ঈর্ষা বলে তার একজনা গোপন প্রেমিক বন্ধু আছে
ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ারের স্থান যেখানে, উর্দু ভাষায় মির্জা আসাদউল্লাহ খান গালিবের (১৭৯৭-১৮৬৯) স্থান নিঃসন্দেহে সেই একই উচ্চতায়। মির্জা গালিব ছিলেন এমন এক অত্যাশ্চর্য কবি, যাকে তাঁর কবিতার মতোই চর্চা করা যায়।
তুর্কি বংশোদ্ভূত এই কবি যদিও নিজেকে ফারসি কবি হিসেবেই পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন, তবু তার উর্দু শের শায়েরি তাঁকে অমরত্ব দান করেছিল। হালকা সরল বাক্যের মাঝে গভীর দর্শন, একই গজলে প্রেমের বিভিন্ন স্তর বর্ণনা, যা নিছক মানবপ্রেম থেকে ঈশ্বরপ্রেম পর্যন্ত পৌঁছায়, হৃদয়ের বিভিন্ন হাল বা অবস্থার বর্ণনা; এই ব্যাপারগুলো তার গজলে গভীর রহস্যময়তা তৈরি করতে পারে এবং পাঠকের মনে কাব্যের অর্থের এক অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে।
ভারতীয় কবি গুলজারের পরিচালনায় মির্জা গালিবের জীবন নিয়ে তৈরি ধারাবাহিক নাটকটি কবির প্রতি আবেগময় ভালোবাসা তৈরির জন্য যথেষ্ট। মূলত এই ধরনের অনুভূতি থেকেই তাঁর কিছু গজলের ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ করলাম।
১.
তাঁর ইশারায় অর্থ থাকে গোপন করা নানান রকম
তাই তো কাছে ডাকে যখন সন্দেহ হয় অন্য রকম।
হায় খোদা কেউ বুঝল না তো কাব্য আমার গহন গভীর
নাই যদি পায় বুঝতে; আমায় জবান দিয়ো অন্য রকম।
চাঁদপানা ওর মুখের সাথে বাঁকানো ওই ভুরুর কী যোগ?
তির সে তো যায় ভালোই বোঝা ধনুকটা যা অন্য রকম।
এই শহরেই থাকছ তুমি; এই ভেবে তাই সান্ত্বনা পাই
সকাল হলেই তোমার জন্য কিনব হৃদয় অন্য রকম।
মন্দিরের ওই মূর্তি ভাঙা সহজ যতই হোক না; তবু
‘আমি’ নামক মূর্তিটাকে ভাঙতে যাওয়াই অন্য রকম।
দিচ্ছি পেতে মাথা আমার, করছে খড়গ শমন জারি
শুনছি তাহার কণ্ঠের আওয়াজ, ‘শাস্তি এবার অন্য রকম’।
হায় যদি না দিতাম হৃদয়, থাকত বেঁচে জীবন খানিক
যদিও বেঁচে থাকলে আমায় কাঁদতে হতো অন্য রকম!
পায় না আমার বন্দী আবেগ বেরোতে; তাই জমতে থাকে
কান্না হয়ে মুক্তি পেলে দৃশ্যটা হয় অন্য রকম।
কাব্য মধুর বাক্যে কত ফোটাচ্ছে ফুল কবির দলে
এদের ভিড়েও মির্জা গালিব কাব্য করেন অন্য রকম।
২.
তার হৃদয়ের সলাজ কাঁপন ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে আমায়
এসব আমার দীর্ঘশ্বাসের কারণ না তো?
নাইবা দেখো আয়নাতে মুখ, নির্মমতার স্বরূপ দেখো!
ভাবছি আবার আয়না পাছে তোমার প্রেমে পড়বে না তো?
৩.
পূর্ণচাঁদের পূর্ণিমা রাত লাগছে ভালো
যদিও আমার সূর্যমুখী এর চেয়ে ভালো!
ভালোবাসার প্রকাশ তো নেই চোখে চোখে রাখছে শুধু
ভাবটা এমন দাম না দিয়েই হৃদয় আমার পায় তো ভালো।
সস্তা দরের গেলাস আমার ভাঙলে আবার কিনতে পাব
জমসেদের ওই সোনার গেলাস থেকে আমার গেলাস ভালো।
না চাইতেই পাওয়ার খুশি স্বর্গ স্বরূপ
যে কখনো চায়না কিছু সেই ভিখারির রুচি ভালো।
দেখিই না ফের কোন উপকার সুন্দরীদের পেছন ছোটে
পুরুত ঠাকুর বললে আমার এ বছরটা যাবে ভালো!
সামান্য এক কুঠার ধরেই শিরির হাতটা ধরল ফরাদ
কোনো গুণই নয়তো হেলার সবই গুণীর জন্য ভালো।
বিন্দু কণা সিন্ধু মাঝে গেলেই সেটা সমুদ্র হয়
তাই তো জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন: ‘সব ভালো যার শেষটা ভালো’।
যদিও আমার বিশ্বাস আছে স্বর্গীয় সেই বাস্তবতার
মনকে খুশি রাখতে এসব ভাবনা আমার জন্যে ভালো।
৪.
