কবি মরে গেলে একটা নির্জন ঘোড়া হয়ে যায়
উদ্ভিদ পর্ব
ফুলের নিশ্বাস
কবি মরে গেলে একটা ঘোড়া হয়ে যায়। তার হ্রেষা আর খুরধ্বনি আর কেউ শুনতে পায় না। আপর্বত প্রান্তরের বুকেও সে নির্ভার ছুটে বেড়ায়। কেউ দেখে না। পিঠে ও বুকে কেবল স্মৃতি থাকে কাশি ও শিরদাঁড়ার ব্যথা হয়ে। তার খুরের খাঁপে তেরোটি ফুলের নিশ্বাস জেগে থাকে। অগোছালো দুপুরকে সে কেবল দিতে পারে ছায়াহীন অস্থির একটা শরীর। দুপুরও টের পায় না।
কবি মরে গেলে একটা নির্জন ঘোড়া হয়ে যায়। আর তার খুরের খাঁপে নিঃসঙ্গ তেরোটি ফুলের নিশ্বাস জেগে থাকে।
আকাশের ফুল
ফুল ভেঙে দেয়ার পর পৃথিবীর উপরে আরো কয়েকটা আকাশ ফনা তুলে দাঁড়ালো, যেনো বা ছায়াবতী বৃক্ষের আকর। বন্যা হলো, মাঠ হলো, ঘাট হলো, ধান আর বুদ্ধের দুয়েকটা রূপ দেয়াল হয়ে গেলো।
মুখের ভিতর মেরুদণ্ড নিয়ে উত্তর মেরুর দিকে গিয়ে তুমি আদিগন্ত শাদা হয়ে গেলে। বুক-পকেটে তখনো লুকিয়ে ছিলো দুটি সুগন্ধিময় এলাচ। তুমি মনে মনে ভাবতে লাগলে এইখানে একফালি এলাচের বন লাগিয়ে আর তিনটা জীবন কাটিয়ে দেবো—একটা নিজের, একটা তার আর একটা পতঙ্গের।
চাঁদ ও চন্দ্রমল্লিকা
চাঁদ ও চন্দ্রমল্লিকার নামে একটা খুন করে ফেলেছি। আমার হাতে রক্ত লেগে গেছে। ছত্রিশবছর ধরে এতো ধুচ্ছি, তারপরও হাত লাল হয়ে আছে। জেনেছি, তোমার পায়ে এই লালে অলক্তরাগ পরালেই আমার হাত ফিরে পাবে পূর্বের সকল বর্ণ। আমি সেই কবে থেকে একটা সবুজ পেয়ারার বুক চিরে তার মধ্যে ঢুকে বসে আছি! আকাশজুড়ে ছায়া মেলে আছে গড়ুরের ডানা। পাতালে গলে যাচ্ছে বিভীষণের শব। আর তুমি আসো না। তুমি আসো না কেনো? হাতে রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক যন্ত্রণার। কেনো পৃথিবীতে এখনো তোমার জন্ম হয় না?
সন্ধ্যার গান
নদীর চরটা গুছিয়ে দাও। শীতের ভোরে বিলম্বিত স্রোত থেকে মুছে দাও অগভীর স্নান। যা কিছু বাগান আছে অদূরে বনের কাছে সঁপে দাও সপত্র সপুষ্প। সঁপে দাও পেয়ারা, আর সব ফলের উৎসার। গন্ধর্ব বিবাহের সিঁথি থেকে মুছে দাও রক্তের দাগ। তারপর শজারুর গায়ের কাঁটা থেকে মুছে দাও জ্বরা। ভূতের নাভীতে ঘষে দাও অজানিত ধান।
আসো, গুছিয়ে দাও আমার হাতের পায়ের কুড়িটি আঙুলজুড়ে ফুটে থাকা সন্ধ্যার গান।
জন্মান্তর
জন্মান্তর মানি না। তবু পৃথিবীকে বানাচ্ছি ক্রমে তামাকের বন। এই বনে পরের জন্মে তামাকের পাতা হবো, আর ধোঁয়া হয়ে তোমার নিশ্বাসের ভিতর ঢুকে যাবো। জেনেছি, তুমি নিকোটিন ভালোবাসো। ভালোবেসে তাকে ধরে রাখো উথল রক্তের ভিতর। আমি একরাত্রি দূর থেকে জেনেছি তাকে।
