:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
এমদাদ রহমান

গল্পকার, অনুবাদক

উপন্যাস কীভাবে পাঠকের সঙ্গে কথা বলে
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকারের প্রচ্ছদ থেকে

কালো বরফ

উপন্যাস কীভাবে পাঠকের সঙ্গে কথা বলে

কালো বরফ যারা পড়বেন বা যারা পড়ছেন, তারা ভাববেন- মণি ভাইজান কে? লেখক কোথায় পেলেন তাঁকে? তাঁর ইমাজিনেশনে সৃষ্টি কি এই আশ্চর্য চরিত্রটি? আবদুল খালেক ও পোকা’র শৈশব আর যৌবনের দ্বৈরথে যে গল্পটি আমরা পাঠ করি, সে গল্পে ‘মণি ভাইজান বিশিষ্ট চরিত্র, সেই চরিত্র আরও তীব্র হয় দেশভাগের কারণে। মণি ভাইজান আর ছবিদি’র যে মর্মভেদী গল্পটি আমরা পড়ি, দেশভাগের বেদনা রক্তে যেন বহুকালের জন্য কালো বরফ হয়ে যায়। কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তাফা কামালের সম্পাদনায় মাহমুদুল হকের যে সাক্ষাৎকার সংকলনটি—হিরণ্ময় কথকথা—আমরা পেয়েছি, তাতে দেখি, মাহমুদুল হক বলছেন—
নিজের কোনো লেখাকে সেরা বলা যায় নাকি? তবে প্রিয় লেখার কথা বলতে গেলে কালো বরফের কথাই বলবো। এটা লিখে তৃপ্তি পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো বাহুল্যহীন, মেদহীন ঝরঝরে একটা উপন্যাস লিখতে পারলাম। মানে এই একটি উপন্যাসই আমার কাছে বেশ কম্প্যাক্ট মনে হয়। অনন্য মনে হয়। আসলে তো তা নয়। লেখাটা চূড়ান্ত করার সময় লেখককে এসব বিষয়ে সচেতন হতে হয়, নির্মম হতে হয়। আমি তো মাটির জাহাজের মূল পাণ্ডুলিপি থেকে ৩৩ পৃষ্ঠা বাদ দিয়েছি- এতো নির্মম কেউ হয় বলো? তো সেই দিক থেকে দেখতে গেলে কালো বরফকে বেশ কম্প্যাক্ট আর গোছানো লেখা বলা যায়… কালো বরফের বিষয় তো এমন আহামরি কিছু নয়… ওটা আমার জীবন নিয়ে লেখা নয়, ওখানে আমি নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় শৈশবের প্রতি আমার কোনো প্রেম নেই। আমার শৈশব খুব দ্বন্দ্বসংকুল, দেশভাগের যন্ত্রণায় ভরা, বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার বেদনায় ভরা। … দেশভাগের সময় আমার বাবা এখানে চলে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু আমরা আসতে চাইনি। মা তো আসার ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। এখানে আসার আগে তিনি দু’বার ঢাকায় এসেছিলেন বাবার সঙ্গে, এবং ফিরে গিয়ে বলেছিলেন- ওটা বর্বরদের দেশ। কারণ কী জানো? যে দু’বার তিনি এসেছিলেন, কোনোবারই রাস্তাঘাটে কোনো মেয়েকে চলাফেরা করতে দেখেননি। তখন তো ঢাকা শহরে মেয়েরা বাইরে বেরুতোই না। দু-একজন বেরুলেও রিকশা পর্দা দিয়ে ঘিরে বেরুতো। তো এইসব দেখে মা’র নাকি মনে হয়েছিল, যে দেশে মেয়েরা বাইরে বেরুতে পারে না সেটা একটা বর্বরের দেশ। … কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা থাকতে পারিনি। … অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে, সবাই আমাদের দেখতে থাকে সন্দেহের চোখে, এমনকি আমাদের সঙ্গে মেলামেশাও প্রায় বন্ধ করে দেয়। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি একসময় এমন এক অবস্থায় পৌঁছায় যে আমরা চলে আসতে বাধ্য হই।

আহমাদ মোস্তাফা কামাল, তারপরে লেখেন- তাঁর (মাহমুদুল হকের) কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ বেদনা অভিমান ও যন্ত্রণা ঝরে পড়ে। অনেক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারি না। বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের যন্ত্রণার সঙ্গে তো আমার কোনো পরিচিয় নেই, কি বলবো আমি? তিনিও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। আমি নিঃশব্দে তাঁর গম্ভীর-বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া মুখ দেখি, ভিজে ওঠা চোখ দেখি।

শুধু মণি ভাইজান দিয়ে কালো বরফকে দেখলে হবে না, দেখতে হবে রেখার চোখের ভেতর দিয়ে, দেখতে হবে আবদুল খালেকের ভেতর দিয়ে। ছবিদির কাছ থেকে মণি ভাইজানের যে বিদায়, তাঁর যে মর্মস্পর্শী অভিঘাত সামলে নিলেই ‘কালো বরফ’ আরও শক্তিশালী হয় রেখা ও খালেকের যৌথ জীবনের খেলাঘরে। মাহমুদুল হক এখানেই তাঁর শক্তির পরিচয় দেন।

মাহমুদুল হকের এই ‘ভিজে ওঠা চোখ’ আমরা তাঁর প্রতিটি লেখায় পাই, কারণ, নিজের অলক্ষ্যেই আমরা দেখি যে তাঁর বইগুলো পড়তে পড়তে নস্টালজিক হয়ে উঠছি, জীবনে যা কিছু হারিয়ে ফেলেছি বোকার মতো, তাঁর জন্যই আমাদের এই ব্যাকুল কান্না, যে কান্না দেখা যায় না। আমাদের পুরো জীবনটিই যে মণি ভাইজান আর ছবিদির বিচ্ছেদের বেদনা, পরস্পরের জীবন থেকে এমনকি পৃথিবী থেকেই চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বেদনার মধ্যে ভিজে থাকে!

