:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
আসাদুল ইসলাম

কবি ও নাট্যকার

ঘুমকুমারী, কে তাহার ঘুম ভাঙায়

ঘুমকুমারী, কে তাহার ঘুম ভাঙায়

ঘুমের দেশে চলে গেছে কন্যা, সে এক দীর্ঘ ঘুম। তাকে জাগাবে কে, কে ঘুম ভাঙাবে রাজকুমারীর। কত রাজকুমার এল, ঘুম আর তার ভাঙে না, যে তাকে ঘুম ভাঙাতে যায় সেই উল্টো বিপদে পড়ে, জেনে শুনে কে যাবে এগিয়ে, কে তাকে ঘুম ভাঙিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ফুলের কাছে, পরীর কাছে, তার স্বপ্নে দেখা মেঘকুমারের কাছে। অচিন দেশের রাজকুমার আসে, যে পালিয়েছে তার পিতার ভয়ে। রাজদণ্ড বড় কঠিন, পিতার হাতে পুত্রও রক্ষা পায় না। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে যে প্রথমে বন্দি হয়, বন্দি রাজকুমার মায়ের সহযোগিতায় বন্দিশালা থেকে পালিয়ে যায় দূরে, পথে পথে ঘোরে। রাজকুমার ফেলে আসে তার শৈশবের দেশ মাটি মা আর মানুষকে আর তার প্রিয়দর্শিনী প্রিয়তমাকে, এখন সে পথের মানুষ। রূপকুমারকে চেনে না কেউ। পিতার হাত থেকে বাঁচতে দূরের দেশে একাকী ঘুরে বেড়ায়। তাকে আশ্রয় দেয় এক গায়ক। গায়ক তাকে গান শোনায়, আর শোনায় সে রাজ্যের দুঃখের গল্প, একজন ঘুমকুমারীর গল্প। এক ডাকিনীর অভিশাপে রাজ্যের রাজকন্যা সংজ্ঞা হারিয়ে তলিয়ে গেছে দীর্ঘঘুমে। ডাকিনী তাকে চরকা ঘোরাতে প্রলুব্ধ করে। চরকা ঘোরানোর সময় অন্য ডাকিনীরা তাকে ঘিরে প্রলয় নৃত্যে মাতে। রাজকুমারী সোনালি ডাকিনীদের উল্লাসে এলোমেলো হয়ে যায়, চরকার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে জ্ঞান হারায়, ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়ায় রাজকন্যা সোনালির নাম হয়ে যায় ঘুমকুমারী। ঘুমকুমারীর গল্প শুনে অচিন রাজকুমারের মনে মায়া হয়, রূপকুমার তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। চেনা নেই, জানা নেই এমন একজনকে বাঁচাতে তাকে কেন এগিয়ে আসতে হবে।

রূপকুমার, রাজপ্রাসাদে জন্মালেও সে নিয়তিতাড়িত। রাজার কুমার হয়েও সে ভাগ্যহতদের প্রতিনিধি। বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিয়তি তাকে পিতার বিরুদ্ধেও দাঁড় করায়। যে শুধু তার পিতা নয়, রাজ্যের রাজাও। শেষ পর্যন্ত রাজা, রাজপ্রাসাদ, রাজরক্ত তাকে আটকে রাখতে পারেনি, নিয়তি তাকে পথে নামিয়েছে। যারা দুর্বল, দুঃখতাড়িত, ভাগ্যহত, তাদের পাশে দাঁড়ানো সে কর্তব্য জ্ঞান করেছে। ঘুমকুমারী ভাগ্যহত, অসহায়। তাকে আগে কখনো দেখেনি, তার নাম শোনেনি, কিন্তু তার ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা জানতে পেরে রূপকুমার তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে।

