আনন্দ পাঠ
কবিতার তারাপদ রায়
“আমি যে জীবনযাপন করি, সে নেহাতই ঘরগৃহস্থী। সে কোন কবির জীবন নয়। আমি জানি আমার চেহারায়, চরিত্রে, আচার-আচরণে কোথাও একবিন্দু কবিত্ব নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাই, খবরের কাগজ একটু পড়ি, তারপর অফিস, সেখানে এক ধুলিমলিন জরাজীর্ণ প্রাসাদের অন্ধকার কক্ষে আমার দিন শেষ হয়ে যায়, সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে সংসারের কাছে ফিরে আসি। স্ত্রী-পুত্র, ভাই এবং একাধিক নিম্ন বংশজাত সারমেয় নিয়ে আমার সামান্য সংসার, কয়েকজন সুহৃদ, কয়েকজন আত্মীয়।…. যখন কোনদিন কুয়াশায় ছেয়ে ছেয়ে যায় চরাচর, মধ্যরাতে ডাকবাংলোর জানালায় চাঁদ উঠে আসে দেবদারু পাতার মধ্যে, কিংবা যখন এসব কিছুই হয় না ধুলোপায়ে গ্রামের কৃষক সামনে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, বলে, ‘আমার বিষয়টা কি হল’, কোথায় যেন সব কিছু আগাগোড়া এক হয়ে যায়। কোন পার্থক্য থাকে না পরিশ্রমে ও কল্পনায়, কোন প্রভেদ থাকে না জীবিকা ও কবিতায়। সেই আমার আনন্দ।”
…… ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি লিখেছিলেন তারাপদ রায়।
‘কান্ডজ্ঞান’ আর ‘বিদ্যাবুদ্ধি’ দিয়েই তারাপদ রায়কে চিনতাম। যে তারাপদ একটা ছাতা নিয়ে লেখেন, মেঘনাদ বাবুর পক্ষে ছাতাটি ফেরেত দেওয়া সম্ভব হয়না। কারণ ওই ছাতা নিয়ে পরের দিন সকালে মেঘনাদ বাবুর ছেলে বাজারে যায় এবং ফেরার পথে যখন বৃষ্টি থেমে গেছে, বাজারের পাশের চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে গিয়ে সেখানে ফেলে আসে। পরে অবশ্য চায়ের দোকানদার ছাতার কথা অস্বীকার করেনি কিন্তু সেদিনই দুপুরে আবার যখন বৃষ্টি আসে তখন দোকানদার মশায় সেটা মাথায় দিয়ে বাড়ি যান ভাত খেতে। এরকম হতে হতে আরও কোনজনের বান্ধবীর বাড়ি চলে গিয়েছে সে ছাতা তার আর খোঁজ থাকে না। কোথায় গেল ছাতাটা তা আর জানা হয় না কোনদিন।
অথবা লেখেন, একটা কাঠের পিড়ি আমেরিকা অব্দি টেনে নেবার স্মৃতি বা চোরের ফেলে যাওয়া টর্চটা এ বাড়ির মানুষ বাদে কেউ জ্বালাতে জানে না। কেননা, ওটার পেছনের স্প্রিং গিয়েছে ছুটে। আর সেখানে বেশ কসরত করে হাতের তালুতে নিয়ে কেমন পেচিয়ে ঝাঁকুনি দিতে হয় সে এক যজ্ঞ।
অমন সরস গদ্য যিনি লিখেন তিনি কবিতা কী লিখবেন! তারাপদ কবিতা লিখেছিলেন শুনেই চোখ কপালে উঠবার দশা। তারপর নেটে দু’একটি কবিতা পড়ে সে চোখ আরও উর্ধ্বগামি।
একজন মানুষ এত ব্যঞ্জনাময় হয়!