দেশভাগের প্রচণ্ড এক ক্ষত নিয়ে বেড়ে ওঠা কলেজ শিক্ষক আবদুল খালেক, কোনও এক ভরদুপুরে, বহু বছর পর তার মায়ের গাওয়া গানের কলি ‘ও আমার কোলে এলো’ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। মাহমুদুল হক লেখেন- আজ, এই ভরদুপুরে, গরিব বৌনাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, এক অস্থির আবদুল খালেক, রেখা যাকে তার স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে তার আব্বা বলে চেনে, হু হু করে কেঁদে ফেলল। এতোদিন পর, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গানের ঐ কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলই মনে হয়, কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!

পাঠকের মনে কি কোনও অভিমানের জন্ম হয়! দেশভাগ যে এক গভীর ক্ষত, উপন্যাসের পাঠ শেষে যে আমাদের চোখের কোণ অলক্ষ্যেই কিছুটা ভিজে ওঠে, যে দৃশ্যের পাঠ-অভিজ্ঞতা হয় আমাদের, সেই দৃশ্যের ক্ষত বয়ে নিয়ে কতকাল বেঁচে থাকতে হবে?
‘কালো বরফ’ পড়তে পড়তে মনে হবে এই লেখা আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলছে অদ্ভুত ভাষায়। আমরা বুঝতে পাছি না তবে অনুভব করছি- আহারে, জীবনের আশ্চর্য সব সকাল দুপুর বিকেল আমরা বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছি! এখন আবার খোঁজ করছি নতুন করে, সেইসব, সেইসব- ‘যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছু একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে।’

কালো বরফ by মাহমুদুল হক
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার, প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ১৯৯২
প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ, মূল্য: ২৫০ টাকা।

শুধু ‘দেশভাগ’ দিয়েও কি এই উপন্যাসের পাঠ সম্পূর্ণ হয়? আবদুল খালেক আর তাঁর স্ত্রী রেখার সেই নৌকোভ্রমণও কালো বরফে তাৎপর্যপূর্ণ! দেশভাগের বেদনার চেয়েও রেখা’র মনের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলো অনেক বেশিই আক্রান্ত করে। সেই যে রেখা আর খালেক নৌকো থেকে নেমে, গাছের আড়ালে শারীরিক মিলনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, রেখার যে আহ্বান-
আমাকে আদর করো, আমাকে ভালবাসো!
ধীরে ধীরে, আবদুল খালেক যেন রেখার কাছে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছিল। কেমন প্রাণহীন। বোধহীন। রেখা মনে করেছিল খালেক তাঁকে আর ভালবাসছে না, কাছে চাইছে না। খালেকের কাছে সে পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু খালেকের মনে তখন তার মৃত বোন, যে বোন মৃত্যুর পর শালিক হয়ে ফিরে আসে আর কিছুদিন পর হারিয়ে যায়, আর মণি ভাইজান। আর জীবনের সব নস্টালজিয়া। জীবনের মধ্য থেকে আশৈশব বঞ্চিত রেখাও তো তেমন। খালেককেই সে বেঁচে থাকার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু খালেককে সে যেন আর বুঝতে পারে না।

শুধু মণি ভাইজান দিয়ে কালো বরফকে দেখলে হবে না, দেখতে হবে রেখার চোখের ভেতর দিয়ে, দেখতে হবে আবদুল খালেকের ভেতর দিয়ে। ছবিদির কাছ থেকে মণি ভাইজানের যে বিদায়, তাঁর যে মর্মস্পর্শী অভিঘাত সামলে নিলেই ‘কালো বরফ’ আরও শক্তিশালী হয় রেখা ও খালেকের যৌথ জীবনের খেলাঘরে। মাহমুদুল হক এখানেই তাঁর শক্তির পরিচয় দেন। আবদুল খালেক তাঁর ছেলেবেলায় মৃত বোনকে ফিরে পেয়েছিল। সে-বোন ফিরে এসেছিল একটা শালিক হয়ে। সে শালিকের ছিল এক পা ভাঙা। একদিন হঠাৎ সে শালিক আর আসে না; সে-শালিকের কথা, বহু বছর পর, আবদুল খালেক তাঁর স্ত্রী রেখাকে জানায়…

রেখা, আলোছায়ার যুগলবন্দিতে, জীবনের কথা বলে চলে। রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আবদুল খালেক, বলে- আমি জানতাম না, তোমার ভেতরে এতো কথা আছে, সকলের ভেতরেই বোধ হয় এই রকম আরও একটা আলাদা সংসার পাতা থাকে!
কালো বরফ পাঠ শেষে, আমরা হয়তো কয়েকদিন একটা ঘোরের ভেতর থাকবো। ঘোর। ফিরে পড়তে চাইবো উপন্যাসটি, হয়তো রবীন্দ্রনাথের গান শুনবো- সব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে/ দখিন-হাওয়া দিশাহারা আমার ফুলের গন্ধে মাতে; আর, ফিরে ফিরে, উপন্যাসের এই কথাক’টি পড়ব- এতোদিন পর, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গানের ঐ কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলই মনে হয়, কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.