:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
শাকিলা আলম

প্রাবন্ধিক

‘কাটা সাপের মুণ্ডু’-র নন্দনস্বভাব: রাষ্ট্র ও সমাজের ‘অপর’

‘কাটা সাপের মুণ্ডু’-র নন্দনস্বভাব: রাষ্ট্র ও সমাজের ‘অপর’

সৌন্দর্যবোধ ও নন্দনতত্ত্বের মধ্যে একটি প্রাচীন ও উৎসগত সম্বন্ধ বিদ্যমান। মূর্ত বা বিমূর্ত শিল্পকর্মকে ‘নান্দনিক’ শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করতে চাইলে সেখানে সুন্দরের একটি অনিবার্য আকাঙ্ক্ষাও আত্মনিহিত থাকতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এই সুন্দর কেবল আলোকিত ও রঙিন রোমান্টিক বোধের সহজাত মাত্র নয়। তা আরো অধিকতর কোনো চিন্তনের পরিসীমানায় বিস্তৃত। আপাত দৃষ্টিতে, উপনিবেশিত ও শোষণক্লিষ্ট পর-অধীন মানুষের রাষ্ট্রিক স্ব-অধীনতা অর্জনের বা প্রাপ্তির মাধ্যমে বিশ শতকের কালচক্র চলমান একুশ শতকের মানুষের চিন্তা ও বোধের ক্ষেত্রে একটি অনিবার্য প্রভাবক শক্তি। মানুষের আত্ম-গরিমা মানুষেরই প্রতিষ্ঠিত মহৎ প্রতিষ্ঠান সভ্যতাকে ছেঁটেকেটে, ভেঙে-গড়ে, ধ্বংস ও বিনির্মাণ করে যে একুশ শতকের জীবনের তীরভূমি পর্যন্ত বহন করে এনছে, সেখানে সৌন্দর্য কেবল আলোকিত রঙিন আদর্শ-নিপুণতার মধ্যেই সমাহিত থাকে না। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আত্মাহুতি দেওয়া অজস্র মানুষ যারা ‘সন্তানকে দুধেভাতে’ রাখার অর্থাৎ, ভবিষ্যতের মানুষ ও তার সভ্যতাকে স্ব-অধিকার প্রাপ্ত করার জন্য নিজেকে বার বার অতিক্রম করে গিয়েছে, তাদের চেতনায় জীবনের অর্থ আলোকিত সুন্দরতা মাত্র নয়। বিবমিষায় ক্লিষ্ট মানুষের জীবনের বোধ স্বপ্নাহত হতে হতে একটি আঠালো থকথকে কোনো বোধের পর্যায়ে উপনীত হয়। জ্যাঁ পল সার্ত্র এই বোধকে সত্তার ‘ভিসকসড’ দশা হিসেবে চিহ্নিত করেন তাঁর বিঙ অ্যান্ড নাথিংনেস গ্রন্থে। ফলে, জীবনানন্দ দাশও তিনের ও চারের দশকে প্রগাঢ় বেদনাতে শান্তি খুঁজে পান। চারের দশকের পর থেকে যে মানুষেরা মানবের তটে উপনীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় দেশভাগ, গণঅভ্যুত্থান, তেভাগা আন্দোলন, নকশাল বিদ্রোহ, স্বাধীনতার সংগ্রামে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে বার বার; যাদের স্বপ্ন লুট হয়েছে বার বার; প্রতিবারই যারা আশায় বসতি করতে করতে মুখথুবড়ে পড়েছে শোষণ ও ক্ষুধার অমোঘ বন্দিশিবিরে, তাদের চেতনায় সৌন্দর্য শঙ্খচূড় সাপের মেদযুক্ত পেটের প্রতি ক্ষুধাতুর আকুলতাও। অসীম ক্ষুধায় বিষধর সাপও লোভনীয় আহার্য বস্তুতে পরিণত হয়।

ফলে, সুন্দরের সীমানা হয়ে ওঠে অবারিত। আর, এই সুন্দরকে সাহিত্যরূপ প্রদান করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় সাতের দশক ও তার পরবর্তীকালের বাংলাদেশের সাহিত্যে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনামলে অবরুদ্ধ সময় বাংলা কথাসাহিত্যকে প্রকরণগতভাবে পরিবর্তিত করে। সাহিত্যে স্বৈরশাসনের সেন্সরশিপ আরোপণের কারণে এই শিল্পমাধ্যম প্রবাহিত হয় প্রকাশের ভিন্নতর মাত্রায়। এই সময়ে সাহিত্যে ভাবের প্রকাশকে বিশেষ ও বিস্তৃত করতে অপ্রকাশের শব্দরূপ ব্যাপকভাবে গ্রাহিত হয়। ফলে, রূপক শব্দালঙ্কার কবিতার ভূমি থেকে অপরাপর সাহিত্যমাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা অর্জন করে। বিশেষত কথাসাহিত্য লেখকের কথার বহুবিধ সীমানা অতিক্রম করে এবং সাহিত্যবস্তু এমন স্বতন্ত্রতা অর্জন করে যে, তা পাঠককে লেখকের সীমানের ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হয়ে সাহিত্যসার আকলন করতে পরিচালিত করে। পাঠক পাঠের মধ্যে এমন জীবনের সংস্পর্শে উপনীত হয় যে, সে জীবন পাঠকেরই অন্য জীবন হিসেবে প্রতিভাত হয়। ফলে, যে পাঠক পাঠসন্নিহিত জীবন যাপন করেন, তার চেতনার সংস্পর্শে উক্ত রীতির সাহিত্যবস্তুর প্রাণপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