রাজকুমারী ঘুমে, যে তাকে বাঁচাতে যাবে সেও অভিশপ্ত হয়ে বিপদে পড়বে। অচিন রাজকুমার সব বিপদ উপেক্ষা করে রাজকুমারীর কাছে যায়। মঞ্চের মাঝখানের পর্দা দু’ভাগ হয়ে দুদিকে সরে যায়, প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় ঘুমকুমারী, নিরাভরণ মঞ্চে একটি দোলনা জাদুর মতো গ্রাস করে পুরো মঞ্চকে আর উন্মোচিত করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া একটি মুখ, আহ নিষ্পাপ মুখের কিশোরী রাজকুমারী, ফুলের দোলনায় সে শায়িত, যেন ভোরের আলোক স্পর্শের জন্য অপেক্ষমান, পাখিরা ডেকে উঠলেই সে জেগে উঠবে।

রাজকুমারী ঘুমে, যে তাকে বাঁচাতে যাবে সেও অভিশপ্ত হয়ে বিপদে পড়বে। অচিন রাজকুমার সব বিপদ উপেক্ষা করে রাজকুমারীর কাছে যায়। মঞ্চের মাঝখানের পর্দা দু’ভাগ হয়ে দুদিকে সরে যায়, প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় ঘুমকুমারী, নিরাভরণ মঞ্চে একটি দোলনা জাদুর মতো গ্রাস করে পুরো মঞ্চকে আর উন্মোচিত করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া একটি মুখ, আহ নিষ্পাপ মুখের কিশোরী রাজকুমারী, ফুলের দোলনায় সে শায়িত, যেন ভোরের আলোক স্পর্শের জন্য অপেক্ষমান, পাখিরা ডেকে উঠলেই সে জেগে উঠবে। দু’হাতের নিচে মাথা রেখে, চুল খুলে, লাল নীল বসনে সে যেন নিজেই একটা ফুল, ফুটে আছে সরোবরে। তার সিঁথিতে ফুল, কানে ফুল, গলায় ফুলের মালা, শুয়ে আছে, যেন স্বপ্নের মধ্যে একটুকরো স্বপ্ন হয়ে, ছবির মধ্যে জীবন্ত ছবি হয়ে, মেঘের মধ্যে ময়ূরকণ্ঠী মেঘ হয়ে, সুরের দোলায় সে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার ঠোঁটে পুষ্পের প্রমোদ, নিমীলিত চোখে নীল জ্যোৎস্নার প্রলেপন, সে ঘুমিয়ে, অঘোর ঘুমে তলিয়ে আছে। তাকে জাগাবে, ঘুম থেকে ডেকে তুলবে এমন কেউ আসেনি আগে। রূপকুমার তার শিয়রে এসে দাঁড়ায়, পূর্ণ নেত্রে তাকায় ঘুমকুমারীর পানে যে ঘুমিয়ে আছে এক গাঢ় বেদনার আচ্ছাদনে। সেই মর্মর বেদনাকে সরিয়ে কী করে তাকে ফিরিয়ে আনবে মানুষের মর্মস্থলে। রাজকুমারীর পায়ের কাছে বা মাথার কাছে নেই কোনো সোনার কাঠি, রূপার কাঠি, যার স্পর্শে ঘুম ভাঙানো যায়।


নাটক: ঘুমকুমারী
রচনা: আফসার আহমদ । নির্দেশনা: রুবাইয়াৎ আহমেদ
পোশাক: খায়েরুজ্জাহান মিতু । প্রযোজনা: নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: আবদুল্লাহ অপু

