কবিতা চিন্তা এবং কবি তৌহিদ আহমেদের ‘কোমল গান্ধার’
দীর্ঘকাল পরও যেন তার স্বর – কণ্ঠস্বর বদলায়নি। স্বরে গাঢ়তা বেড়েছে –আপেক্ষিক পর্যবেক্ষণ ও নিরপেক্ষ বীক্ষণদৃষ্টি গড়ে উঠেছে আর কবিতায় গীতাত্মক বা আত্মপরায়ণতার গুণ উৎকর্ষ পেয়েছে। বদলেছে শুধু নির্মাণ ও নির্মিতির অঞ্জনা ও ব্যঞ্জনা। কিছু কিছু কবি আছে হঠাৎ চমক দেয় না – দেয়ার চেষ্টাও করে না এবং কবিস্বভাবের মধ্যে চমক দেখাবার প্রবৃত্তিও রাখে না। কিন্তু কবিসত্তার ভেতরের মুদ্রণশিল্প অবিরাম অর্থময় একটা সৌকর্য তৈরি করে – যা খুব নিবিষ্ট চোখে না দেখলে কবিকে মূল্যবিবেচনায় চেনাটা সহজ হয় না। কিছু কবি আছে জীবনের সমস্ত উত্তাপকে ধারণ করেও আত্মসিদ্ধ নিরুত্তাপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন এবং পারেন অনন্যভাবে।
আমি যে বললাম ‘নিবিষ্ট চোখে’ দেখার কথা সে কথাটি কী মানে বহন করে? বহন করে এ কথাটি যে, কেমন করে কবি তার সৃজিত-পূজিত-লালিত বাণীকে সংগঠিত করে পাঠকের সামনে—মনোযোগী পাঠকের সামনে তুলে আনেন। এবং কবি যে বিষয় ও বিষয়ের ভেতরের বিষয় আর জরুরি অনুষঙ্গকে তুলে আনেন তার সৃজন দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চারিত শব্দের মননভঙ্গিটি কেমন? কবি ও কবিতা কেমন করে একজন পাঠককে হাত ধরে টানেন এবং মন ধরে আকর্ষণ করেন? কবি তৌহিদ আহমেদের [জন্ম- ০৪ জানুয়ারি ১৯৫৫] কোমল গান্ধার পাঠ করতে গিয়ে এভাবেই জেগেছে আমার মনে প্রশ্নগুলো। যে কোনো কাব্য বা সাহিত্যের আলোচনার নির্মাণে বা সৃজনে আমার কাছে শিল্পকে- মননকে জানার জন্য প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
আমরা জানি কাব্যসাহিত্যের অঙ্গনে কবি তৌহিদ আহমেদ নতুন মুখ নয়। ইতোমধ্যে ছড়া কিশোর কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা তেইশটি। ২০২০ সালের একুশে বইমেলায় ‘বলাকা প্রকাশন’ প্রকাশ করেছে তার ‘বাছাই করা শতেক ছড়া’ এবং ‘কোমল গান্ধার’ কাব্যগ্রন্থ। আমি জানি ছড়া সাহিত্যে তৌহিদ আহমেদ বিশিষ্ট এবং সফল ছড়া সাহিত্যিকের মর্যাদার অধিকারী। তার ‘বাছাই করা শতেক ছড়া’ নিঃসন্দেহে ছড়া সাহিত্যে তাকে কৃতী ছড়া লেখকের আসনে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দেবে। তার ছড়া নির্মাণ নৈপুণ্যে ও সমাজচিন্তা এবং চেতনা প্রকাশে ঋদ্ধ ও শানিত। এবার আমি তার কাব্যগ্রন্থ ‘কোমল গান্ধার’ বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। ‘কোমল গান্ধার’ শিরোনামহীন সত্তরটি কবিতা নিয়ে পরিকল্পিত একটি কাব্যগ্রন্থ বলেই আমার বিশ্বাস। প্রতিটি কবিতা ২০ লাইনের অন্ত্যমিলের ফ্রেমে বন্দি। সারাৎসার কথাটি বললে বলতে হয় একটি চমৎকার কাব্যগ্রন্থ।
প্রত্যেক কবির একটা বড় দায়িত্ব আছে এবং থাকে—সে শুধু শব্দ-ছন্দ-সুর ও প্রকরণের করণকৌশলের সন্ধান করে না বা করবে না – সে তার যুগের প্রাণধর্মকে সত্যকে যুগ-ঘটনার পরম্পরার আলোকে কাব্যকে স্পর্শ করবে একান্ত নিজস্ব কবিব্যক্তিত্ব দিয়ে। রাজনীতি অর্থনীতি ও সমাজ জীবনের যে জীবন্ত ক্রিয়াশীলতা এবং ক্রিয়াশীলতার গহীনে যে অন্তর্বোধের গভীর অদৃশ্য ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া আছে তাকে ছবি ও মনের বোধনে আকারে ইঙ্গিতে ধরিয়ে দেওয়াই কবির কাজ।
আমি বলি, বলতে চাই এবং আস্থার সাথে বিশ্বাস করি – কবি আর শিল্পীর আবিষ্কার ও অনুধাবনের মনস্মৃতি তীক্ষ্ণতা সমাজের অন্য সব মানুষের চেয়ে প্রাগ্রসর। কেন এমন হয়? কবি ভাস্কর চিত্রশিল্পী সংগীতজ্ঞ –তাদের চিত্তের মধ্যে মননে স্নায়ুতে জীবনের বহমান ইতিহাস এবং ইতিহাসের কুশীলবদের সকল স্থিরতা অস্থিরতা যন্ত্রণা আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন ও বেদনা দারুণ মন্থনের মধ্য দিয়ে ছবির মতো মননে আভাসের মতো আত্মস্থ ও প্রকাশ করতে পারেন। কবি চিত্তবৃত্তিকে যেমন –তেমনি সমাজ ও জনমণ্ডলীর পরিবর্তন বিপ্লব উপপ্লব বিপর্যয়ের লক্ষণসহ সবকিছুকেই সকলের আগে চৈতন্য- লোকের চঞ্চল বোধের সাহসী এন্টেনায় ধরতে পারেন ক্রান্তি ও অক্রান্তিকে বুঝতে পারেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। মহৎ কবি ও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক [২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫—২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬] তাঁর অসাধারণ ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাটকে লৌকিক ভাষায় বলেছেন– ‘ঝড়ের খবর আগে পায় বড় গাছের ডাল / বানের খবর আগে পায় যমুনার বোয়াল’। এ কথাটি সাধারণ প্রবাদ–প্রবচন নয় – জীবনের গভীরতম সত্যের স্মারক। সেক্সপীয়রের দিকে চোখ রাখলেই তাঁর অন্তর্ভেদী সমাজবীক্ষণের লৌকিক অথবা অলৌকিকের ক্ষমতাযুক্ত শিল্পবুদ্ধিমত্তা ও আকাশ উচ্চতার মননসম্পদের টের পাই। তিনিই প্রথম আধুনিক মানুষের মানস লক্ষণ—মানুষের জটিল দ্বন্দ্বমূখর মনোজগতের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার অন্তর্গত ছবিটিকে ধরেছিলেন ‘হ্যামলেটে’। এ আবিষ্কার একজন ব্যক্তি হ্যামলেটকে আবিষ্কার নয় শুধু—নতুন জগতের নতুন মানুষের মানসিক প্রোজেকশনকে ধরেছিলেন তিনি। কারণ মহৎ শিল্পী মহৎ চিন্তুক তার কালকে যেমন নখদর্পণে বুঝতে পারেন তেমনি মহান প্রজ্ঞার আলোকে তার কাল থেকে বহুদূরবর্তী ভবিষ্যতে হাঁটতে পারেন ভাবতে পারেন। পাঠ করতে পারেন ভবিষ্যতকে সময়ের গতিচিত্রকে। ইতিহাসের বড় শিল্পীরা জগতের সমগ্র চেতনার অন্তঃসার চিন্তাকে ধারণে চুম্বনে সৃষ্টিতে অগ্রগণ্য থাকেন।