কালের স্বভাবকে অনুভব করে যে লেখকেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তীকালে সাহিত্যচর্চা করেন তাঁদের রচনাতে পূর্ববর্তী সময়জাত বোধ আরো প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। কারণ, বংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টার মৃত্যু স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বপ্নভঙ্গের পরে আরো নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন করে। স্বাধীন দেশে সামরিক শাসন এবং স্বৈরশাসনের প্রাদুর্ভাব সংস্কৃতি ও দেশ-সচেতন লেখককে প্রচণ্ড বিক্ষোভে আলোড়িত করে। ফলে, কথাসাহিত্য রূপকের আশ্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের নগরকেন্দ্রিক, গ্রামকেন্দ্রিক, ব্যক্তি বা ব্যক্তির মন ও সত্তাকেন্দ্রিক বিভিন্ন বাস্তবতাজাত মনন দ্বারা কাহিনিবৃত্ত গঠন করে। এরূপ শিল্পচিন্তার অভিপ্রকাশ পরিলক্ষিত হয় সাতের ও আটের দশকের লেখক শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) তিন মীর্জা (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০); সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০); আল মাহমুদের (১৯৩৬-২০১৯) পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫), সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮৩), গন্ধবণিক (১৯৮৬); শওকত আলীর (১৯৩৬-২০১৮) শুন হে লখিন্দর; হাসান আজিজুল হকের (জ.১৯৩৯) পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৯); আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৭) খোয়ারি (১৯৮২), দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৩), দোজখের ওম (১৯৮৯); আবু জাফর শামসুদ্দীনের (১৯১১-১৯৮৮) ল্যাংড়ী (১৯৮৪); আবুবকর সিদ্দিকের (১৯৩৪) ভূমিহীন দেশ, মরে বাঁচার স্বাধীনতা, চরবিনাশকাল ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের গল্পসমূহে। আটের দশকে বাংলাদেশ সম্প্রদায়ভিত্তিক স্বৈরশাসনের নিগ্রহে পতিত হয়। তখন কেবল ভূতপূর্বকালের সাম্প্রদায়িক শাসনই রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকের ভূমিকায় আসীন হয়নি, একই সঙ্গে সামরিক শাসননীতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনর্শনকেও প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়ে পড়ে নিম্নমুখী। শ্রমিকের, কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিতে এই সময়ে সরকার রাষ্ট্রের উৎপাদন ব্যবস্থাকেই সীমাবদ্ধ করে তোলে। ফলে, শিক্ষানীতি, দর্শনের চর্চা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে অর্থব্যবস্থাও স্বাধীনতা এবং স্বকীয়তা হারায়। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে যুদ্ধাহত অবকাঠামো নিয়ে অগ্রসর হয় তার সে শূন্যতার পরিণতি আরো গভীর হয়ে ওঠে আটের দশকের রাষ্ট্রপরিস্থিতির কারণে। ফলে, নগরে ও গ্রামে যে প্রবল ক্ষুধা রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আচ্ছন্ন করে তা তাদের মূল্যবোধেও অভিক্ষেপ সৃষ্টি করে। মনোবিকার, হতাশা, অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ইত্যাদির পীড়নে মানুষ তার সত্তা ও অস্তিত্বের স্বরূপ বিস্মৃত হতে থাকে। একটি অন্ধ সময় মানুষকে পরিচালিত করতে থাকায় রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের মোক্ষও দূরীভূত হয়। মানুষ হয় আত্মবিস্মৃত। দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস যা মানুষকে তার জীবন নির্ণয়ের ও ধারণের পথপ্রর্শন করে, ক্রমাগত আরোপনে তা মলিন হতে শুরু করে। মানুষ ভুলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের কেন্দ্রীয় দর্শন। রাষ্ট্রের গঠনে অংশগ্রহণকারী মানুষের অস্তিত্বে সদাজাগ্রত দেশ-ধারণা প্রতিকূল জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় স্বকীয় বিমূর্ত আকার হারাতে থাকে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তক লেখকের অবশ্যম্ভাবী দায়বদ্ধতা তৈরি হয় মানুষ ও রাষ্ট্রের প্রতি। লেখক তাঁর নিজস্ব উপনিবেশে এই দায়কে অনিবার্য রূপে স্বীকার করে নেন। এর ফলে, আটের ও নয়ের দশকের বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, মহীবুল আজিজ প্রমুখ লেখকের গল্পভাষ্য সৃষ্টি হয়। বাস্তবতার নানা প্রকরণ তাঁদের লেখনীর সূত্রে বাংলা কথাসাহিত্যে চর্চিত হয়। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যক্তির সত্তা ও অস্তিত্বের বোধের সঙ্গে বিমিশ্রিত হয়ে সৃষ্টি করে মেটান্যারেশন। সমশিল্পসূত্রের মাধ্যমে বাংলা কথাসাহিত্যে অপর এক ভিন্ন জীবনের স্বতন্ত্র রূপ প্রকর্ষিত হয় আটের দশকের লেখক সেলিম মোরশেদের (জ. ১৯৬২) গল্পে। লেখকের প্রথম গ্রন্থ কাটা সাপের মুণ্ডু শীর্ষক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। কিন্তু, গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত গল্পসমূহ রচিত হয় ১৯৮২ সালের কালপর্বে। রাষ্ট্রের সমকালীন সংকটের সমাজতাত্ত্বিক প্রক্ষেপ এই গল্পসমূহের আখ্যানে জারিত হয়। এ গ্রন্থের গল্পগুলোতে সংকটের নানা চেহারা চিহ্নিত হয় সমাজের ছিন্নমূল মানুষগুলোকে বিশেষ গুরুত্বারোপের মাধ্যমে। নামগল্পে বিদ্যমান হেমাঙ্গিনী; ‘বোধিদ্রুম’ গল্পের সেরাজ, ঔরঙ্গ ও পরী; ‘সুব্রত সেনগুপ্তে’র সুব্রত; ‘ভ্রাম্যমাণ দুইজনে’র শাহীদ হাসান; ‘বিপক্ষে ব্রজন’ গল্পের সিরাজ, জমিলা, ইসমাইল; ‘উল্টেপিঠে কিশান’ গল্পের ইসমাইল, সাবিহা ও কিশান; ‘চেনা-জানা’র আবু হোসেন প্রভৃতি চরিত্র রাষ্ট্রের প্রান্তিক শ্রেণির নিম্নবর্গের মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে এই মানুষগুলো ও তার সন্নিহিত সমাজ গল্পে চিত্রিত হয়। কিন্তু, গল্পগুলোর শরীর গঠনে কেবল সমান্তরালতাই প্রয়োগকলা নয়। বিবিধ নিরীক্ষণ বিদ্যমান গল্পসমূহের সংগঠনে। গল্পের বস্তুগত উপকরণগুলো আখ্যানের ভাববস্তুতে উন্নীত করার ক্ষেত্রে এবং ভাববস্তু নির্মাণের আবহ তৈরি করতে গল্পের শরীরের সংগঠনরীতি পাঠকের চেতনায় উপযুক্ত ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে। গল্পের সংগঠনের আকারের মাধ্যমে অন্তর্নিহিত বিমূর্ত দর্শন সাকার হয়ে ওঠে।