‘এক জন্ম’ কবিতাটা আর কেউ লিখতে পারবে না। “অনেকদিন দেখা হবে না তারপর একদিন দেখা হবে…” কবিতার শেষ অংশ, “আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না।” এখানে যেয়ে জীবনের এক কঠিন সত্যের সামনে দাঁড়াতে হয়। সত্যিই তো প্রিয় মানুষ কেন, আমার নিজের সাথেই তো একদিন আর দেখা হবে না ‘আমার’। মৃত্যুকে একেবারে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন তারাপদ রায়।
টাঙ্গাইল শহর ছেড়ে কৈশোরে চলে যাওয়া এক কিশোর, কলকাতায় মধ্যরাত পাহারা দিতে দিতে লিখবেন “কিন্তু মনে নেই সেই নদী, পোড়ো পুকুরের পাশে ভাঙাচোরা হলুদ দালান, আজ সবই অবাস্তব আপনাকে যথার্থ জানাই (বাংলাদেশ কবিতা)” স্বাভাবিক। অথবা আক্ষেপ করে বলবেন, “আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিয়েছো, আমার প্রথম ভালোবাসা, স্টীমারের হুইসিল নৌকার ছেঁড়া পাল, ধলেশ্বরীর তীরে কলাগাছ, ক্রমাগত প্রথম সবুজ পাতা (বাংলাদেশ ১৯৭১ কবিতা)।”
একই কলমের কবিতায় যখন উঠে আসে শান্তিলতার সাথে মদীয়ের সম্পর্কের বিবরণের জবানবন্দী দেবার কথা, সে অবিশ্বাস্য। শান্তি লতাকে মদীয়ে একটি থলকমলের চারা এনে দিয়েছিল ঠিকই কারণ নিজের বংশে স্থলপদ্ম বা ওরকম গাছ লাগাবার আস্য (অনুমতি) ছিল না। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল না, সে শুধু ভেবেছিল ওই গাছ বড় হলে সে জানালা দিয়ে শোভা দেখবে। সেই শোভার মাঝখান দিয়ে মাঝে মাঝে শান্তিলতাকে দেখা যাবে অন্য বাড়ির উঠোনে। কিন্তু এর বেশি সম্পর্ক তাদের ছিল না। ‘জবানবন্দী’ কবিতা এক আশ্চর্যরকম প্রত্যাশার গল্প।
‘কাঁসার গেলাস’ কবিতাটা পড়তে গেলে ভেতরে যেন কোথায় কেঁপে উঠে, বাতাসে কলাপাতা যেমন কাঁপে ঠিক ওমন করে। কবিতাটা তুলে দেবার লোভ আমি না সামলাই?
“কাঁসার গেলাসে লিখে রেখেছিলে নাম
পুরনো ধাতুর দাম
সে গেলাস কবে একেবারে
বিক্রি হয়ে গিয়েছে বাজারে।
আজকাল কারা পান করে,
তোমার নামের জল আজ কার ঘরে?”
মনে পড়ে না ছোটবেলায় দেখা কাঁসার গেলাসে খোদাই করা কোন নাম? মনে আছে এখন সেটি কোথায়? এই হারিয়ে ফেলার সাথে যে আরও কত কিছু হারিয়ে যাবার সংযোগ তৈরি হয়ে যায় পাঠকের। আর তাতে এক বেদনার নকশা তৈরি হয়, সে বেদনা অনেকটা সময় ধরে বহন না করে পাঠকের পথ থাকে না।
‘এক জন্ম’ কবিতাটা আর কেউ লিখতে পারবে না। “অনেকদিন দেখা হবে না তারপর একদিন দেখা হবে…” কবিতার শেষ অংশ, “আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না।” এখানে যেয়ে জীবনের এক কঠিন সত্যের সামনে দাঁড়াতে হয়। সত্যিই তো প্রিয় মানুষ কেন, আমার নিজের সাথেই তো একদিন আর দেখা হবে না ‘আমার’। মৃত্যুকে একেবারে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন তারাপদ রায়।
গ্রামের ভেতর নদী বা নদীর ভেতর গ্রাম এমন করে আমরা কখনও ভেবেছি? এই যে আজ যেখানে বসতি সেখানে একসময় ছিল নদী আবার যখন নদী সব হরণ করে তখন সেই নদীর ভেতরও সেই গ্রাম থাকে। অদৃশ্য হয়ে যায় কিন্তু সত্যি সেখানে এককালে ছিল গ্রাম আটপৌরে গৃহস্থালী।
‘দারিদ্ররেখা’ কবিতার মতো সমাজের উন্নয়নকারী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কষে চপেটাঘাত করা কবিতাও তারাপদ’র কলমে কেমন সাবলীল! এ কবিতা অনেকেরই কমবেশি পড়া। এমনকি নিজেই অবাক হলাম। ক্লাশ এইটে থাকতে আবৃত্তির ক্যাসেটে শুনেছি দারিদ্র্যরেখা, কিন্তু তাঁর লেখা জানতাম না। তিনি কবিতা লিখতেন তাই জানতাম না। তারাপদ নিজেই আসলে তাঁর সেই ‘সাহস কবিতা’।
নিজেই স্বীকার করেছেন, ছন্দের বিশেষ কান তাঁর ছিল না তাই ও পথেই জাননি। তিনি শুধু নিজের কথা বলার জন্য কবিতা লিখেছেন। শক্তি, সুনীল, শঙ্খ যখন কবিতায় ঝড় তুলেছেন দুই বাংলায়, একই সময় তারাপদ লিখেছেন নীচু কিন্তু গভীর স্বরে। এমন কিছু কথা যাতে ছন্দের মাপকাঠি, কবিতার উৎকর্ষ কিছুতে বিশেষ মাপজোকে ফেলা চলে না। তিনি সব কবিতাতেই এমন করে ‘আমি’ গভীর স্বরটা বজায় রেখেছেন যে তা পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পাঠক নিজেই সে ‘আমি’ হয়ে যায়। এরকম লিখতে দু:সাহস লাগে।
সে সাহস আর জেদটা তারপদ রায়ের ছিল নয়ত বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় দিনের পর দিন কবিতা দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েও পাঠিয়ে যেতে পারেন? সেই পত্রিকাতেই একসময় তিনটে এমনকি পাঁচটে করে কবিতা ছাপা হয় তারাপদ রায়ের? দেশ পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে শতাধিক কবিতা। সে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাকে কতখানি ধারণ করেছিলেন যে নিজের সন্তানেরও নাম রেখেছেন কৃত্তিবাস। সত্যি সাহস লাগে।
সে রকম সাহস যে সাহস থাকলে, একটা হাল ছেড়ে দেওয়া গাছে ঝরে যাওয়ার সময়েও হিমে ভরা রাতে একা একা একটা ফুল গাছের বোঁটায় টিকে থাকতে পারে। ‘সেই সাহস’ কবিতাটা পড়লেই বোঝা যায় “সেই সাহস সকলে বুঝতে পারে না, সকলের বোধগম্য নয়।”
তিনি শুধু নিজের কথা বলার জন্য কবিতা লিখেছেন। শক্তি, সুনীল, শঙ্খ যখন কবিতায় ঝড় তুলেছেন দুই বাংলায়, একই সময় তারাপদ লিখেছেন নীচু কিন্তু গভীর স্বরে। এমন কিছু কথা যাতে ছন্দের মাপকাঠি, কবিতার উৎকর্ষ কিছুতে বিশেষ মাপজোকে ফেলা চলে না। তিনি সব কবিতাতেই এমন করে ‘আমি’ গভীর স্বরটা বজায় রেখেছেন যে তা পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পাঠক নিজেই সে ‘আমি’ হয়ে যায়। এরকম লিখতে দু:সাহস লাগে।
বিস্তর হয়ে যাচ্ছে তবুও সামান্য তীরে পৌঁছাচ্ছে না আমার বোধ। আমি তাকে যেমন করে পাচ্ছি, তার সামান্যও লিখতে পারছি না বসে। আশ্চর্য বিষয় একই দিনে আমাকে দু’জন মানুষ তারাপদ রায়ের কবিতা পড়তে দিয়েছিলেন। দুজনেরই অভিব্যক্তি ছিল ভালো কবিতা, সুন্দর এসব নয় স্রেফ ‘আহ্ তারাপদ’। পাঠক কখন এমন করে বলেন, আহ্ তারাপদ! এরমধ্যে একজন তো বলেই বসলেন, ‘তারাপদ আমার’। গতকাল যখন বললাম, ২ ডিসেম্বর তারাপদ রায়ের বইটা কেনার পর থেকে একদিন বাদে একটা দিনও যায়নি, যে বইটা আমার সাথে ছিল না। মানে যেখানেই যাচ্ছি তারাপদ’র বই সাথে। তিনি শুনে সাথে সাথে বললেন, আর আমার এখনও মাথার কাছে। এত বছর ধরে পড়েও মাথার কাছেই তারাপদ। চট করে তারাপদ’র ‘পরমহংস’ কবিতাটাই মনে এলো, “পায়ের কাছে জানলা খোলা, মাথার কাছে পরমহংস, বৃষ্টি আমার, বাতাস আমার, সমস্ত রাত পরমহংস।”
এ বছরে পড়া কোন বইয়ের কথা বলা যায় ভেবে আমি তালিকা করলাম। তাতে ডালরিম্পেলের ‘সিটি অব জ্বিনস’ থেকে গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’। তালিকায় বিভূতিভূষণের আরণ্যক, পরিমল ভট্টাচার্যের শাংগ্রিলার খোঁজে থেকে মুরাকামির ‘কাফকা অন দা শোর’ জায়গা করে নিল। অথচ তালিকা শেষ করতে দেখি হাতের পাশে আসলে পরমহংসই।
তারাপদ রায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। এর বেশি আর কী বলতে পারি কবিতা না বোঝা পাঠক হয়ে আমি?
তারাপদ রায়ের কবিতা সকলে চেনেনা কিন্তু তারাপদ সকলকে চিনতেন। এখানেই তাঁর কবি সত্তার জিতে যাওয়া। পাঠক পরিচিতিই শুধু লেখকের জিতে যাওয়া নয়। ‘তারাপদ আমার’ এমন করে যদি একজন পাঠকও বলেন, তবেই সে লেখক পেয়ে গেলেন তাঁর আসল প্রাপ্তিটুকু। কী লিখলাম ছাইপাশ তারাপদ আপনাকে নিয়ে? ভালবাসার কথা সত্যি বলা যায় না। আমিও আপনার কবিতার মতই আপনার কাছে “শুধু হিজিবিজি ছবি, চাঁদ, মেঘ, বেড়ালছানা সবিনয় নিবেদন কাটাকুটি করে চিরদিন তোমার কাছে পৌঁছনো।” এলাম,আসলে কী এলাম কাছে?
৩১ ডিসেম্বর ২০১৭