প্রত্যেক কবির একটা বড় দায়িত্ব আছে এবং থাকে—সে শুধু শব্দ-ছন্দ-সুর ও প্রকরণের করণকৌশলের সন্ধান করে না বা করবে না – সে তার যুগের প্রাণধর্মকে সত্যকে যুগ-ঘটনার পরম্পরার আলোকে কাব্যকে স্পর্শ করবে একান্ত নিজস্ব কবিব্যক্তিত্ব দিয়ে। রাজনীতি অর্থনীতি ও সমাজ জীবনের যে জীবন্ত ক্রিয়াশীলতা এবং ক্রিয়াশীলতার গহীনে যে অন্তর্বোধের গভীর অদৃশ্য ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া আছে তাকে ছবি ও মনের বোধনে আকারে ইঙ্গিতে ধরিয়ে দেওয়াই কবির কাজ।
কবিতা ও শিল্প বিষয়ক চিন্তাকে আলোচনায় বিস্তারণ দিচ্ছি – শিল্প ও শিল্পীর এবং শিল্প জগতের বিচিত্র বিশাল পরিধিকে দেখানোর জন্য। কবি হচ্ছেন ব্রাজক–পরিব্রাজক। এই পরিব্রাজন থেকে উঠে আসে শস্য ও সম্পদ— যাকে বলি ফসল ও সৃষ্টি এবং মহার্ঘ কৃষ্টি। এ কথাও মানতে হবে যে সময়-কাল–যুগের পরিমণ্ডলের চেতনার মধ্যে কবিকে বাঁচতে হয় জীবনকে ধারণ করতে হয় চিন্তনকে আহরণ করতে হয়। কবি বা শিল্পী সময়ের নির্দেশ ও বহমান নীতি নিয়মকে যেমন মানেন তেমনি জামশেদি চোখে পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনে অমান্য ও বিদ্রোহ করেন। কবি এমন এক ব্যক্তি যিনি সময়কে অতিক্রম করেন নিজস্ব নতুন ভাবনাসময় দিয়ে – হয়ে ওঠেন সময়ের শাসক প্রভু। তবে অধিকাংশ সময় কবির ক্ষেত্রে কাল ও সময় একটি স্থানিক সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে দেয় – দিতে পারে। কবির অধিকার আসে তার উত্তরেধিকার থেকে। সে উত্তরাধিকার কী? তার জীবনলগ্ন জীবনের ইতিবৃত্ত – সমাজ রাজনীতি সংস্কৃতি প্রকৃতি – জনমনের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আর কী? জীবনের দর্শন ক্রিয়া, জীবনের দ্বান্দ্বিকতা, মনোজগতের দৃশ্য ও অদৃশ্যের সম্পর্ক– অর্থাৎ তাবৎ অভিব্যক্তিতে তার অনুভব ও অবস্থান। এ অনুভবে শিল্পী মানসিকতা বাধ্য বলে— শিল্পীকে স্থির থেকে অস্থিরতায়, গতিহীনতা থেকে গতিময়তায়, সন্ত থেকে অনন্তে তার বিরামহীন যাত্রা ও আবিষ্কারে নিরলস সচেষ্ট থাকতে হয়। জীবনান্দ দাশ এ বিষয়কেই বলেছেন ‘কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’। এ আবিষ্কার ছাড়া কবির কবিত্ব মহত্ত্বে পৌঁছায় না — আর পাঠককেও কবি কোনো আশ্রয় দিতে পারেন না। যাকে বলা যায় শিল্পের রসনায় ও ব্যঞ্জনায় শিল্পসুখী আনন্দের আশ্রয়। কবির নিজেকেই পরিবর্তন – পরিবর্তন –বিবর্তন ঘটাতে হয় আত্মতাগিদে। জগৎ ও সংসারের চলমানতার মধ্যে অসংগতিকে ধরে চিহ্নিত করা কবিসত্তার দায়িত্ব অনিবার্য বিষয়। জগতকে অনুভব করা, চিহ্নিত করা কবির কাজ—জগতকে পালটাবার কাজ কবির নয়। কবির কাজ জীবনের শিল্পিত-স্বপ্ন প্রকল্পের ছবি আঁকা — মানুষের মন ও চেতনার ভেতরে গিয়ে সংগোপনে বসে সংগুপ্ত বেদনাকে চারিয়ে দেওয়া। এবং সুন্দরের মুখশ্রীকে – অসুন্দরের বিরুদ্ধে সত্যের প্রেরণায় জাগিয়ে তোলা।
কবিতায় এই জাগরণের কাজ কবি তার নির্মিতি ও সৃজনকলার মধ্য দিয়ে করেন। আমরা জানি কবির চিত্রকল্প – মনোকল্প – চিন্তাকল্প –ধ্যানকল্প আসলে বাস্তব জগতেরই প্রতিফলন কবিমানসের প্রতিভাদীপ্ততার মধ্য দিয়ে। কবির মনোজগতে কবির ভাবনায় ও প্রকাশের বুদ্ধিময় –শিল্পময় স্নায়ুচিত্রে কিছু চিত্রকল্পীয় প্রকল্পনাস্তর জমা হয় —এই সঞ্চয় থেকে নির্মিত হয় দৃশ্যকল্প – যা কবি হৃদয়ের ভিশন –শব্দেসুরে ও প্রজ্ঞায় চিত্রকল্প নির্মাণ করে।
এখানেই মূর্ত হয়ে ওঠে বিমূর্ত–বিমূর্ত হয়ে উঠতে চায় মূর্তে। মূর্ত ও বিমূর্তের এই অনন্ত রহস্যের খেলা আরেক গভীর ছবি সৃষ্টি করে। হ্যাঁ, কবিকে জানতে হলে কবির চিত্রকল্প – চিত্রনির্মাণের মেধাবী ধরনকে বুঝতে হয়। তাতেই সনাক্ত হয় কবি চরিত্র কবি বৈশিষ্ট্য – সর্বোপরি জানা হয় কবিতাটি কেমন – কী ধরনের এবং কী কথা কেমন করে বলা হয়েছে এবং কবিতাটি পড়ে মন কেমন করে – কেমন বোধ জাগ্রত হয়। কবির চিত্রবোধই – সংবেদনবোধই তার কবি ব্যক্তিত্বে উদ্ভাসিত এক স্বতন্ত্র জগৎ। এখানেই আসল কথা—সারাৎসার এবং কবিরা চরিত্রে কে – কেমন।
আমরা জানি আমাদের আধুনিক চিন্তাবোধ ও কাব্যবোধ নির্মাণের প্রথম কবি—আধুনিক কবি মধুসুদন। তার চিত্রকল্পের মধ্যে আমরা প্রাচুর্য দেখি। তার উপমাই তার শব্দচিত্র তৈরি করে—গম্ভীরতা ও গভীরতায় আমাদেরকে নিমজ্জিত করে। রবীন্দ্রনাথে এসে দেখি তার চিত্রকল্পের মধ্যে অসাধারণ একটা তরল নদীগতিময় বিচিত্র রঙিন স্বাদের জটিলতা তার সৃষ্টিকে তার বাণীকে শব্দ ও সুরের সাধনসম্মিলনকে অনেক দূরে নিয়ে যায় – সে যেন পৃথিবী থেকে অন্তরিক্ষ বিস্তারী নক্ষত্র জগতের অভিসারী। আর একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই– রবীন্দ্রনাথই চিত্রময়তায় – চিত্ররূপময়তায় ছবির বিচিত্র অনন্ত রং এবং রঙের অর্থময়তার মানসকাঠামোকে বিচিত্র সজ্জা ও লাবণ্যে কাব্যময়তার উপমা ও আদর্শ দান করেছেন বেশি। তবে একথা মনে রাখা দরকার কবিতায় প্রতিমা নির্মাণ বা ইমেজ সৃষ্টি প্রতিভার অপরিহার্য লক্ষণ হলেও প্রতিমাসৃজন সর্বত্র সখ্য ও দক্ষতার দাবি নিয়ে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারে না। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের—ভাগবত থেকে গৃহীত অষ্টাবিধ প্রতিমা সবসময়ে কবিদের প্রয়োজনেও পড়ে না এবং কাজেও লাগে না। কারণ আধুনিক কবিও অলংকার চায় কিন্তু অতি সালংকারা হওয়াটা তার জন্য লজ্জার ও কাব্যের জন্য মানহানিকর। কারণ সে ব্যক্তিত্ব চায় – ভারবাহী ব্যক্তিত্ব নয়। সে চায় অন্যরকম কিছু – সহজ গতিময়তার আশ্রয়পুষ্ট এবং অবশ্যই নতুনের সৃজন কৃতিত্বের নন্দিত কিছু।