স্বপ্ন দেখতে দেখতে আত্মাহুতি দেওয়া অজস্র মানুষ যারা ‘সন্তানকে দুধেভাতে’ রাখার অর্থাৎ, ভবিষ্যতের মানুষ ও তার সভ্যতাকে স্ব-অধিকার প্রাপ্ত করার জন্য নিজেকে বার বার অতিক্রম করে গিয়েছে, তাদের চেতনায় জীবনের অর্থ আলোকিত সুন্দরতা মাত্র নয়। বিবমিষায় ক্লিষ্ট মানুষের জীবনের বোধ স্বপ্নাহত হতে হতে একটি আঠালো থকথকে কোনো বোধের পর্যায়ে উপনীত হয়।

কোনো প্রতিষ্ঠান বা শিল্পকর্মের সংগঠন এর ক্রিয়ার প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে। আবার, ক্রিয়া সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তাও সংগঠনকে প্রভাবিত করে। ক্রিয়া ও গঠনের সুসমন্বিত যৌথতা শিল্পকর্মকে তার অভিলক্ষ্যে উপনীত হতে সহায়তা করে। আর, এই যুগপৎ প্রাগ্রসরতাই শিল্পকর্মকে করে তোলে নান্দনিক। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পের আখ্যান হেমাঙ্গিনীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। গল্পের কাহিনি হিসেবে ভিখারি হেমাঙ্গিনীর শারীরিক প্রতিবন্ধী দশাও বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়। ক্ষুধার সরল ইতিবৃত্ত এবং হেমাঙ্গিনীর নিরবচ্ছিন্ন দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট হওয়ার মতোই প্রবাহিত ধারায় অগ্রসর হয় গল্পটি। কিন্তু, গল্পের শেষপ্রান্তে গিয়ে লেখক ভিখারির বর্ণনার মধ্যেই আপন স্বর প্রকাশ করেন। সাপ ও হেমাঙ্গিনীর আশু-সংঘর্ষের সময়েই লেখকের জবানিতে এবং গল্পের Text বা পাঠের মধ্যে স্বতন্ত্র লিপির ক্ষুদ্রতর আকারে অনেকটা গবেষণাকর্মের রেফারেন্সের ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয় যে:

বিজ্ঞান বলে: সাপ মঝে মাঝে খোলস ছাড়ে।
সূর্যের বয়স শত-শত কোটি বছর।
অফেন্সকে বেস্ট ডিফেন্স বলা হয়।