জেনেছি, তোমার রক্তের ভিতর গাঢ় লাল প্রেমে এই বিষ জাগে রাত্রিদিন। আর তোমাকে জাগিয়ে রাখে সুতীব্র।
বৃন্দাবনী পর্ব
মাথার বালিশ
সে অন্ধকারকে ধরেছে, অন্ধকার ধরেছে তাকে। তার রক্তে গাঢ় ছায়া বনের। তার স্বেদে নিবিড় সমুদ্র। একটি মাছ সাঁতরে আসছে। প্রিয়তম বুদবুদ তার প্রেরণা। তার জিভে নুন। সে আর মাছ পরস্পর। তাদের প্রকাশ হিরণ্যগর্ভে আদিতে।
সে বালিশ আকড়ে ধরে শক্ত করে। সে তার দুঃস্বপ্নের ভিতর। আমার নগ্ন কোমর, বাহুতে আগুন রেখে খুঁজে ফেরে বরফ। কখনো রাতে তার ঘুম নিভে যায়। সকলে ছেড়ে যায়। মাথার বালিশ তার কাছে থাকে। সে বালিশে প্রাণ বুনে দেয়, সঘন হাতে।
চুম্বনরহিত
চুম্বনরহিত ওষ্ঠাধর সঙ্গে ছিলো, কিছুদিন বাহিরে ছিলাম। অজ্ঞাতে অগ্নি উৎসবের স্মৃতি। স্বাহা স্বাহা ক্রন্দনে কারো শরীরের ঘ্রাণ ভুলে গেছি বহুদিন, বহুদিন। কেউ বলতে পারে ‘সুন্দর’। ফেনায়িত সমুদ্রে শব্দ সকল সন্তরণ। আর আমি সন্তরণ জানি না।
শব্দেরা গাভীন। কিছুদিন অন্যখানে ছিলাম। প্রতিটি চুল ভিজে গেলে তারপর ফিরেছি। আমার শরীর রতিগন্ধহীন।
অলিখিত ধূলিস্রোত
অলিখিত ধূলিস্রোত দশপাতা ভাঁজ করি, রেখে দিই চোখের ভাঁজে। তোমরা যাকে কান্না বলো সেতো বিভাবরী। তাকে আঁকি আমি ধূসর সাঁঝে, কারো কণ্ঠলগ্ন সবুজ পাথরে।
রাতের মোহর চুরি যায় আমার হাতের উত্তরে। মাংসের শুদ্ধতা ভেঙে কাঁপন আসে এই তপ্ত অধরে। নিজেই নিজের ঠোঁঠ কামড়ে স্বরচিত ক্লান্তি বানাই। বিষফল ঝরে গেলে থামে গাছের কাঁপন। আমি ঘুমিয়ে পড়ে জেগে থাকি বহুদিন বহুদিন।
অন্তরালের সড়ক
তার মধ্যে রাতদিন একাকার হয়। শেষরাতে অথবা দিনশেষে যা কিছু আলো আর আভা দেখা যায়—তাকে অমর বলে মনে হয়। আসলে এটা একটা খেলা। হিমহাওয়া ছুঁয়ে পাতা কেনো ঝরে যায়, নীলাভ ধোঁয়াশায় কার মুখ হারায়?
একদিন কুয়াশার দুয়ার খুলে পার হবো অন্তরালের সড়ক। কেউ জানবে না। সে রোদ আর জোছনার মধ্যবর্তী রূপ চুরি করে সাজাবে নিজেকে।
ভুলের কার্পণ্য
ভুলের কার্পণ্য ছিলো না পুরনো মন্দিরের ভিতর-একফালি কালো ঝড় হয়ে পৃথিবীকে করেছে সে বাসন্তী নৃত্য। তারাদের গাছটি ম্লান। ওপাড়ার জোছনায় ডুবে গেছে এইখানে প্রাণের বাগান। যে যার কাজ সেরে হয়েছে রাত। লাটিমদল ঘুরে ঘুরে উঠানের কারুকাজ। চক্রাকার গতির শরীর চিরচেনা মাটির মুখে করেছে দংশন।
আবার দেখা হলে তাকে বলো-গোধূলির পরে যে অন্ধকার তা আমাদেরই আয়োজন। ভুলের কার্পণ্য ছিলো না ক্ষিপ্র-মিছিলে। পোড়ামাটি কেড়ে নিয়েছে মাঠের সিঁথি, মিছিলের আগে।