:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
শোয়েব নাঈম

প্রাবন্ধিক

কবি শাহিদ আনোয়ারের ‘তপস্যা’
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি শাহিদ আনোয়ারের ‘তপস্যা’

‘হেরার চূড়ায় অশ্রু ফেলে গাইছে মরুর স্বর্ণ চিল’—এক ব্যাপ্ত বলয়ের প্রেক্ষাপটে স্থাপিত নিসর্গের অপরূপ সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যে নির্মিত এক অভিভূত স্তবক এটি, যা তীব্র বিষণ্ণ সুরের আবর্তনে উত্থিত করেছে কবির স্বপ্ননির্যাসের এক বিষাদ মধুর স্বরমাধুর্য।

আত্মমগ্নতায় আত্মজ্ঞানসাধনের সুশ্রাব্য, সুললিত, মহাসত্য আর সুগভীর তত্ত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক কবিতায় ব্যাপ্ত এই ‘তপস্যা’ (‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’- গ্রন্থভুক্ত একটি কবিতা)। পরিচিত শব্দার্থকে অব্যাহতি দিয়ে মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যার টেক্সটে সর্বোচ্চ সত্যলাভের সুগমপথে স্বরবৃত্ত ছন্দোবদ্ধের তালে তালে পারমার্থিকতায় প্রদর্শিত হয়েছে এর প্রতিটি স্তবক। কবিতাটি চারমাত্রার পর্ব চালে- ৪+৪+৪+৩ মাত্রাযুক্তির সমন্বয়ে ধ্যানপর্ব, জ্ঞানপর্ব, কর্মপর্ব ও ভক্তিপর্ব- এই চার পরিচ্ছেদে অন্তরের মহিমায় উৎসর্গীকৃত করেন এর পরমোৎকৃষ্ট বিশদীকরণ।

ধ্যানপর্ব:

‘যাচ্ছে সময় হেরার গুহায়, হৃদয় মেধা ভগ্ন প্রায়
জিবরাইলও আসছে না তো, ব্যর্থ এমন লগ্ন যায়
বন পায়রা ওম দিয়ে যায় বাসায় সফেদ ডিম্বতে
অন্ধকারের নীল আঁচলে নীল জোনাকি তন্তুবায়’

জ্ঞানের আলোকবর্তিকা ‘হেরার গুহায়’ ঐতিহাসিক স্থানে সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়। যেখানে নবুওয়াত প্রাপ্তিকালে ধ্যান-নির্জনতায় জিবরাইলের অবতীর্ণের মাধ্যমে ওহী প্রাপ্ত হন নবী মোহাম্মদ (স.)। নবীর তাফাক্কুর তত্ত্বের মাধ্যমে রিভার্স-পাস্ট অর্থাৎ অতীত ক্রমাগত পূনরাবৃত্তি, যা অতীত হয়ে বিপরীত এরো-মার্কে ভবিষ্যতের দিকে ফিরে যায়। এখানে স্বপ্নকে ধ্যানের সমার্থক করে কবির সৃষ্ট ‘যাচ্ছে সময়’ এই পরিভাষায় ধ্যানপর্ব পরিচ্ছেদে জগতের অধ্যাত্মিক রহস্যগুলি আলোকপাত করেছেন কবি শাহিদ আনোয়ার।

জ্ঞানপর্ব:

‘যাচ্ছে সময় লাস্যহীনা, শূন্য তাহার অন্তঃসার
জিব্রাইলও পথ ভুলেছে, ঘুমিয়ে গেছে ইসরাফিল
উড়ছে হাওয়ার মরুর বালি, তপ্ত কণা অন্ধকার
হেরার চূড়ায় অশ্রু ফেলে গাইছে মরুর স্বর্ণ চিল’

হেরাগুহার উত্তারাধিকার কবি শাহিদ আনোয়ার জ্ঞান-বিরুদ্ধ সংশ্লিষ্টতাকে কিভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিমুখী করা যায়-এ প্রাসঙ্গিকতার পক্ষে দ্বান্দিকভাবে যুক্তি পেশ করেছেন এই পরিচ্ছেদে। যুগধারণার বিপন্নতাকে প্রতিফলিত করে সময় চেতনার নবতর বিচ্যুতির অস্থিরতা তাঁর সমগ্র ভাবনায়।

কর্মপর্ব:

‘যাচ্ছে সময় নাড়ীর ঘায়ে, কেউ আসে না, অন্ধকার
ফেরেস্তারা ঘুমিয়ে গেছে, পথ ভুলেছে এই হেরার
হঠাৎ হাওয়ায় ফিসফিসানি, তন্তু ছেঁড়ার শব্দ পাই
হাওয়ার এমন সুর মেশালো দূর থেকে কে তানপূরার?’