তিনটি বাক্য আপাত বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমেও একটি চিরন্তনতাকেই প্রকাশ করে। এই চিরন্তন অবস্থা হল, সূর্যের আলোয় যে প্রাণিজগতের বিকাশ, সেখানে যে প্রাণী অফেন্স বা আক্রমণ করতে পারে সে-ই টিকে থাকতে পারে আর, আক্রমণের মুখোমুখি হলে কেবল আত্মরক্ষাই টিকে থাকার জন্য পর্যাপ্ত নয়। আত্মরক্ষাটিকে স্থায়িত্ব দান করতে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করাই লেখকের মতে সর্বাধিক গ্রাহ্য। এমন চিন্তনের কারণেই নিরীহ হেমাঙ্গিনী নেতিবাচকতার প্রতীক সাপকে আক্রমণ করে। কিন্তু, গল্পটিকে আরো বেশি গভীরতায় পৌঁছে দেয় প্রথম বাক্যটি, ‘সাপ মঝে মাঝে খোলস ছাড়ে।’ সাপের খোলস বদলের সূত্রে হেমাঙ্গিনীর ও সাপটির ভাবগত অবস্থান বিনিময়ের ভাবও দ্যোতিত হয়। কারণ, সাপের ছোবলের ক্রিয়া হেমাঙ্গিনীই সাধন করে। ‘হেমাঙ্গিনী ক্ষিপ্রকারী মুহূর্তে মরিয়া হয়ে বাম হাতের বৃদ্ধাঙুল ও তর্জনীর মূল সহায়তায়, ছোবলে, এক ঝটকায় গোলপাতা থেকে সাপটাকে টেনে আনলো।‘ কিন্তু, তার হাতের ভেতর যখন সাপটি চরম ক্রুদ্ধতায় ঝটপটরত তারপরেই একটি স্বতন্ত্র স্তবকে বর্ণিত হয় হেমাঙ্গিনীর আত্ম-পরিচয় প্রাপ্তির বঞ্চনার ইতিকথা। ছয় হাজার চাবি বানানো এবং আড়াই হাজার তালা খোলার গর্ব থাকলেও গগন পাল হেমাঙ্গিনীকে তার বৈধ সন্তান বানানোর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেনি। তার দায়িত্ব কেবল তিনটি কমলালেবু কিনে দেওয়ার মাধ্যমেই পরিসমাপ্ত হয়। ফলে, হেমাঙ্গিনীর মাতা হয় প্রতারিত। আর, হেমাঙ্গিনী সেই সমাজের প্রতীক হয়ে ওঠে প্রকৃতপক্ষে যে সমাজ জন্মপরিচয়হীন, পঙ্গু। রাষ্ট্রের প্রতি এ সমাজের প্রবল অনাস্থা। সরকারের ভিখারিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সে অংশগ্রহণ করেনি। সাপের ন্যায় বিষধর সরীসৃপও তার ক্ষুধার অনল থেকে মুক্তি পায়নি। কিন্তু আশা ব্যঞ্জিত হয় যখন কাটা হলেও, আধঘণ্টা ধরে আগুনে পুড়লে হেমাঙ্গিনীকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরিক্রমণ করে নিজের পথেই নিষ্ক্রান্ত হয়। গল্পের কাহিনি কোনোরূপ স্থানের ও কালের ঐক্যের সংহতিতে রক্ষিত নয়। রাতের বেলার অন্ধকারে ঘরে ফেরা হেমাঙ্গিনীর হাত ও পোড়া সাপের গন্ধ সবাইকে উদ্গ্রীব করে। এ সবাই কারা? পুরনো জংশনের পেছনের বস্তিবাসী নয়, কারণ সাপ-পোড়া গন্ধ সবাইকে উদ্গ্রীব করার পরে দুপুরবেলা রাস্তায় সরকার গাড়িতে বসে মাইকে কথা বলতে থাকে। ‘কালো ধোঁয়ার গন্ধে অথবা মাইকের জোরালো শব্দে হৃৎপিণ্ড খিঁচিয়ে যায়’। কার? যেহেতু, হেমাঙ্গিনী শব্দহীন এবং সে কথা মানে না। ফলে, হেমাঙ্গিনীরই হৃৎপিণ্ড খিঁচিয়ে যায়।‘প্রচণ্ড ঝোড়ো শব্দে অনেক অবিদ্ধ মগজ ফেটে’ যায়। কিন্তু, হেমাঙ্গিনী তার কর্মে নিরত।

রাষ্ট্রের বা সরকারের কথা হেমাঙ্গিনী মানে না। একই সঙ্গে সে শব্দহীন। রাষ্ট্রে শব্দহীন বা শব্দ ও কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় যারা হেমাঙ্গিনী তাদেরও প্রতীক। উপনিবেশিত রাষ্ট্রে দেশের অধিবাসীরাই ‘Otherness’-এর সংকটে নিপতিত থাকে। যে রাষ্ট্রে সমাজ ও মানুষ স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে সমাজ ও মানুষও হয়ে পড়ে Other বা অপর বা অন্য। কাটা সাপের মুণ্ডু গল্পগ্রন্থে সমাজের ‘অপর’দের স্বরূপ বিবিধভাবে বিশ্লিষ্ট হয়। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পে উপস্থাপিত সাপটি দেখে হেমাঙ্গিনীর মনে হয়েছিল তার হাতটি নিয়ন্ত্রণহীন। আবার, তার খুপরির ভেতরে বিষাক্ত সাপের অবস্থান তাকে হীনমন্য করে ফেলে। আবার, এই সাপসহ হাতই আগুনে আধঘণ্টা পোড়ানো হয়। গল্পের শেষপ্রান্তে গিয়ে সাপ ও হেমাঙ্গিনীর অবস্থান পরস্পরের মধ্যে বিনিময় হয়। এসকল যোগসূত্রতায় প্রতিভাত হয় যে, সাপ হেমাঙ্গিনীরই অস্তিত্বের অংশ। হেমাঙ্গিনীর চুলপোড়া গন্ধে সাপ ফোঁস করে ওঠে। সুতরাং, সাপ ও হেমাঙ্গিনী অভিন্ন।

হেমাঙ্গিনী দেহপসারিনী মাতার সন্তান। এই মাতার জরায়ু যোনিমুখ থেকে ঝুলে পড়ে তামাম দুনিয়ার মতো। স্বৈরশাসকের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরাধীন সমাজ বা হেমাঙ্গিনীর উৎস এই ঝুলে পড়া জরায়ু বা নিপীড়িত দুনিয়া। রাষ্ট্রে বসবাসকারী এই অপরদেরকেই ‘আমি’ বা লেখক সাহস যোগান। ফলে, ক্ষুধা ও আতংকে হেমাঙ্গিনী মৃত্যু-ভয়ে সাহসী হয় এবং আত্মগত সাপের দিকে অগ্রসর হয়, অসীম ক্ষুধায় আত্মগত সাপকেই ভক্ষণ করে।

হেমাঙ্গিনীর খুপরির ভেতরের মাটির লেপা চুলায় আগুনের নীলচে আঁচে সে রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দেয়। নীল রং আভিজাত্যকে, বিত্ত-বৈভবকে প্রকাশ করে। সেই রঙের আগুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দাহ হয় বিশেষ শিল্পরুচিরও। মরা হাড় বা ভূতপূর্ব কালের অভিজাত শিল্পভাবনা আত্মগত ক্ষুধায় কাতর সমাজ নিশ্চিহ্ন করে দিতে সচেষ্ট হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী অপরদের সত্তার এরূপ বিনির্মাণের অবশেষে তারই সত্তার অংশ কাটা সাপের মুণ্ডুর প্রতীকে জাজ্বল্যমান খুপরি থেকে মুক্তি অর্জন করে। সুতরাং, শোষিত অপরদের সমাজের ক্রমমুক্তি সাধিত হয় নিপীড়িত মাতার স্বরূপ, পিতৃপরিচয়ের প্রতারণা, অভিজাত শ্রেণির সাহিত্য ও শিল্পরুচি ভস্মীভূত হয়ে খুপরিতুল্য সমাজেই সংমিশ্রিত হওয়ার মাধ্যমে।