কবিতায় আমরা শুধু তথ্য চাই না – কেন চাই না? তথ্য কখনো কখনো ঋদ্ধতা ও সমৃদ্ধির পরিচায়ক কিন্তু স্থবিরতার কারণ ও হয়ে দাঁড়াতে পারে যথাযোগ্যতায় পরিমিতিবোধে যথাস্থানে স্থাপন করা না গেলে। ভালো কবিতার জন্য যা কাম্য নয়। তবে অনুভূতি ও বিভূতির সুপ্রযুক্ত প্রবাহ কবিতাকে উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির বর দান করে যা মূলত সৃজনকলার মৌলিক আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য। কবি বা লেখক-শিল্পীর বিশিষ্ট প্রোফাইল তৈরি করে কবির বৈশিষ্ট্যপুর্ণ মানসিকতা—যাকে আমরা বলি স্টাইল- কাব্যে কবিব্যক্তির পরিস্ফুটিত ব্যক্তিত্ব লক্ষণ। লেখকের চরিত্রমূলক মানসপ্রবণতা প্রকাশ পায় কখনো একান্ত সহজে কখনো সচেতন প্রয়াসে কখনো বা অজ্ঞাতে – তার যাপিত জীবন জীবনের উদযাপিত ভাবনা ও সমাজের পরিবেশ-প্রকৃতি আচরণ শিক্ষা এবং আহরিত জ্ঞান থেকে। কবি বা লেখক যে সমাজে বাস করছেন তার একটা মানসিক ভূগোল প্রতিষ্ঠার দাবি তার নিজের চেতনা যেমন করতে পারে তেমনি তার সমাজ ও তার কাছে অধীত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি দাবি করতে পারে। তবে তা বিশেষভাবে নির্ভর করে লেখকের শিল্পরুচি, চেতনাবীক্ষণ অর্থাৎ নিরীক্ষা-প্রবণতা ও নবনির্মাণ স্বপ্নপ্রচেষ্টার উপর যা তার মানসকাঠামোর পরিধি ও বিস্তারকে মানসিক পরিচর্যার চরিত্র হিসাবে তুলে ধরে – যাকে বলা যায় পরিমাপ ও পরিণাম চিন্তনে ‘পোয়েটিক ভিস্টাস’। সব কথার আসল কত্থা এখানেই –কবির আইডেন্টি নির্মাণে ও সজ্ঞান কাব্যিক আত্মপরিচয়ে। কবিতা যেহেতু শিল্প এবং অবশ্যই মানবজাতির মহত্তম আবিষ্কার ও সম্পদ সেহেতু কবিতার আলোচনায় কিছু নম্র-জটিল কথন থাকেই। কারণ কবিতাবিচারে—কবির শক্তি, রচনাকৌশলের মেধা-প্রতিভা, সংস্কৃতি বা কাব্যগত ব্যুৎপত্তি আর অভ্যাস অর্থাৎ চলন ও বোধন গতি দেখাটা জরুরি হয়ে পড়ে। কবি কতটুকু ধ্বনিব্যঞ্জনা বা ‘সাজেস্টেড সেন্স’কে ধরতে পেরেছেন সেটাই বড় কথা অবশ্য।
গ্যেটে আলোচনা-সমালোচনাকে ভাগ করেছেন দুই ভাগে—একটা হচ্ছে নেতিবাচক-ধ্বংসাত্মক এবং অন্যটা সৃজন-মূলক। রবীন্দ্রনাথ এবং ক্রোচে-কোলরিজরা যেমন ভাবতেন– সমালোচনার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কবির বিধৃত আদর্শ ও লক্ষ্যকে স্পর্শ করা। আমরা যখন স্পর্শ কথাটি ব্যবহার করি তখন এ কথাই প্রকাশ করতে চাই যে সৃজিত বিষয়ে অবলোকন ও অতীতপ্রজ্ঞা কতটা বিষয়ভেদী ও অন্তর্বেদী হয়ে উঠে কবিকে ও কবিতাকে কতটা আলোকনে সমৃদ্ধ করেছে। এ কথা কখনোই ভুললে চলে না যে— প্রকৃত কবির রচনা বা সৃজন কর্মই তার স্নায়ুবোধে অর্জিত আত্মিক-দৈহিক মানসজগতের ভাষা ও চিন্তনরূপ। কার্লাইল আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন– “criticism stands like an interpreter between the inspired and the uninspired …”। কেন এ কথাটি এ রকম করে বললেন? আমার মনে হয় তিনিও আমাদের মতো বিশ্বাস করেছিলেন— সাহিত্যের যত চিরন্তনতা বা প্রকাশের অভিনব যে শিল্পস্বাতন্ত্র্য তা কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিমননের অভিব্যক্তি। বোধ ভাবনা আবেগ অনুভুতি আকাঙ্ক্ষা ঘৃণা বেদনা দুঃখ প্রেম ভালোবাসা প্রকৃতি ও জীবনের সমূহপ্রবৃত্তি সৃষ্টির এক আশ্চর্য রহস্যময়তার প্রকাশ ও বিকাশ এবং আবিষ্কার ও উদ্ধৃতি। সে কারণেই সাহিত্য চিরকালই বহমান – জন্ম ও জন্মান্তর, নির্মাণ ও বিনির্মাণ এবং প্রতিনির্মাণে–নির্মিতিতে সচেষ্ট সক্রিয় কবির চেতন প্রকাশের সম্পদ।
কবিতায় এই জাগরণের কাজ কবি তার নির্মিতি ও সৃজনকলার মধ্য দিয়ে করেন। আমরা জানি কবির চিত্রকল্প – মনোকল্প – চিন্তাকল্প –ধ্যানকল্প আসলে বাস্তব জগতেরই প্রতিফলন কবিমানসের প্রতিভাদীপ্ততার মধ্য দিয়ে। কবির মনোজগতে কবির ভাবনায় ও প্রকাশের বুদ্ধিময় –শিল্পময় স্নায়ুচিত্রে কিছু চিত্রকল্পীয় প্রকল্পনাস্তর জমা হয় —এই সঞ্চয় থেকে নির্মিত হয় দৃশ্যকল্প – যা কবি হৃদয়ের ভিশন –শব্দেসুরে ও প্রজ্ঞায় চিত্রকল্প নির্মাণ করে।
