঠে। ফুপুজি ফজিলার মত ‘একা থাকন অভিশাপ’ তার ভেতরেও হাহাকার হয়ে অনবরত মুখ নেড়ে য়ায়, পাঠকের তখন মনে পড়ে যাবে ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’র ‘জোটন’, কল্যাণী দত্তের পিঞ্জরে বসিয়া’র ইন্দুমতির কথা। নারীর এই ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে গিয়েও সমাজ কিংবা জৈবিকতার সেই চিরন্তন শিকলে বাঁধা পড়ে যাবার মর্মবেদনা পাঠকের বুকে বাজবে। তবে শেষমেশ নূরকে অন্ধকারের উৎস মাঝে আলো খুঁজে পেতে দেখে বড় আনন্দ হয়। সে প্রাপ্তিতে যেন নূরের চারপাশে বাতাস ফিসফিসিয়ে আওড়ে যায়—
“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো।
সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো,
সেই তো তোমার ভালো।”
নূরের শুধু বাইরের রূপই নয়, ভেতরের রূপটিও লেখক সক্ষমভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন, অন্ধকার শুধু ভয় দেখায় না, এর মধ্যে নিরাময় শক্তিও নিহিত থাকে, অন্ধকারই নূরকে শক্তি দেয়।
‘আমি আঁধারে থাকি’ একটি সামাজিক উপন্যাস। সমাজের ঘটমান অবিচারগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা আছে। কিন্তু সেই চেষ্টা খানিক অগোছালো মনে হয়েছে কখনও কখনও। কিছু অকারণ বর্ণনা বাহুল্য মনে হয়েছে। কিছু চরিত্র আরেকটু মনোযোগ পাওয়ার ছিল বলে মনে করি। উপন্যাসে সমাজ, সংসার, বিয়ে, প্রেম, আইন, আদালত, খুন, ধর্ষণ, যৌনতা, লিভ টুগেদার, জেন্ডার সেন্সিভিটি ইত্যাদি নানান বিষয় ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা চোখে পড়ে। এত বিষয় বলতে গিয়েই হয়ত মাঝে মধ্যে খেই হারিয়েছে গল্পের স্বাভাবিক গতি।
নূরের ঠোঁটের খুঁত সারাইয়ের পর তার প্রতি ভালোবাসায় আপ্লুত মামাতো ভাই তুষারের খানিক প্রতিক্রিয়া দেখা গেলে মন্দ হতো না।
হুট করে একরাতে নূরের ফুপু ফজিলার কোনো এক ‘প্রেমিকের’ আর্বিভাব এবং উবে যাওয়াটা পাঠকের কাছে অদ্ভূত লাগতে পারে। যে অংশে লিভ টুগেদার বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাকে একটু খাপছাড়া মনে হয়। বিয়েতে বিশ্বাসী প্রিয়াংকা এবং জুয়েলের মধ্যে লিভ টুগেদার নিয়ে যে বিতর্ক দেখানো হয়েছে সেটা আরোপিত ঠেকেছে। উপন্যাসে ওটা প্রাসঙ্গিক করার জন্য যে উপাদান যোগ করার দরকার ছিল, তা অনুপস্থিত ছিল। উপন্যাসের কোথাও লিভ টুগেদারের কোন দৃষ্টান্ত নেই। এই আকাঠ পাঠকের মতে, সে রকম কোনো দৃষ্টান্ত দিয়ে কিংবা প্রিয়াংকা এবং জুয়েল লিভ টুগেদারে থেকে ওই তর্কটা করলে প্রাসঙ্গিক মনে হতো।
আমি আঁধারে থাকি সাদিয়া সুলতানার প্রথম উপন্যাস। তাঁর ছোটগল্পের একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে জানি, তিনি ছোটগল্পে কতটা ফাঁকফোকড়হীন সাবলীল। এই উপন্যাসে তাঁর সেই অবাধ স্বাচ্ছন্দ যেন অতটা জোড়ালো ভাবে চোখে পড়েনা। পাঠক হিসেবে সেটা নিজের ব্যর্থতা হিসেবে স্বীকার করছি। গাইবান্ধার স্হানীয় সংলাপ নির্মাণের এবং কোর্টকাছারির দৃশ্যকল্প চিত্রণে লেখকের সাবলীলতা এবং সুসংহতভাব চোখে পড়ার মত। উপন্যাসে বর্ণিত লেখকের কিছু চমৎকার মনোদর্শন, পাঠককের ভাবনায় আঁচড় কাটবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই উপন্যাসে যে জীবনের সঙ্গে সাদিয়া সুলতানা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সেই জীবনের প্রতিভূ নূর, ফজিলা, রেহনুমা, হেদায়ত উল্লাহ, নূরের মামী, মামা, তুষার, প্রিয়ংকা, জুয়েল, সাইফুল প্রমুখেরা কেউই আমাদের অপরিচিত মানুষ নয়। আমাদের চারপাশের জীবন থেকেই তাদের ওঠে আসা। নূরকে কেন্দ্র করে সে জীবনগুলোর আবর্তনের গল্প ‘আমি আঁধারে থাকি’।
উপন্যাসটি পাঠকের প্রচুর সমাদর কুড়িয়ে নিক। লেখকের কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরো জম্পেশ গল্প-উপন্যাস পাওয়ার আশা রাখছি। তাঁর জন্য শুভেচ্ছা নিরন্তর।