তৃতীয় পরিচ্ছেদের ‘কর্মপর্ব’-তে এসে কবিতার চেতনা স্তরের পরিপূর্ণতা পায়। ‘ধ্যানপর্ব’ এবং ‘জ্ঞানপর্ব’ এই দুই অংশ এখানে উপস্থিত, তিনটি পর্ব এখানে একই কালে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘যাচ্ছে সময়’ অভিধায়। অর্থাৎ যখন দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ‘জ্ঞানপর্ব’ এর বয়ান চলে তখন প্রথম অধ্যায় ‘ধ্যানপর্ব’-এর সৃষ্টিও চলতে থাকে, আবার একই কাল-পরিধিতে তৃতীয় ভাগের অনুচ্ছেদও প্রকাশিত হয়। তিনটি পরিচ্ছেদই কাল-পরিধি কর্মশীল হয়ে এই কবিতাটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময় হয়েছে। এই পর্বে এসেই কর্মময় জীবনের চেতনা জেগে ওঠে।

ভক্তিপর্ব:

‘উজল নূরের হাত দু’খানি, পদ্মিনী ঠোঁট সুন্দরীর
চোখের আলোর দীপ জ্বালিয়ে বললো, কবি-বন্ধনে
জিব্রাইলের কন্যা আমি, নম্র বাহু লগ্ন হও
দার্শনিকের মান ভাঙাবো একটি মহান চুম্বনে।’

ভক্তিপর্বে স্পর্শ, গন্ধ, দৃষ্টি ও শ্রুতির সমস্ত ঐকান্তিকতায় সৃষ্টি করেছেন কাব্যাকৃতির সম্পূর্ণতা। এক-একটি প্রকরণে এসেছে নানা ইন্দ্রিয়ের ভিন্ন ভিন্ন অনুভবের অনবদ্য সমন্বয়। ধ্যান-জ্ঞান-কর্ম প্রক্রিয়া থেকে যে প্রাপ্তি ঘটে তা ঐশ্বরিক অনুভূতি-সমান ভক্তি সৃষ্টি করে। অনুভূতিজাত আধ্যাত্মিক এই প্রাপ্তিকে ‘হেরার গুহায়’-এর মত এক আত্মাসম্বন্ধীয় প্রেক্ষাপটে ভক্তিবাদের উত্থান ঘটিয়েছেন। ‘তপস্যা’ মূলত একটি ভক্তিবাদী উদ্ভাসনধর্মী কবিতা।

এই কবিতায় বর্ণিত একটি ভূ-প্রকৃতি আছে যা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের ভূগোল প্রতিকৃতিতে নির্ণিত কবির এই নিজস্ব-ভূগোল। সেই জগতে আছে দীর্ঘ এক উঁচু পর্বত, যেটি সন্নিবেশিত উত্তপ্ত বালুময় মরুভূমিতে। দিন-রাত্রির কাল প্রবাহে দৃশ্য-অদৃশ্য প্রতিবেশ-পরাবেশ অনুষঙ্গের অনেক বিষয়কে ধারণ করে একটি সৃষ্টিকে নির্দেশ করে।

‘তপস্যা’ কবিতার প্রকরণে আছে কওমী ইডিয়মে বিশিষ্ট মতবাদে স্বচ্ছন্দ প্রয়োগ- ‘হেরার গুহায়’, ‘জিব্রাইলও’, ‘ইসরাফিল’, ‘ফেরেস্তারা’, ‘নূরের হাত’… এসবের অনুশীলনে কাব্য-সীমানাকে কবি অনেক বিস্তৃত করেছেন। এই শব্দগুলি কেবল কওমী-চিত্রই নয়, এগুলি কবির অন্তর্গত চিন্তাও। চিত্র ও চিন্তা মননশীল স্পর্শে এই প্রকরণগুলি কবিতাকে পূর্ণতা দিয়েছে।

এই কবিতায় বিশেষণই উপমা, ভিন্ন ভিন্ন উপকরণের সাথে সরাসরি কোনো তুলনা না করেই ১৬টি পঙক্তিতে শুধুমাত্র বিশেষণ পদের প্রভাবে কাব্য-দক্ষতায় উপমার প্রয়োগ করেছেন। যেমন- ‘সময়’, ‘মেধা’, ‘ভগ্ন’, ‘সফেদ’, ‘অন্ধকার’, ‘স্বর্ণ’, ‘ফিসফিসানি’, ‘সুর’… ইত্যাদি। এই জাতীয় বিশেষণগুলি স্পষ্ট আভিধানিক অর্থ না হয়ে সম্মোহন বোধে চাক্ষুষ উপমা সৃষ্টি করেছে।

এই কবিতায় গতিময়তা সৃষ্টি হয়েছে ১৩৬টি স্বরধ্বনির মাধ্যমে। সুর-বৈচিত্র ভরা প্রবাহমান ধ্বনিতে আছে- ৬০টি ‘আ’ স্বরধ্বনি, ৩০টি ‘এ’ স্বরধ্বনি, ২৭টি ‘ই’ স্বরধ্বনি এবং ‘ও’ ৬টি।

‘তপস্যা’ কবিতার কাল-পটভূমি হচ্ছে রাত্রিবেলার, কবি তিন পর্বেই অন্ধকারকে গূঢ়ার্থে স্মরণ করেছেন। এখানে সময় চেতনা হচ্ছে রিভার্স-পাস্ট অর্থাৎ অতীত ক্রমাগত পূনরাবৃত্তি হয়ে ক্রিয়াপদগুলি কোমল ধারার বর্তমান-সূচক। যেমন- ‘যাচ্ছে’, ‘যায়’, ‘ভুলেছে’, ‘গেছে’, ‘উড়ছে’, ‘গাইছে’, ‘আসে’, ‘পাই’, ‘বললো’, ‘হও’… ইত্যাদি। এসব ক্রিয়া সময়েরই একটি রূপ, এই সময়-চেতনা পাঠককে নিয়ে যায় পূনরাবৃত্তি অতীত হয়ে বিপরীত এরো-মার্কে ভবিষ্যতের দিকে।

‘বন পায়রা ওম দিয়ে যায় বাসায় সফেদ ডিম্বতে’—এখানে স্তবকটি চিত্রকল্পগত নয়, মনগত। এখানে বন পায়রার ডিমের রিলেশানে কোনো চিত্রকল্প সৃষ্টি করেননি, করেছেন কবির অন্তর্গত মনোভাবের প্রকাশ। স্নেহ-মমতাভরা মাতৃত্বে প্রাকৃতিক নিয়মে যেমন পাখির সমৃদ্ধ জীবন বিকশিত হয়, কবির হৃদয়ও এমন স্নেহ-পরশের আশ্রয় খুঁজছেন, এমন উপলদ্ধি আসে হৃদয় ও মনের অনুভবে।

‘উড়ছে হাওয়ার মরুর বালি, তপ্ত কণা অন্ধকারে’ বলার মধ্যে কবি এমন এক অচেনা, অসুন্দর ও অশুভের গম্ভীর ব্যঞ্জনাময় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, পাঠকের মন এক আসন্ন সর্বনাশের সম্ভাবনায় স্তম্ভিত হয়ে যায়। ‘তপ্ত’ এই বিশেষণটি অন্ধকারের আরো ভয়াবহতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই কবিতায় বর্ণিত একটি ভূ-প্রকৃতি আছে যা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের ভূগোল প্রতিকৃতিতে নির্ণিত কবির এই নিজস্ব-ভূগোল। সেই জগতে আছে দীর্ঘ এক উঁচু পর্বত, যেটি সন্নিবেশিত উত্তপ্ত বালুময় মরুভূমিতে। দিন-রাত্রির কাল প্রবাহে দৃশ্য-অদৃশ্য প্রতিবেশ-পরাবেশ অনুষঙ্গের অনেক বিষয়কে ধারণ করে একটি সৃষ্টিকে নির্দেশ করে।

এই কবিতায় স্বপ্নজগতের শ্রেয়সীর মতো কবির মায়ালোকের কিছু তাৎক্ষণিক উদ্ভাসনও আছে, যেখানে আছে কওমী ইতিবৃত্তধারাচারী মূল্যমহিমাও। যেমন—
‘বন পায়রা ওম দিয়ে যায়’, ‘অন্ধকারের নীল আঁচলে নীল জোনাকি’, ‘জিব্রাইলও পথ ভুলেছে, ঘুমিয়ে গেছে ইসরাফিল’, ‘ফেরেস্তারা ঘুমিয়ে গেছে’, ‘হাওয়ার এমন সুর মেশালো দূর থেকে কে তানপূরার?’, ‘জিব্রাইলের কন্যা আমি’… ইত্যাদি।

একটি সার্থক কবিতার অবয়বেই থাকে নামকরণ অর্থের ইঙ্গিতময় হীরক দ্যুতি, আধ্যাত্মিক অর্থের সম্ভারে এবং কবির বিশিষ্ট ধারণায় গভীর সংবেদনশীলতা বহন করে ‘তপস্যা’ শিরোনামটি সমকালীন কাব্যপ্রবাহে। কবিতার নামকরণের মধ্যেই আছে তিনটি স্তর- অন্বেষা, আবিষ্কার এবং অনুধ্যানের পরস্পরা।

এই কবিতায় প্রকরণ-সৃষ্ট স্তবকে কোনো স্থিরতা নাই, উম্মোচনী গতিশীলতা আছে সঙ্কেতের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসকাল ভৌগলিক বিচরণের মধ্যেও একটি গতিময়তা আছে।

যে মুহুর্তে কবি বলে ওঠেন, ‘দার্শনিকের মান ভাঙাবো একটি মহান চুম্বনে’, সেই মুহুর্তেই ব্যক্তি অস্তিত্বের পরিধি অতিক্রম করে তিনি হয়ে ওঠেন নবসভ্যতায় উত্তরণে মানাবাত্মার সঙ্গী। তারপরে ‘নম্র বাহু লগ্ন হও’ অনুষঙ্গ নিয়ে আসে ঐশ্বর্য ও প্রশান্তির অবিচল মানবিকতার ইঙ্গিত।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.