সভ্যতা ও সমাজের ক্রমমুক্তির পথ চিহ্নিত হয় এই গল্পগ্রন্থের শেষ গল্প ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো’-তে। গল্পটির বর্ণনা শুরু হয় ‘যে-কথাগুলো বলবো’-এর মাধ্যমে, অর্থাৎ কথন রীতিতে। গ্রন্থের প্রথম গল্পের মতো এই গল্পটিও নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত। মানবসমাজ তার ঐতিহ্যের পথে যেভাবে স্বকীয়ভাবে ধাবিত হতে পারে, তেমন গতিতে গল্প বিবৃত হয়েছে। কিন্তু, প্রথম গল্পের ন্যায় এই গল্পেও কাহিনিপ্রবাহ প্রবল শিল্পশক্তি ধারণ করে আছে। এই গল্প প্রাচীনকালের সভ্যতার প্রলেপে আধুনিককালের মানবসমাজেরই সংস্কৃতির শিথিল সূক্ষ্ম পারিপাট্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর শহরের অধিবাসীকে যে যুবক প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাকে খুঁজতে মাটি খুঁড়লে মানুষের ক্লান্তি কমতে থাকে। তারা যুবকটিকে খুঁজতে খুঁজতে যে গুহায় প্রবেশ করে সেখানে বিদ্যমান ছিল ‘অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবার গোপন মানচিত্র, আমিত্বের আশ্চর্য প্রদীপ আর অমরত্বের মোমবাতি’। বাস্তবের নিরিখে মানুষকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করে তুলতে পারে তার ঐতিহ্য। কারণ ঐতিহ্য মানুষকে তার পূর্বপুরুষ ও তার গুণাবলি এবং অর্জনসমূহের অস্তিত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তোলে। এই জ্ঞানই ব্যক্তির ‘আমিত্ব’ বা নিজত্ব বা নিজের সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। আর ব্যক্তি যখন তার আত্মপরিচয় আর অতীতের ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই আর অর্জন ও সুকর্ম তাকে অমর করে তোলে। সুতরাং, ঐতিহ্যের প্রতি মানুষেরা যে সূত্র ধরে উপনীত হতে পারে, তা হল ওই যুবকের প্রতীকে স্বয়ং সংস্কৃতি। সংস্কৃতি বা যাপিত জীবনের বিবিধ রীতিনীতি মানুষের বিশ্বাস দ্বারাই উজ্জীবিত থাকে। আর বিশ্বাসী মানুষ হল অন্ধ। অন্ধভাবে অর্থাৎ, প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করতে পারলেই ঐতিহ্যকে ও এর অন্তর্গত শক্তিকে অর্জন করা যায়। কিন্তু, আত্মগরিমায় কাতর মানুষেরা যখন নিজস্ব ঐতিহ্য উৎসারিত সংস্কৃতি দ্বারা প্রশ্নবিধ হয়, তখন তারা বিকৃত ধর্মবোধ দ্বারাই সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে হত্যা করে। তাই গল্পেও যুবকটিকে শহরের পবিত্র উপাসনাকেন্দ্রে হত্যা করা হয়।

হেমাঙ্গিনীর খুপরির ভেতরের মাটির লেপা চুলায় আগুনের নীলচে আঁচে সে রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দেয়। নীল রং আভিজাত্যকে, বিত্ত-বৈভবকে প্রকাশ করে। সেই রঙের আগুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দাহ হয় বিশেষ শিল্পরুচিরও। মরা হাড় বা ভূতপূর্ব কালের অভিজাত শিল্পভাবনা আত্মগত ক্ষুধায় কাতর সমাজ নিশ্চিহ্ন করে দিতে সচেষ্ট হয়।