হতবিহ্বল রূপকুমার, বোঝে না, কেমন করে কী হবে, ঘুমকুমারীকে ঘুমের দেশ থেকে কেমন করে ফিরিয়ে আনবে, অভিশাপের সমাপ্তি কোথায়। রূপকুমার কোনো কিনারা পায় না, তবু আশা ছাড়ে না রাজকুমারীর ঘুম ভাঙানোর। রূপকুমার দ্বিধায় পড়ে যায়, কী হবে তবে! কেমন করে ঘুম ভাঙবে রাজকুমারীর! কোনো উপায় অন্ত না দেখে রূপকুমার অন্তিমে তার কোমরে রক্ষিত ছুরি বের করে নিজের হাতের উপর টান দিয়ে রক্তাক্ত করে। রক্তাক্ত হাত মেলে ধরে ঘুমকুমারীর মুখের উপর। রূপকুমারের রক্তফোঁটায় ঘুমন্ত রাজকন্যা সোনালির চৈতন্য ফিরে আসে, তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে দাঁড়িয়ে আছে রক্তাক্ত রাজকুমার। দীর্ঘ ঘুম থেকে সদ্য চৈতন্যে ফেরা রাজকন্যা, রাজকুমারকে দেখে তার চেনা চেনা মনে হয়, কোথায় যেন দেখেছে, মনে করতে পারে না। রাজকুমারকে দেখে তার ভালো লাগে, কিন্তু চারপাশের পরিবেশ তার কাছে অচেনা, এ যেন মৃত্যুপুরী, তার মনে হয় এই পৃথিবীতে সে কোনো দিন ছিল না। রাজকন্যা রূপকুমারের পরামর্শে যখন মৃতদের গায়ে হাত রাখে তখন যেন নতুন করে পুনর্জীবন আসে প্রাসাদে, মৃতরা জেগে ওঠে। মানুষ জাগে ফের, ফিরে আসে মানুষের কলরব। জেগে ওঠা মানুষের ভিড়ে রাজকুমারী সোনালি এসে পাশে দাঁড়ায় রূপকুমারের, খুব চেনা, তবু অস্পষ্ট।

একসময় বুঝতে পারে এই রাজকুমারকে সে স্বপ্নে দেখেছিল মেঘের দেশে, মেঘকুমার। সখীদের সাথে একদা স্বপ্নে দেখা এই রাজকুমারের গল্পই তাদের শুনিয়েছিল। আজ ঘুম ভেঙে সেই স্বপ্নের মানুষটিকে দেখে রাজকন্যা আপ্লুত হয়। তার হাতে সমর্পিত হতে চায়। কিন্তু রূপকুমারের মনে পড়ে ফেলা আসা গ্রামে তার ভালোবাসার মানুষটি রয়ে গেছে, সে হয়তো অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কিন্তু সে অনেক দূরের দেশ। সেখানে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব না। রূপকুমারের মানসিক দ্যোতনার মধ্যে সেই হারানো প্রেমিকা ফিরে আসে, রূপকুমার আর রাজকুমারীর মিলনের মাঝ থেকে সে যেন নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ঘুমকুমারীর দীর্ঘ ঘুমের অবসরে বাদ্য বাজে, সুরে আর গানে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে রাজ্যের বিমর্ষ মানুষেরা নতুন করে, তাদের মধ্যে প্রাণ ফিরে আসে। ঘুমকুমারীর ঘুম ভাঙানোর উছিলায় একটি বিমর্ষ জনপদের মানুষের মনে প্রাণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রূপকুমার যেন তার নিয়তিকেই প্রতিষ্ঠা করল।

‘ঘুমকুমারী’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পরীক্ষা প্রযোজনা হলেও তারা দর্শকদের পরীক্ষায় পাস করেছে। নাটকটি ফাঁকা জমিনে উপস্থাপনের জন্য নির্দেশককেও সাহসের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। নাটকে ঘরবাড়ি সিঁড়িটিড়ি দিয়ে যে একাকার অবস্থা থাকে, তার বিপরীতে নিরাভরণ মঞ্চ অভিনয় দিয়ে ভরিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। কঠিন কাজটি সাবলীলভাবে করতে সমর্থ হয়েছেন নির্দেশক রুবাইয়াৎ আহমেদ। নাটকের কাঁচা খেলোয়াড়রা যেদিন দক্ষ হবে, সেদিন ঘুমকুমারী তাদের হাতে পড়লে আমাদের অনেকের ঘুমই হারাম হয়ে যেতে পারে। সবার জন্য শুভাশিস রইলো। প্রথম বর্ষের প্রযোজনা ‘ঘুমকুমারী’ প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে সেই প্রত্যাশা।

১২.০৫.২০১৯

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.