আমি কিন্তু এ কথা সর্বাংশে মানি যে- কবিতাকে ভোগ উপভোগ করতে হলে আলোচক–সমালোচকের দ্বারস্থ হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। কারণ পাঠককেই কাব্যের শ্রীসৌন্দর্য বিশিষ্ট বিখ্যাত জেলের প্রযত্নে আবিষ্কার ও ধরে আনতে হয়। এখানেই সহৃদয় পাঠকের কিছু দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে—অনধিগম্যকে গম্য করার – অদৃশ্য রস ও রূপকে মননে দৃশ্যায়িত করার সাধারণ অথচ অসাধারণ কাজটি করতে হবে। তবে আলোচককে–আলোচনাকে সাহিত্য ও শিল্পবোধ অর্জনে আমি বিবেচকের কাজ মনে করি না। কারণ প্রত্যেক বিদ্যারই কিছু মৌলিক ও প্রাথমিক করণকৌশল আছে – তাকে জানতে সূত্রধরের সাহায্য নেয়াটা অগৌরবের নয় – বরং গৌরবের কাজ। ভালো আলোচক বোদ্ধা আলোচক বোধিসম্পন্ন আলোচক ঋষি – সম্পদে ধনবান আলোচক মহৎ কাব্যের রূপকে গোপনের অবগুণ্ঠন থেকে রহস্যের চাবিকাঠি দিয়ে ইঙ্গিতময়তার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বোধের চলচ্চিত্র করে তুলতে পারেন। এবং পারেন বলেই সাহিত্য নিজেকে উদ্ভাসনের সুযোগ নেয়—পাঠকও উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেন।
থাক এবার – আবার কবি তৌহিদ আহমেদের সৃষ্টি ও নির্মাণ ‘কোমল গান্ধার’ এর দিকে ফিরে যাই। কোমল গান্ধারে পৌঁছানোর জন্যই এতক্ষণের সমস্ত আলাপ আয়োজন। প্রথমেই বলে রাখি আমার মনে হয়েছে – আমার দৃষ্টির বিবেচনায় ‘কোমল গান্ধার’ রচনায় এবং কাব্যসৃষ্টির যোজনায় কবির দীর্ঘদিনের ধৈর্যশীল মানসপরিকল্পনা ছিলো। চৌদ্দশ’ লাইনের পরিমিতিবোধের কাব্য উপহার সহজ বিষয় নয়। সমগ্র কাব্যটির রূপ – কলা –নির্মিতি ও সার্বিক শিল্পবোধকে বুঝতে হলে দীর্ঘ আলোচনা– প্রসঙ্গের প্রয়োজন। দীর্ঘ আলোচনায় কাব্যপিপাসু কাব্যদরদী পাঠক বিব্রতবোধ না করলে ও [সৌভাগ্যবশত] আমি নিজেই বিব্রত ও অস্বস্তিবোধ করবো – কারণ আমার আলস্যই আমার শিল্প—মহৎ সৃষ্টি। যাক ওসব ব্যক্তিগত আশয় নিয়ে কথা না বলাই ঊত্তম। জোবেয়ার – ফরাসি চিন্তুক ও বোধের রসিকমানুষ যিনি—তিনি বলতেন ‘আমি রোপণ করি না বপন করি। আরো বলতেন ‘আমি কথার ভেতরে ওজন খুঁজি মূল্য খুঁজি – কথার সারাৎসার খুঁজি – কোনো তথ্য নয়’।
তৌহিদ আহমেদের ‘কোমল গান্ধার’ এর কাব্যকথা বলতে গিয়ে সে রকম পরামর্শেরই আশ্রয় নিতে চাই। ১৯৯৭ সালের কথা। তৌহিদ আহমেদ চাকরি উপলক্ষে তখন চট্টগ্রামে। তৌহিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো। বলতে গেলে চট্টগ্রাম তার নিজেরই শহর। আমাদের একটা আড্ডা ছিলো—‘জলযোগ আড্ডা’। চট্টগ্রামের নামকরা বনেদি মিষ্টি ও চায়ের দোকান। রেয়াজুদ্দিন বাজারের বিপুল জনকুণ্ডলের ভেতরেও ‘জলযোগ’ এর বিখ্যাত আড্ডাটি ছিলো সাহিত্য-শিল্প-নন্দনের মানুষদের সকাল-সন্ধ্যা-রাত গভীরের মেলা। জলযোগের মালিক [বর্তমানে প্রায়াত] সুধীর নাথও ছিলেন শিল্পপিপাসু রসিক মানুষ। আমাদের মাথায় [কবি স্বপন দত্ত, ফাউজুল কবির, কবি আবসার হাবীব, এবং কবি তৌহিদ আহমেদ] একদিন প্রচণ্ড শিল্পমাদকতা পূর্ণ ঝোঁক চাপলো। ১৯৯৭ এর একুশে উপলক্ষে স্মরণযোগ্য কোনো কবিতাকাজ করতে হবে – যা আমাদের শিল্পমেধার পরিচয় বহন করবে। পরিকল্পনাটা এসেছিলো আমাদের প্রিয় ও অগ্রজসমান কবি স্বপন দত্তের কাছ থেকেই। পরিকল্পনাটা এমন – চারজন কবি লিখবেন ৪টি দীর্ঘ কবিতা –যা আমাদের শিল্পমেধাকে প্রতিনিধিত্ব করবে। প্রতিটি কবিতা হবে ১৬ পৃষ্ঠার। ৪টি কাব্যই একটি প্যাকেট আশ্রয় নেবে। গ্রন্থগুলো ঋদ্ধ ও সুসজ্জিত হবে। স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের মর্মান্তিক কালো বর্বরতম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপট ও আত্মজৈবনিক শিল্প চিন্তন থেকে রচিত হলো ৪টি কাব্যগ্রন্থ। কবি স্বপন দত্ত লিখলেন ”জেগে আছি ভালোবাসা একুশ বছর”। ফাঊজুল কবির লিখলেন ”একা হলে জলতরঙ্গ নীলকণ্ঠ বাউল”। কবি আবসার হাবীব লিখলেন “জয় হোক মানুষের”। কবি তৌহিদ আহমেদ লিখলেন “ও মুজিব ও জীবন্ত বিষাদ”। ৪টি কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিশিষ্ট শিল্পী চন্দ্রশেখর দে। প্রকাশ করলেন চট্টগ্রামের অর্ক প্রকাশনী। ৪টি অনন্য গ্রন্থ প্রকাশের পর আমাদের মধ্যে একটা গভীর স্বস্তি শিল্পের প্রতি আনুগত্য ও দায়বদ্ধতার অনাবিল আনন্দও জেগেছিলো। কবি-প্রফেসর মোহিত উল আলম দারুণ প্রযত্নে চারটি গ্রন্থেরই চমৎকার হৃদয়গ্রাহী আলোচনা লিখেছিলেন চট্টগ্রামের ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ এর সাহিত্য সাময়িকিতে। চারটি গ্রন্থের উপর আরেকটি সুন্দর আলোচনা ‘দৈনিক পুর্বকোণ’ সাহিত্য পাতায় তুলে ধরেছিলেন কবি ওমর কায়সার। পরে বিজন মজুমদার সম্পাদিত আমাদের সাহিত্যপত্র ‘বাকপ্রতিমা’য় কবি ও গল্পকার রবিন ঘোষ তিনটি গ্রন্থ নিয়ে চমৎকার আলোচনা উপস্থাপন করেছিলেন।
আমার বিশ্বাস ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত ও জীবনের এবং অসীম ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে গড়ে উঠেছিলো যে বাংলাদেশ—তার প্রাণপ্রিয় মহান নেতা জনক-স্থপতিকে কেউ হত্যা করে ইতিহাসের বিজয়ী ধারাকে ভিন্ন স্রোতে পরিচালনার অপচেষ্টা চালাতে পারে বা চালাবে একথা কেউ কল্পনা ও করেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির ইতিহাসে দেশদ্রোহী ঘাতকেরা সেই নির্লজ্জ ঘটনাই ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি রাজনীতির কবি-নেতা [পোয়েট অফ পলিটিক্স] বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের [১৫ আগস্ট ১৯৭৫] তাঁর স্মৃতিতে ও স্মরণে এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গোপনে অগোপনে অনেক কাব্য-সাহিত্যই রচিত হয়েছে। রচিত হয়েছে অমর পংক্তিমালা—অন্নদাশংকর রায়ের – ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী বহমান / ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। রচিত হয়েছে আরো অনেক অসাধারণ কাব্য সংগীত নাটক সাহিত্য। এদের মধ্যে কবি তৌহিদ আহমেদের ‘ও মুজিব ও জীবন্ত বিষাদ’ শব্দে ছন্দে আবেগে মুজিবের স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণে এক অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি হয় তো অনেকের চোখে পড়েনি। কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতি অনেকের দৃষ্টিকে ভয়ার্ত করে রেখছিলো। নতুবা এই চমৎকার কাব্যগ্রন্থটি আলোচিত হলে মুখে মুখে ফিরতে পারতো এর স্মৃতিকাতর বেদনাঘন নস্টালজিক পংক্তিমালা। আমাদের ৪টি কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কভার পৃষ্ঠায় আমরা নিজেদের কাব্য সম্পর্কে এবং রচনার উদ্দেশ্য বৃত্তান্ত লেখার ব্যবস্থা রেখেছিলাম। চারজন কবিই খুব স্বল্পপরিসরে নিজেদের অসাধারণ আবেগ কাব্যবিশ্বাস ও জীবনতৃষ্ণাকে প্রকাশ করেছিলো। ‘ও মুজিব ও জীবন্ত বিষাদ’ কাব্যে তৌহিদ যে সংক্ষিপ্ত প্রত্যয়ন মুদ্রিত করেছিলো তা এ রকম। “মগজের ভিতর দাউদাউ ক্রোধের আগুন। স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নে ভরা দিনগুলি একটা বিপর্যস্ত সময় যাপন। দুঃস্থ, ক্ষতবিক্ষত আর মর্মান্তিক জীবনস্রোত। আলোড়িত দেশকাল। চোখের সামনে মিছিলের উপর উঠে যায় ঘাতক ট্রাক। লালদীঘিতে টইটম্বুর জনসভায় চলে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। হত্যা। ধর্ষণ। বরিশালে কলেজ ক্যাম্পাসে স্মৃতিকণা বিশ্বাস। দিনাজপুরে চলতি ভ্যানে ইয়াসমীন। আর চট্টগ্রামে পুলিশ ফাঁড়িতে সীমা। ভীষণ সব সর্বনাশ দেখতে হয় চোখ মেলে। এর মাঝে ব্যক্তিগত বিষাদ আর ফেলে আসা ম্লান মফস্বল বুকের ভিতর কবিতা পড়ে। এখানে আলো নেই, আশা নেই, এমনকি ভালোবাসা নেই। তবু আমার বুকের ভিতর মেঘ ও জলের ভিটেমাটি। আর তাই কবিতার দরোজায় মাথা কুটি। শব্দ–ছবিতে জেগে ওঠে এক অনন্য মানুষের মূখ, এক তুলনাহীন স্বপ্নের দেশ। আনন্দের আর বিষাদের।”
এ হচ্ছে সময়ের- তৎকালীন সময়ের মানচিত্র – সমাজ ও ভৌগোলিক চিত্র। আকাশভাঙ্গা বেদনার চিত্র। এই চিত্রই নির্বাচিত শব্দ – ঘ্রাণে কাব্যিক রূপ নিয়েছে ‘ও মুজিব ও জীবন্ত বিষাদ’ কাব্যগ্রন্থে। দীর্ঘ কবিতা – কাব্যগ্রন্থের সনেটীয় প্যাটার্নের শেষ ১৪টি লাইন উদ্ধৃত করছি—
“তুমিও নিহত পিতা ক্রুশবিদ্ধ ঈশার মতন / তবুও রয়েছ বেঁচে ধানখেতে শিষের ভিতরে / অনেক স্মৃতির কষ্ট উর্দ্ধাকাশে তারার পতন / তবুও রয়েছো বেঁচে কিষাণের ম্লান কুঁড়েঘরে।
তোমার কবরে বাতি বারোমাস জ্বেলে রাখে চাঁদ / নদীর জলের গন্ধে অবিরাম তোমার নিঃশ্বাস / বিষাদ মেঘের ধারা ঝরে জল প্রাণের বিশ্বাস / বাতাস তোমার ভাষ্য নিশিদিন করে অনুবাদ।
বটের শীতল ছায়ে যেন তুমি কতোকাল ঘুমে / এদেশ মানুষ নদী তোমার নিকটে ঋণী / অফুরন্ত মাঠ নদী তোমার চরণ যায় চুমে / তোমার কবরে ফুল ভালোবাসা ফোটে প্রতিদিনই।
তুমিও নিহত পিতা ক্রুশবিদ্ধ ঈশার মতন / অনেক স্মৃতির কষ্ট উর্দ্ধাকাশে তারার পতন।”
(ও মুজিব ও জীবন্ত বিষাদ)
কবিতাংশটি কবির তীরবদ্ধ অথবা ক্রুশবিদ্ধ হৃদয়ের বেদনচিন্তনকে সমগ্র জাতির আত্মার ভেতরে এক ভৌগোলিক হাওয়ায় রোপণ করে দেয় যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়কে। এখানেই তৌহিদ বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের এবং মুক্তিযুদ্ধের কবিপুত্র। ব্যক্তির শোককে সমষ্টিতে ব্যাপ্ত করার কাজই কবির কাজ। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব- মহত্ত্বকে উদযাপন করে কবি মহৎ কাব্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ‘ও মুজিব ও জীবন্ত বিষাদ’ নিয়ে কথাবলি আর বাড়াবো না। শুধু বলে রাখি “শিল্পের একটা মুলমন্ত্রই হচ্ছে ‘নালমতিবিস্তরেণ’। অতিবিস্তরে যে অপর্যাপ্ত রস থাকে, তা নয়। অমৃত হয় একটি
ফোঁটা, তৃপ্তি দেয় অফুরন্ত।” একথা আমার নয় –মহৎ শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
কবি মোহিতলাল মজুমদার তাঁর কোনো একটি কবিতায় বলেছিলেন– ‘সত্যেরে চাহি না তবু, সুন্দরেরে করি আরাধনা’। কবিতার রহস্য আশ্চর্যবোধকতা অথবা মায়া এখানেই। তীর্যক–শিল্পিত বাঁকাভঙ্গিতেই প্রকাশ। সুন্দরেরে যতটা চাই – তার চেয়ে বেশি চাই সত্যকে-শিল্পের সত্যকে। আর সত্যকার কবিতার বিষয়ে মনের ও প্রাণের সত্যকথাটি সাধারণ ভাষায় অসাধারণ বচনে কথাটি বলে ফেলেছেন ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— যেখানে এসে কাজ শেষ হয়ে যায়— কিন্তু বলা শেষ হয় না – সেখানেই জন্ম নেয় মহৎ কবিতা।