গুহায় সংরক্ষিত ক্ষমতাসমূহ অর্জন করতে শহরবাসী নিজেরাই অন্ধ হয়। কিন্তু স্বকীয়ভাবে অন্ধ বা বিশ্বাসী হওয়া আর অন্ধত্ববরণ করা বা বিশ্বাসকে আরোপিত ভাবে গ্রহণ করার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান। ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস স্বকীয় না হওয়ায় ভ্রান্ত দর্শনে চালিত মানুষগুলো নিজেরাই এক অপরকে সন্দেহ করতে থাকে। ফলে তাদের ‘যৌথমমত্ব হারিয়ে’ যায় এবং তারা ‘নিজস্বতার বাইরে ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে চায়’। মূলত সমষ্টিচেতনার অন্ত ঘটার ফলে সভ্যতা ও সমাজের মানুষগুলোর মধ্যে অসহযোগের মনোভাব বিরাজ করে। ফলে, শহরের শক্তির প্রতীক কাঠের ঘোড়া নদীর জলে বিলুপ্ত হয়। এসকলের বাইরে অবস্থান করছিলো নীল চুলের মেয়েটি। নীল রঙকে এ গল্পেও ব্যবহার করা হয় বিশেষ ক্ষেত্রে। নীল রঙকে এখানেও আভিজাত্য বা শিল্পমুখরতা হিসেবে গ্রহণ করলে প্রতিভাত হয় যে, এই আভিজাত্য বা শিল্পমুখরতাই মানুষকে সংস্কৃতির খোঁজে ঐতিহ্যের প্রতি সমাহিত হওয়ার পথ চিহ্নিত করে। আবার, এই শিল্পেরই নেই ঐতিহ্যের প্রতি লোভ। শিল্পবোধের মধ্যেই সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের বোধ প্রথিত থাকে। ঐতিহ্যের শক্তি অনন্ত। এই অনন্ত শক্তিই চিরকালীন। চিরন্তনতা শিল্পের বিশেষ স্বভাব। এই শিল্পবোধ জীবনে প্রয়োজনের সীমানার ঊর্ধ্বের চেতনা। ফলে, নীল চুলের মেয়েটি নীরব শক্তির তীব্র আকর্ষণেই অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিশ শতকের শেষপ্রান্তের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় শিল্পবোধে বিশ্বাস আর ঐতিহ্যই একমাত্র অভিলক্ষ্য নয়। এ সময়ের সাহিত্য ও শিল্পের জন্য প্রয়োজন সূর্যের বাস্তব আলোও বা প্রবল যুক্তিসিদ্ধতা। একইভাবে, ‘শিলা, অনন্তে’ গল্পে ভীষণভাবে বৃক্ষের ফল প্রত্যাশী মহব্বত আলীর কন্যা শিলা পিতামাতার একমাত্র জীবিত সন্তান। শিলার পিতার পাতাবাহার গাছ ফল উৎপানকারী নয়, তাই হতাশ এবং শিলার মাতা রিজিয়া সুলতানা পীর মেজবাহউদ্দীনের কন্যা, নিজের পরিবারকে বিশেষত সন্তানকে জীবিত রাখতে সে প্রবল ধর্মসাধনা করে চলে। পিতামাতার এরূপ আচরণের ফলেই শিলা হয় ধর্ষিতা। কিন্তু তা পিতামাতার অগোচরেই থেকে যায়। ‘জীবনের, শিলা ভাবে, মূল্য কী? গুপ্ত মন বলে, ইচ্ছাপূরণ।’ শিলার ইচ্ছা সে বৃষ্টিতে ভেজা মাটি গালে দেয়, ‘মৃত্তিকা মানুষের অধিকার’। এসকল চিন্তার মধ্য দিয়ে শিলা ক্রমশ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে থাকে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিরই অংশ। সভ্যতার অজুহাতে মানুষ ক্রমে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর সভ্যতা এবং আধুনিকতার অর্থ এমন দাঁড়িয়েছে যে, সভ্যতা মানেই প্রকৃতিবিযুক্ত। বস্ত্র, জুতো, কংক্রিটের আবাসস্থান মানুষকে প্রকৃতি থেকে দূরতর করে রাখে। কিন্তু শুদ্ধ হৃদয় প্রকৃতির আহ্বান শ্রবণ করে। এই আহ্বান প্রবল হয়ে ওঠে যখন ‘এক মেঘলা দিন: কান্নার ভারে কী যেন ছিঁড়ে গেলো। মৃত্তিকায় কম্পন এলো। তক্ষুণি পলে পলে শিলার তলপেট মুচড়ে ওঠে। তারপর আচমকা দুঃস্বপ্নের রঙে লজ্জা ও ভয়ের আদর্শ নিয়ে এক মানব ফুল ও ফল সতীদ্বার থেকে প্রদর্শিত হয়। চমকে উঠে শিলা অনেক সময় নিয়ে তাকে দেখলো। জানলো। তারপর আত্মজের স্পন্দন ক্রূরতায় রুদ্ধ করে দিয়ে কাঁদলো জলবিহীন। সময় নিয়ে ঘরের পেছনে গর্ত খুঁজে নিলো। ইট আর আকন্দের ডালপালায় চাপা দিয়েছিলো গর্তের মুখ।’ এই অনুভূতির পরে পরিবর্তিত শিলা জানে ‘যতো পাকা কৃষকই ধরো— মন না বুঝে যত্ন নিলে হবে না।‘ আর এ গল্পেও লেখক তাঁর স্বর উপস্থাপন করেন। গল্পের ও শিলার পরিণতির দিনের বর্ণনা লিখিত হয় যে, ‘যেহেতু তা শিল্পেরই সত্য, সংলগ্ন রূপকের প্রয়োজনীয়তা, তাই ভরে ওঠে সূর্যের ছটায়, পবিত্র মাটি আর হাওয়ার গন্ধে আর শহর থেকে বিশ মাইল দূরে সাঁওতাল পল্লীর দু’মাইল সম্মুখে এক যৌক্তিকতায়। সুবেহ সাদিক।’ এমন দিনে শিলা সবুজ পোশাক পরিহিত হয়ে বিলীন হয়ে যায় সবুজ অরণ্যে। অরণ্যের ভেতর থেকে যে এক তীব্র শক্তির নীরব সন্ত্রাস মোশতাকের মুখোমুখি হতে চায়, শিলা সেই শক্তির পক্ষপাতী। শিলা প্রকৃতির সঙ্গে বিমিশ্র হয়ে যায়। বাস্তবতার সীমানাকে অতিক্রম করে শিলা নামক সত্তা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। পরবর্তীকালে মোশতাক গাছে বা বৃষ্টির কণায় যেখানেই শিলাকে আহ্বান করেছে সেখানেই উত্তর এসেছে ‘আছি’। গল্পের কথনেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রকৃতি ও ভূমি দুর্বোধ্য আকারহীন এক অবয়ব। এই আকারহীন অবয়ব একটি শক্তি, যা অলঙ্ঘ্যনীয়। কিন্তু এই শক্তির সন্ধান যা অমরত্ব দান করে তার মাঝে শিলার মুক্তি সাধিত হয়। একটি দায়মুক্ত সমাজ থেকে উৎপন্ন হয় শিলা। সমাজ সন্তানের উৎপাদনে এবং বংশরক্ষায় অত্যন্ত তৎপর হলেও জীবনের মোক্ষ সম্পর্কে এই সমাজের মানুষ জ্ঞানহীন। জীবনকে স্তরে স্তরে উন্মোচন করে বা আবিষ্কার করে উপস্থাপনেরই প্রয়াস বিদ্যমান সেলিম মোরশেদের কাটা সাপের মুণ্ডু গ্রন্থের গল্পসমূহে। এই প্রয়াস কেবল গল্পগুলোর কাহিনিবৃত্তেই আবদ্ধ নয়। গল্পের প্রতিটি উপাদান যেমন, চরিত্র, পরিপ্রেক্ষিত, ভাষা, শব্দ, সমাজচিত্র, প্রকৃতি, শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থব্যবস্থা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, লোভ, লিবিডো ইত্যাদি গল্পের আখ্যানধর্মকে লক্ষ্যে রেখে নির্মিত হয়। গল্পগুলোর আখ্যানধর্মে বিদ্যমান জীবনের ও সত্তার মুক্তির সূত্র প্রণয়ন করা। ফলে, ‘বোধিদ্রুম’ গল্পে ‘টুইনচা’ নামক চরিত্র সৃষ্টি হয়। টুইনচা পরী ও ঔরঙ্গ চরিত্রকে প্রকৃত পথ নির্দেশ করে। টুইনচা নিজের মধ্যদিয়ে প্রভুর প্রকাশকে আহ্বান করে। এছাড়াও, ‘চেনা-জানা’, ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’ গল্পদুটি অপরাধ জগতে নিমগ্ন দুটি যুবকের ইতিবৃত্ত উপস্থাপন করে। আবু হোসেনের জীবন ও অস্তিত্বের মতোই ‘চেনা-জানা’ গল্পটির গঠন টুকরো টুকরো অংশে বিভক্ত। ‘সেক্স কল্পনা’, ‘ভায়োলেন্স’, ‘পলিটিক্স’, ‘কালচার’, ‘ট্রেন’ ইত্যাদি উপ-শিরোনামে গল্পটি বিভক্ত। আবু হোসেনের জীবনের তথ্যগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে উপস্থাপন করে ‘কালচার’ শীর্ষক অংশটিতেই গ্রন্থের অপরাপর গল্পগুলোর ন্যায় শিল্পরীতি পরিলক্ষিত হয়। ‘কালচার’ অংশে লক্ষমণি বিপুল চৌধুরী নামক বিত্তবান চঞ্চল প্রকৃতির গল্প আবু হোসেনকে শোনায়। বিপুল চৌধুরী নদীতে ঘর বানাতে চায়। সে এমন নদীর অন্বেষণ করে চলে যেখানে রুই-কাতলা, কুমির-কামোট কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। অর্থাৎ, একটি সংঘর্ষহীন স্থিরতার আশা করে বিপুল চৌধুরী। সুরত নদীতে গিয়ে অবশেষে সে ডিম দিয়ে ঘর বানায় যা লক্ষমণির ভাষায় ‘মাজার’। ঘরের দেয়ালে সাপ ও বাঘের হাসি হাসি হাসি ছবি। লক্ষমণির বাবার ভাষ্য মতে সেগুলো ‘আর্টের বাঘ! আর্ট মানে আরাম।’