ঈর্ষা বলে তার একজনা গোপন প্রেমিক বন্ধু আছে,
বুদ্ধি বলে এমন নিঠুর বেদরদি বন্ধু কার?
রহস্যের এই সরাইখানায় প্রতি ফোঁটাই এক এক গ্লাস
মজনু চলে ইশারাতে লায়লার সেই চক্ষুটার।
গর্ব করার মতো আবেগ লুকিয়ে থাকে নম্রতায়
এক ফোঁটা জল কণার মাঝে মুখ লুকানো সিন্ধু তার।
সাক্ষাৎ এক টুকরো আপদ হতচ্ছাড়া হৃদয় মোর
স্বাচ্ছন্দ্যের শত্রু হয়ে পথ হারানোই লক্ষ্য যার।
সংগত নয় ঈর্ষা করা প্রেমিক কিংবা প্রেমাস্পদ
হাতটা আমার মাথায় যখন আয়নাটা হয় সামনে তার।
সামান্য এক খোদাইকারক ছিল শিরির মূর্তিকার
আসাদ, মাথায় পাথর ঠুকেও পাবে না কেউ বন্ধু তার।
৫.
ভালোবাসা না পাই যদি একলা থাকা সেও ভালো।
আমার ব্যর্থ প্রেমের গল্প তোমার প্রচার সেও ভালো।
কোনোমতেই সম্পর্কের শেষটা যেন হয় না গো
কিছুই যদি না ভাবো তো শত্রু ভাবো, সেও ভালো।
আমার উপস্থিতি যদি অস্বস্তির কারণ হয়
নাইবা ডাকো বন্ধু সভায়, একলা ডাকো, সেও ভালো।
নিজেই তো আর নিজের শত্রু হওয়ার উপায় নেই
অন্য লোকের মন যদি পাও, আমার জন্য সেও ভালো।
তুমি তোমার অস্তিত্বেই প্রকাশ হবে যেই-বা হও
জ্ঞান যদি আর না হয়, তবে অজ্ঞানতা সেও ভালো।
জীবন এত ছোট যেন মেঘের চমক ফুরিয়ে যায়
হৃদয়টাকে খুন করবার সময়টা পাই- সেও ভালো।
একটিবারের জন্যেও কি হালটা আমায় ছাড়তে দেখো
না যদি পাই ভালোবাসা কঠিন বিপদ সেও ভালো।
দিয়েই দে না একটা কিছু অত্যাচারী ভাগ্য আজ
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারার অনুমতি, সেও ভালো।
আমরাও আজ তোমার পায়ে জীবন দেয়া দেখিয়ে দেব
না দেখার ওই ভাবটা আবার দেখাও যদি, সেও ভালো।
প্রেমের পথে শেষ চেষ্টার শেষ না হওয়াই উচিত, আসাদ
কাজ যদি আর না হয় তবু চেষ্টা থাকুক, সেও ভালো।
৬.
যুদ্ধে যাওয়ার যোগ্য সে নয় মৃত্যু ভয়েই মরার ছিল
প্রেমের কষ্ট সহ্য করার জন্য মরদ হওয়ার ছিল।
বেঁচেও যদি ছিলাম আমার মৃত্যুভয়টা সঙ্গী ছিল
মরে যাওয়ার আগেও আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়েই ছিল।
লিখেই গেলাম কাব্য আমার প্রেম বিরহের সমগ্রতে
অথচ সেই ভাবনাগুলো আমার টুকরো টুকরো ছিল।
আজ যে নদী রক্তস্রোতা বইছে আমার বুকের ভেতর
এর আগে তার রঙের ভেতর গোলাপ ফুলের লজ্জা ছিল।
প্রেমের পথের কষ্ট কি আর ধ্বংস করার উপায় আছে?
হৃদয় তাকে দেবার পরও কষ্ট পাওয়ার ছিল।
বন্ধ করতে এ পাগলামি বন্দী কত করলে আমায়
খাঁচার ভেতর থেকেও আমার উধাও এমন হওয়ার ছিল।
কাফনবিহীন লাশটা হলো আসাদ নামের অতৃপ্ত জন
ক্ষমা করুন খোদা সে এক আজব স্বাধীন মানুষ ছিল।
৭.
দয়া হলে পরে ডেকে নিয়ো প্রিয় যখন খুশি
হারিয়ে যাওয়া সময় তো নই যে আসতেও পারি না।
মন্দ কথার কী জবাব দেব বলো?
কথা তো আর মাথা নয় যে উঠাতেও পারি না।
বিষ তো পাই না আমি সহজে হে সুন্দরী,
নইলে কোন সে শপথ আমার যে খেতেও পারি না।
আরও পড়ুন- নিমগ্নতা ও ঐশী প্রেমের কবি মির্জা গালিব