আরো একটা কথা বলাটা সঙ্গত মনে হয় কবিতার স্বার্থে– কথাটা হঠাৎ করেই মনে এসে উঁকি মেরে গেলো তাই ভাবলাম বলেই ফেলি। কথাটা এই— কবির ব্যক্তিগত মন-রুচি-ধারণার পরিচয় জানাটা যেমন প্রয়োজন — তার চাইতেও কবির স্বকাল-সমকালটাকে জানাটা বেশি জরুরি মনে হয়। কেন কথাটা এমন করে বলা হয়? বলা হয়— এ কারণে যে—কাল-সময় ব্যক্তি- সমাজ-ইতিহাস মনকে প্রভাবিত করে বদলে দেয় – দিতে পারে। ফলে ব্যক্তিমন কালের স্বভাব চরিত্র ও চিহ্নকে ধরে রাখে। নৈর্ব্যক্তিক শিল্পের ক্ষেত্রে এ কথাটি বেশি খাটে—কারণ সেখানে ব্যক্তিত্বের বিসর্জন ঘটে। ব্যক্তিত্বের বিসর্জনের ভেতর দিয়েই নৈর্ব্যক্তিক সাহিত্যের জন্ম হয় – সাহিত্যতাত্ত্বিকরা এ কথাই বলেন। যদিও কথাটি সর্বাংশে খাঁটি বা সঠিক বলে নেয়া যায় না। যে রোমান্টিক সাহিত্য-শিল্প ব্যক্তিকে বিসর্জন দেয় না, সে সাহিত্য ও তো কালের কথা জীবনের কথা সমাজের কথা বাস্তবতার কথা বলে – বলে ফেলে –বলে ফেলেছে এবং বলা হয়েছে তার ভুরিভুরি প্রমাণ সাহিত্যে আছে।
‘Poetry is the breath of inner spirit of knowledge’—ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর এ কথাকে বিস্মৃত হবার উপায় দেখি না। তবে যেভাবেই হয়ে উঠুক কবিতা আসলে নির্মাণ নয় [যদিও সাধারণ অর্থে সাধারণত বলে থাকি] নির্মাণের চেয়ে অধিক গভীর অর্থবাহী সৃজনাত্মার নির্মিতি। কথাটাকে আরেকটু পরিচ্ছন্ন খোলাসা করে বলতে গেলে বলতে হয় নির্মিতি হচ্ছে কারিগরি বুদ্ধিমত্তা বা কারিগরি পারদর্শিতার চেয়ে ও সূক্ষ্ণতম গভীরতর সুন্দরের অর্থবোধক কাজ। এই নির্মিতির যজ্ঞে কবিকে হয়ে উঠতে হয়—নিজেকে নির্মিতি ও নির্মাণের যৌথক্রিয়ার সাধনার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। কবিকেই তার মানসভুবন কর্মশালার মধ্য দিয়ে বলতে হয়— আমিই কবিতা আমিই শিল্প।
এবার কবিতা ভাবনা ও শিল্প চেতনার আলোকে কবি তৌহিদ আহমেদের ‘কোমল গান্ধার’ এর জীবনচিন্তন কবিবোধ বিষয়-আশয় শিল্পবোধ রসবোধ প্রকাশবোধ এবং নির্মিতিবোধের একটা চুম্বক ধারণা তুলে ধরতে চাই। কোমল গান্ধার গ্রন্থিত হয়েছে ৭০টি কবিতা দিয়ে। কবিতাগুলির কোনো শিরোনাম নেই। প্রতিটি কবিতা অন্ত্যমিলের ২০টি লাইনে শৃংখলিত। অর্থাৎ কোমল গান্ধারের কবিতাগুলি বিষয়ী ধ্যানের শিল্প চেতনে আত্মিকবন্ধনে আলিঙ্গনাবদ্ধ। অসাধারণ লিরিকবোধের কাব্যগ্রন্থ বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য জীবনের সম্মিলনী সংস্কৃতিবোধের ‘কোমল গান্ধার’ শুধু বোধিমান পাঠককে নয়—সাধারণ পাঠককেও সহজেই টেনে নেবে বুকে। ছন্দের ও বিষয়ের সহজিয়া আকর্ষণ পাঠককে দূরে যেতে দেবে না। তৌহিদের টনটনে ছন্দজ্ঞানই তাকে মর্মস্পর্শী কুশলী আত্মবিশ্বাসী লিরিক কবিতে পরিণত করেছে। তৌহিদকে বোঝার জন্য তার কাব্যহৃদয়ে প্রবেশের জন্য একটি ইঙ্গিতময় ঋদ্ধ আলোচনার জন্য আমি তার ৭০টি কবিতা থেকে কিছু উজ্জ্বল পংক্তিমালা উদ্ধার ও উদ্ধৃত করবো যাতে তার কবিস্বভাব নির্মিতির চরিত্র বিষয়ী প্রকাশের প্রজ্ঞাময়তাকে একটি গুচ্ছ ধারণায় প্রকাশ করা যায়। এবং একটি ইঙ্গিতময়তার মাধ্যমে তার কাব্যসত্তা ও কবি ব্যক্তিত্বের পেছনের রহস্যকথাটি যেন ধরিয়ে দেয়া যায়। শ্যামলীর ‘আমি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “মানুষের অহংকার পটেই / বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প”। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করলাম একারণে শিল্পীদের অহংপটে কীভাবে বিধৃত হয়ে মানুষের অন্তরে ছড়িয়ে যায় বিশ্বকর্মার শিল্পবোধ।
‘কবর’ কবিকে এতটা আবিষ্ট- আচ্ছন্ন করেছে কেন? কেন কবর ও মৃত্যু তার কবিসত্তাকে লগ্ন ও মগ্ন করেছে। এই কবর ও মৃত্যু কী আমাদের সমগ্র জাতির বেদনাঘনতার অস্তিত্বময় পরিচয়। জাতির বেদনার সাথে কবির ব্যক্তিগত জীবন চেতনার বেদনাও কী হৃদয়মথিত ক্যানভাসে উঠে এসেছে? কারণ আমার জানা মতে একমাত্র কবি জসীম উদদীন এর অসাধারণ ‘কবর’ কবিতা ছাড়া আর কোনো কবির কবিতায় মৃত্যু-বিষয়ের এতটা চয়ন দেখা যায় না।
এবার দেখা যাক ‘কোমল গান্ধার’ এর উজ্জ্বল পংক্তিসমূহ। যদিও পংক্তিসুমূহ বাছাই করে তাদেরকে প্রতিনিধিত্বে স্থান দেয়া একান্ত কষ্টকর। কারণ কোনো পংক্তিই আরেকটি পংক্তির আত্মীয়তার সম্পর্কের সঙ্গতিকে ছেড়ে পৃথক ব্যক্তিত্বে আসতে চায় না সামগ্রিক ঐক্যের বন্ধন থেকে। কাব্যটি পাঠ করলে পাঠক নিজেই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। ‘কোমল গান্ধার’ থেকে গৃহীত উদ্ধৃতি—
কবিতা [এক]
‘তেরশ’ নদীর জলে ভেসে যায় জনপদে শতাব্দীর প্রিয় ভদ্রাসন/
বিপন্ন বসত বাড়ি ঢুকেছে ফুলের বনে অন্ধ এক মত্ত হনুমান’
কবিতা [দুই]
‘ফেটেছে শিমুল বীজ বৃক্ষদের নবজন্ম অপেক্ষার রঙিন দুপুর/
নির্জন মাঠের ধারে সুন্দরের আরাধনা বেজে উঠে সোনার নূপুর’
কবিতা [তিন]
‘কবর খোঁড়ার শব্দে মাঝরাতে জেগে উঠে ধুপবাতি শ্বেত গন্ধকাঠ/
রাতের পোশাক পরে নক্ষত্রের রাজকন্যা খুলে রাখে গোপন কপাট’
কবিতা [ছয়]
‘আতর গোলাপ মেখে অন্ধকারে শুয়ে থাকে প্রতিদিন শব্দহীন ঘর/
বিষণ্ণ পাখিরা এসে করুণ আয়াত পড়ে শোকাতুর মাটির কবর’
কবিতা [সাত]
‘আমরা কোথায় যাবো সবুজের মানচিত্রে রক্তপাত গুমখুন ভীতি/
আমরা দ্রাবিড় জাতি আমাদের বীজমন্ত্র ভালোবাসা ধর্মের স্মপ্রীতি’
কবিতা [দশ]
‘দূরের দরিয়া হতে ফিরে আসে জেলে নাও ইলিশের ঝলমলে দিন/
মাঠের ওপারে শুয়ে কবরে ঘুমিয়ে যারা তারা আজ শীতল কফিন’
কবিতা [এগার]
‘যমুনা ঘুমিয়ে গেছে মহানন্দা নিরুদ্দেশ লুপ্তপ্রায় গোমতির জল/
যাবার সময় হলে অন্ধকারে ডুবে যায় জীবনের অন্তিম গজল’
কবিতা [চৌদ্দ]
‘ডুবেছে সোনার তরী গন্তব্যের কাছাকাছি নাবিকেরা করিয়াছে ভিড়/
জলের উজানে ভাসে জলের প্রহরী তিনি জলজন্ম খোয়াজ খিজির’
কবিতা [ষোল]
‘বাতাসে বারুদ গন্ধ সভ্যতার অন্ধকারে রক্তমাখা শ্বেত কবুতর/
তেরশ’ নদীর জলে অবিরল স্রোতধারা অন্তহীন মৃত্যুর খবর’
কবিতা [উনিশ]
‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে নিবেদিত শব্দ পাঠ স্রোতস্বিনী জাহ্নবীর জলে/
লৌকিক সাম্পানে ভাসে প্রতিভার বটবৃক্ষ শতাব্দীর গোপন অর্গল’
কবিতা [পঁচিশ]
‘কবরে ঘুমিয়ে থাকে মৃত্তিকার অন্ধকারে ছাইরঙ্গা মাটির পুতুল/
জলের কল্লোল তুলে কৈবর্তের সন্তানেরা ফিরে আসে দরিয়ার কুল’
কবিতা [ছাব্বিশ]
‘পবিত্র প্রভুর নামে পাঠ করি আলোকিত কিতাবের করূণ আয়াত/
অসহ্য সুন্দর তিনি তাঁর কাছে নতজানু সেজদায় আমার হায়াৎ;
কবিতা [বত্রিশ]
‘কবিরা ঘুমিয়ে আছে কবরের আঙিনায় শোণিতাক্ত শব্দাক্ষর বুনে/
মৃত্যুর জানাজা পড়ে বনের পাখিরা এসে ঝাঁপ দেয় জুমের আগুনে’
কবিতা [পঁয়ত্রিশ]
‘প্রতিটি যুদ্ধের শেষে অনিদ্রায় জেগে থাকে সভ্যতার দীপ্র বাতিঘর/
পাথরে ঘুমিয়ে থাকে রাত্রিরূপ মৃত আত্মা অলৌকিক আশ্চর্য কবর’
কবিতা [সাতচল্লিশ]
‘কালের মলিন ধূলা জাদুঘরে পড়ে আছে আশরাফি সোনার মোহর/
ফকির লালন শাহ অনন্ত বিরহে কাঁদে ছেঁউড়িয়া লালনের ঘর’
কবিতা [সাতান্ন]
‘বন্ধুর কবরে শুয়ে মৃত্যু শোকে পাঠ করি ছন্দময় করুণ আয়াত/
উদ্যত সাপের ফণা চারিদিকে মন্ত্রপাঠ পরাজিত কবির হায়াৎ’
কবিতা [ঊনষাট]
‘নিজের কবরে শুয়ে মৃত্যুকে জেনেছে সত্য অন্ধ এক সাদা বক পাখি/
যাবার সময় হলে বনপোড়া হরিণীরা জলের ভাষায় যায় ডাকি’
কবিতা [তেষট্টি]
‘কবিরা হারিয়ে গেলে কবরের মাটি দিয়ে লিখে রাখে স্তব্ধ এপিটাফ/
আকাশে বাড়িয়ে গলা সারারাত স্বপ্ন দেখে ছাইরঙা পাথ্রে জিরাফ’
কবিতা [সাতষট্টি]
‘সোনার আলোয় দীপ্ত নালন্দার পাঠগৃহে মহাজ্ঞানী অতীশ শ্রীজ্ঞান/
প্রতিটি যুদ্ধের শেষে আমাদের ঘরে ঘরে স্বজনের রক্তেভেজা ধান’
কবিতা [সত্তর]
‘জয়ের পতাকা ওড়ে খোলা ছাদে মাঠে মাঠে নদীগন্ধ রূপশালী ধান/
শীতের শিশির ঝরে ভোরবেলা ফুটে থাকে আলমুগ্ধ ফুলের বাগান,
– ——–
– ——–
তেরশ’ নদীর দেশে বাতাসে আসছে ভেসে বিশালাক্ষ্ণী নদীর খবর
ঘরের ভিতরে ঘর মানুষ ঘুমিয়ে আছে জেগে আছে মাটির কবর’।।
কাব্যটি – মানে ‘কোমল গান্ধার’ শেষ হয় এভাবে– ‘ঘরের ভেতরে ঘর’ এবং ‘মানুষ ঘুমিয়ে আছে’ এবং ‘জেগে আছে মাটির কবর’। প্রশ্ন জাগে এ কেমন সমাপ্তি! একটা মন কেমন কেমন করা সমাপ্তি। উদ্ধৃত অংশগুলো পাঠ করলে পাঠক বুঝে যাবেন সমগ্র কাব্যের মনন ও মেজাজ এবং কবি হৃদয়ের চরিত্র শিল্পজ বেদনাবোধ। তৌহিদ আহমেদ বাংলাদেশের সন্তান এবং তিনি বাংলাভাষা বাঙালি জীবন ও প্রকৃতিবোধ—বাংলাদেশ নামক দেশটির মানুষ – মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রকৃতি আকাশ নদী প্রাণের সুখ- দুঃখময় প্রবাহের রূপময়তা চিত্রময়তা লিরিকতাপূর্ণ জীবনবেদের কবি। হাজার বছরের ব-দ্বীপিয় ভূখণ্ডের মানবের মানসিক ভূগোল ঐতিহ্য সংস্কৃতি সংগ্রামের ইতিহাস মুক্তিচেতনা স্বাধীনতা সংগ্রাম যুদ্ধ রক্তদান জাতির জনকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীরতম হাহাকার সব কিছুকেই কোমল গান্ধারে তুলে এনেছেন কবি-শিল্পীর প্রযত্নে। আমার কেন জানি মনে হয় মার্কিন কবি সিডনি লেনিয়ার [১৮৪২-১৮৮১] এর কাব্যবিশ্বাসের প্রতি জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তৌহিদের একটা মানস সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সিডনি লেনিয়ার তাঁর সেমিনাল পোয়েম ‘সিম্ফনি’ শেষ করেছেন এভাবে— ‘মিউজিক ইজ লাভ ইন সার্চ অফ ওয়ার্ড’। কথাটি মনে এলো তৌহিদের কবিতার ধ্বনিত-সুর মাধুর্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। দেশপ্রেম মাতৃভূমি এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কবি হয়ে ওঠেন সর্বাংগসুন্দর মাটির মানুষ–জীবনের কবি। তেরশ’ নদীর কথা তাকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করে রাখে – ১৩ শত নদী মানে বাঙালি জাতি বাঙালির প্রবহমাণ সংস্কৃতি–প্রাচীন অস্ট্রিক–দ্রাবিড় মিলিয়ে অধুনাতন বাঙালি সত্তা। তার শব্দ চয়ন ও শব্দ ব্যবহারের দিকে তাকালেই দেখি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সমাজ জীবন–ধর্ম বর্ণ- জাতি নির্বিশেষে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান পার্বত্য জনসম্প্রদায়ের – সকলেরই সমাবেশ ঘটেছে। জীবনের কথা মৃত্যুর কথা যুদ্ধ রক্ত রক্তমাখা ফসলের কথা নদী আর ধীবর জীবনের কথা বারবার এসেছে এবং এসেছে বাংলাদেশ ও বাঙালি জীবনের আশা ও আকাঙ্ক্ষার আনন্দ-বেদনার প্রাণ স্পর্শী প্রচ্ছদ নির্মাণের জন্য। বারবার ঘুরেফিরে এসেছে লোবানের ঘ্রাণ এবং মৃত্যু এবং কবর। ‘কবর’ কবিকে এতটা আবিষ্ট- আচ্ছন্ন করেছে কেন? কেন কবর ও মৃত্যু তার কবিসত্তাকে লগ্ন ও মগ্ন করেছে। এই কবর ও মৃত্যু কী আমাদের সমগ্র জাতির বেদনাঘনতার অস্তিত্বময় পরিচয়। জাতির বেদনার সাথে কবির ব্যক্তিগত জীবন চেতনার বেদনাও কী হৃদয়মথিত ক্যানভাসে উঠে এসেছে? কারণ আমার জানা মতে একমাত্র কবি জসীম উদদীন এর অসাধারণ ‘কবর’ কবিতা ছাড়া আর কোনো কবির কবিতায় মৃত্যু-বিষয়ের এতটা চয়ন দেখা যায় না। অনুসন্ধিৎসু পাঠক–গবেষকরা এ বিষয়ে ভাবতে পারেন। সব মিলিয়ে ‘কোমল গান্ধার’ বাঙালি জীবনসত্তার বেদনাঘন এক প্রচ্ছদ কাব্য।