বিত্তশালী অভিজাত শ্রেণির মতে আর্ট আরামের বিষয়, আদ্দির পাঞ্জাবি, হরিণের শিঙ, সাইগল, উত্তমকুমার, দিবদাস-পার্বতী ইত্যাদির চর্চা আর্টের ও কালচারের প্রকাশ। কিন্তু সেলিম মোরশেদের গল্পসমূহের আর্ট বা নন্দন আরামের জন্য মাত্র নয়। এই গল্পসমূহ চিন্তাকে আঘাত করে। বাস্তবের ভিতর ও বাহিরকে উন্মুক্ত করে তুলতে চায়। ফলে, সরকার, রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো যা মানুষকে তার আপন জগতেই অপর করে তোলো, সেসব কাঠামোকে অনাবৃত করে দিতে চায়। এর ফলেই ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো’ গল্পতে শহরের মানুষেরা, বিশেষত কেরানিরা তাদের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি পেয়েছিল এবং তারা দেখেছিল যে ‘তাদের কর্তৃপক্ষের ভেতরে রয়েছে পরিমাণবিহীন ফাঁকির প্রবণতা।’ কাঠামোবদ্ধ জীবনের নিগড়ে বন্দি মানুষেরা তাদের আত্মপরিচয়, জীবনের স্বরূপ ও মোক্ষ সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে যায়। এই অজ্ঞানতাকে প্রকাশ করার লক্ষ্যে সেলিম মোরশেদের গল্পের আবহ আপাতদৃষ্টির বাস্তবতার কাঠামোকে সর্বদাই অতিক্রম করে যায়। সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশীয় আবহে উপস্থাপিত হয় ‘বদ্ধ’ গল্পটি। উত্তম পুরুষের জবানিতে বর্ণিত গল্পটিতে উপস্থাপিত হয় ‘সেমো’ নামক একটি চরিত্রকে। সেমোকে প্রভু হিসেবে সম্বোধন করা হয়। তাঁর কাছে জানানো হয়, ‘প্রভু, সেমো, আমাদের উর্বর জমি আর ঐতিহ্যগুলো এখন অর্কষিত।’ অকর্ষিত ঐতিহ্যের সংকট মানুষকে শক্তিহীন করে ফেলে। ‘নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিলো’ গল্পে যে দর্শন রূপকের মাধ্যমে উপস্থিত হয়েছে এই গল্পে তা আরো বেশি স্পষ্ট ও নিরাবৃতভাবে অভিব্যক্ত হয়। সেমো’র জবানিতে ‘আমাদের ঐতিহ্য অবশ্যই আমের মতো যা শুরু থেকেই প্রত্যাশা দিয়েছে, আমাদেরকে শক্তি দিয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে এবং নারকেল; একটা বাটি একটা রুটি এক গ্লাস পানি— আমাদেরকে এই সমন্বয় শিখিয়েছে অনিবার্য উপাদানের।’ সন্তান এবং ঐতিহ্য ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোর অন্যতম সাধারণ আলেখ্য। ফলে, লেখকের গল্পগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রের নিপীড়িত অপরত্বের সংকটে আকীর্ণ মানুষের কথা এবং এই মানুষগুলোর ‘অ-পর’ বা আত্ম ও সত্তার পরিচয় নির্ণয়েরও সূত্রসন্ধান-প্রয়াস। অপর হোক বা অ-পর, প্রবঞ্চনাময় রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সূত্রেই উৎসমুখী হতে হয় মানুষকে। কখনো কখনো ‘নিশ্চয় গভীর অন্ধকার…মানুষকে পথ বাতিলয়ে দেয়’ (‘উল্টোপিঠে কিশান’)। অন্ধকার শূন্যতারও সমরূপ। শূন্যতাই সৃষ্টির উৎস। ঐতিহ্যের পথে সংস্কৃতির অনুসরণে শূন্য থেকে মানুষ অভিযাত্রা করতে পারে। এই পথেই সাধিত হতে পারে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণির মানুষের ক্রমমুক্তি।

শিল্পের সৃষ্টির সঙ্গে লেখকের উপলব্ধিজাত সত্যবোধের একটি অনিবার্য সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকে। সত্যের অন্তর্গত বোধ লেখককে লেখনী ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করে, আবার বাধ্যও করে। ঐতিহ্যের সূত্রে শোষকের রাষ্ট্রে অস্তিত্ববিচ্যুত মানুষের স্বরূপ সংশ্লিষ্ট বোধ আটের দশকের লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ছোটগল্পেও পরিলক্ষিত হয়। ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত্যবোধ ও ঐতিহ্য অভীপ্সা চিত্রিত হয় তাঁর রচনায়। যুক্তিহীন অন্ধধর্মবিশ্বাস শাসিত গ্রামজীবনের মানস-কাঠামোর স্বরূপ উন্মোচনে লেখকের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে তাঁর ‘যারা বেঁচে আছে’ গল্পে। কিন্তু দর্শনকে গল্পের নন্দনক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে ঐতিহ্যের সঙ্গে অস্তিত্বহীন মানুষের সম্বন্ধ নির্ণয়ের প্রয়াস বিদ্যমান সেলিম মোরশেদের গল্পের শিল্পরীতিতে। শিল্পরীতির নির্মাণে মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতি-চিন্তাকে সংমিশ্রিতকরণের প্রয়াস আল মাহমুদের রচনাশৈলীতেও বিদ্যমান। কিন্তু, সকল শ্রেণির মানুষকে পূর্বোক্ত রীতিতে আবিষ্কারকরণের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে সেলিম মোরশেদ স্বতন্ত্র। রচনারীতি ও উপস্থাপনের শৈলীতে তিনি শহীদুল জহিরের সমবর্তী লেখক। সেলিম মোরশেদ তাঁর শিল্পশৈলীর মাধ্যমে অপর ও অ-পরদের জীবনসংকট সমাধানের সূত্র সৃষ্টি হয়। আর, এরূপ শিল্প অভিপ্রায়েই তিনি বাংলা ছোটগল্পে অনিবার্য হয়ে ওঠেন।

  1. মামুন হুসাইন তাঁর ‘বইয়ের ভেতর বই পড়া’ প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন, ‘শব্দ ও ভাষার এই তীব্র জটা ছিন্ন করে, এবার অনুভব হয়, লেখা আসলে আমাদের দ্বিতীয় জীবনই বটে। অথবা লেখা আনে আমাদের সেই জগতের আভাষ— যেখানে আমরা থাকতে চাই, কিন্তু সেখানে আমরা উদ্বাস্তু, আমাদের সেখানে বসতভিটে নেই।’
  2. মেটান্যারেশন শব্দটি Metanarrative বা Grand narration শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দটির চিন্তক জ্যাঁ ফ্রানসোয়া লিয়োটার্ড। তিনি সাহিত্যের টেক্সট বা পাঠের অন্তর্নিহিত সার্বজনীন সত্যবোধ, মূল্যবোধের বিস্তৃত ও সামগ্রিক পরিচয় ধারণ করেন। টেক্সেটের কাহিনি ও ফেনোমেনাগুলোকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে যে সার্বজনীন জ্ঞান বা আখ্যান নির্দেশিত হয় তাকে চিহ্নিত করতে জ্যাঁ ফ্রানসোয়া লিয়োটার্ড টার্মটি ব্যবহার করেন।
  3. মাসুমুল আলম সাপলুডু খেলার প্রথম সংস্করণের মুখবন্দনায় বলেন— ৮০’র দশকের সবচেয়ে দায়বদ্ধ লেখক সেলিম মোরশেদের কাটা সাপের মুণ্ডু-র (১৯৯৩) গল্পগুলোর রচনাকাল ১৯৮২।
  4. Otherness বা অপরত্বের ধারণা উপস্থাপন করেন এডওয়ার্ড সাই তাঁর অরিয়েন্টালিজম-এ। ঔপনিবেশিক শাসনের সাংস্কৃতিক স্বরূপ চিহ্নিত করতে তিনি স্বভূমিতে অধিকারবঞ্চিত মানুষের ক্ষেত্রে অপর ও অপরত্বের ধারণা সৃষ্টি করেন।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!