অরুন্ধতী রায়ের বিবৃতি
ইঞ্জিনটিকে অকার্যকর করে ফেলাই আমাদের কাজ
করোনা ভাইরাসের মহামারী পুঁজিবাদের যন্ত্রটিকে দৃশ্যমান এক স্থবির দশায় এনে ফেলেছে।
তবে তা অস্থায়ীমাত্র। মানব জাতি যখন মুহুর্তের কারাগারে বন্দি হয়ে রয়েছে, তখন পৃথিবী আমাদের তার স্ব-নিরাময় ক্ষমতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমনকি আমাদের অসুস্থতা ও বিপর্যয়ের মুহুর্তগুলিতে আমরা তার সহায়তা করতে পারিনি বটে, তবে সে যা দেখাবে বলে মনস্থির করেছে তাতে আমাদের সম্মিলিত দম অবাক হয়ে যেতে পারে! তবে সে সবের অবসান ঘটাতেও পরিকল্পনা জারি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে, বাঘের জন্য সংরক্ষিত একটি অভয়ারণ্যের বড়সড় অংশই ধর্মীয় জমায়েতে রূপান্তরিত হতে চলেছে — কুম্ভ মেলা – যা লাখো হিন্দু তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণের কারণ। আসামের একটি হাতির রিজার্ভ কয়লা খননের জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং অরুণাচল প্রদেশের হিমালয় অংশের হাজার হাজার একর আদিম বনাঞ্চল একটি নতুন জলবিদ্যুৎ বাঁধের জলাধার হিশেবে ব্যবহার তথা ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। ইত্যবসরে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাঁদে খনি খননের জন্য একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।
ঠিক যেভাবে করোনা ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে এবং বিদ্যমান অসুস্থতাগুলিকে সম্প্রসারিত করেছে, একইভাবে সেটি দেশে দেশে এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে এবং এসবের কাঠামোগত বৈকল্য ও কদর্যতাকেই উন্মুক্ত করেছে। অন্যায়, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ এবং সর্বোপরি বৈষম্যকে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে তুলে ধরেছে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একই কাঠামো, যা দরিদ্র জনগনের দুর্ভোগের প্রতি উদাসীন ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সেই দুর্ভোগ বাড়ানোর উদ্দেশেই কাজ করেছে, সে বেশ বুঝতে পারছে যে দরিদ্র জনগণের এই দুর্ভোগ বস্তুত ধনী সমাজের জন্য হুমকি স্বরূপ। এখন পর্যন্ত এই দুই শ্রেণির মধ্যে কোনও অগ্নি-রেখা বিদ্যমান নেই বটে। তবে শিগগিরই তা দৃশ্যমান হবে। সম্ভবত সেটি ভ্যাকসিনের রূপ ধরেই হাজির হবে। ক্ষমতাধররা স্পিগোটকে বগলদাবা করবে এবং পুরানো খেলাটি আবার শুরু হবে– দ্য সার্ভাইবল অফ দ্য রিচেস্ট।
প্রাক-করোনাকালে, যদি আমরা রাষ্ট্রীয় নজরদারির ভেতর ঘুমঘোরে হেঁটে বেড়িয়ে থাকি, তুলনায় এখন আমরা আতঙ্কিত হয়ে একটি অতিখাসা-নজরদারি রাষ্ট্রের আস্তিনে ঢুকে যাচ্ছি যেখানে আমাদের সমস্ত কিছুই তাদের হাতে তুলে দিতে বলা হচ্ছে – আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, আমাদের মর্যাদা-স্বাধীনতা এবং আমরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে নিজেদের পরিচালনার ভার তাদের হাতে দিয়ে দিচ্ছি।
আমার কাছে এটি একটি রহস্যময় ব্যাপারই, যে এই মুহূর্তে রাষ্ট্র ক্ষমতার এই রূপগুলো ভাইরাসটিকে ধ্বংসেরে উপায় খোঁজার নিমিত্তে যেরকম গভীর অনুশীলনে ব্যস্ত রয়েছে, তারা কীভাবে এতোদিন তাদের মহান অগ্রগতি এবং সভ্যতা’র মতো ধারণাগুলির মৌতাতে ডুবে ছিলো? কি করে তারা তাদের পারমাণবিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক অস্ত্রের মজুদখানার সংখ্যা গুনেই বুঁদ ছিলো? জনগণকে তাদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো পেতে বাধা সৃষ্টি করে, খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে দেশে দেশে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে গেছে। তারা কেবল এই গ্রহটির ধ্বংসকে ত্বরান্বিতই করে গেছে, যা ঘটবে (এবং সত্যই এটি ইতিমধ্যে ঘটে গেছে, যদিও এ-খবর টিভিতে নেই) তা এ ধরণের ধ্বংসাত্মকতার কারণেই ঘটবে, যেটি কোভিড-১৯ কে স্রেফ ছেলেখেলা বানিয়ে ছাড়বে।
এখন যখন আমরা সবাই লকডাউনে আছি, তারা কিন্তু তাদের দাবার ঘুঁটি বেশ দ্রুত লয়েই চালছে। করোনাভাইরাস কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলির জন্য উপহার হিশেবে এসেছে। এরকম মহামারী নতুন কিছু নয়। তবে এটি ডিজিটাল যুগের প্রথম মহামারী। আমরা এই মুহুর্তে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিপর্যস্ত পুঁজিবাদী এবং তথ্যশিকারিদের সঙ্গে জাতীয় কর্তৃপক্ষের স্বার্থের গাঁটছড়া বাধার বা একীকরণের সাক্ষ্য দেখতে পাচ্ছি। ভারতে এই ব্যাপারটি বেশ দ্রুত গতিতেই ঘটছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ভারতের বৃহত্তম মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক জিও-এর সাথে এর ৪০০ মিলিয়ন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর ঠায়-ঠিকুজি ভাগ করে নিয়েছে। বিল গেটস প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রশংসা করছেন, প্রোটোকল যেভাবে তৈরি করা হয়েছে তাতে লাভ আদায় করতে কোনও সন্দেহ নেই বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। নজরদারি/ স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাপ ‘আরোগ্য সেতু’ ইতিমধ্যে ৬০ কোটিরও বেশি লোক ডাউনলোড করেছে। এই অ্যাপ-এর ব্যাবহার ইতিমধ্যে সরকারী কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
প্রাক-করোনাকালে, যদি আমরা রাষ্ট্রীয় নজরদারির ভেতর ঘুমঘোরে হেঁটে বেড়িয়ে থাকি, তুলনায় এখন আমরা আতঙ্কিত হয়ে একটি অতিখাসা-নজরদারি রাষ্ট্রের আস্তিনে ঢুকে যাচ্ছি যেখানে আমাদের সমস্ত কিছুই তাদের হাতে তুলে দিতে বলা হচ্ছে – আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, আমাদের মর্যাদা-স্বাধীনতা এবং আমরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে নিজেদের পরিচালনার ভার তাদের হাতে দিয়ে দিচ্ছি। লকডাউন অবস্থা তুলে নেওয়ার পরেও, যদি আমরা দ্রুতবেগে সামনে না এগোই তবে আমরা চিরকালের জন্য বন্দি হয়ে পড়ব।
আমরা এই দারুণ সক্রিয় ইঞ্জিনটিকে কোন উপায়ে অকার্যকর করব? এখন এর উপায় খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ।