:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
জিললুর রহমান

কবি, গদ্যকার, অনুবাদক

এমিলি ডিকিনসন-এর কবিতা ও জীবন

এমিলি ডিকিনসন-এর কবিতা ও জীবন

এমিলি এলিজাবেথ ডিকিনসন ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে অগ্রসর একজন কবি, একজন বিরল-অতিপ্রজ-অন্তর্মুখী ব্যক্তিগত-অনুষঙ্গের কবি। অথচ তাঁর রচিত প্রায় ১৮০০ কবিতার মধ্যে মাত্র এক ডজনেরও কম তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়। তাঁর যে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিলো, তা-ও প্রকাশকেরা প্রচলিত কাব্যভঙ্গির নিয়মের মধ্যে সাজাতে গিয়ে মারাত্মকভাবে পালটে ফেলেছিলো। যে সময়কালে ডিকিনসন কবিতা লিখেছেন, সে সময়ের জন্য তাঁর কবিতাগুলো ছিলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও ভিন্নধর্মী। তাঁর লেখা কবিতাগুলো ছিলো স্বল্প বাক্যে রচিত, বৈশিষ্টসূচকভাবে শিরোনামহীন, এবং প্রায়শ তীর্যক চরণের ব্যবহার করেন – সাথে সাথে অপ্রচলিত বড় হরফের ব্যবহার এবং বিরামচিহ্ন সম্বলিত। তাঁর অনেক কবিতার বিষয়বস্তু মৃত্যু ও অমরতার ধারণা সংক্রান্ত। যে কবিতাগুলো সেসময়ে বা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিলো তা অনেকাংশেই সম্পাদিত অবস্থায়। প্রকাশক সম্পাদকেরা সে যুগে কবিতার যে চলমান ফর্ম বা আঙ্গিকে অভ্যস্ত ছিলো, এমিলির কবিতাকে তারা তেমন তেমন করে সম্পাদনা করে প্রকাশের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

যদিও ডিকিনসন এর সমসাময়িক লেখকেরা তাঁর লেখা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিলেন, তারপরও ১৮৮৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে ছোট বোন লাভানিয়া তাঁর কবিতার ভাণ্ডার আবিস্কার করার আগে, তাঁর কাজের ব্যাপ্তি জনসমক্ষে এভাবে উপস্থাপিত হয় নি। তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন বের হয় ১৮৯০ সালে – তা-ও থমাস ওয়েন্টওয়র্থ হিগিনসন এবং মাবেল লুমিস টড প্রচুর সম্পাদনা করেন তার কাজের উপরে। একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন এবং প্রায় অপরিবর্তিত প্রকাশনা আমরা পাই ১৯৫৫ সালে যখন থমাস এইচ জনসন ‘এমিলি ডিকিনসন এর কবিতা’ শিরোনামে বইটি প্রকাশ করেন। বর্তমানে ডিকিনসনকে মোটামুটি সকল মহলেই একজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান কবি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

আমেরিকান কবি এমিলি ডিকিনসন এর জন্ম ম্যাচাসুসেটস এর আমহার্স্ট-এ (১৮৩০-১৮৮৬)। একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং অত্যন্ত বন্ধন-দৃঢ় পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়েও ডিকিনসন তাঁর জীবন কাটান বেশ একান্ত নিরিবিলিতে। আমহার্স্ট একাডেমিতে ৭ বছর পড়ালেখা করার পরে তাঁর যৌবনে অসুস্থতার জন্য কিছুদিন মাউন্ট হোলিওক ফ্যামিলি স্যানিটারিতে কাটিয়ে তারপর আমহার্স্টে নিজ পরিবারে ফিরে আসেন। স্থানীয়দের কাছে উৎকেন্দ্রিক হিসেবে বিবেচিত হলেও তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিলো শাদা জামাকাপড়ের দিকে সবিশেষ ঝোঁক। আর তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন অতিথিদের প্রতি তাঁর উদাসীনতার জন্য। ডিকিনসন চিরকুমারী ছিলেন এবং অন্যদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব পুরোপুরিভাবে চিঠিপত্র আদানপ্রদানের উপরেই নির্ভরশীল ছিলো। তাঁর জীবনের শেষাংশে ডিকিনসন নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসী জীবন যাপন করেন।

তাঁর অনেক কবিতার বিষয়বস্তু মৃত্যু ও অমরতার ধারণা সংক্রান্ত। যে কবিতাগুলো সেসময়ে বা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিলো তা অনেকাংশেই সম্পাদিত অবস্থায়। প্রকাশক সম্পাদকেরা সে যুগে কবিতার যে চলমান ফর্ম বা আঙ্গিকে অভ্যস্ত ছিলো, এমিলির কবিতাকে তারা তেমন তেমন করে সম্পাদনা করে প্রকাশের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

একাডেমিতে ৭ বছর অধ্যয়নকালে ইংরেজি, চিরায়ত সাহিত্য, লাতিন, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ইতিহাস, “মানসিক দর্শন” এবং পাটিগণিত নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। ছাত্রজীবনে খুবই মেধাবী ছিলেন, যদিও অসুস্থতার কারণে শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়। ডিকিনসন তাঁর যৌবনকাল থেকেই বাড়ির অভ্যন্তরীণ মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন। বিশেষ করে যারা তাঁর খুব ঘনিষ্ট ছিলেন, তাদের মৃত্যু। যখন ১৮৪৪ সালে তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও চাচাতো বোন সোফিয়া হল্যাণ্ড টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২ বছর পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমিলি লেখেন, “মনে হচ্ছিলো, যদি আমি তাকে – তার মুখের উপর দৃষ্টি দেয়ার সুযোগই না পাই তবে আমার মরাই উচিত”। তিনি এতো বিষণ্ন হয়ে পড়লেন যে, তাঁর বাবা-মা তাঁকে বোস্টনে সুস্থ হওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেন। এসময়ের কবিতায় পাই –

“কবরের পরেও উদ্দীপনা –
তার মুখাবয়ব দেখার তৃষ্ণা;
রাজসিক ড্রামের তালে তালে আমাকে সমর্থন জোগায়,
দিনের পর দিন বাড়ে সে ইচ্ছা।”

সুস্থ হবার পরে তিনি ফিরে আসেন আমহার্স্ট এর একাডেমিতে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করার উদ্দেশ্যে। এসময়ে তিনি বন্ধু হিসেবে পান আবিয়াহ রুট, অ্যাবি উড, জেন হাম্ফ্রে এবং সুসান হান্টিংটন গিলবার্ট – যারা ছিলেন তাঁর আজীবন এবং পত্রালাপের বন্ধু। ১৮৪৫ সালে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন ঘটে আমহার্স্টে। ফলে ডিকিনসনের সঙ্গীদের মধ্যে ৪৬ ধরনের ধর্মমত দেখা যায়। এতে কবিও উল্লসিত হয়ে এর প্রবাহে ভেসে যান কিছুদিন। যদিও তা বেশিকাল স্থায়ী হয়নি। ডিকিনসন কোনো নির্ধারিত ধর্মমতের অনুসারী হননি। ১৮৫২ সালে চার্চে যাওয়ার পর্ব শেষ করে দিয়ে ডিকিনসন লেখেন, কেউ কেউ রবিবারকে রাখে চার্চে যাবার জন্যে, কিন্তু আমি রাখি বাড়িতে থাকার জন্যে। সম্ভবত এমন কোনো এক সময়ে এমিলি লিখেছিলেন –

“তাদের শ্বেতপাথরের ঘরে নিরাপদে –
প্রভাতের স্পর্শ বিহীন
আর দুপুরেরও স্পর্শহীন –
পুনরুত্থান দলের বিনম্র   সদস্যগণ শায়িত –
শাটিন এর ভেলা – আর পাথরের ছাদ!
বছরগুলো কাটুক সুন্দর – বাঁকা চাঁদে – তারও ’পরে –
পৃথিবীর সিঞ্চন তার পরিধিতে
আর মহাকাশে – সারিবদ্ধভাবে –
মুকুটেরা – নিপতিত – প্রধান শাসক – আত্মসমর্পন করে –
নিশব্দ বিন্দুর মতো – বরফের চাকতিতে – ”

এমিলির যখন ১৮ চলছে, ডিকিনসন পরিবার বন্ধুত্ব গড়ে তোলে তরুণ আইনবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিউটন এর সাথে। নিউটনের মৃত্যুর পরে ডিকিনসন এর লেখা এক চিঠির ভাষ্য মতে ভদ্রলোক তাদের পরিবারের বেশ ঘনিষ্ট ছিলেন – যদিও তাদের সম্পর্ক তেমন একটা রোমান্টিক মনে হয় নি। নিউটন তাঁকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর লেখার সাথে; আর নিউটনের উপহার রালফ ওয়াল্ডো এমারসন এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এমিলিকে বেশ প্রভাবিত করে। তিনি পরে লিখেছেন, আমার বাবার ছাত্র যার নাম আমাকে শিখিয়েছেন, তা আমার গোপন বসন্তকে ছুঁয়ে গেছে। ডিকিনসন কেবল বাইবেল এর সাথেই নয়, পরিচিত ছিলেন সমকালীন জনপ্রিয় সাহিত্যের সাথেও। সম্ভবত তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন লিডিয়া মারিয়া চাইল্ড এর ‘নিউইয়র্কের চিঠি’র। এটাও নিউটনের দেওয়া আরেকটি উপহার। তার ভাই হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লঙফেলো-র কাভানাগ বইটি তার জন্য লুকিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন, কেননা তার বাবা এটা অনুমোদন না-ও দিতে পারতেন।
আর এক বন্ধু ১৮৪৯ সালের শেষ দিকে চার্লোট ব্রোন্টে-র ‘জেন আই’ পড়তে দেন। ‘জেন আই’র এর প্রভাব সঠিক অনুমান করা যায় না। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর জীবেন বেশ প্রভাব ফেলেছেন।

১৮৪৫ সালে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন ঘটে আমহার্স্টে। ফলে ডিকিনসনের সঙ্গীদের মধ্যে ৪৬ ধরনের ধর্মমত দেখা যায়। এতে কবিও উল্লসিত হয়ে এর প্রবাহে ভেসে যান কিছুদিন। যদিও তা বেশিকাল স্থায়ী হয়নি। ডিকিনসন কোনো নির্ধারিত ধর্মমতের অনুসারী হননি। ১৮৫২ সালে চার্চে যাওয়ার পর্ব শেষ করে দিয়ে ডিকিনসন লেখেন, কেউ কেউ রবিবারকে রাখে চার্চে যাবার জন্যে, কিন্তু আমি রাখি বাড়িতে থাকার জন্যে।

১৮৫০ এর শুরুর দিকে ডিকিনসন লেখেন, “আমহার্স্ট এই শীতে আনন্দের সাথে জীবন্ত হয়ে আছে, … ওহ, এ খুব অসাধারণ শহর!” তবে আরেকটি মৃত্যু তার এই উচ্ছ্বসিত প্রাণোচ্ছ্বলতা অবসাদে পরিণত করে দেয়। আমহার্স্ট একাডেমির প্রিন্সিপাল লিওনার্দ হাম্পফ্রে যখন ব্রেইন-কনজেসশান-এ আকস্মিক মারা গেলেন, ডিপ্রেশনে ভোগা ডিকিনসন তাঁর বন্ধু আবিয়াহ রুট-কে তখন লেখেনঃ “আমার কিছু বন্ধু চলে গেছে, আর আমার কিছু বন্ধু ঘুমাচ্ছে – ঘুমাচ্ছে যাজকীয় ঘুম – সন্ধ্যার সময়গুলো বিষণ্ন – একদিন এ ছিলো আমার পড়ার সময় – আমার প্রভু বিশ্রামে গেছেন, আর বইটির খোলা পৃষ্ঠা আর বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রটি একা, আমাকে অশ্রুসজল করে তোলে; আর আমি পারি নে সেসব মুছে ফেলতে। আমি পারলেও তা করবো না, কেননা চলে যাওয়া হাম্পফ্রে-র জন্য আমি কেবল এটাই করতে পারি।”

এমিলির সাথে সবচেয়ে গাঢ় ও সুদৃঢ় বন্ধুত্ব ছিলো ১৮৫০ এর দিকে ভ্রাতৃবধু সুসান গিলবার্ট এর সাথে। এমিলি তাঁকে প্রায় ৩০০-র উপরে চিঠি লিখেছেন। সুসান কবিকে বেশ প্রশ্রয় দিতেন – তিনি সবচেয়ে প্রিয়তম বন্ধুর মতো ভূমিকা রেখেছিলেন, প্রভাবিত করেছিলেন, আবেশিত করেছিলেন এবং পরামর্শদাতা ছিলেন – যার সম্পাদকীয় পরামর্শগুলো ডিকিনসন মাঝে মাঝে মেনে চলতেন। সুসান এমিলির সৃজনশীলতার প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছেন।

১৮৫৫ এর আগে এমিলি আমহার্স্ট থেকে বেশি দূরে কখনো যান নি। সেই বসন্তে মা ও বোনের সাথে তিনি দূরের যাত্রায় বের হন। প্রথমে তারা ৩ সপ্তাহ কাটান ওয়াশিংটনে- যেখানে তার বাবা কংগ্রেস-এ ম্যাচাসুসেটস-কে প্রতিনিধিত্ব করেন। তারপরে তারা ফিলাডেলফিয়া যান ২ সপ্তাহের জন্য পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। এখানে তিনি বিখ্যাত মন্ত্রী চার্লস ওয়াডসওয়ার্থ এর সাথে পরিচিত হন, পরে যার সাথে গড়ে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব, যা ১৮৮২ সালে চার্লস এর মৃত্যু পর্যন্ত টিকে ছিলো। তবে, ১৮৫৫ এর পরে চার্লসকে কেবলমাত্র ২ বার দেখার সুযোগ পান এমিলি। কারণ চার্লস ১৮৬২তে সান ফ্রান্সিস্কোতে চলে যান। এমিলি চার্লস সম্পর্কে নানাভাবে লিখেছেন – “আমার ফিলাডেলফিয়া”, “আমার যাজক”, “আমার প্রিয়তম পার্থিব বন্ধু” এবং “ছোট্ট বালিকাবস্থা থেকে আমার মেষপালক” ইত্যাদি।

শিশু এমিলি ডিকিনসন (বামে) এবং তার বোন লাভিনিয়া ও ভাই অস্টিন। ছবি: Getty Images/​Hulton Archive.

১৮৫০ এর মাঝামাঝি থেকে এমিলির মা পুরোপুরিভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন নানারকম রোগে ১৮৮২তে মৃত্যু পর্যন্ত। ১৮৫৮তে এমিলি এক বন্ধুকে লেখেন, “যদি বাড়ি বা মাকে ছেড়ে বেরোতে পারি তবে দেখা করবো। আমি একেবারেই বের হই না। যদি বাবা ফিরে আসে আর কিছু না পায়, অথবা যদি আমি কিছু করতে ভুলে যাই। আমার দৌড়ে যেতে হয় প্রায়ই মায়ের কাছে – আমি জানি না তার জন্য কী প্রার্থনা করবো।” মায়ের অসুস্থতা এমিলিকে আরো বেশি গৃহকর্মে কর্তব্যপরায়ন করে তোলে আর গৃহবন্দী করে ফেলে। চল্লিশ বছর পরে, লাভিনিয়া প্রকাশ করে যে, এমিলির মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায়, কেউ একজনকে তাঁর সাথে থাকার প্রয়োজন ছিলো। আর এই কর্তব্য এমিলি নিজে আপন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। যা তাঁর জীবন, সৃষ্টি ও প্রকৃতির সাথে মিলে গিয়েছিলো।

১৮৫৮-র গ্রীষ্মে এমিলি বহির্বিশ্ব থেকে নিজেকে আরো আরো বেশি একাকী করে নেন। ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে ৪০টি পর্বে তিনি প্রায় ৮০০ কবিতা লেখেন। তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউই এসব লেখার বা গ্রন্থের খবর রাখেনি। ১৮৫০-এ স্প্রিংফিল্ড রিপাবলিকান এর স্বত্তাধিকারী ও প্রধান সম্পাদক স্যামুয়েল বাওলেস এবং তাঁর স্ত্রী ম্যারি-র সাথে এমিলির বন্ধুত্ব হয়। তারা বহুবার ডিকিনসন এর সাথে দেখা করেন এবং এই সময়ে এমিলি তাকে ৩ ডজনেরও বেশি চিঠি এবং প্রায় ৫০টি কবিতা পাঠান। এই বন্ধুত্বের ফলে বেশ কিছু লেখা ছাপা হয় এবং বাওলেস তাঁর জার্নালে এমিলির কিছু কবিতা প্রকাশ করেন। ১৮৫৮ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে ধারণা করা হয় ডিকিনসন ত্রয়ী-পত্র লিখেছেন, যেগুলো মাস্টার-লেটার নামে খ্যাত। এই ৩টি চিঠি লেখা হয় কোনো অজানা ব্যক্তিকে – সম্বোধন করা হয় “মাস্টার” বলে – যা বিদ্বৎসমাজে প্রচুর ভাবনা ও তর্কের বিষয় হয়ে আছে। ১৮৬০ এর প্রথমার্ধে এসে সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে একাকী করার পরে দেখা গেল ডিকিনসন এর সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনি এগোরাফোবিয়া (জনমানুষের ভীড় আছে এমন স্থানের প্রতি ভীতি বোধ) ও মৃগীরোগে ভুগছিলেন।

১৮৬২ সালে থমাস ওয়েন্টওয়র্থ হিগিনসন নামে এক সাহিত্য সমালোচক, এক র‍্যাডিকাল এবোলিশনিস্ট (বৈপ্লবিক মৃত্যুদণ্ডবিলোপপন্থী) এবং প্রাক্তন মন্ত্রী, একটা উল্লেখযোগ্য গদ্য লেখেন “মাসিক অতলান্তিক” বা “দ্য আটলান্টিক মান্থলি”-র জন্য। যার শিরোনাম ছিলো – “এক যুবক অবদানকারীকে পত্র”। এই লেখা থেকে প্রভাবিত হয়ে ডিকিনসন ভাবতে থাকেন একজন পাঠক বা শ্রোতার সামনে লেখা পাঠ না করলে লেখার প্রকৃত আস্বাদ মেলে না। তিনি হিগিনসনকে পত্র লেখেন লেখালেখির ক্ষেত্রে পরামর্শ চেয়ে। ডিকিনসন মর্যাদা দিয়েছিলেন তাঁর পরামর্শকে। তিনি সম্বোধন করতেন মিঃ হিগিনসন বা প্রিয় বন্ধু বলে, আর পত্রের নিচে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে লিখতেন ‘তোমার পাতালবাসী বাসন-ভূত’ বা ‘তোমার বিদ্যার্থী’ ইত্যাদি। তাঁর লেখার প্রতি হিগিনসন এর আগ্রহ তাঁকে বিশাল নৈতিক সমর্থন দেয়। ডিকিনসন বলেন যে হিগিনসন ১৮৬২ সালে তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিলেন – আর এই সম্পর্ক আমৃত্যু বজায় ছিলো। সাহিত্য সমালোচক এডমুণ্ড উইলসন গৃহযুদ্ধের সাহিত্যের আলোচনায় মন্তব্য করেছিলেন যে, “তাঁর লেখা অবশ্যই প্রকাশ পাওয়া উচিত”।

১৮৫৮তে এমিলি এক বন্ধুকে লেখেন, “যদি বাড়ি বা মাকে ছেড়ে বেরোতে পারি তবে দেখা করবো। আমি একেবারেই বের হই না। যদি বাবা ফিরে আসে আর কিছু না পায়, অথবা যদি আমি কিছু করতে ভুলে যাই। আমার দৌড়ে যেতে হয় প্রায়ই মায়ের কাছে – আমি জানি না তার জন্য কী প্রার্থনা করবো।” মায়ের অসুস্থতা এমিলিকে আরো বেশি গৃহকর্মে কর্তব্যপরায়ন করে তোলে আর গৃহবন্দী করে ফেলে।

১৮৬০ এর সাথে তুলনায় দেখা যাচ্ছে ১৮৬৬তে তিনি খুব কমই লেখালেখি করেছেন। ব্যক্তিগত ক্ষতি, বাড়িতে সহায়তার অভাব এসবই হয়তো কারণ। এসময়ে ১৬ বছরের সঙ্গ দান শেষ করে প্রিয় সারমেয় কার্লো মারা যায়। ডিকিনসন এর পরে আর কোনো কুকুর রাখেন নি। ওদিকে ৯ বছরের গৃহভৃত্য মার্গারেট ও’ব্রায়েন সে বছরেই বিয়ে করে সে বাড়ি ত্যাগ করে। যে সময়ে এমিলি অনেক বেশি গৃহকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে অবশ্য ১৮৬৯ সালে নতুন পরিচারিকা মার্গারেট মাহের কাজে যোগ দেয়।

“একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার – এ ছিলো – আমি বলি –
এক মহিলা – সাদা – হবার জন্য –
আর পরিধানের জন্য – যদি ঈশ্বর আমাকে উপযুক্ত ভাবেন –
তাঁর অপবাদহীন রহস্যময়তা – “

এমন সময়ে ডিকিনসন এর আচরণে পরিবর্তন আসতে থাকে। যে তিনি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরেই যেতেন না, সেই এমিলি ১৮৬৭তে আবার অতিথিদের সাথে সরাসরি মুখোমুখি না হয়ে বরং দরজার অপর প্রান্ত থেকে কথা বলা শুরু করেন। এসময়ে তাঁকে কেউ দেখতে পেতেন না। আর দেখা দিলেও তিনি থাকতেন সাদা সুতী জামা পরিহিত।

১৮৭৪ সালের ১৬ জুন যখন বোস্টনে এডওয়ার্ড ডিকিনসন স্ট্রোক করেন ও মারা যান, যখন তার ফিউনারেল হয় বাড়ির হলরুম-সদৃশ প্রবেশ কক্ষে, এমিলি তার নিজ কক্ষে অবস্থান করেন, ভেজানো দরোজার বিপরিত পাশে। পরের বছর ১৫ জুন ১৮৭৫ সালে এমিলির মা’ও স্ট্রোক এর শিকার হন- যার ফলে একপার্শ্ব-অবশ (প্যারালাইসিস) ও স্মৃতিভ্রম ঘটে তাঁর। তাঁর মায়ের এই অবস্থায় এমিলি লিখেছিলেন “ঘরের চেয়ে ঘর বহু দূর”।

“যদিও বিশাল জলাশয় নিদ্রারত,
তারা এখনও তেমনই গভীর,
আমরা দ্বিধা করতে পারি না –
না কোনো দোদুল্যচিত্ত ঈশ্বর
আগুন জ্বেলেছে এই বসতবাটিতে
একে দূর করে দেবে বলে – ”

১৮৭২-৭৩ থেকে ওটিস ফিলিপস লর্ড নামে এক বয়স্ক বিচারকের সাথে এমিলির পরিচয় ঘটে। ১৮৭৭-এ তাঁর স্ত্রী বিয়োগের পরে যে সম্পর্ক কিছুটা শেষ বয়েসের রোমান্স-এ মোড় নেয়। যদিও অধিকাংশ পত্রাদি ধ্বংস হয়ে গেছে, যা কিছু ছিঁটে-ফোঁটা পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় তিনি সমজদার পাঠক ছিলেন এবং তাঁর পত্রালাপে শেক্সপিয়র এর ওথেলো, এন্টনি ও ক্লিওপেট্রা, হ্যামলেট এবং কিং লিয়র থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। ডিকিনসন তাঁকে লিখেছিলেন –

“যখন অন্যরা চার্চে যাচ্ছে, আমিও আমারটাতে যাই,
তুমি কি আমার চার্চ নও?
আর আমরা কি করিনি স্তোত্রপাঠ
যা আমরা ছাড়া আর কেউই জানে না?”

ডিকিনসন তাঁকে ভালোবেসে “আমার প্রিয় সালেম” সম্বোধন করতেন। আর প্রতি রবিবারে তাঁরা ধার্মিকতায় পরস্পরকে চিঠি লিখতেন। দীর্ঘ রোগ ভুগে ১৮৮৪ সালের মার্চে জাজ লর্ড মারা গেলে ডিকিনসন বলেন “আমাদের সর্বশেষ হারালো”। যদিও শেষবছর পর্যন্ত তিনি লিখে গিয়েছেন, ডিকিনসন তাঁর কবিতাকে সংশোধন ও সম্পাদনা করা বন্ধ করে দেন। তিনি তাঁর বোন থেকে কথা আদায় করেন, তার কাগজ পত্র জ্বালিয়ে দেবার ব্যাপারে। লাভিনিয়াও অবিবাহিত ছিলেন এবং ঘরেই থাকতেন ১৮৯৯ সালে নিজের মৃত্যু পর্যন্ত।

১৮৮৬ সালের ১৫ মে তারিখে ৫৫ বছর বয়সে দীর্ঘ দুঃখময় ভোগান্তির শেষে এমিলি ডিকিনসন মৃত্যুবরণ করেন। অস্টিন তাঁর ডায়েরিতে লেখেন – দিনটি ছিলো অদ্ভুত – সে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করলো – সে ভয়াবহ শ্বাসপ্রশ্বাস বিকেলের আগে যেন ছ’বার হুইসেল বাজিয়ে গেলো। ডিকিনসন এর প্রধান চিকিৎসক ঘোষণা করলেন ডিকিনসন ব্রাইটস রোগে আড়াই বছর ভুগে মারা গিয়েছেন।

 


অলংকরণ: রাজিব রায়

আরও পড়ুন- এমিলি ডিকিনসনের কবিতা

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.