তৌহিদ আহমেদ মূলত বেদনা ও বাঙালির চিরায়ত জীবন সুন্দরের কবি। বেদনা ও প্রশান্তি যেন যুগপত বাউল জবানে। তৌহিদের গভীরতম আবেগ তার বেদনাকে অন্তর্লীন অন্তর্মননে এতটাই লিরিক–গীতল করে তোলে যে মনে হয় তার বুকের মধ্যে সর্বক্ষণ বাউলরোদন চুপ করে বাসে থাকে। যেটাকে আরেকজন পাকাবাউল ছাড়া ধরতে পারে না বলে তাকে অনেকেই সহজের কবি ভেবে বসে থাকেন। আধুনিক সাহিত্য বা বিশ্বের কবিচিত্তের বিচিত্র প্রবণতা চরিত্র লক্ষণকে যাদের জানা আছে— বোধের মাত্রায় লিরিসিজমের গভীর নির্মিতি-করণকে যারা জানেন তারা বোঝেন সহজের কবিতা সহজ নয়। তার ছন্দ নদীর গতিতে ঝর্ণার গতিতে হৃদয়ের মৃদুল সুন্দরে নিয়ে যায় – যেখানে শব্দগুলি সুর তোলে স্বর জাগায় এবং চলমান বাক্যবন্ধে ছন্দভ্রমণে মাতাল মদ্য শুভ্রতাকে শব্দের ঘ্রাণে ছড়িয়ে দেয়। তৌহিদ বাংলাদেশের মাঠঘাট ফুল পাখি জনতাজীবনের মমতার কবি । তার গ্রাম হরিপুর তার আইডিলিক জীবন ভাবনার আর্কেডীয়া । সমস্ত বাংলাদেশটাই তার কাছে জীবনের মরণের স্বপ্নের হরিপুর । ফলে
নগরে বাস করেও নাগরিকতা তাকে খুব একটা স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। অন্তত তার কবিতার প্রচ্ছদপট বা প্রেক্ষাপটে সে রকম দৃশ্যপট পাই না। বরং মনে হয় আর্বান এগ্লোমারেশন তাকে আহত ও বিদ্ধ করে এ বিষয়টি তার অন্য অনেক কবিতা পড়ে বোঝা যায়। আসলে সমস্ত বাংলাদেশ তার সমস্ত সৌন্দর্য বিষাদ আর মৃন্ময়ী বিশালাক্ষী বেদনা নিয়ে এক সবুজ প্রাচীন হরিপুর [ফেনি]।
এখানে রবীন্দ্রনাকে স্মরণ করি– রবীন্দ্রনাথ ছন্দ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন– নদী কূল ছাপিয়ে বর্ষায় যখন সব প্লাবিত করে তখন সে আর নদী থাকে না, অন্য কিছু হয়ে যায়। নদীর চরিত্রের মধ্যে যেমন অস্থির চলমানতা আছে, স্রোতের বেগ আছে—আবার কখনো মন্থরতা আছে– যে মন্থর জলে স্নান করা যায় তাকেই নদী বলা যায়। তৌহিদের কোমল গান্ধারে নদীর গৌরবের মতো সুন্দরের লাবণ্য আছে। সেখানেই তার কবিতা তাকে ধনী করে তোলে কবিত্বের চিত্রল সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে। এখানে একটু কবি এজরা পাউন্ডের কাছে যাই—তার কথাটা একটু শুনি। শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি একটা অসাধরণ উক্তি করেছিলেন– তিনি বলেছিলেন ‘এডুকেশন ইজ দ্য ওনানিজম অফ সোল’। অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে আত্মার সাথে মননের প্রাত্যহিক মৈথুন। আসলে পাউন্ডের কথাটি কবি ও কবিতার জন্যই বলেছিলেন। কবিতাও হৃদয়ের সাথে বোধের জগতের সাথে মননের চয়নের সাথে শিল্পের মিথুন ক্রিয়া। সকল ভালো কবি মহৎ কবির জন্যই পাউন্ডের এই বাণী সাধুসত্য।
তৌহিদের সমগ্র কবিতার মধ্যে একটা ঐক্য আছে—সুরের ঐক্য সুন্দরের ঐক্য বাংলাদেশের বিচিত্র রূপের ঐক্য মানবিক সম্পদ ও ঐতিহ্যের ঐক্য। ইংরেজ কবি ডিলান টমাস তার সমস্ত কবি সৃজন সত্তা ও ব্যক্তিগত জীবন সত্তাকে একটি ঐক্যসূত্রেই গ্রন্থিত বলে ঘোষণা করেছিলেন। আর ঐতিহ্যের কথাই যদি বিবেচনা করি আমাদের বাঙালি জীবন চেতনাবোধের সংস্কৃতির ঘ্রাণ তার কবিতার পরতে পরতে বিদ্ধৃত হয়ে আছে। সেটা আছে শব্দ ব্যবহারও ঐতিহাসিক কালের ধারায় কবির গমনাগমনের কাব্য পথরেখায়। এখানে বলা প্রয়োজন সুন্দরের প্রয়োজনেই আমাদেরকে ঐতিহ্যের কাছে যেতে হবে। এলিয়ট তার ”ঐতিহ্য ও ব্যক্তিগত প্রতিভা’’ প্রবন্ধে বলেছেন— ঐতিহ্যের মধ্যেই জাতির ইতিহাসবোধকে অনুসরণ করতে হবে। ঐতিহ্য মানে পূর্বযুগের অনুসরণ ও অনুবর্তন নয়। এলিয়ট স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন— ঐতিহ্য শুধু উত্তরাধিকার সুত্রে মেলানো যায় না। এঁকে সীমাহীন ধৈর্য পরিশ্রম মেধা ও সৃজনশীলতাকে দিয়ে অর্জন করতে হয়। শুধু অর্জন করলেই চলে না— সংরক্ষণ করতে হয় – পুনরুৎপাদন করতে হয় প্রযত্নে’। আর পাউন্ড বলেছেন ঐতিহ্য হচ্ছে সুন্দর—সুন্দরের ধারণা সুন্দরের প্রতিমা—একে সংরক্ষণ করতে হয়— ঐতিহ্য জীবনকে শৃংখলিত করবার বিষয় নয়। ঐতিহ্য বিশেষ কালের সম্পদ নয়, চিরকালের প্রবাহমানতাতেই ঐতিহ্য বেঁচে থাকে – বহুস্রোতধারা কালের প্রবাহে এখানে এসে মিলেমিশে লীন হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এ কারণেই শিল্পসাহিত্যে – সকল কালের মানুষকে এবং চিরকালের মনুষ্যত্ববোধের মানুষকে আহবান ও স্বাগত জানিয়েছেন। একটা কথা বলে শেষ করি— বাঙ্গালির অসট্রিক নৃধারার রক্ত ও স্নায়ুতে নাকি লিরিকের ঐতিহাসিক প্রবাহমানতা আছে – তাই বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব নাকি লিরিকে। কথাটা যদি সত্য হয়—আনন্দের কারণ হতে পারে।
সবশেষে একটি কথা বলা প্রয়োজন কবি তৌহিদ আহমেদ ‘কোমল গান্ধার’ কাব্যগ্রন্থটি আমার নামে উৎসর্গ করেছেন – এতে আমি কৃতজ্ঞ এবং আনন্দিত। আমার এ আলোচনা বন্ধুকৃত্য নয়—একজন মহৎ সুন্দর কবির সাহিত্য ক্ষমতার বিচার।